শুভ বিবাহ পর্ব-৩০

0
644

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

৩০

তুতুনের মত গোঁয়ার মেয়ে দ্বিতীয়টা দেখিনি। ও অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সুমিষ্ট ভাষায় বিভিন্নভাবে আমাকে রিজেক্ট করে যাচ্ছে। আমার বিয়ের চাইতে আব্বু আম্মুর এখন শায়লার দিকে নজর বেশি। আমার বোনটা মাশাআল্লাহ আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়ে গিয়েছে। ওকে সাজতে দেখলে আমি অবশ্য কখনোই ভালো কিছু বলি না, বরং উল্টাপাল্টা বলে ওকে কনফিউজ করে দিই। ছোট থেকেই এমন করতাম৷ যেই লিপস্টিক দিলে ওকে ভালো লাগত, সেটা দেখে জিভ বের করে মুখ ভেঙচে বলতাম,
❝কি বিছরি রঙ! তোকে দেখলে কুকুরেরও টয়লেট কষা হয়ে যাবে। যা মুছে আয়!❞
ছোটবেলা তুতুন এসব শুনে ঠোঁট উলটে কান্না আটকে লিপস্টিক মুছতে দৌড়ে চলে যেত। চুল আম্মু না বেঁধে নিজে নিজে বাঁধলে একটানে খুলে বলতাম,
❝এভাবে কেউ চুল বাঁধে? ঘোড়ার লেজের মত? যা, চুল ঠিক কর! যা!❞

এখন আর এসবে শায়লা বিচলিত হয় না। আমি যত বদনাম করি, ততই ও ঘাড় উঁচু করে বলবে,
❝জানি জানি। আমাকে ভালো লাগছে তাই তোমার সহ্য হচ্ছে না। পোড়া গন্ধ আসছে!❞
আমি প্রতিবাদ জানাই।
❝মোটেও না! তোকে দেখে কোনো মেয়েই তোর দিকে তাকাবে না, ছেলে দূরে থাক❞
❝আমার দিকে না তাকালেও চলবে। তোকে তো লোকে দেখে? ঐটাই যথেষ্ট❞
আমার বোন, তাই আমার মতোই কথা শিখেছে। আমি হাসি, তাচ্ছিল্য করি। কিন্তু ডীপ ইনসাইড, আই লাভ মাই সিস্টার। ওর জন্য ছেলে দেখা হচ্ছে, বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময় পাত্রপক্ষের মহিলারা এসে দেখে যাচ্ছ। কেউ আয়োজন করে আসছে, কেউ আবার না জানিয়ে ঘুরে ফিরে দেখে যাচ্ছে। এসব দেখে আমার অদ্ভুত লাগে, পোড়ায়। বোনকে আগের মত কাছে পাওয়া হবে না, জ্বালানো হবে না। সে দূরের মানুষ হয়ে যাবে। মেহমানের মত।

আব্বু আম্মু গতকাল থেকে কি নিয়ে যেন ফিসফাস করছিল। আজ রাতে আমাকে তাদের ঘরে ডাকলো ডিনারের পরে। আমি মাস্টার বেডে ঢুকলাম৷ আম্মু দুই পা গুটিয়ে বিছানায় বসে আছে, আব্বু পেছনে বালিশ দিয়ে আধাশোয়া হয়ে আছে। আমাকে ঢুকতে দেখে আম্মু বলল,
❝দরজা লাগা❞
বুঝলাম, খুব সিরিয়াস কোনো আলোচনা হবে। তাদের সামনে চেয়ার টেনে বসলাম। আম্মু বলল,
❝শায়লা কয়দিন আগে দেখতে আসছিল না?❞
❝কয়দিন আগে আসছিল?❞
❝আরে, আসলো না কয়দিন আগে?❞
❝কয়দিন আগে কবে আসছিল?❞
❝ধুর! তোর জানা লাগব না❞
আব্বুর দিকে চেয়ে বলল,
❝ছেলে পক্ষ কিন্তু ভালো। ছেলে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। বাড়ি আছে রূপগঞ্জে। নিজেদের বাড়ি। বড় দুই বোন, দুইজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোট ভাই আছে। বাসায় মানুষ কম। কাজের মানুষও আছে❞
আব্বু যোগ করলো,
❝সবচেয়ে বড় কথা, ছেলের বাবা মায়ের মানসিকতা ভালো। শায়লা আদরই করবে❞
❝আর ছেলে?❞
আমি প্রশ্ন করলাম। আব্বু আম্মু আমার মুখের দিকে এক সাথে তাকালো। তারপর আম্মু আব্বুর দিকে তাকালো। আব্বু বলল,
❝ছেলেও ভালোই। কাল ওরা বাসায় আসবে আনুষ্ঠানিক কথাবার্তা বলতে। তখন ভালোভাবে দেখে নিও। তোমার আর কোনো প্রশ্ন আছে?❞
❝তোমরা ভালোভাবে খোঁজ নিলেই হবে। আমি কালকেই দেখব যা দেখার❞

