শুভ বিবাহ পর্ব-৩২

0
1308

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

৩২

একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি। অস্থির ভঙ্গিতে বারবার সামনের ড্রিংকে চুমুক দিচ্ছি। বাইরে ভীষণ গরম পড়েছে। এখন যদিও বর্ষাকাল, তবুও সুযোগ পেলে সূর্যের তাপে চামড়া পোড়ায় আর ঘামে ঘামে শার্টে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। এখানে এসি চলছে, তবুও ঘামছি। কারণ সাড়ে চার বছর পর কণার মুখোমুখি হচ্ছি। শেষ যখন ওকে দেখেছিলাম, তখন বিছরি একটা কান্ডের জন্ম দিয়েছি। তারপর ওকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছি। সেই ভাঙা চোড়া মেয়েটা এখন কেমন হয়েছে জানি না। আজকে এখানে হয়ত সে একটা সিন ক্রিয়েটও করতে পারে। আমি নিশ্চিত না। এজন্য ঘামছি। এক সময় কণার নাটাই আমার হাতে ছিল। ইচ্ছেমতো নাটাই ধরে ঘুড়ি উড়িয়েছি। যদি দুঃস্বপ্নেও বুঝতাম যে আজকের দিনটা আসবে, তাহলে কিছুটা হলেও সংযত হতাম।

কিছুক্ষণের মাঝে আমার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে আমার দিকে আগাতে দেখলাম। চোখে কমলা রঙের রোদচশমা, কাঁধ ছোঁয়া স্ট্রেইট চুল, ফুল হাতা টপ আর জিন্স পরে খট খট করে সে এদিকে এগিয়ে আসছে। ওকে দেখে আমি উঠে দাঁড়ালাম। অকারণে হাত দিয়ে শার্ট ঠিক করার চেষ্টা করলাম। কলারে হাত দিয়ে সেটা ঠিক আছে কিনা দেখলাম। তারপর নার্ভাসনেস কাটাতে ওর দিকে চেয়ে হাসলাম। কণা অবশ্য আমাকে দেখে হাসলো না। আবার রাগও দেখাচ্ছে না। খুব স্বাভাবিক মুখভঙ্গি তার, যেন আমার উপস্থিতিতে তার কোনো আসে যায় না। আমি সামনে বসতে ইশারা করলাম,
❝কেমন আছো?❞

কণা মুচকি হাসলো। চশমা খুলে বসতে বসতে আমাকে ভালোভাবে পরখ করে বলল,
❝ভালোই তো আছি! তুমি তো বোধহয় ভালো নেই❞
আমি ম্লান হাসলাম। বেশ কিছু মাস ধরে তুতুনের সাথে যোগাযোগ এর চেষ্টা করেছি, লাভ হয়নি। মেয়েটা আমাকে ভালোভাবে ইগ্নোর করেছে। শেষ বার আমাকে অপমানও করেছে। আগে কখনো মেয়েদের কথা গায়ে মাখতাম না। কেন যেন তুতুনের কথাগুলো খুব গায়ে লাগলো। তখন থেকে আরও পাগল পাগল লাগছে। আমি যে মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি, তা প্রতি মুহূর্তে টের পাচ্ছি। ওর জন্য যেকোনো কিছু করা সম্ভব। আর এজন্যই কণার কাছে আসা। তুতুন আমাকে বলেছে, কণার কাছে গিয়ে যেন আগে মাফ চাই। এরপরও ও রাজী হবে কিনা জানি না, তবুও এসেছি মাফ চাইতে।

কণার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছি না বলে আবার প্রশ্ন করলো,
❝কি হলো? কোনো কথা নেই?❞
❝আসলে… আসলে… আমি সরি সবকিছুর জন্য❞
❝কোন সবকিছু?❞
❝এ পর্যন্ত যা যা ভুল করেছি❞
❝ব্যস? এই? ক্ষমা হয়ে গেল?❞
কণার মুখে আমার জন্য তাচ্ছিল্য। আমি একবার চেয়ে মুখ নিচু করে ফেললাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। কণা দাম্ভিকতার সাথে বলে চলেছে,
❝একটা মানুষকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভাঙো, তার বিশ্বাস, ব্যক্তিত্ব, ভালোমন্দ চিন্তা করার শক্তি সব ভেঙে গুড়িয়ে দাও। তারপর কয়েক বছর পর এসে বলো, আমি সরি! সেই মানুষটা উঠে দাঁড়াতে কত সময় নিল, কত রক্তক্ষরণ হলো, সে খবর কি রাখো? বুঝিয়ে কি বলা যেত না? একটু কি নরম হওয়া যেতো না?❞

