শুভ বিবাহ পর্ব-১৯

0
664

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

১৯

জাহিদকে ধরার জন্য আমি আবার পেছন দিকে দৌড় দিলাম। ও কলা ভবনের দিকে যাচ্ছিল, আমাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে অবাক হলো খুব।
❝কিরে! আবার কি হলো!❞
চাপা কন্ঠে বললাম,
❝তোর সাথে কথা আছে। শুভর বাসার ঠিকানা দে❞
❝ওর বাসার ঠিকানা দিয়ে তুই কি করবি?❞
❝এটা কি তোর মাথাব্যথা? তুই দে!❞
❝দেখ, তুই পরে বড় কোনো হাঙ্গামা করবি। ওসব করা যাবে না। চল তুই আমার সাথে, আমরা সামনাসামনি মিটমাট করে দিব সবাই মিলে❞

আমি জাহিদের হাত ধরে উলটো দিকে টান দিলাম।
❝আমি কি বলেছি সব মিটমাট করে দে? আমি তোকে ওর বাসার ঠিকানা চেয়েছি। আমাদের মিটমাট আমরাই করে নিতে পারব❞
❝ঠিকানা দেয়া যাবে না❞
❝তুই দিবি না তাহলে?❞
❝তুই বোঝার চেষ্টা কর। ওর বাসায় গিয়ে তুই কি করবি? যা করবি, তাতে কি তোর সম্মান বাড়বে? ওর বাড়ির মানুষ তোকে ভালো কথা বলবে?❞
❝ভাই, আমি শুধু জানবো, আমি ওর বাসায় যাবো না। কারো সাথেই কথা বলব না! বিশ্বাস কর? আমার অন্য দরকার আছে❞
❝না, ঠিকানা দিতে পারব না❞

জাহিদকে কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না যে আমি শুভর বাসায় কোনো সমস্যার উদ্রেক করতে যাচ্ছি না। অগত্যা সেখান থেকে চলে আসলাম। বাইরে আমার ড্রাইভার বসে আছে। আমাদের ড্রাইভারের নাম মতিন, আমি ডাকি মতিন কাকা। মতিন কাকা যখন আমদের বাড়িতে কাজ শুরু করেন, তখন আমি খুব ছোট। কাকার কোলে আমার অনেক ছবি আছে, নিজের মেয়ের মত আদর করতেন তিনি আমাকে। এখনো করেন। বাড়ির কর্মচারীদের সাথে আমার সম্পর্ক ভালোই। তবে মতিন কাকার সাথে অন্য রকম ভালোবাসার সম্পর্ক, যেন নিজের কাকা আমার। তার কাছে আমার অনেক আবদার থাকে। আমি তাই গাড়িতে উঠে কাকাকে বললাম,
❝কাকা, একটা সাহায্য লাগবে আপনার❞

আমি বড় হওয়ার পর কাকা আমার কথার জবাব কম দেন, কিংবা দেন না, কেবল মাথা নাড়েন। এবারও তিনি মাথা নাড়লেন। আমি বললাম,
❝একটা ছেলে বের হবে কিছুক্ষণ পর। আপনি ওকে ফলো করবেন ওর বাসা পর্যন্ত। ও বাস সিএনজি যাইই নিক, আপনি সেটাকে ফলো করবেন। মতিন কাকা বললেন,
❝মামুনি, অনুমতি দিলে একটা কথা বলতাম❞
❝বলেন কাকা❞
❝আমি জানি না ছেলেটা কে, কিন্তু তার বাসা পর্যন্ত গিয়া কোনো কিছু কইরেন না। মানুষ খুব খারাপ। আপনে বড় হইতাছেন, আপনেরে নিয়া স্যার আর ম্যামের চিন্তা হয়। আমারও হয়। আমার দুই মাইয়ারে তো বিয়া দিছি, আমি বুজি। আপনে কি করতেছেন না করতেছেন, একটু বুইঝা কইরেন। বিপদে পইড়েন না❞
আমি ক্ষীণ কন্ঠে ঠিক আছে বললাম। আমি কি খুব উগ্র হয়ে গেছি? নাকি সবসময় উগ্র ছিলাম? জাহিদ, মতিন কাকা, কেউ ভাবতে পারছে না যে আমি নীরবে কেবল শুভর বাসা দেখে আসবো। আসলেই কি এটা সত্যি? আমি কি সত্যিই কিছু ঘটাবো?

