শুভ বিবাহ পর্ব-৩১

0
807

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

৩১

পরদিন শায়লার হলুদে বসে আছি। আত্মীয় স্বজনে বাসা গমগম করছে। কিছুক্ষণ আগে পাত্রপক্ষ এসেছে বলে হৈচৈটা একটু বেশি। ওদের বাসার বসার ঘর ফাঁকা করে সেখানে হলুদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি এক কোণায় চেয়ারে বসে বসে সবাইকে দেখছি। শায়লার দুইহাতে মেহেদী দেয়া হচ্ছে। সে হাসিমুখে সবাইকে দেখছে আর কথা বলছে। আমি উপভোগ করছি ওর এই নির্মল আনন্দ। হয়ত পরে সম্পর্ক আর জীবনের অনেক রকম সমীকরণ আসবে, কিন্তু এই মুহূর্তে মেয়েটা নির্মল আনন্দ উপভোগ করছে। আশেপাশের সব ঝামেলা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা সামলাচ্ছে, ওকে কিছুই ভাবতে হচ্ছে না। এমন সময়টা আর কখনো আসবে না জীবনে।

আমাকে ধ্যানভঙ্গ করে শুভ ভাইয়া পাশে এসে বসলো। আমার দিকে না তাকিয়েই বলল,
❝লুকিং প্রিটি এজ ইউজুয়াল❞
আমি তার দিকে ফিরলাম।
❝আপনি তো আমাকে দেখেননি। কি করে বুঝলেন?❞
শুভ ভাইয়া সামনের দিকে ফিরেই বলল,
❝আসার পর থেকেই তো দেখছি। নতুন করে এখনই দেখা লাগবে?❞
শুভ ভাইয়া আমার দিকে ফিরলেন। তার মুখে মিষ্টি হাসি। কিন্তু আমার মন গলানোর জন্য সেটা যথেষ্ট নয়। আমি সামনে ফিরলাম। শায়লাকে দেখছি মন দিয়ে। আর শুভ ভাইয়া আমাকে দেখছে মন দিয়ে। গতকাল কণা আপুকে জিজ্ঞাসা করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পাইনি। বেশ কয়েকবার কল করে রেখে দিয়েছে। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন, উনাকে বিরক্ত করছি। কেন এমন মনে হচ্ছে জানি না। আগে কখনো এমন মনে হয়নি। তাই আপুকে আর নক করিনি। ভাবছি, নিজে নিজের সমস্যা সমাধান করবো। তাই শুভ ভাইয়ার দিকে ফিরলাম।
❝আপনার কি কাজ নেই?❞
সে বেহায়ার মতো জবাব দিল,
❝আছে তো। সেই কাজটাই করছি❞
❝আপনি এমন করলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাবো❞
❝তুমি যেখানে যাবা, আমি সেখানে তোমাকে অনুসরণ করবো❞
আমি উঠে দাঁড়াতেই শায়লা আমাকে দেখলো। আমাকে দেখে সে জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলো ওর সাথে স্টেজে আসার জন্য। আর কি পালানোর উপায় আছে? বাধ্য হয়ে সেখানে গেলাম। শায়লাকে হলুদ ছুঁইয়ে টুকটাক কথা বলছি। এখনও ওদের পারিবারিক ফটোসেশন শুরু হয়নি। আমার দিকে ঘেঁষে এসে চাপা স্বরে শায়লা বলল,
❝তোমাকে যে আমার ভাইয়া পছন্দ করে, সেটা জানো?❞
আমি মুখে হাসি ধরে রেখে বললাম,
❝এই কথা জানে না, এমন মানুষ বোধহয় এই বাসাতেই এখন একটাও নেই❞
❝এমনটা কেন মনে হলো?!❞
❝তোমার কিছু কাজিন এসে যেচে পড়ে পরিচিত হলো। তারা খুব হেসে হেসে কথা বলছিল। আমার সাথে কথা বলেই তোমার ভাইয়ের কাছে গেল। তার সাথে কথা বলার সময়ও আড়চোখে আমাকে লক্ষ্য করছিল❞
❝তাহলে তোমার মতামত কি?❞
❝তোমার ভাইয়ার কাজ তোমার ভাইয়া করেছে, আমার কাজ আমি করবো। তোমার ভাইয়ার আমাকে ভালো লাগলেও আমার তাকে ভালো লাগে না। আমি সেজন্য দুঃখিতও না। এটা আমার প অনুভূতি❞
❝বুঝলাম। আমার ভাইয়া কিন্তু তোমাকে নিয়ে সত্যিই সিরিয়াস। ও নাকি অনেক আগে থেকে তোমাকে নিয়ে অন্য রকম চিন্তা ভাবনা করতো❞
আমি তাচ্ছিল্য করলাম একটু।
❝তোমার ভাইয়া যে কোন মেয়েকে নিয়ে অন্য রকম চিন্তা ভাবনা করেনি, সেটাই তো গবেষণার বিষয়! তবে কেন এতজন থাকতে আমাকেই মনে ধরলো, সেটা আমি বুঝতে পারছি না❞
❝দেখো, বিয়ের আগে অনেক ছেলেরই এমন থাকে। বিয়ের পর আর সেসব স্থায়ী হয় না, এক জনের সাথেই তারা থিতু হয়। ভাইয়াকে কখনো একজনকে নিয়ে এতটা ভাবতে দেখিনি❞
❝বিয়ের আগে অনেক ছেলেরই থাকে? তাহলে যদি বিয়ের আগে আমার এমন অভ্যাস থাকতো, আমাকে মেনে নিতে?❞
❝বিয়ের আগে যার যাইই থাকুক, বিয়ের পর ঠিক হওয়াটা জরুরী আমি মনে করি❞
❝কিন্তু কি গ্যারান্টি আছে যে সে বিয়ের পরও করবে না? ঢেঁকি কিন্তু স্বর্গে গেলেও ধান ভাণে!❞