আমি মুখ না খুলে পারলাম না।
❝মনে করে দেখো, আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম❞
❝অহ, তাই?! কবে?! আমার তো মনেই পড়ছে না! একটু মনে করিয়ে দেবেন?!❞
কণা গালে হাত দিয়ে অতিঅভিনয় করছে আর আমাকে ভেঙাচ্ছে। আমি তবুও বললাম,
❝আমি তোমাকে বলেছিলাম তোমাকে আমার ভালো লাগে না, তাই ব্রেকাপ করেছি। এইটুকু তো বলেছিলাম, নাকি?❞
❝হ্যাঁ। কিন্তু কেন ভালো লাগে না, আমার দোষ কোথায়, সেসব তো জানতে চাইতাম। সেটার উত্তর কোথায়?❞
আমি ক্লান্ত কন্ঠে জবাব দেই,
❝উত্তর আছে। তখন বয়স কম ছিল, বুঝতাম কম। এখন বুঝি। এজন্য তখন কোনো জবাব দেইনি। আসলে আমি কখনো কারো সাথে পার্মানেন্ট রিলেশনে যেতে চাইনি। তোমার সাথে যখন হুট করে বুঝতে না বুঝতেই কিছু একটা হয়ে গেল, তখনও চেষ্টা করতাম তোমার সাথে লয়াল থাকতে। কিন্তু পারতাম না। কারণ আসলে আমি কখনো সেভাবে তোমাকে ভালোই বাসিনি❞

কণা বুকের উপর হাত বেঁধে গম্ভীর মুখে আমার কথা শুনছে। আমাকে থেমে ওর দিকে তাকাতে দেখে আবারও কথা শুরু করতে ইশারা করলো। আমি বলছি,
❝তোমাকে যদি ভালোবাসতাম, তাহলে কেবল একটা মায়া হতো না, একটা তীব্র অনুভূতি হতো। সেটা কখনোই হয়নি। হ্যাঁ, চুমু খেয়েছি, হাত ধরেছি, শারীরিক দিকে থেকে আরো ইনভলভ হয়েছি। কিন্তু তারপরও সেই প্রেম আসেনি। এটা তখন বুঝতে পারতাম। কিন্তু কেন আসেনি, সেটা বুঝতাম না বলে তোমাকে ব্যাখ্যাও দেইনি, কথাও বাড়াতে চাইনি। তার উপর ছিল তোমার জোরাজুরি, খবরদারি। আমাকে জোর করতে সবকিছুতে, অধিকার খাটাতে। সম্ভবত এই কারণে তোমার প্রতি একটা বিরক্তির শুরু হয়। আমি স্পেস চাচ্ছিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না। যদি সেদিন তোমার বাসায় গিয়েছি। ভুল বলবো না, তোমাকে বিয়ে করে তোমার বাবার সম্পদ পাওয়ার লোভও হচ্ছিল। কিন্তু পরে আর সেটা মাথায় আসলো না। বরং মনে হলো, তুমি আর আমি আলাদা হলেই ভালো। যাকে ভালো লাগে না, তার সাথে সম্পর্ক আর দূরে টেনে নেয়া যাবে না। অন্যান্য মেয়েদের সাথে ঘুরি, টাইম পাস করি, ছেড়ে দেই। কেউ কাঁদে, কেউ কাঁদে না। কিন্তু তুমি আলাদা ছিলে। তোমার সাথে সম্পর্ক থাকলে বিয়েও হতো। কিন্তু যেখানে পারস্পরিক সম্মান, ভালোবাসা, একটা টান নেই, সেখানে কিভাবে আগাবো? এজন্যই ব্রেকাপ করেছি❞