কথা বলে নিজের ঘরে চলে আসলাম। আসার সময় শায়লার ঘর পার হতে হয়েছে। ও গুনগুন করে গান গাচ্ছে। দরজার একটুখানি ফাঁক দিয়ে ওকে বেশ সুখে থাকতে দেখা যাচ্ছে। বিয়ের পর এমন সুখেই থাকুক, সেটাই আশা।

পরদিন পাত্রপক্ষ আসলো। চার পাঁচজনের কথা থাকলেও আসলো তেরোজন। পেটপুরে খেলো, ঘুরে ঘুরে ঘরবাড়ি দেখলো। আমি অবশ্য ছেলেকে খেয়াল করলাম। নিপাট ভদ্রলোক। বোকাসোকাও বটে। আমার বোকা মানুষ ভালো লাগে। যেহেতু আমি চালাক, আমি চাই না আমার পরিবারের অন্য সদস্য আমাকে টেক্কা দেয়ার মত হোক৷ সব মিলিয়ে এই মাসের মাঝে বিয়ের তারিখ নির্ধারণ করা হলো। মেহমান বিদায় হওয়ার পর দেখলাম শায়লা ঘরে বসে গয়না খুলছে, মুখে হাসি। দরাম করে ওর বিছানায় শুয়ে পড়ে বললাম,
❝খুব খুশি বিয়ে হচ্ছে দেখে, না?❞

শায়লা আমার কথা শুনে মুখ গোমড়া করলো।
❝আমি কেন খুশি হব? খুশি তো তুমি। বাসাটা নিজের করে পাচ্ছো❞
❝পেয়ে আর লাভ হচ্ছে কি? ঝগড়া করার জন্য তুই থাকবি না। একা একা বাসা জমে নাকি?❞
❝তাহলে তোমার ঝগড়া করার একটা পার্টনার আনলেই পারো। যতক্ষণ বাসায় থাকবা, ততক্ষণ চুলোচুলি করবা!❞
❝তুই আমার বোন হয়ে আমার কি দায়িত্ব পালন করছিস? একটা বউ খুঁজে দিতে পারিস না? নিজেই ঢ্যাঙ ঢ্যাঙ করে বিয়ে করতে যাইতেছিস। ভাইয়ের জন্য কোনো চিন্তাই নাই!❞

শায়লা আমার দিকে ঘুরলো।
❝তোমার বউ তো তুমিই খুঁজতে পারো। তুমি এমনিতেও খুব এক্সপার্ট। মেয়েরা তো তোমার হাতের মোয়া। নিজের সুবিধা মতো একটা মোয়া আনলেই হয়। শুধু শুধু আমাকে টানার কি আছে?❞
❝ওরে বাবা! আমাকে নিয়ে এত উচ্চ ধারণা?❞
❝এসব আমার না, এলাকার সবার ধারণা। তোমাকে চেনে না, এমন কেউ নেই। আমাকে একটা কথা বলো তো। তুমি এমন কেন? খালি মেয়েদের পেছনে লেগে থাকো কেন? তুমি জানো সবাই আমাকে কি ডাকে?❞