শায়লা এপর্যায়ে চুপ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আশেপাশের মেয়েদের সরিয়ে আমাকে বলল,
❝আমি জানি তুমি ভাইয়ার কোন ব্যাপারে ইংগিত করছো। আমি এটাও স্বীকার করি, সে যা করেছে, তা মোটেও ঠিক না, সমর্থনযোগ্য না। কিন্তু কখনো কি শুনেছ যে একজন পুরুষের নানা রকম বদঅভ্যাস সে বিয়ের পর সঠিক জীবনসঙ্গীর প্রভাবে ছেড়ে দেয়? আমার ভাইও বদলে যাবে। ইনফ্যাক্ট বদলে গেছেও। আর বিয়ের পর আরও বদলাবে। তোমাকে আসলে আমি জোর করতে চাই না। কিন্তু তোমাকে আমার ভাবি হিসেবে ভীষণ পছন্দ জানো? ভাইয়া প্রথম যেদিন তোমার কথা বাসায় বলল, সবাই খুব খুশি হয়েছিল, স্পেশালি আম্মু। আম্মু নাকি ভাইয়ার জন্য তোমার কথা অনেক আগে থেকে ভেবে রেখেছে। আম্মু অবশ্য আরও অনেককে ভেবেছে! সেটা মুখ্য নয়। বাসার সবাই যেমন তোমাকে আদরে রাখবে, তেমনই ভাইয়াও তোমাকে ভালো রাখবে। আমি জানি❞