পেছনের সিটে হেলে পড়ে ঠোঁট কামড়ে ভাবছি। আমি কি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি? না, হারাইনি। নিজের আবেগকে শক্ত হাতে লাগাম টেনে থামাতে হবে। নিজের যথেষ্ট ক্ষতি করে ফেলেছি, আর ক্ষতি করার মত বিলাসিতা করা যাবে না।

আমদের খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি, অল্প সময় এর মাঝে শুভ ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে টিএসসির দিকে হাঁটা দিল। আজ বোধহয় ভার্সিটির বাস ধরবে না। ওকে ফলো করতে করতে দেখলাম একটা রিক্সা নিল। সেখান থেকে একটা বাসে করে সে সাইনবোর্ডে আসলো। ওর বাসের পিছে পিছে থাকতে গিয়ে অনেক ধীরে ধীরে আসতে হয়েছে আমাদের। সাইনবোর্ড এলাকার ভেতরে গিয়ে এক যায়গায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানলো, এক কাপ রঙ চা নিল। আমরা দূর থেকে ওকে দেখছি। গাড়ির জানালায় সান ফিল্ম লাগানো থাকায় বাইরে থেকে দেখার জো নেই গাড়িতে কে আছে। এই নিয়ে আমাদের কখনো বিড়ম্বনায় পড়তেও হয় না। আমি চুপচাপ শুভর মতিগতি দেখছি। শুভ চা আর সিগারেট শেষ করে একটা বিল্ডিং এর দিকে পা বাড়াতেই পাশে একটা বিল্ডিং থেকে একটা মেয়ে বেরিয়ে এলো, সাথে একজন মহিলা। শুভ ওদের দেখে থামলো, কি যেন কথা বলল। মেয়েটার ডান কাঁধ থেকে পুরো হাত প্লাস্টার করা। আমি চুপচাপ মেয়েটিকে দেখছি। কি স্নিগ্ধ মুখখানা ওর, মিষ্টি একটা মেয়ে। বাম হাত দিয়ে এর মাঝেই দুবার নাকের উপর চশমা ঠেলে দিয়েছে। ওর চশমা বোধহয় ঢোলা হয়, বারবার সরে আসে। শুভ বেশ হাসিমুখে ওদের সাথে কথা বলে একটা রিকশা ডেকে ওদের তুলে দিল। রিকশাটা যতক্ষণ দেখা যাচ্ছিল, ততক্ষণ চেয়ে রইল। চোখের আড়ালে যেতেই সেও বিল্ডিংয়ের লোহার গেট ঠেলে ঢুকে পড়ল। আমি মতিন কাকাকে শান্ত কন্ঠে বললাম,
❝কাকা বাসার দিকে চলেন। আমাদের আর কাজ নেই❞

……………….

আমার এক্সিডেন্টের পর থেকে সবার কথা বলা, আমার প্রতি ব্যবহার বদলেছে, যত্নটা বেড়ে গিয়েছে। যে আমাকে আম্মু সবসময় বকত, সেখানে সে আমার সব আবদার করার প্রায় সাথে সাথে পূরণ করার জন্য ছুটে যাচ্ছে। আব্বু আমাকে সবসময় আদর করত, এখন আরও করছে। যত বান্ধবীর সাথে ঝগড়া ছিল, সবাই আমাকে দেখতে এসেছে। একদিন দল বেঁধে এসে ওরা আমার বাসায় হামলা চালিয়েছে। স্কুলে না যেতে পেরে আমি বেশ হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, ওদের উপস্থিতি মনে প্রশান্তির বাতাস এনে দিয়েছে। বেশ অনেকে উপহার দিয়েছে, কাছের বান্ধবীরা পড়া এনে দিয়েছে। তারা অভয় দিয়ে গেছে আমায়। কত আত্মীয়রা আমায় যে দেখতে আসছে। আম্মু তাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে, আমি চুপচাপ সবাইকে দেখি। কেউ এখন আমাকে কোনো কাজে বাঁধা দেয় না, আমিও যে বাঁধা দেয়ার মত কিছু করি, এমনটাও না।

