শুভ বিবাহ পর্ব-২৪

0
766

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

২৪

আমার মেডিকেলের পরীক্ষা গুলো ভালো হলেও ওসব যায়গায় আমার রোল আসলো না। ঢাকা মেডিকেলের রেজাল্টে ওয়েটিং, চিটাগং মেডিকেলে ওয়েটিং, সোহরাওয়ার্দীতে ওয়েটিং। কিছু কিছু যায়গায় টিকিই নি। কান্না পায় সারাদিন। আমার বোধহয় আর মেডিকেলে পড়া হবে না! সবাই আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখলো, কত কি ভাবলো- কিছুই সত্যি হচ্ছে না। আমার স্বপ্ন গুলো ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। কণা আপুও আমাকে শুধু সান্ত্বনা দেয়। ইসাবেলা আপু সেদিন এসে খুব রিলাক্স করার চেষ্টা করেছে আমাকে। বার বার বলছে, আমি প্রাইভেট মেডিকেলে পড়তে তো পারব। প্রাইভেটে পড়তে দশ থেকে পনের লাখ টাকা লাগবে। মানলাম আমার দুই ভাই বিদেশ থাকে। তাই বলে তারা তো আর এত টাকাও উপার্জন করে না! উপরন্তু সেখানেও তাদের খরচ আছে। ট্যাক্স, রেন্ট, ইন্সুরেন্স, সব মিলিয়ে মাসিক উপার্জনের একটা বড় অংশ চলে যায় ওদের। এদিকে আব্বু রিটায়ার্ড। আব্বুর পেনশনের টাকায় এই বাসা হয়েছে। বাকি কাজ কিছু ব্যাংক লোন এনে সম্পন্ন করা হয়েছিল দুই বছর আগে মাত্র শোধ করেছে সবাই মিলে। এখন আমার পিছে এত গুলো টাকা ঢালার কোনো প্রয়োজন আছে? নাকি এটা কোনোভাবে সম্ভব?

আমার মাথা আউলা ঝাউলা লাগে। ঘর থেকেও বের হতে ইচ্ছা করে না। সারাদিন বই খাতার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবি, এজন্যই কি এত পড়াশোনা করেছি? এই আমার প্রাপ্য?

আমার এই দশা দেখে আম্মু আমাকে নিয়ে বের হলো ঘুরতে। ঘুরে এসে আম্মুকে বললাম,
❝একটু ছাদে যাবো❞
❝মাত্রই না বাইরে থেকে আসলাম? আবার ছাদে কি? এখন না সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে? সন্ধ্যেয় মেয়েরা বের হয়? কতবার তোকে নিষেধ করছি উল্টাপাল্টা সময় ছাদে যাবি না। মায়ের কথা তোদের পছন্দ হয়না। এখন ছাদে যেয়ে কোনো কাজ নেই, বাসায় থাক❞
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে আম্মু থামলো। আমি একঘেয়ে কন্ঠে বললাম,
❝আমি এখন ছাদে যাবো❞

আম্মুর ফিরতি জবাবের অপেক্ষা না করে কেবল জানিয়ে দিয়েই বেরিয়ে আসলাম। ছাদে এসে দেখছি আকাশে গোধূলি রঙ। সূর্যের শেষ বিচ্ছুরণ এদিক ওদিক বড় বড় দালান গুলোয় আবছাভাবে পড়ছে। আর হয় দশ মিনিট। এরপর সূর্যের দেখা এই ধরণীর কেউ পাবে না আজকের মত। আমি এক ধ্যানে প্রকৃতির এমন রূপ বৈচিত্র্য দেখি। আকাশে নীড়ে ফেরা পাখিদের ছুটোছুটি। দিন শেষে তাদের ঘরে ফেরার আয়োজন চলছে। কাছে-দূরের রাস্তাগুলোয় গাড়ি আর মানুষের আনাগোনা। পাখিদের দিন শেষ হলেও মানুষের নতুন প্রহরের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেবল আমিই যেন নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি। কোনো ব্যস্ততা নেই আমার।

এমন সময় আমার পেছন থেকে একটা শব্দ আসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, শুভ ভাইয়া এই ছাদে লাফিয়ে এসেছে। তার আসার শব্দটাই শুনেছি। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে গেল তাকে আমার দিকে আগাতে দেখে।
❝কি খবর তেঁতুল ফুল?❞

অনেক দিন পর আমাকে এই নামে ডাকলেন উনি। সবসময় আমি বিরক্তি প্রকাশ করি। ভ্রু কুঁচকে, ঠোঁট ফুলিয়ে এই নামের প্রতি অপছন্দতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাই। আজ করলাম না। মন ভালো নেই। তবে তার প্রশ্ন শুনে জবাব দিলাম না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলল,
❝তেঁতুল ফুল বললাম বলে রাগ নাকি?❞
❝না। আমি ঠিক আছি❞
❝মনে হচ্ছে মন খারাপ?❞
❝তেমন কিছু না❞
❝কোথাও টিকলে?❞
❝নাহ❞
এই প্রশ্নের জবাবে ভেতরের দীর্ঘশ্বাস ঠেকাতে পারলাম না। আজকাল চাচা, মামা, ফুফু, ভাইয়া, আপু সবার একটা কমন প্রশ্ন। আচ্ছা, আমি টিকলে তো তারা জানতেই পারত। আমাকে কি এজন্য ঘটা করে জিজ্ঞাসা করতে হত? শুভ ভাইয়া তবুও আলাপ জমানোর চেষ্টা করে। আমি পাত্তা দেই না। এতক্ষণ ভাল লাগলেও শুভ ভাইয়ার আগমনে পরিবেশটা অশুভ হয়ে গিয়েছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বললাম,
❝আপনি থাকেন। আমি চললাম❞
❝আন্টি বকবে?❞
❝হুম❞
❝আন্টিকে খুব ভয় পাও, না? উনার কথা ছাড়া কিছু করো না বোধহয়?❞
❝করি তো❞
❝কি করো?❞
❝এই যে, ছাদে আসলাম❞