শায়লার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলাম।
❝আর ইউ এসেইমড অফ মি?❞
❝আগে লাগত। কিন্তু এখন ভোঁতা হয়ে গিয়েছি। তোমার সব ঠিক আছে শুধু মেয়েদের নিয়ে ছোঁকছোঁক করা ছাড়া। তুমি কি আদৌ বিয়ে করতে পারবা? একটা মেয়ের সাথে আল দ্যা লাইফ এহেড… আর ইউ শিওর?❞
আমি কথা ঘুরানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
❝তোর বান্ধবীদের সাথে কিন্তু এমন কিছু করিনি আমি। কারণ আই বিলিভ, তোর কোনো একটা বান্ধবীই হবে আমার সোল মেট। সোল মেট পেলে তার সাথে আমার এক জীবন না, জনম জনম কেট্র যাবে!❞

কথাটা বলতে বলতে দাঁত বের করে হেসে ফেললাম। শায়লা আমার অবস্থা দেখে শব্দ করে হেসে পাশে এসে বসলো। পায়ের উপর পা তুলে দুই হাতে চেপে ধরে বলল,
❝আমার বান্ধবীদের পিছে না লাগার জন্য অনে অনেক কৃতজ্ঞতা। ইউ সেইভড মি! কিন্তু এখন আমার কোন বান্ধবী তোমার সোল মেট হলো, বলো তো?❞
আমি ঝট করে উঠে বসলাম। সারা মুখে হাসি। শায়লা আমার ইশারা বুঝতে পেরেছে। হাসি হাসি মুখে বলল,
❝ও বাবা! তুমি তো গ্লো করছো! একেবারে ভেতর থেকে! খুলে বলো তো কি হলো?❞

আমি শায়লাকে আমার আর তুতুনের ব্যাপারে সব খুলে বললাম। সাথে কণার ব্যাপারটাও বললাম। শায়লা মুখ গম্ভীরতায় ছেয়ে গেছে।
❝তোর বান্ধবী কি তোর বিয়েতে আসবে না? ওকে ইনভাইট কর। আমি তো আর বললেই দিনাজপুর যেতে পারি না। ঢাকা থেকে একটু বেশিই দূরে। ঢাকায় হলে ওর কলেজের আশেপাশে থাকতাম, দেখা করতাম, মানানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু এত দূরে দিয়ে…❞
❝তুমি কণা আপুকে ম্যানেজ করার চেষ্টা কেন করতেছ না?❞
❝কণাকে ম্যানেজ? এই মেয়েকে কিভাবে ম্যানেজ করব? সে তক দেশের বাইরে! তার উপর ও কখনো স্বীকার করবে না যে ও মিথ্যা বলছে। তুতুনের সাথে ওর কি স্বার্থ জানি না, কিন্তু ও তুতুনের কাছে কখনোই নিজেকে কালার করবে না। আর তুতুনও আমার কথা বিশ্বাস করবে না। সো বেসিক্যালি…❞

আমি ঘাড় নাড়ালাম। শায়লা বলল,
❝তুতুনের যায়গায় আমি থাকলে আমিও তোমাকে এক্সেপ্ট করতাম না। এটা স্বাভাবিক। তুমি ওর জন্য তেমন কিছুই করতে পারো নি যে ও কনভিন্স হবে। যাই হোক, এখন আমার কি করতে হবে?❞
❝আমার পক্ষ হয়ে ওকে বুঝাবি। দেখ ও কি বলে? তোর কথা শুনে ওর রিএকশন জানা❞

…………….

শায়লা কল করেছিল। ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের সপ্তাহে অনুষ্ঠান। অনেক অনুরোধ করলো যাওয়ার জন্য। কোইন্সিডেন্টলি আমারও পরীক্ষা নেই, ঢাকাও যাওয়ার দরকার ছিল। আব্বু আম্মু শুনেই রাজী হলো। আন্টি উনাদের কল করে দাওয়াত দিয়েছে। সবাই মিলে ঢাকা যাওয়ার জন্য লাগেজ গোছাচ্ছি। সবই ঠিক আছে। একমাত্র বিরক্তিকর বিষয় হলো শুভ ভাইয়ার উপস্থিতি। যতবার তার কথা মাথায় আসছে, ততবার সেখানে যাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছি। গত পাঁচ মাস ধরে সে পিছনে লেগে আছে। আমি যতই অনাগ্রহ প্রকাশ করি, সে যেন ততই কাছে আসে। আগে ধমক, বকার উপর রাখতো, আর এখন কেবল আমাকে গলানোর ধান্ধা। যদিও সে কখনো লিমিট ক্রস করেনি, কিন্তু তবুও পিছু ছাড়ছে না। এটাই ইরিটেটিং ব্যাপার। অনেক সময় এমন হয়, উনার কয়েকটা কল না ধরলে উনি আর কল না করে টেক্সট করে, ❝তুতুন, শরীর খারাপ করে নি তো? ভালো আছ?❞ অবাক লাগে আমার। এত ভালো ব্যবহার কখনো সে করেনি। আমার সাথে এত ভালো ব্যবহার কেন করছে? আমি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ঢাকায় গিয়ে কি কি করব, সেই লিস্ট বানাচ্ছি।