কথা শেষ করে শায়লা আমার হাত চেপে ধরলো। আমিও ওর হাত চেপে বললাম,
❝আমার পক্ষে তোমার ভাইয়াকে মেনে নেয়া সম্ভব না শায়লা। অন্তত সব কিছু জানার পরে তো নয়ই। আমি তাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারবো না। কারণ বিয়েটা একটা ছেলের জন্য দুই তিনের অপশন থাকলে আমাদের মেয়েদের জন্য অতটা সহজ না। বিয়ে হলে এক সময় আমি পুরাতন হবো, বুড়ি হবো, অসুস্থ হবো। তোমার ভাইয়ার তখন অন্য মেয়েকে ভালো লাগতেই পারে। সে বিরক্ত হতেই পারে। তখন আমি কোথায় যাবো? সে যেভাবে মেয়েদের চেকইন করে, বিয়ের পরে করবে না, এর কি প্রমাণ? আমি এমন অনেকের সংসার ধ্বংস হতে দেখেছি। হয়ত তার সাথে আমার সন্দেহের বশে সংসার টিকবে না, কিংবা তার অভ্যাসের কারণে❞
শায়লা মলিনকন্ঠে বলল,
❝হাজার খারাপ হলেও ভাইটা তো আমার। দিন শেষে আমি আমার ভাইয়ের কথাই বলব। তবে তোমাকে জোর করবো না। আমি নিজেও তো একটা মেয়ে! তুমি ভেবে দেখো কি করবে❞

শায়লার সাথে আমার কথা আর বেশি দূর এগুলো না। সেখানে খাবার খেয়ে দ্রুত বাসায় আসলাম। শায়লাকে যেসব কথা বলেছি, সেসব শুভ ভাইয়া কিংবা মুরুব্বিদের গুছিয়ে বলতে পারবো না। মুরুব্বিদের সামনে আমি এত যুক্তি দেখাতে পারি না। শুভ ভাইয়াকে ইশারায় সরাসরি, নানাভাবে এরচেয়েও বেশি বলেছি। লাভ হয়নি। শুভ ভাইয়ার হাবভাবে মনে হয়েছে, সে সবাইকে এক এক করে হাত করে ফেলছে। আর আমার কলেজ জীবনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে শুভ ভাইয়াকে সবাই খুব ভালো চোখে দেখে। আব্বু আম্মু এখনো আমাকে কিছু না বললেও বিদেশে আমার দুই ভাইকে বোধহয় বলেছে। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না পুরো ব্যাপারটা কত দ্রু এগুচ্ছে। ঠিক কি করবো, কি করলে সবাইকে থামানো যাবে, তাও জানি না। আপাতত অপেক্ষায় থাকি।

দেখতে দেখতে ঢাকায় থাকার সময় ফুরিয়ে এলো, আমরাও দিনাজপুর যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগামীকাল সকালে বের হবো। লাগেজে নিজের জিনিসগুলো ভরে নিচ্ছি। এ সময় আম্মু ঘরে ঢুকে আমার বিছানায় বসলো। চুপচাপ সে আমাকে আর আমার কাজ দেখছে। হাতের ফতুয়াটা গুছিয়ে লাগেজে রেখে বললাম,
❝কিছু বলবা?❞
❝বড় হয়ে গেছিস তুই। কখন বড় হলি, ঠিক বুঝলাম না❞
বিনিময়ে আমি একটা হাসি দিয়ে আবার কাপড় গোছানোয় মনোযোগ দিলাম। আম্মু বলে যাচ্ছে,
❝আমার পনের বছর বয়সে তোর বাবার সাথে বিয়ে হয়। তোর বাবাও তখন ছোট, একুশ হবে বয়স। বুঝতে না বুঝতেই চার বছরের মাঝে তোর দুই ভাই পর পর জন্ম নিল। তারপর একটু সতর্ক হলাম। ছেলেরা বড় হওয়ার পর সবাই বলল, আরেকটু চেষ্টা করো। একটা মেয়ে না থাকলে ঘরকে ঘর মনে হয় না। আল্লাহর রহমতে এক বছরের মাঝে তুই পেটে আসলি। এতদিন পর আবার সেই বাচ্চা নেয়ার কষ্ট! কি যে ছটফট করতাম আমি! ছেলেদের স্কুলে পাঠিয়ে, ঘরের কাজ করে, ওদের পড়িয়ে পড়িয়ে আমি আর পারি না! তারপর তুই আসলি। আবার সেই কাঁথা, ছোট কাপড়, তেল, মশারি, কত কি! তুই ঠিক পুতুলের মত ছিলি। বিয়ের আগে যেমন পুতুল পুতুল খেলতাম, তেমন একটা অনুভূতি আসতো আমার। সবসময় তোকে তেমন বানাতে চাইছে যেমনটা আমি হইতে চাইতাম। এজন্য তোকে শাসন আর বকাঝকা করতাম। এর মধ্যে ছেলেরা চলে গেল বিদেশ। আর তোকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। আমি। এর মাঝে তুই যে ডাক্তার হবি, এত দূরে যাবি, ভাবিনি! এখন তোকে দেখলে অবাক লাগে। আমার পুতুলটা কত বড় হয়ে গেছে! ক’দিন পর নাকি বিয়ে দিব? আমার পুতুলটারও একটা পুতুল হবে?!❞

