নীড়
রেশমী রফিক
৩০।।
বসার ঘরে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বসে আছে দিবা। পাশে সাইফুল বসা। সে সোফায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসেছে। পায়ের উপর পা তুলে। তবে তা বেশিক্ষণ টিকবে না। শফিকুল চৌধুরী বসার ঘরে পা দেবার আগমুহূর্তে সুরুত করে তার পা নেমে যাবে। একদম ভদ্রলোকের মতো শিরদাঁড়া খাঁড়া করে সোজা হয়ে বসবে।
বিয়ের পর থেকেই দিবা লক্ষ করেছে, তার এই ফুপাশ্বশুরকে পুরো শ্বশুরবাড়ির মানুষজন সমীহ করে চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমীহ নয়, রীতিমতো ভক্তি চলে। কেউবা ভয় পায়। সাইফুলদের বংশে তিনি মোটামুটি শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ, যাকে পারিবারিক আলোচনায় সবাই ডাকে। যার কথায় সবাই উঠবস করে। দিবার বিয়ের আলোচনাতেও তিনি উপস্থিত ছিলেন। দিবাদের বাসায় গেছেন সাইফুলের বাবা-মা আর অন্যদের সাথে। তবে দিবার পক্ষের মুরব্বিদের সাথে মূলত তিনিই কথা বলেছেন। বাকিরা তার কথায় সায় দিয়েছে শুধু। হু-হা করেছে। দিবার ধারণা, তিনি মত না দিলে ওদের বিয়েটা হতো না। সাইফুল যতই গো ধরুক। সাইফুলদের বাড়িতে কেউ ওকে পছন্দ করেনি খুব একটা। বিয়ের আগে অত বুঝা না গেলেও এখন দিনে-রাতে প্রায়ই উপলব্ধি হয়। সংসারের ঠোকাঠুকির ফাঁকে অনেক কথা কানে চলে আসে। প্রথম কয়েকদিন তার খারাপ লেগেছে অনেক। ঘরের দরজা আটকে রীতিমতো কান্নাকাটি করে ভাসিয়েছে। সাইফুলকে বকা দিয়েছে, কেন পরিবারের অমতে গিয়ে ওকে বিয়ে করল সে।
সাইফুল ওকে বারবার নিরস্ত করেছে। না পারলে বোনকে ডেকে এনেছে। সায়রা হচ্ছে দিবার কলিজা বান্ধবী। সে ওদের ঘরে ঢুকেই বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর দুই ভাইবোন মিলে বুঝ দিয়েছে, সংসার জীবনে এরকম হাজার কথা কানে আসবেই। যুগ-যুগ ধরে এটাই চলে আসছে। নতুন বউ বাড়িতে পা দেয়ামাত্র একটা দলের ফিসফাঁস শুরু হয়ে যায়। এগুলোকে ঠেকানো সম্ভব না। তাই পাত্তা না দিয়ে সংসার ধর্মে মন দিতে হবে। পাত্তা দিলেই বরং সর্বনাশ। এরা নতুন বউয়ের দোষ খুঁজে পেতে হয়রান হবে।
দিবা শেষমেশ সায়রার কথা মেনেছে। এমনিতেও ওর দৃষ্টিতে সাইফুলের পরিবার মানেই ওর বাবা-মা আর সায়রা। এরাই যখন অমত করেনি, তাহলে বাকিরা কে কী বলল, তাতে কান দেয়াটা আসলেই বোকামি। যৌথ পরিবার বলেই একটু-আধটু সয়ে নিতে হবে। পরবর্তীতে যতই দিন গেছে, দিবা খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সাইফুল আর সায়রা ছাড়া আর কেউ ওকে পছন্দ করে না। সাইফুলের বাবা-মা নিরীহ ধরনের মানুষ। তারা কখনোই ছেলেমেয়েদের ইচ্ছেয় বাঁধা দেননি। তবে মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ আছে। তাদের পছন্দ ছিল বংশের ভেতরই কোনো এক মেয়েকে। সম্ভবত সাইফুলের দূর সম্পর্কের কোনো কাজিন হবে। মেয়েটা দেশের বাইরে থাকে। ওখানেই জন্ম আর বেড়ে উঠা। তবে পারিবারিক অনুশাসন আর বাঙালী সংস্কৃতি তার জীবনে এতই প্রভাব ফেলেছে, তাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে বাংলাদেশে থাকে না। কানাঘুষো থেকে জানা গেছে, এই মেয়েকে খুব ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করে রেখেছেন সাইফুলের বাবা-মা। মেয়ের বাবা-মায়ের সাথেও মৌখিক কথাবার্তা হয়েছে। খুব সম্ভব মেয়েটাও ছোটবেলা থেকেই জেনেশুনে বড় হয়েছে যে, বাংলাদেশে ওর হবু বর আর হবু শ্বশুরবাড়ি ঠিক করা আছে। সাইফুল নিজেও জানত। তবে মেয়েটা কখনোই তার মনে সেরকম প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিয়ের প্রসঙ্গও খুব একটা আঁচড় কাটেনি। ফলাফলে, তার মনে অনায়াসে স্থান গেড়ে নিতে পেরেছে দিবা। সাথে সায়রার সমর্থন থাকায় এই ভালোলাগা-ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত এগোনোর সুযোগ পেয়েছে।
সাইফুলের বাবা-মা খুব খুব ভদ্র। মনের মধ্যে যাই থাকুক, দিবার সাথে এখন অবধি তার বিরুপ আচরণ করেননি। মন থেকে মেনে না নিলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দিবাও তাদের মন জয় করার প্রচেষ্টায় নেমেছে। কী করলে তারা খুশি হবেন, কীভাবে করলে তাদের মুখে হাসি ফুটবে, এই নিয়ে সারাক্ষণ তার ধ্যানজ্ঞান চলে। ইতোমধ্যে খানিকটা সফলও হয়েছে। এতকিছুর মধ্যে বাবার বাড়ি অনেকটাই বিস্মৃত হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়। শেফালি মেয়েকে সাংসারিক জীবনের ছোটখাট কৌশল শিখিয়ে দেন। সেগুলো প্রয়োগ করে সে। ভাইবোনদের কথা মাথায় ঢোকানোর ফুসরত হয়নি। তাছাড়া বেশিদিনও তো পেরোয়নি। মাত্র একমাস। এর মধ্যে তুবা কী করে ফেলল, তার মাথায় আসছে না।
আগেই বিয়েটা পাকাপোক্ত হয়ে যাওয়ায় কয়েক বছর সাইফুলের সাথে, ওর পরিবারের সাথে পরিচিত হয়েছে দিবা। সাইফুলদের বাসায় প্রায়ই যাওয়া হতো। আর সায়রার বান্ধবী হিসেবে এমনিতেও যাওয়া-আসা ছিল। তখন কোনো এক সময়ে শারারের সাথে পরিচয় হয়েছে। এরপর কালেভদ্রে দেখা হয়েছে। একবার ওর ফোন নম্বর নিল শারার। তখন থেকে প্রায়ই কল করত। বিশেষ করে যখন সাইফুলকে তার দরকার হতো এবং বাসায় ওকে পাওয়া যেত না। আবার ফেসবুকেও বন্ধুতালিকায় যুক্ত হবার সুবাদে অল্পসল্প কথা হতো। তাই বলে তুবার সাথে তার সম্পৃক্ত হবার প্রশ্নই আসে না। নয়তো তুবা ঠিকই ওর কথা বলত বোনকে। তাছাড়া তুবাকে সে কোনোদিন দেখেছে বলেও মনে হয় না। বিয়েবাড়ির ভীড়ে আলাদা করে চোখে পড়ার মতো মেয়েও নয় তুবা। তাহলে?
দিবার মাথায় চিন্তাভাবনার ঝড় বইছে। কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক ভাবতে পারছে না। এসির ভেতর বসেও কুলকুল করে ঘামছে সে। ঘেমেনেয়ে একাকার হবার আরেকটা কারণ হচ্ছে, সামনের সোফায় বসা শারার আর তুবা। বসার ঘরে ঢুকতেই তুবা দৌড়ে আসতে চাইছিল ওর দিকে। সেও তুবাকে জড়িয়ে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু শারার আটকে দিল। তুবার হাত শক্ত করে ধরে রাখল সে। দিবাকে শান্ত সুরে বলল,
– বসো ভাবি।
দিবা হতভম্ব। তুবা তখনো হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল,
– কী ব্যাপার? হাত ধরে রাখছেন কেন? হাত ছাড়েন।
শারার খুব স্বাভাবিক সুরে বলল,
– তুমি এখানে বসো।
– এখানে বসব কেন? আপু আসছে। আমি আপুর কাছে যাব।
– তোমার আপু পালিয়ে যাচ্ছে না, তুবা। সে এখানেই বসবে। এই সামনের সোফায়।
– তো? আমি আপুর কাছে গেলে কী সমস্যা?