কণা চুপ করে থাকলো। আমি আবার বললাম,
❝এই যে এখন দেশের বাহিরে পড়াশোনা করছো, ক্যারিয়ার করছ, খারাপ কি? এই দেশের সব দিকে ক্রাইসিস। জানি, সেসব তোমাকে টাচও করতো না। তবুও, অন্তত আমার আশেপাশে ছিলে না তাই ভালোই আছো। আমিও ভালো আছি। অন্তত তোমার কোনো কষ্টের কারণ তো হচ্ছি না❞
কণা এবার বলল,
❝বুঝলাম। আগের চেয়ে ম্যাচিউর হয়েছ খুব। গুছিয়ে কথা বলতে শিখেছ❞
❝কিন্তু একটা কাজ তুমি না করলেও পারতা❞
❝কি কাজ?❞
❝ঐদিন তোমার আর আমার মাঝে হওয়া সব ইন্টিমেট মোমেন্ট নীনা আর স্নিগ্ধাকে বলা কি খুব জরুরী ছিল? তোমরা মেয়েরা কি নিজের মাঝে কিচ্ছু রাখতে পারো না?❞
❝বলবো না? কেন বলবো না? তুমি আমার সাথে এত বড় অপরাধ করেছ, আর আমি…❞
❝অপরাধ? কণা, সত্যি করে বুকে হাত দিয়ে বলো তো। তুমি কি নিজের ইচ্ছায় আমাকে সেদিন নিজের বাসায় ডাকোনি? সেদিন জামদানী শাড়ি পরে ছিলে তুমি। সেজেছিলে। স্বেচ্ছায় আমরা সব করেছি। যদি সেদিন আমার মায়ের ফোন না আসতো, যেটুকু বাকি ছিল, সেটুকু কি হতো না? হতো। তখন কি বলতা? এই রেইপড ইউ? তুমি ভিক্টিম? অথচ এইটা তো তোমার ইচ্ছায়ই হয়েছে! বলো, তোমার হাত ধরেছি কখনো, অথচ তুমি চাও নি? এমন হয়েছে?❞
❝কিন্তু তাই বলে এত কিছুর পরে কেন ব্রেকাপ কেন করবা? কেন আগে না?❞
❝কণা এখনো সাড়ে চার বছর পিছে পড়ে আছো! মানুষ বিয়ে করে বাচ্চার বাবা মা হওয়ার পরও ডিভোর্স নেয়। কারণ তারা একজন আরেকজনের সাথে আর ভালো থাকতে পারে না। আমাদের ব্রেকাপটাও একই কারণে হয়েছে। তুমি আমাকে অনেক ভালোবাসতে হয়ত, আই এগ্রি। কিন্তু আমার দিক থেকে কিছু ছিল না আর। আরও এক্সপ্লেনেশান লাগবে?❞

কণা বিরক্ত হয়ে ফোন বের করে কি যেন দেখছে। তু পর বলল,
❝এই সব পুরাতন কাসুন্দি ঘাটার জন্যই কি এত বছর পর আমাকে খোঁজ করা হচ্ছিল?❞
❝না। অন্য একটা কারণে❞
❝আমি জানি তো এসব কিছু না। তুমি নিজের স্বার্থের জন্য আমাকে খুঁজছ❞
❝সেটা ঠিক না। আমি তোমার কাছে মাফ চাওয়ার জন্যই খুঁজেছি। যোগাযোগের কোনো উপায় তো রাখোনি, তাই দেখা করতে চেয়েছি❞
❝আর?❞
❝আর তুমি কেন তুতুনের কাছে মিথ্যা কথা বলেছ, সেটা জানতে চাই❞
কণা এবার একটা পৈশাচিক হাসি দিল।
❝জানতাম, এইজন্যই এমন জরুরী তলব। তুমিও তো ফ্রেন্ডসার্কেলে বলেছ আমাদের মাঝে সব হয়ে গেছে, সব। মিথ্যা বললে কেন?!❞
❝কারণ তুমি সবকিছু নীনা আর স্নিগ্ধাকে বলেছ। আমি কখনো আমাদের মাঝখানের কথা কাউকে বলতাম? বলতাম না। কিন্তু তুমি বলেছ, আবার আমার উপর নীনাকে লেলিয়েও দিয়েছ!❞
❝লেলিয়ে দিয়েছি মানে?! এটা আবার কেমন শব্দ? নীনা কি কুকুর নাকি?❞
❝নীনা আমাকে সেদিন কলার চেপে ধরেছিল। আমার সাথে মারামারি করছিল। ঐদিন যদি আমি ভুলে যেতাম ও একটা মেয়ে, গায়ের জোরে তখন ও পারত? ইজ্জত কার যেত? আমার না ওর? আমার অবশ্য সেসব নিয়েও এখন মাথাব্যথা নেই। আমার আসল প্রশ্ন, তুমি এত মানুষ থাকতে তুতুনকে কেন এসব বলতে গেলে? আমাদের মাঝে কেন তুতুনকে ঝামেলায় ফেলতে হবে? কেন?❞
❝কারণ তুমি না বুঝলেও আমি বুঝতে পারছিলাম ইউ আর ইন লাভ উইথ হার। এজন্য আগেভাগে ওকে যা বলার বলেছি❞