আম্মুর চোখে পানি। আমার চোখের কোল ঘেঁষে পানি জমলো। আম্মু সবসময় আমাকে শাসনের মাঝে রাখে। আমাকে শাসন করতে করতে কখন আমার মাটা বুড়িয়ে গেছে, খেয়াল করিনি। আম্মুর মাথায় এখন কিছু আধাপাকা চুল উঁকি দেয়। আব্বুকে দেখলে অবশ্য বোঝাই যায় যে সে বুড়িয়েছে। পুরো মাথা ভরা শুভ্র চুল, যদিও তিনি শক্ত-সামর্থ্য আছেন এখনো। আমি আম্মুর পাশে বসে এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আম্মু আমার কপালে চুমু খেলেন।
❝তোর বিয়ের কথা বললাম। কিছু বললি না যে?❞
আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললাম,
❝কি বলবো?❞
❝তোর জন্য একটা ছেলে দেখেছি। তুই চিনিস❞

আমি জানতাম! জানতাম আম্মু শুভ ভাইয়ার কথাই বলবে! কিন্তু আমি কিভাবে এখান থেকে পালাবো? এখনই যদি রেগে কিছু একটা বলে বসি, আম্মু নরম থেকে গরম হয়ে যাবে। আমাকে চুপ দেখে আম্মু আবার বলল,
❝ছেলেটা ভালো খুব। পাশেই তো থাকে। তুই ভালো থাকবি। পুরো পরিবারটা খুব ভালো। বুঝেছিস কার কথা বলছি? আমাদের শুভ। ছেলেটা সবসময় সালাম দিয়ে কথা বলে। তোকেও ভালো রাখবে❞

আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, সবার সামনে ভালো সেজে থাকলেই কেউ ভালো হয় না আম্মু! পর্দার আড়ালে অন্য এক মানুষ লুকিয়ে থাকে। সেই মানুষকে আগে চিনতে হয়। আমি শুভ ভাইয়ার মুখোশোর আড়ালের মানুষটাকে চিনি। এজন্য তাকে বিয়ে করতে চাই না! মুখে বললাম,
❝আমার এমবিবিএস শেষ হয়নি আম্মু। আরো এক বছর। তারপর ইন্টার্নি আছে। অনেক পড়া। এখন সম্ভব না আম্মু! আমি বিয়ের জন্য রেডি না। আমি বড় হইনি আম্মু। আমি এখনো তোমার ছোট্ট পুতুল আছি❞

……………..

