নীড় পর্ব-২২

0
1230

নীড়
রেশমী রফিক
২২।।
প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ পুরুষের মনেই বিয়ে সম্পর্কে একটা আনন্দ-আভা কাজ করে। হয়তো সমাজ বা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকে না সবসময় বা সবার ক্ষেত্রে। তাই বলে মনের ফুলে ফেপে উঠাকে তো রোধ করা যায় না। তেমনি ছেলেরা স্বপ্নে বা কল্পনায় সুন্দরী কোনো মেয়েকে বউ হিসেবে কামনা করে। শারারেরও তাই হবার কথা। কিন্তু সে ভিরমি খেল প্রায়। বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শফিকুল চৌধুরীর দিকে। তারপর হতভম্ব সুরে বলল,
– সিরিয়াসলি, বাবা? তোমার মাথা ঠিক আছে?
শফিকুল চৌধুরী খানিক অবাক হলেন। তার ধারণা এবারেও ভুল। ভেবেছিলেন, বিয়ের কথা শুনলে শারার খুশি হবে। মুখে কিছু না বলুক, নিশ্চুপ থাকুক কিন্তু মনের মধ্যে বিয়ের লাড্ডু কেবল ফুটতেই থাকবে না, লাফাতে শুরু করবে। কারণ বিয়েটা তার প্রেমিকার সাথেই হচ্ছে। কিন্তু শারারের মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তার গলায় ফাঁস পরানো হচ্ছে। তবে শফিকুল চৌধুরী মনের ভাব প্রকাশ করলেন না। আগের মতোই শান্ত সুরে বললেন,
– তোমার কেন মনে হচ্ছে আমার মাথা ঠিক নেই?
– এই বিয়ে কী করে সম্ভব?
– কেন সম্ভব নয়? তুমি কি এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাও না? যদি না চাও, তাহলে ওকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? অফিসের কাজ ফেলে ওকে এই রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে আসাটা তোমার কাছে এত জরুরী মনে হলো!
– বাবা, আমি তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারছি না।
– বুঝানোর দরকারও নেই।
– তুমি এই অবস্থায় আমাকে বিয়ে করতে বলছ?
– তবে কি তুমি বিয়ে ছাড়াই বাসর ঘরের প্ল্যান করেছ?
শফিকুল চৌধুরীর কথা শুনে শারার বাকরুদ্ধ। আর কোনো কথাই তার মুখে জোগাল না। তুবার ব্যাপারটা সে এতক্ষণ ধরেই বুঝাতে পারেনি বাবাকে। এখন এই বিয়ে না করার পক্ষে কোনো যুক্তি তার মাথায় আসছেও না। সুস্থ থাকলে নাহয় মাথা ঠান্ডা রেখে বাবার সাথে আলোচনায় বসতে পারত। এখন মাথা ঠান্ডা আছে ঠিকই, কিন্তু আঘাতটা পাত্তা না দিলেও ভোগাচ্ছে বেশ। পুরো মাথা ভার হয়ে আছে। চোখ মেলে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। এই অবস্থায় কথা অল্পসল্প বলা গেলেও দীর্ঘ আলোচনায় যাওয়া সম্ভব না।
শারারের মেজাজ খারাপ হলো তুবার উপর। সমস্ত রাগ আদতে ওর উপরই গিয়ে পড়ল। এই মেয়ের কী দরকার ছিল গাড়িতে ঘুমুবার? জীবনে কখনো গাড়িতে চড়েনি সে? নাকি এসিওয়ালা আরামদায়ক গাড়িতে চড়া তার ভাগ্যে জোটেনি? এজন্যই বুঝি শারারের গাড়িতে স্থায়ী যাত্রী হবার পাঁয়তারা করেছে! কিন্তু গাড়ি তো এখন আর আস্ত নেই। উত্তেজিত জনতা মনের আয়েশ মিটিয়ে গাড়ি ভেঙ্গেছে। স্বর্ণর উপর তাদের যত রাগ বা ক্ষোভ, সবটা গাড়ির উপর ঝেড়ে দিয়েছে। এখন যতটুকু অবশিষ্ট আছে, গ্যারাজে নেবার পর এটাকে আগের অবস্থায় আনতে চাইলে কমসে কম দুই লক্ষ টাকা খরচ হবে।
