শুভ বিবাহ পর্ব-২৮

0
784

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

২৮

সায়মনের সাথে বসে বসে খাবার এঞ্জয় করছি। আজকেও এক মেয়ে ওকে প্রপোজ করেছে। মেয়েটা ল্যাবেই ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেছিল। সায়মন কিভাবে সেই মেয়ের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে, সেই বিশদ বর্ণনা দিচ্ছিল। এই সময় ফোন বেজে উঠল। টেবিলের উপর সেটা উপুড় করে রাখা ছিল। আমি উলটে স্ক্রিন দেখলাম। তুতুন কল করেছে। মেয়েটার কলের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। যেহেতু আজকে শুভ ওকে প্রপোজ করেছে, স্বভাবতই প্রথম সুযোগেই তুতুন আমাকে কল করবে।

ভিডিও কল দেখে আমি সোজা হয়ে বসে ওর কল রিসিভ করলাম। ওপাশের স্ক্রিনে তুতুন ফোলা ফোলা এক জোড়া চোখ আর লাল নাক নিয়ে বসে আছে। আমাকে দেখে তার যেন কান্নার দমক কিছুটা বাড়লো। কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলল,
❝তুমি জানো আজকে কি হইছে? আজকে শুভ ভাইয়া আমার মেডিকেলে এসে আমাকে প্রপোজ করেছে! আমাকে নাকি বিয়ে করতে চায়! আমার সাথে উনার…❞

তুতুনের কথা কান্নার দমকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। টিসু দিয়ে দুচোখের পানি চেপে চেপে মুছছে। আমি সিরিয়াস ভঙ্গিতে চুপচাপ ওকে দেখছি। কান্না কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে আবার বলল,
❝আমি উনাকে সকালেই বলে দিয়েছি, উনার সাথে আমার যায় না। মানায় না। আমি চাই না এমন কিছু। তোমার সাথে কি কি হয়েছে, এসবও টেনেছি। জানি না তুমি রাগ করবে কিনা, কিন্তু আমি চুপ থাকতে পারিনি। সব বলেছি। সে বলেছে, তুমি নাকি মিথ্যা বলেছ। তোমাদের মাঝে নাকি এমন কিছু হয়নি। আমিও বলেছি, আপু কখনোই মিথ্যা বলতে পারে না! আমি তো তাকে বিশ্বাস করি না, তোমাকে বিশ্বাস করি! শুভ ভাইয়াকে সকালে মানা করার পর আমি ক্লাসে চলে যাই। ক্লাস শেষে দুপুরের পর দেখি তখনও উনি কলেজে ঘুরঘুর করছে। আমাকে দেখে সবার সামনে রাস্তা আটকে আবার ঘ্যানঘ্যান শুরু করলো। আমার ফ্রেন্ডরা তখন কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছিল। তুমি তো জানো, আমি তেমন কোনো ছেলের সাথে কথা বলি না। বলতে পারি না আসলে। তাহলে এখন একটা ছেলের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তর্ক করছি, তাও আবার বিয়ে নিয়ে; এটা দেখলে ওরা কি আমাকে ভুল বুঝবে না? বলো?❞

তুতুন কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আমাকে প্রশ্ন করলো। তুতুনের জন্য আমার সত্যিই খারাপ লাগছে। আমি বাগড়া না দিলে হয়ত শুভর সাথে একটা শুভ পরিণয় হয়েই যেত। বাঁধ সেধেছি এই আমি! মাথা নেড়ে বললাম,
❝যারা তোর সত্যিকারের বন্ধু, তারা তোকে ভুল বুঝবে না। আর যারা ভুল বুঝবে, তাদের পাত্তা দিস না। সিম্পল!❞
❝কণাপু, তোমার মত করে আমি তো থাকতে পারি না! আমার খারাপ লাগে। সবার সামনে আমার নিজেকে খুব ছোট লাগছিল জানো? বারবার উনাকে বলেছি, এখানে বাড়াবাড়ি না করতে। সবাই দেখছে, আমাকে নিয়ে অপবাদ দিবে ওরা! কিন্তু কে শুনে কার কথা? উনি বারবার রিকোয়েস্ট করেই যাচ্ছেন! আমার খুব কান্না পেয়েছিল জানো? রাগে কি হলো জানি না, উনাকে আমি বলেছি থাপ্পড় দিব❞

তুতুনের কথা শুনে মনে হচ্ছে, থাপ্পড়ের কথা বলে ও খুব ভুল করেছে। ওর বলা উচিত হয়নি সেটা। আমি ভ্রু কুঁচকালাম।
❝থাপ্পড় দিবি কেন বলছিস? থাপ্পড় দিস নাই কেন? একটা মেয়ের কলেজে এসে ছ্যাচড়ামো করবে, থাপ্পড় তো ওর প্রাপ্য!❞
তুতুনের চোখের পানি আরেকদফা মুছে বলল,
❝আমার কি সেই সাহস আছে আপু? থাপ্পড়ের কথা বলার পর তো শুভ ভাইয়া একদম আমার কাছে এসে হাত ধরে বলেছে, থাপ্পড় দিবা? তুমি আমাকে থাপ্পড় দিতে চাও? কেন? সত্য বললাম দেখে? দাও, থাপ্পড় দাও? দাও?❞
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
❝তারপর?!❞
❝আমি জোর করে হাত ছুটিয়ে চলে এসেছি! আমি জানি, কাল কলেজে গেলে আমি মুখ দেখাতে পারবো না!❞