ক’দিন ধরে বিচ্ছিন্ন লাগছে খুব। আমার আব্বুর নাকি অন্য এক মহিলার সাথে রিলেশন আছে। এসব নিয়ে আম্মু অনেক অশান্তিতে আছে। সে নিয়মিত নাইট পার্টিতে যাচ্ছে। ড্রিংকস আগেও করত শখের বশে, এখন সেটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। আমি দূরে থাকায় এসব জানতাম না। মামী গতকাল বলল। তখন থেকে সব এলোমেলো। আম্মুকে কল দিলাম। আম্মু দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
❝তোমার বাবার আমলনামা দেখার সময় আমার নেই, না আছে তোমারটা দেখার। তুমি সরে গিয়েছ। আমার একমাত্র মেয়ে আমার থেকে দূরে থাকে। আমার স্বামীও অন্য নারীতে মুখ বুঁজে থাকে। আমি কি করবো? আমিও আমার মত পথ বেছে নিয়েছি। এখন আর অন্যের কথা না ভেবে নিজেরা নিজেদের রাস্তায় থাকলেই ভালো। তোমাকে শতবার নিষেধ করেছি, বিদেশ যেও না। সেই তো গেলে। এখন আর জোর করে আমাকে বদলাতে পারবে না❞
আমি রেগে গিয়ে বলেছি,
❝দেশে তো অনেক বছর ছিলাম! তুমি কি বাসায় থাকো? আমাকে সময় দাও? আমাকে জিজ্ঞাসা করো আমি কি করি? শেষ কবে আমার জন্য শখ করে রান্না করেছ বলবা? আমার চুলে তেল দিয়ে দাও? তোমার চেয়ে মামীই তো আমার বেশি খেয়াল রাখে!❞
❝কণা! লোয়ার ইউর ভয়েস! আম ইউর মাম!❞
❝ইয়েস মাম! দ্যাট মাম হু ডাজন্ট গিভ আ শিট আবাউট মি! শুধু ব্লেম করার সময় আমার নামটা বলবে! আমার জন্য ঘরে থাকো না, অথচ আমি ঘরে থাকবো তোমার জন্য! হাউ রিডিকুলাস❞
❝কণা, আমি আগেও বলেছি। এত পড়াশোনা করেছি আমি ঘরে বসে থাকতে না। আমার কাজ থাকবেই। তারপরও আমি চেষ্টা করেছি তোমাকে সময় দেয়ার❞
❝হ্যাঁ, তবুও মামীর মত সময় তো আর দাওনি!❞
❝তোমার মামী তো আমার শিক্ষিত না। এজন্য ঘরে বসে বসে থালাবাটি নাড়াচাড়া করে জীবন পার করেছে। আমি ওসব পারি না!❞
❝পারতে হবে না। এখন যা পারছ, তাই পারতে থাকো। তুমি আর আব্বু সবসময় নিজেরা যা বুঝেছ, তাইই। আমিও তাই আমারটাই বুঝলাম। তোমাদের যা খুশি করো❞

এই আম্মুর সাথে আমার শেষ কথা। আমার আম্মু যে একেবারে খারাপ, তা না। কিন্তু সে এতবেশী বর্হিমুখী যে এখন তার ঘরে স্বামী সন্তান কেউ নেই। আমি নাহয় বিয়ে করে চলেই যেতাম। কিন্তু আব্বু তো থাকতো? আব্বুও আম্মুর অনেক অবহেলার সাক্ষী। আব্বু যদি অন্য কারো সাথে ইনভলভ হয়, আমি তাকে দোষ দিব না। পুরুষরা দিন শেষে নারীসঙ্গ খোঁজেই। আমার বাবাও খুঁজেছে। শুভ খুঁজেছে। সবাই খুঁজবে। অভিমানে আমার চোখ জ্বলে ওঠে। তাই সবার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমাকে বেসামালভাবে ছন্নছাড়া দেখে সায়মন আমার হাত চেপে ধরে।
❝কি হয়েছে তোমার? ছ্যাঁকা খেয়েছ?❞
আমি জবাব দেইনি। সায়মন আবার বলে,
❝শুভ কি বিয়ে করছে তুতুনকে? বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?❞
বললাম, ❝বিয়ে করলে করবে। তাতে কার বাপের কি? আমার তো বাবা মায়ের বিয়েরই ঠিক নেই… আমার তো….❞