কয়েকদিন পর ঢাকায় এসেছি। শায়লা একেবারে আমার কলিজার বান্ধবী না, তবুও তো বান্ধবী। তাই এসেই দেখা না করে দুই দিন সময় নিলাম। প্রথম দিন কেবল ঘুমিয়ে কাটালাম। পরদিন ইসাবেলা আপুর সাথে দেখা করতে গেলাম। সারাদিন ঘুরে ঘুরে শপিং আর রেস্টুরেন্টে খেলাম। অনেক দিন পর মনে হচ্ছে যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছি। সারাদিন মেডিকেলের পড়ায় পিষ্ট হয়ে থাকি। আজ সারাদিন ভালো কাটিয়ে যখন বাসায় আসলাম, তখন সন্ধ্যের আলোয় শুভ ভাইয়াকে তাদের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমাকে রিকশা থেক নামতে দেখে কাছে এসে মিষ্টি করে হাসলো। আমার কাছে যদি সে হাসি ভূতের মত। কি বলব সেটা বুঝতে পারছি না। উনি হাতের ব্যাগ গুলোর দিকে ইশারা করলেন,
❝হেল্প লাগবে? ব্যাগ ধরব?❞
❝না, আমি পারবো❞
❝শায়লার হলুদ কালকে। আগে আগে চলে এসো❞
❝দেখি❞

ঘুরে দরজার কাছে আসতেই উনি বললেন,
❝তোমাকে দেখে ভালো লাগছে❞
❝আমাকে দেখে ভালো লাগার কি আছে?❞
বলতে না চাইলেও মুখ থেকে বের হয়ে আসলো। শুভ ভাইয়া আমাকে দেখে হাসলো। এবার তার হাসিটা অশুভ মনে হলো। তবুও বললাম,
❝আমাকে দেখে খুশি হওয়ার কিছু নেই। আসলে শুধু শায়লার জন্য না, আমার কিছু কাজ ছিল এজন্য ঢাকা এসেছি। আপনার খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই❞
❝তোমাকে আমার এজন্যই ভালো লাগে। খুব সুন্দর করে সত্য বলো। কিন্তু যেহেতু তোমাকে আমার এত পছন্দ, তাই তোমার উপস্থিতিতে তো আমি খুশি হবোই, তাই না? এখন তুমি যে কারণেই আসো না কেন, এসেছ, সেটি ফ্যাক্ট। রাইট?❞
❝শুনেন শুভ ভাইয়া। আপনি আমাকে পছন্দ করেন, সেটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি আপনাকে অপছন্দ করি, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার মনে হয়, যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার তার তার কাছেই রাখি। সেটাই ভালো। ওকে?❞
❝হোয়াট ইফ আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ফ্যামিলি ম্যাটার এ রূপ নেয়?❞
আমি সতর্ক হলাম।
❝হোয়াট ডু ইউ মিন?❞
❝তোমার ফ্যামিলির সবাই আমাকে খুব পছন্দ করে, জনো তো? তোমার পরিবারের সবাই যদি রাজী হয়, মানে সবাই, তাহলেও কি আমি তোমার অপছন্দের লিস্টে থাকব?❞

শুভ ভাইয়ার কথা আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু জবাব দিলাম না। তার প্রতি আমার কখনো কোনো ভালো অনুভূতি ছিল না। এখন কি পারিবারিক চাপে সেটা হওয়া সম্ভব? আমি দ্রুত বাসায় প্রবেশ করলাম। জানি না সামনে কি আছে, তবে মনে হচ্ছে এই অশুভ মানুষটা আমাকে একটা অশুভ প্যাচে ফেলবে। কি করব আমি? কণাপুকে বলব?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here