– সমস্যা আছে। তুমি এখানে বসো।
তুবা উদ্ধত সুরে বলল,
– বসব না। আপনি আমার হাত ছাড়েন।
এই পর্যায়ে শারার কিছু বলল না। তবে তার চোখমুখ দেখে মনে হলো, এখনই বুঝি তুবাকে কষে থাপ্পড় মারবে। হয়তো হাতও তুলেছিল। দিবার কথা ভেবে সামলে নিল বুঝি। কয়েক মুহূর্তে দিবা চট করে ধরতে পারেনি। তবে শারারকে অনুরোধ করেছিল, তুবার হাত ছাড়তে। শারার তাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– তুমি বসো।
দিবা এক পা বাড়িয়েছিল। সাইফুল আটকাল এবার। ইশারায় বসতে বলল ওকে। বসার ঘরের থমথমে পরিস্থিতি দিবাকে কিছু একটা উপলব্ধি করাল, যার কারণে সে কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ বসে পড়েছে। তুবাকে প্রায় জোর করে সোফায় বসিয়েছে শারার। হাত তখনো ছাড়েনি। সাইফুল তখন বলল,
– তুবা, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? বসো। আমরা তো চলে আসছি।
তুবা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা বন্ধ করল। সাইফুলকে উদ্দেশ্য করে প্রায় কাঁদো-কাঁদো সুরে বলল,
– আমি বাসায় যাব। প্লিজ সাইফুল ভাই। আমাকে বাসায় নিয়ে যান।
দিবাকেও বলল,
– আপু প্লিজ। আমি বাসায় যাব।
দিবা কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওই মুহূর্তে শারার বলল,
– তুবা শোন। তুমি অবশ্যই বাসায় যাবা। তোমার আপু তোমাকে নিতেই এসেছে। কিন্তু তার আগে কিছু ডিসকাশন আছে। আব্বু ফ্রেশ হতে গেছে। আসলে কথাবার্তা বলবে ভাবির সাথে। ততক্ষণ তুমি চুপ করে বসে থাক। নড়বা না একদম।
তুবা প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলল,
– আমি আর কোনোদিন ক্লাস বাদ দিয়ে অন্য কোথাও যাব না। কোনোদিন কোচিং ফাঁকি দিব না।
দিবা হতবাক। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। শারার বলল,
– আর কোনোদিন ক্লাস-কোচিং বাদ দেয়ার সুযোগও পাবা না।
– ঠিক বলছেন। আম্মা আমাকে আজকে মেরেই ফেলবে। কুঁচি কুঁচি করে কাটবে। তারপর নদিতে ভাসিয়ে দিবে।
– রিল্যাক্স। ওসব কিছুই হবে না। ভাবি কথা বলবে আন্টির সাথে। তুমি কান্না বন্ধ করো।
দিবা শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মাকে সে কী বলবে, জানে না। এখানে আসার আগে তার মনে হয়নি ঘটনা এত গুরুতর। আপনমনে ধরে নিয়েছিল, কোনোভাবে হয়তো শারারের সাথে পরিচয় হয়েছে তুবার। এরপর দেখা করতে গিয়েছিল রেস্টুরেন্টে। সেখানে অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনায় ওরা বাজেভাবে ফেঁসে গেছে, যার কারণে ফুপাজানকে ছুটতে হয়েছে। এখন ওকে ডেকেছেন, তুবার নামে অভিযোগ দিতে। অথবা তুবাকে সতর্ক করতে। কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত ঘটনা এগিয়েছে, ঘুণাক্ষরেও মাথায় আসেনি। সাইফুল অবশ্য বিয়ের কথা বলেছিল। তখনও মনে হয়নি কিছু। হয়তোবা সাইফুলের কথা সেভাবে মাথায়ই ঢুকেনি। কিন্তু এখন তুবার পরনে বেনারসি শাড়ি দেখার পর মাথা বনবন করে ঘুরছে। কেন যেন আতঙ্ক জেঁকে বসছে মনে।