ধুর! কীসব ভাবছে? মাথা আসলে আউলে গেছে। ঠিকঠাক চিন্তা করতেও পারছে না। নয়তো তুবার সাথে গাড়ির সংযোগ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে কেন? এটা ঠিক, তুবাদের নিজেদের গাড়ি নেই। সবসময় রিকশা বা সিএনজিতে চলাফেরা করে অভ্যেস ওদের। তাই বলে কখনোই গাড়িতে চড়েনি, কথাটা ভুল। তুবা বা ওর পরিবারের সাথে খুব বেশিদিনের পরিচয় না হলেও দিবার বিয়েতে শারার নিজেই দেখেছে তুবাকে গাড়িতে চড়তে। বিয়ে উপলক্ষ্যে গাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। আর আত্মীয়স্বজনদের গাড়ি তো ছিলই। তাছাড়া, যে ক’দিন তুবার সাথে দেখা হয়েছে, গাড়ির প্রতি ওর কোনো অবসেশন আছে বলে মনে হয়নি।
নাহ, মাথাটা আসলেই আউলে গেছে। অনেকগুলো বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। অনেকটা জোর করে ওসব চিন্তাভাবনা বন্ধ করল শারার। কী হচ্ছে, কী হবে ওসবের ভার ছেড়ে দিল হঠাৎ। ক্লান্ত লাগছে খুব। কিচ্ছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না আর। তবে তুবার উপর রাগটা কমল না। উলটো ফুলেফেঁপে দ্বিগুণ হতে লাগল। অনেকটা সময় চুপ ছিল সে। চুপ থাকার কারণও ছিল। যে ঘরটায় সে বসা, সেখানে শফিকুল চৌধুরীও ছিলেন। ওর সামনে বসেই কার-কার সাথে যেন কথা বললেন ফোনে। একটু আগে কী ভেবে ঘর থেকে বের হলেন, ফোনে কথা বলা অবস্থাতেই। শারার তাকে কিছু বলতে চাইছিল। তার ফোনালাপ শেষ হবার অপেক্ষায় ছিল সে। কিন্তু সুযোগ মিলল না।
ঘরের আরেক প্রান্তে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বসে আছে তুবা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। শারার তার দিকে একবারও তাকায়নি। মাথা নিচু করে রেখেছিল। নয়তো স্পষ্ট দেখতে পেত নিঃশব্দ কান্নার দমকে তুবার শরীর কাঁপছে। হঠাৎ ফোঁপানির শব্দ একটু জোরালো হতেই শারারের কানে গেল তা। আচানক কী হলো ওর কে জানে, ঝট করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। হনহন করে এগিয়ে গেল তুবার দিকে। পরমুহূর্তে ঠাস করে থাপ্পড় মারল ওর গালে। এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল তুবা। স্বর্ণ টেবিলের ওপাশে বসা ছিল। হুড়মুড় করে দৌড়ে এলো। শারারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– কী করছ তুমি? ওকে মারলে কেন?
শারার ওকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল। থাপ্পড় খেয়ে তুবা উঠে দাঁড়িয়েছে। স্বর্ণর ঠিক পেছনে অবস্থান নিয়েছে সে। ওকে হাত ধরে টেনে সামনে আনল শারার। আরেকটা থাপ্পড় মারার উদ্যোগ নিতেই স্বর্ণ চিৎকার করে উঠল,
– হোয়্যাট দ্য হেল ইউর প্রবলেম ইজ?