সবচেয়ে বেশি বদলেছে অশুভ ভাইয়া। সে অশুভ থেকে শুভতে রূপান্তরিত হয়েছে। শুনেছি সে নাকি আমাকে রক্তও দিয়েছে! এও সম্ভব? সে কি করে খবর পেল যে আমার রক্ত লাগবে? তবুও ভালো, আমাকে রক্ত দিয়েছে, রক্ত শুষে নেয়নি! তবে তার আমূল পরিবর্তন দেখেছি এরপর থেকে। আমাকে সে হাসপাতালে দেখতে এসেছিল। আমি অবশ্য কথা বলিনি, কিন্তু উনাকে দেখে মনে হচ্ছিল, অনেক কিছু বলতে চান উনি। তার চোখের ভাষায় অন্য কিছু ছিল, আর তাতে আমার কৌতুহল জেগেছে। তাই বলে তো আর তা প্রকাশ করা যায় না! আমিও করিনি। অপেক্ষা করেছি বাসায় আসার। আম্মুর কাছে খবর পেয়েছি, সে মাঝে মাঝে আমার খবর নিতে আসে। কয়েকদিন আগে আমি বসার ঘরে ঢুকে চমকে গিয়েছিলাম। শুভ ভাইয়া আর উনার আম্মু বসে আছে। আমাকে দেখে উনি খুব ভালো মানুষের মত হাসলেন।

যে কেউ তাকে দেখলে তখন একটা ‘গুড বয়’ তকমা লাগিয়ে দিত। অথচ আমার কাছে সেই হাসি ভূতের হাসির মত লাগলো, ঠিক যেন অন্ধকারে অনেক বছর ঘাপটি মেরে থাকা কোনো মামদো ভূত যা আমাকে ভয় দেখাতো, হুট করে সে হাসার চেষ্টা করছে! কি বিছরি ব্যাপার রে বাবাহ! আমি তাকে ফিরতি হাসি না দিয়ে উলটো নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে বসেছি। তিনি কি চাচ্ছেন? কেন এমন করছেন? তাকে তো এমন মানায় না! এর কি কোনো কারণ আছে? আমার কাছে বিষয়টা রহস্যজনক লাগলো।

তবে রহস্য বেশিদিন রহস্যা থাকলো না। কিছুদিন পর আমি ছাদে গিয়েছিলাম মুমু আর ঝুমুর সাথে। ওদের সাথে গল্প করছিলাম। মেয়ে দুটো বড় হয়ে গেছে। এ সময় শুভ ভাইয়া তাদের ছাদে উঠে আমাদের দেখে। আমি আড়চোখে তার উপস্থিতি টের পেয়েও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখিনি। মুমু আর ঝুমুর পেছনে একটু পরে ভূতের মত তিনি উদয় হলেন। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চমকে গেলেও বুঝতে পারলাম উনি ছাদ টপকে এসেছে। ভাগ্যিস এই দৃশ্য আমায় দেখতে হয় নি! খুব ভয় করে তাকে এমন করতে দেখলে। যদি ফাঁক গলে কোনোভাবে পড়ে যায়? তারপর… উফ! আর ভাবা যায় না! আমি তাকে দেখে স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করি। মুমু আর ঝুমুও চুপ মেরে যায়। শুভ ভাইয়া কেবল আমাকে না, সুযোগ পেলে ওদেরও দু’চারবার বকে দিয়েছে। আজ আমাদের তিন জনকে আশ্চর্যের চূড়ান্তটি দেখিয়ে নরম স্বরে মুমু আর ঝুমুকে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়াতে বলল। সে নাকি আমার সাথে কথা বলবে। মুমু আর ঝুমু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো, তবে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার উপর। শুভ ভাইয়া কিছু করলে ওরাও উত্তম মধ্যম দেয়ার চেষ্টা করবে, ভাবভঙ্গি তাইই বলছে। আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। আমাকে দেখে সে প্রথমে অপ্রস্তুত হাসি হাসলো। তারপর বলল,
❝তোমার কাছে আসলে আমি সরি বলতে এসেছি। সরি না বলে শান্তি পাচ্ছি না, ঘুম হচ্ছে, বুকের ভেতর কেমন একটা ভার বয়ে বেড়াচ্ছি যেন!❞

