শুভ বিবাহ পর্ব-১৮

0
667

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

১৮

আমি বিছানায় হাঁটু ভাঁজ করে দুই হাতে তা বুকে চেপে মুখ গুঁজে রয়েছে। সামনে নীনা আর স্নিগ্ধা বসে আছে। তাদের দুজনের চোখের ভাষা দুরকম। স্নিগ্ধার করুণা হচ্ছে আমার উপর, নীনার রাগ হচ্ছে। ভীষণ রাগ। সে আমার সাথে একটু আগে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করেছে। স্নিগ্ধা তখন আমাকে দুইহাতে জড়িয়ে রেখেছিল, যেন নীনার বকা থেকে ও আমাকে বাঁচাচ্ছে। আমি চুপচাপ কেবল নীনার কথা শুনে গেছি। ও একটাও অযৌক্তিক কথা বলেনি। আমি সত্যিই একেবারে পিছলে গিয়ে এমন একটা মানুষে পরিণত হলাম যেখানে আমার নিজস্বতা বলে কিছুই রইল না। তানাহলে আমার মত একটা মেয়ে এধরনের অযাচিত ভুল করে?

নীনা আমার আঁজলা ভরে আমার মুখ খানা তুললো।
❝তোকে শক্ত হতে হবে, বদলাতে হবে কণা। এরকম চলতে পারে না। তুই দিন দিন এত বদলে যাচ্ছিস কেন জানিস? শুভ হচ্ছে একটা পঁচা আপেল। পঁচা আপেলের স্পর্শে এসে তুইও পঁচে যাচ্ছিস। পঁচা আপেল থেকে তোর দূরে সরতে হবে❞
❝আর আমি গতকাল যে কাজটা করলাম, সেটা কি করে ভুলব?❞
❝এখন যা অসম্ভব মনে হচ্ছে, এক সময় দেখবি, সময়ই তোকে সবটা শিখিয়ে দিয়েছে। সময় জিনিসটা এমনই। আমাদের বদলে দেয়। এই যে তোর এখন পালক ছেঁড়া, ঝড়ে বিধ্বস্ত পাখির ন্যায় দশা, এই দশা বেশিদিন থাকবে না। জানিস তো, চল্লিশ বছর পর চিলের সব পালক ঝড়ে যেতে থাকে, ঠোঁট ফেটে যায়, নখ ভেঙে আসে৷ সে তখন একটা পাহাড়ের উপর আশ্রয় নিয়ে নিজেই নিজের পুরাতন সব পালক টেনে ফেলে দেয়, নখ ভাঙে, ঠোঁটে আঘাত করে ফাটায়। এরপর সে বসে থাকে নতুন করে সব গজানোর জন্য। সব যখন নতুন করে হয়, আবারও সে আগের মত তেজে শিকার করে বেড়ায়। তোকেও অপেক্ষা করতে হবে। নিজেকে তো ধ্বংস করেছিস, এখন অপেক্ষা কর নতুন করে বেঁচে উঠার, নতুন রূপে আবর্তিত হওয়ার। দেখবি, ঠিক আগের মত হয়ে উঠবি!❞

আমি ব্যাকুলতা নিয়ে বলি,
❝আর শুভ? ওকে কি করব? ওর সাথে কেমন ব্যবহার করব?❞
স্নিগ্ধা বলল,
❝আমার মনে হয়, একেবারে ব্রেকাপ ঠিক হবে না। তুই বরং শুভকে স্পেস দে, ওকে ওর মত থাকতে দে। মাঝে মাঝে কল দিবি, ও ব্যাক না করলেও কিছু বলবি না। তুই তোর মত থাকবি❞

আমার চোখ জোড়া অশ্রুতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
❝আমি যে পারিনা রে! আমার অস্থির লাগা শুরু হয়, মাথা ব্যথা করে, কান্না পায়, খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, অসহায় লাগে!❞
নীনা মুখ শক্ত করে বলে,
❝এজন্যই বললাম ব্রেকাপ কর। ওর সাথে থাকলে এত দ্রুত ভুলতে পারবি না, সময় লাগবে তোর। তার চেয়ে ব্রেকাপ কর, ভুলতে পারবি ওকে। তুই তোর মত করে থাকবি তখন❞

আমার আবার কান্না পাচ্ছে। একবার শুভর উপর অভিমান হচ্ছে, প্রচন্ডরকমের। আরেকবার নিজের উপর করুণা হচ্ছে, প্রচন্ডরকমের। আমি এখনো জানি, শুভ যদি এই মুহূর্তে আমাকে কল দেয়, আমার সাথে নরম স্বরে কথা বলে, আমি গলে যাবো, এক্কেবারে গলে যাবো। এর আগের সব কষ্টের কথা ভুলে যাবো এক্কেবারে। প্রতিবার তো তাইই হয়ে এসেছে। এজন্যই যে শুভ আমাকে নিয়ে খেলছে, সেটাও বোধহয় বুঝতে পারছি। অথচ কি অদ্ভুত, আমি নিজেকে বদলাতেই পারছি না!

