#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria
২৬
পিচ্চি পিচ্চি পোলাপানরা কিভাবে যেন চোখের সামনে হুট করে বড় হয়ে যায়। শায়লাও বড় হয়ে গেছে। আর সেটা টের পেলাম গতকাল যখন ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলো। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমার সেই ছোট্ট বোনটা যার সাথে উঠতে বসতে মারামারি করতাম, সে আজ বিয়ের উপযুক্ত। আম্মু যদিও ওকে আরও পড়াবে। সে একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু দেখতে দেখতেই তো বিয়ের উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই নিজের বাড়ি ছেড়ে পরের বাড়ি চলে যাবে।
তুতুনও বড় হয়ে গেছে। মেডিকেলে চান্স পেয়ে দিনাজপুরে চলে গেছে। বিভিন্ন ওকেশানে আসলেও তেমন একটা সামনে পড়ে না। জানালায় দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে যখন সিগারেটে আগুন ধরাই, তখন তিন তলার জানালাটায় চোখ পড়ে। এখন অন্ধকার থাকে। কারণ ওদের বাসাটা খালি।
আমার কি হয়েছে কে জানে! ইদানীং অনেক মেয়ের সাথে কথা হলেও কাউকে মনে ধরে না। বসুন্ধরার এক মেয়ের সাথে কিছুদিন যাবৎ বেশ খাতির হয়েছে। মেয়েটার কন্ঠ শ্রেয়া ঘোষালের মত। শুনতে মধু মধু লাগে। সারারাত কথা বলা হয়। মেয়েটা মুখিয়ে থাকে। ওকে পেয়েছি রঙ নাম্বার থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর নাম বলার পর তার ইন্টারেস্ট বেড়ে তুঙ্গে উঠে গিয়েছে। মেয়ের বাবার টাকা পয়সা ভালোই। কিন্তু একেবারে বেকুব মনে হয় ওকে। বুদ্ধি কম। কম বুদ্ধিমান মেয়ের সাথে কতক্ষণ কথা বলা যায়? ভালো লাগে? তবুও বলি। কারো সাথে প্রেম করতে ইচ্ছা করে না এখন। মাঝে মাঝে কণার কথা অবশ্য মনে পড়ে। আমার জীবনে ওই সবচেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হয়েছে। এখন বোধহয় ভালোই আছে। আমি সেদিকে ঘাটানোর চেষ্টা করি না। বন্ধুদের মুখে মুখে শুনি। ওদের সাথে কণার যোগাযোগ আছে। আমি কেবল ওর সম্পর্কে শুনে যাই, মন্তব্য করি না।
বসুন্ধরার সেই মেয়ের নাম মণিকা। মণিকা ফেসবুকও চালায়। ওর ছবি দেখে ভালোই লেগেছে। সুন্দরী আছে। সুন্দরীরা একটু বোকাই হয়। খাস বাংলায় বেকুব হাঁদা। মণিকা কয়েকদিন ধরে দেখা করতে চাচ্ছে। আমি যদিও আগ্রহ দেখাচ্ছি না। কারণ পকেট ফাঁকা। টিউশনের টাকা পেতে কয়েকদিন সময় লাগবে। তার আগে দেখা করতে চাই না। যদিও ও বলেছে ও খাওয়াবে। মেয়ে মানুষের টাকায় খেতে পারলে মন্দ কি? তবুও রিস্ক নেয়া যায় না।
দুইদিন পর একটা টিউশনির টাকা পেলাম। টাকার অংকটা একটু ভারি, তাই মন ফুরফুরে। মণিকাকে কল দিলাম। একটু দেখা করে আসি। মাঞ্জা মারলাম একটু বাসা থেকে। এরপর রওনা করলাম। বিকেলের দিকে আমি যমুনা ফিউচার পার্কে এসে দাঁড়িয়ে আছি। গেইটের সামনেই দাঁড়িয়েছি যেন আসলেই দেখতে পারি। দশ মিনিট পর একটা শুকনা মেয়ে আসলো। এত ঝকমক সাজ দিয়েছে যে বিকেলের রোদে আমার চোখ ঝলসে যাওয়ার জোগাড়! জামা থেকে, জুতো থেকে, ব্যাগ থেকে, কপালের টিপ থেকে এমনকি চেহারায় মাখানো মেকাপ থেকেও আলোর ঝলকানি এসে আমাকে হতবিহ্বল করে দিল। আমি ওকে প্রথম দেখাতে বলেই ফেললাম,