তুতুন সত্যি সত্যি মুখ ঢেকে কান্না শুরু করলো, যেন আমাকেও মুখ দেখাতে চাচ্ছে না। আমার বিরক্ত লাগছে। এইটুকুতে এত কান্নার কি হলো শুনি? এই মেয়েটা কথায় কথা কাঁদে, কারণে অকারণে কাঁদে! আমি এপাশ থেকে মৃদু ধমক লাগালাম।
❝এই! তুই কান্না থামা তো। কান্না থামিয়ে এরপর কি হয়েছে বল❞

তুতুনের কান্না কিছুটা কমে এলে সে হাপুসনয়নে আবারও বলছে,
❝শুভ ভাইয়ার কারণে আমি তখন বাধ্য হয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে রিকশা নিলাম বাসায় চলে আসবো বলে। আমার আজকে এক স্যারের সাথে জরুরী দেখা করার দরকার ছিল, লাইব্রেরী ওয়ার্ক ছিল, কিচ্ছু করা হলো না! বাসায় এসে আম্মু আব্বুকে কিচ্ছু বুঝতে দেইনি। সব ঠিক ছিল। কিন্তু সন্ধ্যা সাতটার দিকে হুট করে শুভ ভাইয়া হাজির!❞
❝তোদের বাসায়?❞
❝হ্যাঁ! আব্বু আম্মুকে কিসব বুঝিয়ে গেছে, বলে গেছে, জানি না। আমার ভয় লাগছে। যদি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়? আমার মেডিকেলের পড়াশোনার কি হবে? উনার মত চরিত্রহীন মানুষ তো আমার পড়ালেখা দূরে থাক, স্বাভাবিকভাবেই বাঁচতে দিবে না! আমি কি করব আপুউউউ???❞

কথা শেষ হতে না হতেই তুতুন মাথা নিচু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। আমি চুপচাপ ওকে দেখছি। খারাপ লাগার বদলে বিরক্তি বাড়ছে কেন যেন। হয়ত একটু পর পর কান্না করছে বলে। আমি তো এখানে কান্নাকাটির কোনো কারণ দেখছি না! তবুও কন্ঠে সান্ত্বনার সুর ঢেলে বললাম,
❝তুই এত ভেঙে পড়ছিস কেন? আংকেল আন্টিকে বললেই হয় যে তুই বিয়ে করবি না। এতে এত চিন্তার কি আছে?❞
❝আব্বু আম্মু মানবে না। উনাদেরকে তোমার কথা বললেও বিশ্বাস করবে না। শুভ ভাইয়ার মতো আব্বু আম্মুও বলবে, তুমি আমাদের বিয়ে ভাঙার জন্য মিথ্যা কথা বলছো। আমি জানি, তুমি কখনো মিথ্যা বলতে পারো না!❞

আমি অবাক হয়ে নিষ্পাপ মেয়েটাকে দেখছি। সে আমাকে ঠিকঠাক মতো না চিনেও কি পরিমাণ বিশ্বাস করে। অথচ শুভই সত্য বলছে! মিথ্যা তো আমি বলেছি প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে। প্রায় চার বছর আগে যখন শুভ আর তুতুনকে আমি সন্দেহ করতাম, তখনই তুতুনকে এই মিথ্যা জানিয়েছি। সেই মিথ্যাকে আর কখনো সত্যে পরিণত করিনি। আজও করবো না, ভুল ভাঙাবো না। শুভ কখনো প্রমাণ করতে পারবে না আমি মিথ্যা বলেছি। তাছাড়া শুভ নিজেই তো বন্ধুদের কাছে বলে এসেছে আমাদের নামে। এখন সে কোন মুখে আবার বলবে যে আমার ভার্জিনিটি সে নেয়নি? কোন মুখে সে পবিত্র সাজবে? পারবে না। শুভ বিয়ে করলে তার বউয়ের কাছেও এই তথ্য চলে যেতে পারে! যদিও আমি চাই না তেমন কিছু করতে। তবুও শুভকে এভাবে ছটফট করতে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে। চার বছর আগে আমি এভাবে ছটফট করতে করতে দেশ ছেড়েছি। দেখি শুভ এবার কি করে!