কন্ঠরোধ হয়ে এলো আমার। সায়মন এক হাতে আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে।
❝মামের কাছে সব শুনলাম। তুমি ভেঙে পড়ো না। তারা কেউ লিমিট ক্রস করবে না। তাদের কাছে তাদের রেপুটেশন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যাইই করুক, তা রিউমার পর্যন্ত থাকতে দেবে। তারপর আবার নিজেদের ট্র‍্যাকে ফিরে আসবে❞
সায়মনের থেকে একটু সরে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম।
❝কোনো ট্রিপে যাবি?❞
❝কোথায় যেতে চাও?❞
❝যেখানে গেলে এসব ভাবতে হবে না, নেচারের ভেতর বুঁদ হয়ে থাকবো!❞
সায়মন হেসে বলল,
❝ব্যাগ প্যাক করো। কিছু শপিং করে নাও। আমরা কাল যাচ্ছি❞

………………

তুতুনের মা আমার মাকে জানালেন, তার মেয়ে বিয়ের জন্য তৈরি নয়। ইন্টার্নির পর সে বিয়ে করবে
তারপর ঢাকায় এসে প্রস্তুতি নেবে। ইন্টার্নির আগে ঢাকা থেকে দূরে থাকতে হবে। তাই তারা পরের কথা ভাবছেন। আমি বুঝলাম, এটা তুতুনের চাল। ও হয়ত পালানোর চেষ্টা করছে। আমিও লেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। আজকাল তেমন কোনো মেয়েকে ভালো লাগে না। সারাদিন মাথায় ঐ এক নাম ঘোরে। তুতুনের বড় বড় চোখ, মিষ্টি ঐ ঠোঁটজোড়া, ফোলা ফোলা গাল, মুখের এক পাশে এসে পড়া অবাধ্য কিছু চুল- এসব আমায় টানে। সেদিন স্কুলে দুই ঝুটি করা এক মেয়েকে তুতুন ডেকে বসেছি। আমার মনে মেয়েটা গেঁথে বসে গেছে। মাঝে মাঝেই তাই ওকে কল করি। মেয়েটা এখন খুব একটা ফোন ধরে না। ধরলেও বেশি একটা কথা আগায় না। সুযোগ হলেই জিজ্ঞাসা করবে, ❝হোয়াই মি?❞ আমি হাসি। এই জবাবটা আমিও জানি না। কেবল জানি, অনলি ইউ। তুতুন আমার কথা বিশ্বাস করে না। আমি অপেক্ষায় আছি কবে কণা আসবে। শুনেছি, আগামী মাসে ওর আসার কথা। জাহিদ বলল। কণাকে পেলে ওর পায়ে ধরে বলবো যেন তুতুনের কাছে সত্যিটা বলে। আমি সেদিন কণাকে পুরোপুরি বিবস্ত্রও করতে পারিনি। তার আগেই উঠে গিয়েছি। আর সেটা কণাকেও আঘাত করেছিল। সেই ফাটলের জেরে আমরা দুজন আর এক হতে পারিনি।

তুতুনের অবহেলায় আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। ভেতরে অসহ্য খারাপ লাগে। কবে মেয়েটা আমাকে বুঝবে? আমি তো আগের মত নেই আর। মেয়েটা কবে আমাকে বিশ্বাস করবে? আচ্ছা, কণা যদি কখনো সত্যি না বলতে চায়? তুতুনকে পাওয়ার সব আশা শেষ হয়ে যাবে। কারণ আমি চাই না জোর জবরদস্তি করে বিয়ে করতে। বিয়ে করলেই হয় না, আমাকে ওর চাইতে হবে। অবহেলায় কি সংসার পাতানো যায়?

……………..