❝তুমি কি চুমকি দিয়ে গোসল করে এসছ?❞
মেয়েটা মুখ কালো করে ফেলল। আমাকে বলল,
❝আমাকে সুন্দর লাগছে না?❞
আমি একটা ফিচকি মারলাম।
❝ব্যাপক সুন্দরী লাগছে! হজম হচ্ছে না!❞
মণিকাকে নিয়ে আমি যারপরনাই হতাশ। এই মেয়ে শুধু বোকা তা না, সেই রকমের ক্ষেতও। আমি ওকে নিয়ে বিভিন্ন শো-রুম গুলোয় ঘুরছি। মণিকা কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত মন্তব্য করছে। আমার কেমন যেন লাগছে! হুট করে কণার কথা মনে পড়ল। ও থাকলে এখন এমন লাগতো না। কণা অনেক স্মার্ট একটা মেয়ে ছিল। ওর ড্রেসাপ, চলাফেরা সব কিছু পার্ফেক্ট ছিল। সমস্যা একটাই, মেয়েটা তার স্ট্রং পার্সোনালিটির কারণে অন্যকে মানতে পারে না। ওকে তো আমি কিছু কখনো বলিনি যখন ওদের হায়ার ক্লাস সোসাইটির পার্টি গুলোয় যেত। আমিও ওর হাই ক্লাস আত্মীয়, ফ্রেন্ড সার্কেলদের ঘোরাঘুরি, ছবি দেখেছি। কোথায়, আমি তো কখনো এসব নিয়ে মন্তব্য করিনি! ওর এক কাজিন আছে, তার ড্রিংকিং প্রব্লেম আছে। তার সাথেও কণার ক্লোজ ছবি আছে। আমি কি এসব নিয়ে ভেজাল করতাম? ভেজাল দূরে থাক, মন্তব্যও করিনি। কিন্তু আমার সবকিছু নিয়েই ওর অভিযোগ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ও আমাকে ওর মত করে চাইতো। আমি ভাই অন্য কারো জন্য নিজেকে বদলাতে পারব না। তার উপর আমাদের মধ্যে কি হয়েছে, সেসব বান্ধবীরা জানবে কেন? বলবে কেন? ঠিকই আছে সরে গিয়েছি। নাহলে এতক্ষণে আমার গলার উপর চেপে বসে শ্বাস আটকে মারত!
মণিকা আমার সামনে ঘুরঘুর করছে, একটু পর পর চুল এপাশ ওপাশ করছে। আমি ওর সাথে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। তেমন কোনো বড় রেস্টুরেন্ট নয়। মণিকা মেন্যু দেখছে আর বকবক করছে। আমি অপেক্ষা করে আছি কখন বের হবো। এই সময় এক ছেলে হুড়মুড় করে সেখানে ঢুকে বলল,
❝তুমি এইহানে ক্যা? এই ব্যাডা ক্যাডা? তুমি কি করতাছ?❞
মণিকার মুখে আতঙ্ক। সে তোতলাচ্ছে। আমি হতভম্ভ। কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। সেই ছেলের সাথে আরও দুজন আছে। ছেলেটা তাদের দেখিয়ে বলল,
❝এইডি কল না দিলে আমি তো বিশ্বাসই করতাম না যে তুমি এইহানে আরেক ব্যাডার লগে আইছ! এইডা কোইত্তে আইছে? আমার ময়না পাখিরে লইয়্যা ঘুরে?❞
আমি কিছু বলার আগেই একটা ছেলে আমাকে ঘুসি মেরে বসলো। যমুনা ফিউচার পার্কের মত একটা ভদ্রলোকের স্থানে আমি দুইটা ছেলের হাতে গণপিটুনি খেলাম। মার দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেল ওরা। দোকানের ওয়েইটার, ক্যাশিয়ার, কাস্টমাররা চেয়ে চেয়ে দেখলো। আমি খুড়িয়ে খুড়িয়ে বের হতে হতে দেখলাম, সবাই আমার দিকে ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি চেঁচিয়ে বললাম,
❝আরে ভাই, এই মাইয়ার সাথে আমি এই প্রথম দেখা করলাম! আমি ওর সাথে প্রেম করি নাই! এই মাইয়াই আমার পিছে পিছে আইছে!❞
আশেপাশেরনিজের কেউ আমাকে কিছু বলল না। আমি দ্রুত বের হয়ে আসলাম। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। এরপর থেকে আর জীবনেও কারো সাথে দেখা করতে যাবো না। কান ধরলাম!
