শুভ বিবাহ পর্ব-১৭

0
988

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

১৭

বাসায় এসে যখন বিছানায় গেলাম, তখনও বারবার তুতুনের রক্তজমাট বাঁধা মুখ খানা ভেসে উঠল। ভাগ্যক্রমে ওর মাথায় বেশি চোট পায়নি। হাত ঘুরিয়ে মাথা বাঁচাতে গিয়ে ও বেকায়দাভাবে কাঁধে আর হাতে ব্যথা পেয়েছে। খুব শখ ছিল একটা বাইকের। কিন্তু তুতুনের এমন অবস্থা আমাকে নিরুৎসাহিত করছে। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছি, তুতুন যদি মরে যেত? আমি কি কখনো কিছু করতে পারতাম? আমার ভেতরে তুতুনের প্রতি এক সমুদ্র অনুভূতি এসে জমা হয়েছে, তা কি বুঝেছি?

বিছানা ছেড়ে আলো জ্বালালাম। আয়নার সামনে নিজেকে দেখছি। আজ দুপুরেও তো আমার উন্মুক্ত বক্ষে কণার হাত ঘুরছিল, আমার হাত ছিল কণার দেহে। হ্যাঁ, এই দুই হাত দিয়েই তো কণাকে ছুঁয়েছি। আর আজই কিনা এমন হলো? বারবার তুতুনের কথা মনে পড়ছে। পিচ্চি তেঁতুলটার কেন এমন হলো কেন? কি ছোট্ট একটা মেয়ে। এখনও দুই শিং বানিয়ে ঘোরে, চশমা নাকের উপর ঠেলে ঠেলে বারবার চায়। সেই মেয়েটা এভাবে দেখতে না জানি ওর কাছের মানুষদের কেমন লাগছে। আমি বারবার আয়নায় নিজেকে দেখি। নিজেকে কেমন যেন ঘেন্না লাগছে। না, কণার সাথে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোয় না, তুতুনকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যাওয়ায়। আমি কেন এমন করলাম?

শুয়ে শুয়ে ভাবছি। তুতুনকে ভাবছি। কণার সাথে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর কথা হয়েছিল। উদগ্রীব হয়ে ছিল ও, সাথে রাগ আর অভিমানের সংমিশ্রণে একটা মোরাব্বা হয়ে সেজেছিল। আমি কাঁটাচামচ দিয়ে খুঁচিয়েছি মোরব্বাটাকে। কণা আহত কন্ঠে বলেছে,
❝এমন করছিস কেন রে? আমার বুঝি তোর জন্য চিন্তা হয় না?❞
কণাকে আরও দু চারটে কথা বলে ফেলেছি। শেষে ওর ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে ফোন কেটেছি। হতে পারে না এমন? এরকম সময় গুলোয় মেয়েদেরই তো দোষ হয়। তাবত দুনিয়ার সব দোষ মেয়েদেরই হয়। কিন্তু মনের গভীরে আমি জানি, দোষটা কণার না। দোষ আমার, আমার লোভের। এর আগেও প্রেম করেছি, কিন্তু কণার সাথে কেমন করে যেন গভীরে চলে যাচ্ছি। এটা আর কখনো হয়নি। আমি কি আসলেই ওর সাথে এত গভীরে যেতে চাই?

আচ্ছা, কণা আজ কি রঙের শাড়ি পরেছিল? ওটাকে কি গোলাপি বলে মেয়েরা? বেবি পিংক? নাকি মিষ্টি রঙ? কি রঙের ব্লাউজ ছিল ওর? ওকে যখন চুমু খেয়েছি, তখন কেমন বোধ হয়েছে? আমি চোখ বুঁজতেই গোলাপি জামদানীতে তুতুনকে থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। তুতুনকে দেখলাম কেন?!