আমি অবাক হলাম।
❝সরি কেন?❞
❝তোমার যেদিন এক্সিডেন্ট হয় সেদিনের একটা ঘটনা নিয়ে❞
আমি প্রশ্ন নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। সে আবার বলছে,
❝সেদিন যখন তোমার এক্সিডেন্ট হলো, আমি তখন সিএনজি নিয়ে তোমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তোমাকে খেয়াল করিনি, ফেলে চলে গিয়েছি। পর যখন জানলাম, ওটা তুমি ছিলে, তখন থেকে অপরাধবোধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমি অনেক বড় ভুল করেছি। হয়ত তখন আমি এগিয়ে গেলে তোমার ক্ষতি কম হত। তোমাকে দেখলেই সে স্মৃতি ভেসে ওঠে…❞

শুভ ভাইয়া চুপ করে গেছেন। আমিও চুপ করে আছি, কি বলা উচিত বুঝতে পারছি না। উনি ক্ষীন কন্ঠে আবার বললেন,
❝এজন্য তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আশা করি আমাকে ক্ষমা করবে❞

আমার খুব বলতে ইচ্ছা হলো, আপনি তো আর আমাকে গাড়ি দিয়ে মেরে দেননি! আপনি না থাকলেও আমি বেঁচে থাকতাম, এটাই আমার ভাগ্য। আপনি কেন অকারণে কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু ঠিক তখনই মনে হলো, সে কতটা হৃদয়হীন খারাপ মানুষ হলে একটা মৃতপ্রায় মানুষকে ফেলে চলে যেতে পারে?! হয়ত আমি বলে আফসোস হচ্ছে। কিন্তু আমার যায়গায় অন্য কেউ যদি হতো, তাহলে কি তার এমন প্রায়শ্চিত্ত হতো? কক্ষণো না! আমার কেমন জেদ চেপে গেল। পাশের বাসায় আসার পর থেকে সে আমাকে জ্বালিয়ে মারছে। আমার কি উচিত তাকে মাফ করে দেয়া।

কিন্তু আমি ভালো মানুষ। তাই বুক ফুলিয়ে সাহস করে তাকে অপমান করতে পারলাম না। তবে মন খারাপ করে চলে আসলাম। আমার নীরব প্রস্থানে সে কি ভাবছে তা বুঝতে পারছি না। এরপর থেকে সে আমাকে দেখলেই হাসি দেয়। আমি অবশ্য একটু আধটু হাসার চেষ্টা করি, কিন্তু লাভ হয় না। আমার হাসার চেষ্টা যে বরং কাঁদার মত হয়ে যায়, তা উনার থেকেই বুঝলাম। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সময় হেসে বলছিল,
❝এই তেঁতুল! তুমি আমাকে দেখলে এমন কান্না কান্না মুখ করে থাকো কেন? আমি দেখতে ভূতের মত? নাকি তোমাকে ধরে মারব?❞

তার এসব উদ্ভট কথা আম্মুর ভালো লাগে। তিনি বেশ হাসিমুখে বললেন,
❝ও আসলে সবার সামনে লজ্জা পায়, শুধু পালাই পালাই করে। মিশতেই চায় না করো সাথে! আমার ওকে নিয়ে যা টেনশন হয়!❞
আমি তবুও সেই একই মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকি। শুভ ভাইয়া একটা রিকশা ডেকে আমাদের তুলে দেয়। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এই লোকের এই পরিবর্তন আমার ভালো লাগছে না একদম। ডাল ম্যায় কুচ কালা তো জারুর হ্যায়!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here