ফেসবুকে চ্যাট করলেও এরপর আর কারো সাথে দেখা করার রিস্ক নেইনি। আজকালকার মেয়েগুলো যেন কেমন হয়ে গেছে। এত সহজে আর পটে না। আমিও এখন অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছি। ভার্সিটি সার্কেলের একেকজন একেক দিকে চলে গিয়েছে। গেলেও সবাইকে পাই না। নীনা আর স্নিগ্ধা অনেক আগেই কণার সাথে বিচ্ছেদকে ইস্যু করে সরে গেছে। আমিও ছেলে বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত থাকি।
মাস্টার্স শেষ করার পর পর একটা চাকরি হয়ে গেল ইংলিশ মিডিয়ামে। পশ এলাকার পশ স্কুল। স্যালারি ভালো। আমার রেজাল্ট খুব একটা খারাপ না, তাই খুব ভালো ভাবে চাকরিটা জুটে গেল। যেদিন প্রথম গেলাম স্কুলে, সেদিন বাসায় ফিরেই তুতুন আর ওর মাকে আমাদের ড্রইং রুমে আবিষ্কার করলাম। আমাকে দেখে তুতুন অপ্রস্তুত হয়ে শায়লার সাথে ভেতরে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তুতুন এই ক’বছরে খুব সুন্দর হয়ে গেছে, যেন পরিণীতা এক নারী। চোখে রিমলেস চশমাও আছে। ওটা কি ডাক্তার হচ্ছে, এটা বুঝাতে? নাকি চোখে সমস্যা বলে? আমি অবাক হয়ে তুতুনকে দেখছিলাম। তখনই আন্টি আমার মনোযোগ ভঙ্গ করে আমার খোঁজ খবর জানতে চাইলেন। আমি এটা ওটা বলে ঘুরে নিজের ঘরে আসলাম। কাপড় ছাড়তে ছাড়ত্ব তুতুনের মুখটা সামনে বারবার আসছে।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে শায়লার ঘরের দিকে আগালাম। ঐ ঘরে যাবার আগেই রান্নাঘরে ফিসফাস শব্দ পেলাম। মোড় ঘুরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম, তুতুন আর শায়লা কি নিয়ে যেন হাসছে। আমাকে দেখে ওরা চুপ হয়ে গেল। আমি তুতুন জিজ্ঞাসা করলাম,
❝কেমন আছো?❞
❝ভালো,❞ তুতুন মাথা নাড়ালো। আমি স্মিত হেসে রান্নাঘরের দরজায় হেলান দিলাম।
❝কবে আসলে ঢাকা❞
❝দুইদিন আগে❞
❝তোমার জানালায় তো আলো দেখলাম না❞
কথাটা শুনে শায়লা আর তুতুন অবাক হলো।
❝আসলে আম্মু আব্বুর ঘরেই থাকছি। সব যায়গায় ধুলো। পরিষ্কার করার ঝামেলার জন্য যাইনি❞
❝চলে যাবা নাকি আবার?❞
❝এইতো কয়েকদিন পর❞
❝পড়াশোনা কেমন চলছে?❞
❝ভালোই❞
❝সমস্যা হয় না ওখানে?❞
❝মফস্বলে তো একটু হয়ই। তবুও ভালো লাগে। এত শব্দ নেই ঢাকার মত। গোছানো সবকিছু। ঢাকার মত এলোমেলো না❞
❝ভাবছি তোমাদের ওদিকে যাবো। ঘুরতে আর কি। তোমাদের বাসাতেও যাব। আন্টি আংকেল খুশি হবে না?❞
❝হবে তো! আসবেন, অবশ্যই আসবেন❞