এই কথাটাও শারার উপেক্ষা করল। ততক্ষণে তুবার আরেক গালে দ্বিতীয় থাপ্পড় বসে গেছে। পুরুষ মানুষের হাত এমনিতেই শক্ত হয়। সে তুলনায় মেয়েদের শরীরে নমনীয়তার পরিমাণ বেশি। শারারের হাতের থাপ্পড়টা খুব বেশি জোরালো ছিল না হয়তো। কিন্তু তুবার দুই গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট হয়ে গেছে। স্বর্ণ ওকে সরিয়ে নিতে চাইলে শারার হেঁচকা টানে তার আগেই ওকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলল। বলা ভালো, স্বর্ণ আর শারারের মধ্যে কাড়াকাড়ির পর্ব চলছে। স্বর্ণ চড়া সুরে শারারকে নিষেধ করছে, সতর্ক করছে, কিন্তু শারার যেন ধর্তব্যে নেই। অথবা কানজোড়া বন্ধ হয়ে গেছে তার।
তুবার ভাগ্য ভালো, ওই মুহূর্তে শফিকুল চৌধুরী ঘরে ঢুকলেন। পরিস্থিতি বুঝে উঠতে তার খুব একটা সময় লাগল না। তড়িঘড়ি করে এবার ছেলেকেই ঘরের এক প্রান্তে সরিয়ে নিলেন তিনি। চোখ পাকিয়ে নীরব ধমকি দিলেন। নয়তো তুবার কপালে আরও থাপ্পড় জুটত। বাবার কড়া দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা শারারের কম্ম নয়। তাই তখনকার মতো ক্ষান্ত হলো সে। কোনো কথা না বলে আবার বসে পড়ল সোফায়। যদিও হাত নিশপিশ করছে। তুবাকে মনের সাধ মিটিয়ে আরও কয়েকটা থাপ্পড় না দিতে পারলে তার শান্তি হবেই না। শফিকুল চৌধুরী কখনো ছেলের গায়ে হাত তোলেননি। এবারও হাত তুলতে গিয়েও নিজেকে সামলে ফেললেন। কেবল ক্রুদ্ধ সুরে বললেন,
– ভেজাল করো না, শারার। যেখানে আমি আছি, সেখানে আমার উপর দিয়ে ভেজাল করার সাহস হয় কী করে তোমার? এতই জোর তোমার গায়ে, তাহলে এই সিচুয়েশন হলো কী করে? ওই মেয়ের উপর যে জোর খাটাচ্ছ, সেটা সময়মতো খাটালে আমাকে এর মধ্যে জড়াতে হতো না।
শফিকুল চৌধুরী কী বলতে চাইলেন, শারারের মাথায় ঢুকল না। সেখানে দাবানলের মতো আগুন জ্বলছে। হাতজোড়া মুঠ করে অনেক কষ্টে সেই দাবানল থামাতে চেষ্টা করছে সে। এসময় শফিকুল চৌধুরীর উচিত ছিল, ছেলের শান্ত হবার সময়টুকু অপেক্ষা করা। শারার যে ফুঁসছে, সেটা ঘরের মধ্যে থাকা যে কেউ দেখলেই বুঝতে পারবে। কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলেন। ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
– কাশেম এখন শপিংমলে আছে। ওকে বলো, কী কালারের শাড়ি কিনতে হবে। তোমার নিজের জন্য কী কালারের পাঞ্জাবি কেনা হবে, তাও বলে দিও।
শারারের চোখ লাল হয়ে আছে। সেই অবস্থাতেই মুখ তুলে বাবার দিকে তাকাল। শফিকুল চৌধুরী বরাবরের মতো তাড়া দিলেন,
– কী হলো? ফোনটা ধরো। কাশেমকে যা বলার, তাড়াতাড়ি বলতে হবে। আমার পক্ষে এখানে অনন্তকাল বসে থাকা সম্ভব না। সে দ্রুত ফিরলেই এখানকার ঝামেলা শেষ হবে।
শারার ফোনটা হাতে নিল। পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে, অনুমান করে স্বর্ণ বলল,
– আংকেল, বিয়েটা না হলেই কি নয়? অন্যভাবে কি ঝামেলা সলভ করা যাবে না?