দেয়াল ঘড়িতে তখন দুইটা বাজছে। তুতুন কি ঘুমাচ্ছে? নাকি জেগে আছে? ওর কি খুব ব্যথা হচ্ছে? উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। ঐ জানালাটায় পিচ্চিটা আবার কবে দাঁড়াবে? পিচ্চিটা বাড়ি ফিরলে এবার আর বকব না।

………………

আমি ঠিক বুঝলাম না শুভর এমন কি জরুরী কাজ যে আমাকে এই অবস্থায় ফেলে গেল? ওর কি পরিবারের কারো কিছু হয়েছে? ওর বাবা মা ভালো আছে? আমাকে তেমন কিছু না বলেই ও দৌড়ে চলে গেল। যাবার সময় ওর প্যাকেটটাও নিল না। আমি অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছিলাম। শাড়ির আঁচল তুলে গায়ে জড়াতে ইচ্ছাও করেনি। ভেবেছিলাম, যে সরিয়েছে, সেই জড়াবে। তার আগেই সে পালালো। আমি প্রথম প্রথম উৎকন্ঠা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম ওর একটা ফোনের। ধীরে অসহিষ্ণু হয়ে উঠলাম। ও কোথায় গেছে, কি হয়েছে, জানাবে তো? আমি সেটা জানতেও পারব না? বাধ্য হয়ে দুই ঘন্টা পর ওকে কল দিলাম রিসিভ হলো না। এরপর বারবার করে কল দিতে থাকলাম, মেসেজ পাঠালাম। লাভ হলো না। শুভ কিছুই জানাচ্ছে না আমাকে। ভয় লাগছে, যেভাবে বেরিয়ে গেছে, ও কোনো বিপদে পড়ল না তো? আমি তো জানতেও পারছি না! এতবার চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে বাথরুমে গিয়ে বাথটাবের পানিতে ডুব দিলাম। মাঝে মাঝে যখন খুব বেশি খারাপ লাগে, তখন ঐ পানিতে নাক মুখ ডুবিয়ে রাখি। মিনিট খানেকের মত নিঃশ্বাস আটকে রাখার ক্ষমতা আছে। সেই মিনিট খানেক মনে হয় অন্য কোনো পৃথিবীতে চলে গিয়েছি আমি। শান্তি লাগে। ভীষণ শান্তি লাগে।

মাথা ভিজিয়ে উঠে আসলাম সেখান থেকে। বিরাট অট্টালিকায় কিছু কাজের মানুষ ছাড়া আমি একমাত্র মানুষ। ওদের কারো সাথে আমার তেমন সখ্যতা নেই, আবার একেবারে খারাপও না সম্পর্কটা। তবে দিন শেষে কাউকে না কাউকে লাগে নিজের কথা গুলো বলার জন্য। মাঝে মাঝে যখন আমাদের জাফরিন খালা আর ড্রাইভার এক সাথে বসে গল্প করে, কিংবা নতুন মেইড মেয়েটা, নুহার সাথে গুজগুজ করে, তখন আমি দূর থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। কি হত আমার আম্মু যদি আরও একজন ভাই অথবা বোন জন্ম দিত? কিংবা বাসায় থাকত? সবার আম্মু যেমন থাকে? কি হত দেশে বিদেশে সমাজ সেবায় না গেলে? এই যে আজ আমি ক্ষতবিক্ষত, এই আমার সেবা কে করবে? কে আমার পাশে থাকবে?

বিষন্ন মনে বিছানার ঐ পাশটা ছুঁয়ে দিচ্ছি যেখানে শুভ ছিল। ওর প্রতি আকর্ষণ, ভালোবাসা আমার সকল বাঁধ ভেঙে ফেলেছে। প্রথম যেদিন রাজী হলাম, তখন বারবার মনে হচ্ছিল, ভুল হচ্ছে কোথাও। সময় এর সাথে সাথে মনে হলো, যাকে এত ভালোবাসি, তার জন্য কি এইটুকু করা যায় না? আজ যখন ও আমার এত কাছে আসলো, মনে হলো, আমি তাহারে পাইলাম, এই তাহারে পাইলাম!

কিন্তু পাওয়ার আগেই সে হারিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত যখন ওর সাথে কথা বললাম, তখন রাত হয়ে গেছে। আমার উৎকন্ঠা দেখেও সে রেগে গেল, আমি কেন বুঝতে চেষ্টা করি না, আমি তাকে বুঝি না, সারাক্ষণ জ্বালাই, ঘাড়ের উপর পড়ে থাকি, নিজেই বিরক্তির কারণ হই, এসব বলল। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, আমার ভুলটা কোথায়? আমি কি ওর কথা ভাবিনি? আজ আমি কত বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছি ও কি বুঝতে পারছে? ও কি আমাকে একটুও বুঝে না? অথচ আমি যে ওর মাঝে মরে গেছি, সে খবর ওকে কে দেবে?