তুতুন ভেবেছিল আমি এমনি এমনি বলেছি। আমি সত্যি সত্যি পরের মাসে বন্ধুদের নিয়ে ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। বাসায় যাওয়ার পর আন্টি খুব খাতির যত্ন করলেন। আন্টি আংকেল আগে থেকে আমাদের আসার খবর জানলেও তুতুন জানতো না। সে ভার্সিটি থেকে ফিরে আমাদের দেখে চমকে গেল। আমার মনে হলো, আমাকে এড়ানোর চেষ্টা করলো। আমি তবুও ওর সাথে দেখা করতে গেলাম। ওদের ভাড়া বাসাটাই বিশাল। তুতুনের ঘরে গিয়ে দেখলাম, মেয়ের ঘর খুব সুন্দর গোছানো। আমাকে দেখে তুতুন বলল,
❝কিছু বলবেন ভাইয়া?❞
❝হ্যাঁ, বলব। তোমাদের শহরে আসলাম, দিনাজপুর শহর ঘুরিয়ে দেখাবে না?❞
❝আমি তো খুব একটা ঘুরতে যাই না। পড়ার অনেক চাপ তো। সময় হয় না❞
❝সেটা আমি জানি। অন্তত মেডিকেল কলেজ তো ঘুরে দেখাতে পারো, নাকি?❞
তুতুন মাথা নাড়লো। আমিও কথা আদায়ের ভঙ্গিতে বললাম,
❝তাহলে কাল তোমার কলেযে ঘুরব, সেই কথা থাকলো❞
উঠে চলে আসার মুহূর্তে তুতুন ডাকলো।
❝ভাইয়া, একটা কথা❞
আমি পেছন ফিরলাম। ও ইতস্ততভাবে বলল,
❝এতগুলো বন্ধু নিয়ে আসবেন? না মানে, আমার আনইজি লাগে…❞
❝আচ্ছা, তাহলে আমি একাই আসবো❞
তুতুনকে চোখ মেরে বেরিয়ে আসলাম। আমি অপেক্ষায় থাকবো কালকের। কারণ তুতুনকে দেখে আজকে আমি বুঝতে পারছি, এই মেয়েটাই আমার জন্য পার্ফেক্ট। চোখের সামনে ছোট থেকে বড় হওয়া মেয়েটার সাথে কখনো ফ্লার্ট করিনি, অথচ ওকেই আমি পছন্দ করি খুব। ওকে দেখলে শরীরের অদ্ভুত একটা দোলা দিয়ে যায়। খুব কাছ থেকে ওকে পরখ করে দেখতে ইচ্ছা করে। মনে হয়, আলতো করে ওকে একটু ছুঁয়ে দিই। কিংবা চিমটি দিয়ে কাঁদিয়ে দিই। আর ও কাঁদতে থাকুক। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে আসার আগে আম্মু আমাকে বলেছে,
❝তুতুনকে কেমন লাগে?❞
❝ভালোই তো। ভবিষ্যৎ ডাক্তার। জাতির ভবিষ্যৎ! কেন?❞
❝মেয়েটা খুব লক্ষী। এমন একটা লক্ষী মেয়েকেই তোর বউ হিসেবে চাচ্ছিলাম। তুই কি বলিস?❞
আম্মুকে তখন কিছু জবাব দেইনি। বরং ঠান্ডা মাথায় এখানে আসার প্ল্যান করলাম। তখন থেকে প্রতিটা সেকেন্ডে উপলব্ধি করেছি, এক মাত্র যে মেয়েকে আমি কখনো বিয়ের কথা বলিনি, তাকেই বিয়ে করার জন্য আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে আছি। এটাই কি তুতুনের প্রতি আমার একটা অন্য রকম টানের কারণ?
কারণটা কাল তুতুনের সাথে দেখা করে জানতে হবে। কাল দেখা যাবে, তুতুন আমাকে নিয়ে কি ভাবে।
চলবে…
(আমার পরীক্ষা ছিল, তাই অনেক বেশি দেরী হয়ে গিয়েছে। আরও একটা কারণ আছে। সেটা সময় হলেই সবাই জানবে। এত এত দেরীর জন্য এত্ত এত্ত গুলা সরি!)