অনেক দিন পর দেশে এসেছি। এয়ারপোর্টে নেমে ভেজা ভেজা ঘ্রাণে মনটা ভরে গেল। দেশের মাটিতে যেমনই থাকি, বিদেশ থেকে এসে একটা বাড়ি চলে এলাম জাতীয় ফিলিং হয়! যদিও আদ্রতায় চোখের চশমা ঝাপসা হয়ে গেল, তবুও আনন্দো হলো ভীষণ! বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। আমি ট্রলি হাতে অবাক চোখে বাঙলা মাটির বুকে আছড়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা দেখি। ইশ, কত্তদিন পর! ঐ শীতের দেশের বৃষ্টিতে এই সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পাই না। দেশটা কত আপন, তা কেবল দূরে গেলেই টের পাই! আমাকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে দেখে সায়মন বলল,
❝গাড়িতে ওঠে বাকি সব দেখেন ম্যাডাম! আপাতত আপনি দাঁড়িয়ে থাকায় পেছনে লাইন লেগে গেছে!❞
আমি অবাক হয়ে পিছের মানুষদের সরি সরি বলতে বলতে গাড়ির দিকে এগুলাম। গাড়িতে উঠে সায়মনকে বললাম,
❝তুই বলবি না আমার পিছে মানুষ আছে?❞
❝আমি কি জানি যে তুমি দেশের বৃষ্টি দেখে এমন ম্যাস্মোরাইজড হয়ে যাবা?❞
❝উফ, কতদিন পর আসলাম! মনে হচ্ছে কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!❞
❝দূর থেকে দেখেই কলিজা ঠান্ডা করো। আবার শখ করে ভিজতে যেও না। পরে ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসবা❞

দেশে ফিরে ভীষণ আনন্দ হলো। সায়মন ঠিকই বলেছিল। আব্বু আম্মু নিজেরা যাইই করুক, ঝামেলা করেনি। তারা এখনো এক ছাদের নিচে আছে। আমার সাথে মায়ের ঝগড়ায় কিছু সুবিধা হলো, এতবছর এর রেকর্ড ভেঙে মা আজ নিজের হাতে সব রান্না করছেন। বাসায় ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। যত যাইই হোক, মা তো মাই! আমাকে আর সায়মনকে পেয়ে মা ভীষণ খুশি। সায়মন অবশ্য সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। ও যে আসবে, সেটা কেউ জানতো না। আমাদের দেখে আম্মুর আনন্দ আর ধরে না। বাবাও আজ বাসায়। সবাই মিলে আনন্দ করে খেয়ে ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙলো একাধিক নরম হাতের স্পর্শে। চোখ খুলে দেখলাম স্নিগ্ধা আর নীনা! কত্তদিন পর!

চেঁচামেচি আনন্দ শেষে তিনজন যখন ঠান্ডা হলাম, তখন স্নিগ্ধা জানালো, ওর কিছুদিন পর বিয়ে। অবশ্যই ইমরানের সাথে না, পরিবারের পছন্দে বিয়ে। ছেলে ব্যাংকার, ঢাকায় বাবার বাড়ি আছে। সুখে থাকতে আর কি লাগে? নীনা অবশ্য সরকারি চাকরির জন্য পড়ছে। চাকরি হলেই বিয়েটা সেরে ফেলবে তার আশিক দিওয়ানা জিওন এর সাথে। জিওনের নাম শুনলেই বোঝা যায় সে দেশি মানুষ না। ওর মা ফিলিপাইনী, বাবা বাংলাদেশী। তবে মহিলা ভীনদেশী হলেও আমাদের দেশের মানুষের সাথে মানিয়ে নিয়েছেন। আমাদের উত্তেজনার শেষ দিকে নীনা কিছুটা গম্ভীর মুখে জানালো,
❝শুভ থেকে খুঁজছে অনেক দিন ধরে। তোর সাথে দেখা করতে চায়। করবি?❞

আমি ওদের দুজনের মুখের দিকে তাকালাম। সাড়ে চার বছর আগে শুভকে নিয়ে ভাবলে যেমন অনুভূতি হতো, আজও তেমনই হচ্ছে। আমি কি দেখা করতে যাবো?❞

চলবে…

(এতদিন পর দিলাম বলে বেশি করে পুষিয়ে দিলাম! বাই দ্যা ওয়ে, আমার তৃতীয় বই ‘প্রতীক্ষার প্রহর’ এর প্রি-অর্ডার চলছে। এটি পাবেন বইমেলার ২৮ নং স্টলে। খুব শীঘ্রই বইমেলায় দেখা হবে প্রিয় পাঠকদের সাথে!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here