সমস্ত রজনী বিনিদ্র কাটিতে পরদিন সকালেও ওর কোনো সাড়া পেলাম না। অপেক্ষা করতে না পেরে ওকে কল দিলাম। প্রথম বার ফোন রিসিভ না করলেও দ্বিতীয় রিসিভ করল।
❝এখনো রেগে আছো?❞
ওপাশ থেকে শুভর ঠান্ডা কন্ঠের জবাব,
❝নাহ, ঠিক আছি❞
❝কি হয়েছে আমাকে কি সেটা বলা যায়?❞
❝আমার পাশের বাসার একজন এক্সিডেন্ট করেছে❞
❝কিন্তু তুমি তাতে এত ব্যস্ত হলে যে?❞
❝তাহলে কি বসে থাকব? ওর রক্ত লাগবে, আর আমি বসে থাকব তোমার সাথে? নাকি তোমাকে রেখে এসেছি এসব বলছ?❞
❝আহ, আবার রাগ হচ্ছো। এরকম কিছু না। তোমাদের অনেক ক্লোজ কেউ কিনা, এজন্য প্রশ্ন করলাম❞
ওপাশে কিছুটা নীরবতা। আমিও থেমে আছি, অপেক্ষা করছি। শুভ ধীরে ধীরে বলল,
❝তোমার কাছে আসার সময় ওকে আমি রক্তাক্ত অবস্থায় দেখেছিলাম। কিন্তু এত রক্ত ছিল যে আমি চিনতেই পারিনি। আম্মু যখন ফোন দিয়ে সব বলল, আমি তখন বুঝলাম। ওকে ঐ অবস্থায় দেখেও ফেলে রেখে এসেছি শুধু তোমার কাছে আসার জন্য। অন্য সময় হলে এই অমানুষিক কাজটা আমি কখনো করতাম না❞
❝এখন কি এজন্য আমি দোষী হয়ে গেলাম শুভ?❞
❝চিন্তা করে দেখো দোষ কার❞
❝আশ্চর্য! আমি কি তোমাকে কাউকে মৃত্যুর মুখে ফেলে আসতে বলেছি? এখানে আমার দোষটা কোথায় বলবা? গতকাল থেকে আমাকে কোন দোষে শাস্তি দিচ্ছ?❞

ওপাশে শুভ খুব রেগে গেল।
❝আমি কি বলেছি যে তুমি আমাকে এরকম কিছু করতে বলেছ? এজন্য তোমার উপর রাগ উঠে আমার! আমি একটা ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আর তুমি আছ তোমার নাটক নিয়ে! একটুও বোঝার দরকার মনে করো না আমাকে? পেয়েছটা কি? তোমার এই ঘ্যানঘ্যানানির জন্যই গতকালকে ফোন ধরিনি! জানি তো এসব আজাইরা প্যাচাল ক্যাচাল করবা তুমি। আসলাম কেন, গেলাম কেন, ফোন ধরলাম না কেন, বললাম না কেন, শুনলাম না কেন! আমার দুনিয়ায় কি তুমি ছাড়া কিছু নেই আর? কেউ নেই? আর ফোন দিবা না আমাকে তুমি! সকাল সকাল মাথা আউলে দিয়েছ!❞

কট করে শুভ লাইন কেটে দিল। আমার চোখের সীমানা বেরিয়ে বাঁধভাঙা জলে তখন সব ঝাপসা লাগছে। শুভ আজকাল আমার কোনো কথাই সহ্য করতে পারে না। কষ্টে বুক ফেটে যায়, কিন্তু সামান্য উহ করলেও শুভ তাতে রেগে যায়। আমাকে ও কষ্ট দিতে পারবে, অথচ আমি কিছুই করতে পারব না? বলতেও না? শুভ বোধহয় আমাকে ভালোবাসে না। আচ্ছা, ভালো না বাসলে গতকাল কেন এসেছিল? কান্নার দমকে আমার নিঃশ্বাস আটকে আসছে। আমি নীনাকে কল দিলাম।
❝দোস্ত, বাসায় আয় প্লিজ। পারছি না আর!❞

নীনা কিছুই জানে না, কি বুঝলো, তাও জানি না। কেবল বলল, ও আসছে। আমি জানি, আধাঘন্টার মাঝে ও হাজির হবে। এটাই বন্ধুত্ব। অথচ শুভ দুমিনিটও আমার কথা শুনতে রাজী হয় না। আমি বালিশে মুখ চেপে কাঁদতে থাকলাম। কেন শুভকে এত ভালোবাসলাম যে নিজেকে বিসর্জন দিচ্ছি? কেন?