আমি খুব অবাক হলাম।
❝আমিই জানি না, অথচ তুমি কি করে বুঝছ?❞
❝সিম্পল। তুতুনের এক্সিডেন্টের পর থেকে ওর প্রতি তোমার পাগলামী দেখার মত ছিল। আমি ভেবেছি তুমি ডাবল টাইমিং করছ। তুতুনকে ধরার পর বুঝলাম, তুমি ওর প্রতি পাগল হয়েছ ঠিকই, কিন্তু কেন হয়েছ নিজেও জানো না❞
❝ভালো। কিন্তু আমার জবাব কিন্তু এখনো পাইনি। কেন তুতুনকে মিথ্যা বললে?❞
❝কারণ আমি চাইনি তুমি তুতুনকে তুমি নষ্ট করার সুযোগ পাও। যেমনটা আমার ক্ষেত্রে পেয়েছ❞

আমার রাগ উঠছে। কিন্তু সেসব প্রকাশ করতে পারবো না। করলে কণা তুতুনকে সত্য বলবে না। আমি বললাম,
❝তুতুনকে কবে নষ্ট করতে চেয়েছি? তুতুন এসব বলেছে?❞
❝না, আমিই বলছি। ইউ নেভার ডিজার্ভ সামওয়ান পিউর লাইক হার❞
❝হোয়াই? কারণ তুমি জেলাস?❞

কণা অস্বীকার করলো। কিন্তু ওর চোখ বলছে অন্য কথা। ও আসলে জেলাস। ও চায় না আমি ভালো থাকি।এজন্য এসব করেছে। আমি হুট করে ওর হাত চেপে ধরলাম।
❝কণা, অনেক বছর তো চলে গেল। আমার আর তোমার রাস্তা এখন আলাদা। যদিন শুনলাম তুমি চলে গেছ, সেদিন থেকে কখনো তোমার খারাপ চাইনি, সত্যি। প্লিজ, আমি সরি তোমার কষ্টের জন্য। ওটা কম বয়সের ভুল ছিল। এখন আমি তুতুনকে নিয়ে সিরিয়াস। ওকে বিয়ে করতে চাই। পরিবারের সবাই রাজী। শুধুমাত্র তোমার সেই একটা মিথ্যার জন্য ও আমাকে অপছন্দ করে। ওকে প্লিজ সত্যটা বলে দাও। প্লিজ কণা। কোনোদিন কিচ্ছু চাইবো না আমি❞

কণা ওর হাত সরিয়ে বলল,
❝অসম্ভব। এটা করতে পারবো না❞
❝কেন?❞
❝মেয়েটা কষ্ট পাবে। আমি সেটা পারবো না❞
❝কিন্তু তাই বলে একটা মিথ্যার জন্য আমার এতবড় ক্ষতি করবা তুমি? এখন কি ও কষ্ট পায় না?❞
❝কষ্ট পাবে কেন? ওকে ওর মত থাকতে দিলেই হয়।তোমার কি দরকার ওকেই বিয়ে করার?❞
❝কণা, আমি ওকে সত্যিই ভালোবাসি! প্লিজ, আমাকে হেল্প করো, প্লিজ!❞
কণা ফোন ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
❝সরি। আই কান্ট কিপ ইউর রিকোয়েস্ট। তুতুনকে যেটা বলেছি, সেটা আর ফেরত নিতে পারব না। ও আমাকে মিথ্যুক ভাববে। ও আমাকে অনেক বিশ্বাস করে। বিশ্বাস ভাঙতে পারব না। সরি শুভ❞

কণা উঠে চলে গেল। আমি টেবিলে কায়দা করে লুকিয়ে রাখা ফোন চেক করলাম। রেকর্ডিং ও চেক করলাম। সব রেকর্ড হয়েছে। এবার তুতুনকে বিশ্বাস করাতে পারবো কণার মিথ্যা কথা। কণা আসলে প্রতিশোধ নিতে চায়। এখন আর হবে না। এখন কণাকে তুতুন নিজেই ঘাড় ধরে নিজের মন থেকে বের করে দিবে।

বিল পে করে বেরিয়ে আসলাম। এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। তুতুনকে দেখলেই আমার বুকের ভেতর তোলপাড় হয়। ওকে ছাড়া আমি কল্পনা করতে পারিনা নিজেকে। ওর জন্য আমি সব কর‍তে পারি। সব। আই লাভ হার! ডিপলি এন্ড ম্যাডলি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here