পরদিন ক্লাস ছিল। নীনা আর স্নিগ্ধাকে ওদের বাসায় যেতে দেইনি। আমার এমন ব্রেক ডাউনের সময় একা থাকা ঠিক না। স্নিগ্ধা ভয় পাচ্ছে, একা রেখে গেলে যদি আমি খারাপ কিছু করি? নীনা ভাবছে, আমি কিছু না করলেও উল্টাপাল্টা ভেবে শুভকে বারবার কল দিব। সমস্যা গুলো তখন আরও বাড়বে।

নীনা ঠিক ভাবছে। আমি এমনটাই করে ফেলতে পারি। তবে ওর বিশ্বাস, আজ রাতটা কোনোমতে কাটাতে পারলে কাল সকালে উঠে আমার জন্য শুভকে ছাড়া থাকা সহজ হবে। এটা ভুল। আমি জানি, আগামীকাল সকালেও আমি শুভকে চাইব, তারপরের সকালে, এরপরের সকালেও। আমি প্রতি সকালেই শুভকে খুঁজব, চোখ বুঁজে ওর স্পর্শ চাইবো। এটা একটা ভয়ংকর মনে অসুখ। আমার অসুখ হয়েছে, আমি অসুস্থ। আমার অসুখের নাম শুভ।

আমার বাসা থেকেই তৈরি হয়ে ওরা দুজন আমাকে নিয়ে ক্লাসে গেল। আজ ওরা আমার সাথে একেবারে লেপ্টে আছে। টয়লেটে গেলেও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, দরজায় ছিটকিনি টানতে নিষেধ করছে। ওরা ভীষণ ভয় পেয়েছে। সারাটা রাত আমি চোখ লাগাতে পারিনি। যখন ঘর অন্ধকার করে ওরাও আমার পাশে শুয়ে পড়ল, আমি রাত জাগা পেঁচার মত পর্দার ফাঁক ফোকর গলে বাহির থেকে আসা আলোর বিচ্ছুরণের দিকে চেয়ে থাকলাম। যখন ভোর হয়ে এলো, আকাশে সূর্যের আলো ঝলমলিয়ে উঠল, তখনও ওরা আমাকে চোখ খোলা অবস্থায় আবিষ্কার করল। একারণেই ওদের যত ভয়। ওদের ধারণা, টয়লেটে যদি আমি মাথা ঘুরে পড়ে যাই? যদি খারাপ কিছু ঘটে আমার সাথে? ওরা জানে না, শুভ আমায় এমন কত রাত জাগিয়ে ফেলেছে। ওর প্রতীক্ষায়, কখনোর ওর কন্ঠস্বর আমাকে রাতের প্রতিটা প্রহর কাটিয়ে সকালেও ঘুমাতে দেয়নি। আমি তো এমনটায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি এখন!

ক্লাসে গিয়ে শুভকে দেখলাম না। জাহিদ, ইমরানদের দেখলেও তাদের মাঝে শুভ নেই। নীনা আর স্নিগ্ধা না থাকলে হয়ত ওর কথা জিজ্ঞাসা করতাম, এখন তা করতে পারছি না। তবে নীনা আমার দৃষ্টির চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছে। পড়ার মাঝে আমাকে বলল,
❝শুভকে খুঁজছিস? লাভ হবে না। ও আসেনি। বেঈমান একটা!❞

আমি কোনো জবাব দেইনি। শুভ ভালো আছে তো? আমাকে ছাড়া?

পাক্কা দুইদিন পর ওর দেখা মিললো। কথাবার্তা৷ চেহারার রঙ একেবারে বদলে গেছে। কেমন যেন অন্য রকম লাগছে ওকে। ও কি ভালো নেই? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছি। কারণ ওকে তো জিজ্ঞাসা করা হবে না। শুভ আমার দিকে কয়েকবার তাকিয়েছে। আমাদের চোখাচোখি হলেও তাতে কোনো কথা ছিল না, ভাষা ছিল না। কেবল ছিল ওর আমার দৃষ্টির বেড়ি থেকে পালানোর অভিপ্রায়। আমিও তাকে বিরক্ত করিনি। দেখি, অপেক্ষা করি, ও কি করে তা দেখতে চাই।