…………….

ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে। আজ জুম্মার নামাজ পড়তে হবে। নামাযের ক্ষেত্রে আমি বরাবর ফাঁকিবাজ। সারা সপ্তাহ নামায না পড়লেও আমাকে অকেশনাল নামাজি বলে চালিয়ে দেয়া যায়। তবে আজ মন থেকে নামাজে যাবো। নামাজে দাঁড়িয়ে মন থেকে ক্ষমা চাবো। সমস্ত শরীর ভরা অপরাধের বোঝা মনে হচ্ছে। বারবার তুতুনের রক্তমাখা রূপ মনের পর্দায় ভাসে। নামাজের পর তুতুনকে দেখতে যেতে হবে। মেয়েটার কি অবস্থা এখন? রিলিজ কবে দিবে? ওর কিছু লাগতেও তো পারে। দেখি সেখানে গিয়ে কি করা যায়।

বিকালে হাসপাতালে গেলাম। আগামীকাল তুতুনের রিলিজ। আমি তুতুনের কেবিনের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। আন্টি ব্যস্ত হয়ে আমাকে একটা চেয়ারে বসতে বললেন। ওকে দেখতে অনেকেই ফল ফলাদি এনেছে, আন্টি সেখান থেকে নিয়ে আমাকে সাধছে। তুতুন সোজা হয়ে আধশোয়া হয়ে টিভির দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আমাকে দেখেও সে সরাসরি আমার দিকে তাকায় নি, যেন আমার কোনো অস্তিত্ব নেই ওর কাছে। আমিও চুপচাপ ওদের দেখছি। আন্টির অনেক অনুরোধের পর এক টুকরো আপেল মুখে তুললাম, এর বেশি ফল মুখে রুচলো না। তুতুন এক দিনেই ভীষণ শুকিয়েছে। আমার তুতুনের জন্য ভীষণ একটা মন খারাপ করা বিষন্নতা চেপে ধরেছে। কেন ধরেছে, তা এখনো বুঝতে পারছি না, ইচ্ছাও করছে না। যতবার ওকে দেখি, মনে হয় যেন আমিই ওকে মেরে রেখে এসেছি। এরকমটা কেন হচ্ছে জানি না, জানতেও চাই না।

তুতুনের কেবিনে বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিল, তাই বেরিয়ে আসলাম। মেয়েটা বোধহয় বুঝে গেছে। ও কি আমাকে দেখেছিল সেদিন? দেখার কথা না। তাহলে কেন আমার সাথে কথা বলছে না? আমি কি খুব বেশি খারাপ ব্যবহার করতাম ওর সাথে? ও তো আমাকে দেখলেই পালাতো। আমাকে কি ওর খুব অপছন্দ? আমি কি এতটাই খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছিলাম ওর সাথে? থাক, ও ওর মত থাকুক। মেয়েটা সুস্থ হোক, আমিও একটু স্বস্তি পাই।

ফোন বের করলাম। কণা সকালের পর আর কল করেনি। ওর কথা শুনতে কেন যেন এখন ইচ্ছেও করে না। ভেবেছিলাম, কাল নতুন করে আমাদের মাঝে একটা আকর্ষণ তৈরি হবে। কিছুই হলো না। ওর প্রতি বিরক্তি আরও বেড়েছে। ওর বাবার সম্পদের লোভও হচ্ছে না, বরং ওকে একটা উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে। ঠিক যেন ঘরের অপ্রয়োজনীয় একটা আসবাব। কখন একে বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে, সে অপেক্ষায় থাকে কেউ। কণাকেও এমন লাগছে। অপ্রয়োজনীয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here