তুতুনের দিকে এবার মনোযোগ দিলাম। ওকে বললাম,
❝আংকেল আন্টি বাদ। তোর ভাইয়াদের বললে উনারা বুঝবে না?❞
❝কি বলব?❞
❝এই যে, শুভ চরিত্রহীন মেয়েবাজ জাতীয় একটা ছেলে?❞
❝কিভাবে প্রমাণ করবো সেটা?❞
❝তোর কোন কাজিনের সাথে না শুভ ফ্লার্ট করার চেষ্টা করেছিল? সেই কাজিনকে বলতে বল?❞
❝ইসাবেলা আপু? অসম্ভব! উনি তো শুভ ভাইয়াকে ওরকম ভাবেই না। আমার এক্সিডেন্টে রক্ত দেয়ার পর থেকে আমাদের বাসার সবাই উনাকে পছন্দ করে। সবাইকে এসব বলতে হলে জোরালো প্রমাণ লাগবে❞

আমি ভাবতে ভাবতে ওকে বললাম,
❝আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে!❞
❝কি আইডিয়া?❞
❝শুভকে অন্য কোনো মেয়েকে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করা যায়! ও যখন পটে যাবে, তখন সেসব নিয়ে তোর ফ্যামিলিতে সিনক্রিয়েট করা যাবে❞
❝কে করবে এসব?❞
❝দেখি কাকে পাওয়া যায়!❞

তুতুনকে ঠান্ডা করে কল কাটার সাথে সাথে সায়মন বিরক্তি প্রকাশ করলো।
❝কার সাথে এত বকবক করলা!❞
❝ঐ যে, তোকে বলেছিলাম না শুভর পাশের বাসায় থাকে? ঐ মেয়েটা❞
❝শুভ কে? তোমার এক্স?❞
❝ইয়েস!❞
❝ঐ মেয়ের সাথে তোমার এত কি? এক্স বাদ, ঐ মেয়েকেও বাদ দাও❞
❝মেয়েটা খুব কিউট। আর অনেক লক্ষীও। শুভর সাথে বিয়ের কথাবার্তা চলতেছে। মেয়েটা কান্নাকাটি করতেছে বিয়ে করবে না বলে❞
❝তুমিও কি চাও? ওরা বিয়ে না করুক?❞
❝ডেফিনিটলি। শুভর মত মানুষ এত ভালো একটা মেয়ে ডিজার্ভ করে নাকি?❞
❝তুমি কেন ওদের জাজ করতেছ?❞
❝মানে?!❞
❝মানে হলো তুমি বলতে চাও তোমার কনসেন্ট নিয়ে সে তোমার সাথে ইন্টিমেট হতো। তারপরও শুভ খারাপ আর তুমি ভালো?❞
❝কি বলতে চাস তুই? আমার সাথে শুভর তুলনা করতেছিস? আমি কি ওর মত একটা রিলেশনে থাকতে চিট করতাম? ওর সাথে কমিটেড থাকার পরও অন্য কারো সাথে ফ্লার্টিং করতাম?!❞

সায়মন নির্লিপ্ততার সাথে প্রশ্ন করলো,
❝রেগে যাচ্ছ কেন? তুমি হয়ত ভাবছ ওর সাথে কমিটেড। কিন্তু আদৌ কি শুভ কখনো কমিটেড ছিল? আমার তো মনে হয় না। হয়ত ও কখনো তোমাকে ভালোই বাসেনি। হয়ত শুভ তোমার সাথে থাকা সম্পর্কটাকে তোমার মত করে দেখতই না! হতে পারে না?❞
❝কিন্তু আমাদের তো রিলেশন ছিল!❞
❝কে করেছিল সেটা? তুমি? না ও? হয়ত ও তোমার সাথে টাইম পাস করছিল। সে তোমাদের সম্পর্কটাকে কখনো কমিটেড ভাবেই নি। আসলে আমরা ছেলেরা সবসময় কমিটমেন্ট, রেস্পন্সিবিলিটি- এসব ভারী ভারী শব্দ থেকে পালিয়ে বেড়াই। প্রেমটা যদি সত্যিকারের না হয়, এই কাজগুলোয় ফাঁক ফোকর থেকে যায়। অনেকে চাপে পড়ে করে। কিন্তু মন থেকে করা আর চাপে পড়ে করার মাঝেও পার্থক্য থাকে। হয়ত তুমি কখনো শুভর মনের ঐ যায়গাটা পাও নি যেটা তুমি পেয়েছ বলে ভাবো। এজন্য খুব সহজে ও তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ভালো করে ভেবে দেখ। এরকমই ব্যাপারটা❞

আমি মুখ নিচু করে চুপচাপ খাচ্ছি। আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু এই কথা অন্যের কাছে দূরে থাক, নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাই না। সায়মন ড্রিংকসটা শেষ করে বলল,
❝আর এসব হিন্দি সিরিয়ালের মত গুটিবাজি বন্ধ করো। তোমাকে ঠিকঠাক মর্যাদা দিতে পারেনি বলে সে অন্য কোনো মেয়েকেও পারবে না, এমন ভাবার দরকার নেই। ওরা ভালো থাকলে ওদের ভালো থাকতে দাও!❞

সায়মনের শেষের কথাটা মাথায় গেঁথে গেল। কিন্তু আমি শুভকে ভালো থাকতে দিতে পারি না! যে আমাকে বিছানায় মানসিকভাবে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রেখে চলে যেতে পারে, তাকে আমি এত সহজে চলে যেতে দিব না! তুতুনকে আমিই তো কন্ট্রোল করি। অসুবিধে নেই, শুভকে তড়পিয়ে তড়পিয়ে মারবো আমি।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here