শুভ ভাইয়া কেমন করে হাসলো। বিশ্রি হাসি। ইচ্ছা হলো ঘুসি মারি একটা। বিশ্রিভাবে হেসে বলল,
❝তোমার সাহস দেখি, এইটুকু, বাতি ইন্দুরের মত!❞
আমার ভীষণ রাগ হলো। দাঁত কিটকিট করে বললাম,
❝ইঁদুর কাটলে কিন্তু প্লেগ হয়! ভুলেও এত ছোট ভাববেন না আমাকে। আমি বাবা মায়ের বিরুদ্ধে যাই না মানে আমি সাহস না, দুঃসাহস দেখাই না। আপনাদের মত আমি দুঃসাহস দেখিয়ে আমি নিজের গায়ে দাগও ফেলতে চাই না❞

কথা শেষ হতে না হতেই আমি সেখান থেকে রীতিমতো পলায়ন করলাম। আমার দুঃসাহস নেই বলে যে একটু আগে ভাব নেয়ার চেষ্টা করেছি, সেটা একেবারে মিথ্যা। কারণ মাত্র আমি শুভ ভাইয়াকে যা বলেছি, তা কেবল দুঃসাহসিক কাজ নয়, অবিশ্বাস্য রকমের দুঃসাহসিক কাজ! কণা আপু পই পই করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, ভুলেও শুভ ভাইয়ার সামনে এমন কোনো কথা না বলতে যাতে সে জানে যে আমি তার কুকীর্তি সম্পর্কে জানি। যদি শুভ ভাইয়া আজকে বুঝে যায়? সিঁড়ির ধাপ ভাঙতে ভাঙতে দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। দরজা হাঁ করে খুলে গেছে। আমি দরজার সামনে প্রায় উপুড় হয়ে পড়ে আছি। আম্মু জগ থেকে পানি ঢালছিলেন। আমাকে এমন ধুপ করে পড়ে থাকতে দেখে বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরলেন।

❝জ্বীনে কি দৌড়ানি দিছে তোকে?❞

আমি দ্রুত উঠে হাত পা ঝেড়ে দরজা আটকে ঘরের দিকে দৌড়ালাম। আজকে কপালে শনি আছে মনে হয়।

বেশ কিছুদিন পরের কথা।

কোনো পাব্লিক মেডিকেলে আমার সুযোগ হলো না। ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়েছি। কারো সাথে যোগাযোগ করছি না, কথা বলছি। শুধু হতাশ লাগে আমার। জীবন এমন কেন? কেন মেডিকেলে পড়তে চাইলাম? পৃথিবীতে আর কোনো সাবজেক্ট ছিল না? আব্বু প্রাইভেট মেডিকেলের কথা বলেছিল। আম্মু মুখ কালো করে রেখেছে সেটা শুনে। কারণ আমরা সবাই জানি, প্রাইভেট মেডিকেলে আব্বু পড়াতে পারবে না। অনেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার পরামর্শ দিচ্ছে। আমি তো ম্যাথে দুর্বল৷ ফিজিক্সেও। তাহলে কিভাবে ম্যানেজ করব?

কণা আপুর একটা টেক্সট এসেছে। ফোন নিয়ে সেটা খুলে মুখের উপর মোবাইল স্ক্রিন ধরলাম। আপু লিখেছে,
❝তুই কেন মেডিকেল নিয়ে এত ভাবছিস? মেডিকেলের আরেকটা সেক্টর কিন্তু ফার্মাসি। ওটায়ও পড়তে পারিস। বাংলাদেশে এখন এটা একটা আপরাইজিং ডিমান্ডেবল সাবজেক্ট। মেয়েদের জন্য ক্যারিয়ারটা একটু কষ্টের হলেও বাইরের দেশে অনেক সুবিধা পাবি। কেন এই সেক্টর নিয়ে ভাবছিস না?❞

বসা থেকে থেকে উঠে বসলাম। আপুর কথা মতো এই সাবজেক্ট নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করলাম। দুই ঘন্টা পর যখন উঠলাম, তখন আমার মুখে হাসি। কণা আপু জিনিয়াস। ওকে আমার সবসময় একটা এঞ্জেল মনে হয়, যে এঞ্জেলকে আমি অশুভ একটা মানুষের কারণে পেয়েছি। খারাপ ঘটনা গুলো মাঝে মাঝে কত সুন্দর সময়ের জন্ম দেয়। তাই না?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here