শফিকুল চৌধুরীর রাগ এবার স্বর্ণর উপর গিয়ে পড়ল। তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
– আমার ছেলের কী ব্যবস্থা আমি করব, সেটা আমাকেই ভাবতে দাও। তুমি তো ভাবলে অনেক। হলো কিছু? ব্যবসা করতে বসেছ এখানে। অথচ বিজনেস করতে গেলে কী কী ট্রিকস করতে হয়, কিছুই জানো না। এই ঝামেলা হয়েছে তোমার জন্য। সো, ঝামেলা কীভাবে সল্ভ হবে সেটা তুমি ভাবো। আমি শুধু আমার ছেলের দিকটাই দেখব। যদি মনে করো, আমার ছেলের বিয়ে হলেই তুমি আজকের মতো বেঁচে যাচ্ছ, দ্যাটস টোটালি রঙ। আমি এমপির সাথে কথা বলেছি, দলের ছেলেপেলের সাথে ডিল করেছি। তারা আমার ছেলেকে ছেড়ে দেবে। সাথে তার গার্লফ্রেন্ডকেও। কিন্তু তোমার ছাড়াছাড়ি নেই। বিজনেসের নামে কী করো আর কী না করো, সেটা তোমার ব্যাপার। তুমি তোমার দিকটাই সামলাও।
স্বর্ণ হতভম্ব। কথার পিঠে কী বলবে, ভেবে না পেয়ে কোনোমতে শুধু এটুকুই বলতে পারল,
– কিন্তু শাড়ি কী জন্য?
শফিকুল চৌধুরী গলা চড়ালেন,
– তবে কি ওই মেয়ে ল্যাংটা হয়ে বসে থাকবে তোমার সামনে?
স্বর্ণর হতবাক হবার মাত্রা বাড়ল। একবার চকিতে তুবার দিকে তাকাল সে। যেন শফিকুল চৌধুরীর কথার সত্যতা নিজে যাচাই করতে চাইল, আসলেই তুবা উলঙ্গ কি না। শফিকুল চৌধুরী এবার হুংকার ছাড়লেন ছেলের উদ্দেশ্যে,
– বলছিস কাশেমকে? এতক্ষণ লাগে কেন একটা কথা বলতে? কী কালারের শাড়ি কিনবি সেইটা বলতে তোর এত সময় লাগে কেন?
অবস্থা অবশ্যই বেগতিক। ঘটনাচক্রে তার চেয়ে বেশি খারাপ। কারণ, তিনি শারারকে তুই-তোকারি শুরু করেছেন। শফিকুল চৌধুরী অবশ্য সবসময়ই সবাইকে আপনি বা তুমি সম্বোধন করেন। তুই শব্দটা তার ডিকশনারিতে দুর্লভ। যখন তার মেজাজের পারদ চুড়ান্তে পৌঁছে যায়, তখনই শুধু তুই ডাকেন তিনি। তাও ছেলেকে আজ অবধি ডাকা হয়নি। শারার আগে কেবল একবারই বাবার মুখে তুই শুনেছিল। তার মাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছিল সেটা। আজ দ্বিতীয়বার শুনল, তাও আদরের ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন শফিকুল। স্বভাবতই ঘুর্ণিঝড় শুরু হবার পূর্বক্ষণের রুপ এটা। অন্য কেউ হলে ভড়কে যেত। শারার ভড়কায়নি। তবে তার রাগ পিছু হটেছে। ক্রোধের পারদ আচমকা এক ধাপ নিচে নেমে গেছে। তবু শফিকুল চৌধুরীর ছেলে সে। একই রক্ত তার গায়েও আছে। সেকারণেই হয়তো বিড়বিড় করে কাশেমকে বলল,
– গু কালার শাড়ি কিনে আন শুধু। আর কিছু কেনার দরকার নাই। তাড়াতাড়ি ফেরত আসবি।
(চলবে)
পরের পর্ব আগামীকাল দুপুর তিনটায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here