কয়েকদিনের মাঝে টুকটাক কথা বলল ও, বিশেষ করে সবাই যখন এক সাথে আড্ডা দিতে বসলাম। তবে সেসব কথাই বন্ধু হিসেবে যেমন ব্যবহার সবাই করে থাকে। আমি ওর প্রেমিকা, এ নিয়ে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই, সেই প্রকাশটাও আগের মত করছে না। সবার কাছ থেকে সরে আসার পর নীনা দাঁতে দাঁত পিষে ক্রোধ প্রকাশ করতে করতে বলল,
❝দেখলি ইতরটার ব্যবহার? এমন ভাব ধরে ঘুরছে যেন তোর সাথে ওর কিছুই নাই! একেবারেই নাই! এরকম অসভ্য ইতরগুলোর জন্য কাঁদিস কিভাবে? তোদের কান্না আসে কিভাবে রে?❞
আমি কিছু না বলে মুখ নিচু করে হাঁটি। স্নিগ্ধা হাত চেপে ধরে চোখের ভাষায় অভয় দেয়, সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমার মন ভালো করতে শপিংয়ে যাই সবাই, সেখানে গিয়ে নাগা বার্গার খাওয়ায়। আমি হাসি, মেকি হাসি। আমার ভেতরটাকে শুভ খুন করে রেখে গেছে। আত্মার লাশ নিয়ে মানুষ হাসতে পারে না। আমি হাসছি। এ এক অদ্ভুত অত্যাশ্চর্য!

বেশ কিছুদিন পরের কথা।

জাহিদ আমাকে একা কথা বলতে সবার থেকে আলাদা করে নিয়ে গেল। আমি চুপচাপ রেজিস্ট্রার বিল্ডিং এর চারদিকের গাছ গুলোর দিকে দেখছি। ওরা সবাই যখন হাকিম চত্বরের দিকে গেল, জাহিদ তখন আমাকে মল চত্বরের এদিকে টেনে আনলো।

❝তোদের মাঝে কি হয়েছে একটু বলবি?❞
❝কাদের মাঝে?❞
❝তোর আর শুভর?❞
❝কিছুই হয়নি। আর কিছু হবেও না❞
❝ইউ গাইজ ব্রোক আপ?❞
❝এখনও জানি না। শুভও কিছু বলেনি, আমিও না। দুজনে দুজনের মত আছি। সেপারেশন বলতে পারিস, ব্রেকাপ বলতে পারিস, যেকোনো কিছু বলতে পারিস❞
জাহিদের মুখ শক্ত হয়ে উঠেছে।
❝ও কি তোকে ডিচ করেছে? চিট করেছে ব্লাডি লুজারটা?❞
আমি গালের একপাশ ঠেলে হাসলাম।
❝কি দরকার এসব ঘাটানোর? বাদ দে না❞
❝ও যদি এমন কিছু করে, আমি ওকে ছাড়ব না, আই সোয়্যার!❞
আমি হাসলাম।
❝জাহিদ, মানুষের মনের উপর জোর খাটে না। থাক না, ওকে এভাবেই থাকতে দে। ও যদি ভুল করে, তার শাস্তি তোর ওকে দিতে হবে না, ও এমনিতেই পাবে। আমাকেও এভাবেই থাকতে দে। বিষ ব্যথা নিয়ে ভালোই আছি❞

ওকে কিছু বলতে না দিয়ে সরে আসলাম। আমি আজকাল ঘুমের ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুমাই। ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না। না, কেউ প্রেস্ক্রাইব করেনি আমায়, নিজ থেকে খাচ্ছি। জানি, কেউ শুনলে বলবে, এভাবে খেও না, ড্রাগ এডিক্টেড হয়ে পড়বে। এডিকশন আসলেই বা কি করার? আমার আত্মা মরে গেলেও দেহটা তো ঠিক বেঁচে আছে। দেহের জন্য ঘুম আবশ্যক। নাহলে আবার কোন রোগ বসা বাঁধে! এখন বুঝি কেন মানুষ দুঃখে ড্রাগ নেয়।

জাহিদের কাছ থেকে আসার কিছু পরে একটা শব্দ আমার মাথায় হিট করল, ‘চিট’। শুভ কি আমার সাথে চিট করেছে? ও কি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে পছন্দ করে? কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে? আমাকে কি এজন্যই ছুঁড়ে ফেলা? অনেক ভাবলাম। কে হতে পারে? আচমকা মনে পড়ল, ওর পাশের বাসার একজনের জন্য ও আমাকে ফেলে সেদিন চলে গিয়েছিল। ওই কি তাহলে শুভর আসল ভালোবাসা? আর আমাকে কি ও কেবল ব্যবহার করছিল? আমার সত্য জানতে হবে। সপ্তাহ খানেক পর আমি আবার উত্তেজিত হয়ে উঠেছি সত্য উদঘাটনে। কি করে পাবো ঐ মেয়েকে? আমি তো শুভর বাসার ঠিকানাই জানি না! তবুও আমাকে বের করতে হবে, যে করেই হোক!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here