শফিকুল চৌধুরী বসার ঘরে ঢুকার আগে গলা খাঁকারি দিলেন। সেই শব্দ শুনে ঘরের ভেতর এক প্রকার ত্রাস সৃষ্টি হলো। তুবা মাথা নিচু করে রাখলেও শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। এবারে সোজা হয়ে বসল। দিবা আর সাইফুল বরাবরের মতোই তটস্থ। কেবল শারার নির্বিকার। আপনমনে মোবাইল টিপাটিপি করছে সে। শফিকুল চৌধুরীর সাথে লুৎফুন্নেসাও এসেছেন। এখন আর আগের মতো ঔদ্ধতা দেখা যাচ্ছে না তার চেহারায়। বরং স্বচ্ছ পানির মতো টলমলে পরিস্কার। খানিকটা মায়াময় আর ধীরস্থির। সচরাচর তাকে যেমনটা দেখা যায়। তুবা একবার মাথা তুলে তাকিয়েই আবার নিচু করে ফেলল। শফিকুল চৌধুরী বাদিকের সোফায় বসলেন। পাশে লুৎফুন্নেসা।
শুরুতেই শফিকুল চৌধুরী দিবার সাথে সালাম বিনিময় করলেন। ওর কুশল জিজ্ঞেস করলেন। পরিবারের খোঁজ নিলেন। আজকের ঘটনা ওর বাসায় জানাজানি হয়েছে কি না, কতদূর জেনেছে তাও জিজ্ঞেস করলেন। উত্তর দেবার আগে চকিতে সাইফুলের দিকে তাকাল দিবা। স্বামী-স্ত্রীর চোখাচোখি হলো। ইশারা বিনিময় হলো। সাইফুল আগেই সতর্ক করে রেখেছে ওকে। সেভাবেই উত্তর দিল,
– বাসায় আম্মা খুব কান্নাকাটি করছে। তুবার কোনো খোঁজ পাচ্ছে না, তাই। আব্বাও খুব টেনশনে আছে। সবাই এদিক-সেদিক খোঁজাখুঁজি করছে। এর মধ্যেই কিছুক্ষণ আগে সাইফুল আমাকে জানাল, তুবার খোঁজ মিলেছে। ও নাকি দুপুরে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল শারারের সাথে। তারপর কী একটা ঝামেলা হয়েছে…
শফিকুল চৌধুরী ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
– শুধু ঝামেলা না। খুব বড় ধরনের কিছু। এবং এখানে আমার ফ্যামিলির সম্মানটাও জড়িত।
দিবা ঢোঁক গিলল। বলল,
– জি?
– তোমার বোন আর আমার ছেলে এদের মধ্যে কতদিনের সম্পর্ক, কী ধরনের সম্পর্ক, তুমি কি জানো কিছু?
দিবা সতর্ক ভঙ্গিতে শারারের দিকে তাকাল। তা দেখে শফিকুল চৌধুরী আবার বললেন,
– ওর দিকে তাকিয়ে লাভ নেই। সত্যিটা জানা যাবে না। শারার এই পর্যন্ত আমাকে একেকবার একেক কথা বলেছে। একবার বলল, তোমার বোনের সাথে ওর কোনো সম্পর্ক নেই। তোমাদের বিয়ের সময় পরিচয় হয়েছে। তারপর অল্প যোগাযোগ ছিল। তোমার বোন নাকি খেতে খুব ভালোবাসে। তার কাছে আবদার করেছে। তাই সে আজ তোমার বোনকে নিয়ে গিয়েছিল স্বর্ণপাতার থালায়।
তুবা বিড়বিড় করে বলল,
– মিথ্যা কথা। আমি তো কর্ণফুলী সিটিতে…
শারার চট করে ওর পা মাড়িয়ে দিল জুতো দিয়ে। তুবা আঁতকে উঠে নিজেকে সামলে নিল। আড়চোখে লুৎফুন্নেসার দিকে তাকাল। ওর দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তিনি। খুব শান্ত কিন্তু ভয়ঙ্কর একটা দৃষ্টি। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। শফিকুল চৌধুরী বলতে লাগলেন,
– এরপর শুনলাম, তারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করে। এজন্য ডেটিং করতে গিয়েছিল। কিন্তু সম্পর্ক বলতে কিছু নেই। জাস্ট ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। আমি যখন ডিসাইড করলাম ওদের বিয়ে দেব। শারার তখন খুব অবজেকশন জানিয়েছে। বিয়ে সে করবেই না কোনো অবস্থাতে। আমি ঘাড় ধরে ওকে বিয়ে করিয়েছি। কিন্তু বাসায় আসার পর তার মত পাল্টে গেছে। তুবা তার স্ত্রী, এই ব্যাপারটা তার মগজে এতই পাকাপোক্ত হয়ে গেড়ে বসেছে, তুবাকে ছেড়ে এক পাও নড়তে চাচ্ছে না। দেখতেই পাচ্ছ তার অবস্থা।
একটু বিরতি নিলেন শফিকুল চৌধুরী। হয়তো দিবা বা সাইফুলের কিছু বলার অপেক্ষা করলেন। কিন্তু ওরা কিছু বলল না। এই আলোচনায় একমাত্র বক্তা হিসেবে তাকেই মেনে নিয়েছে যেন সবাই। তবে শারার প্রায় অস্ফুট সুরে বলল,
– আব্বু, তোমার কী বলার আছে, তাড়াতাড়ি বলো। অ্যাম টায়ার্ড।
– তোমাকে বলা হয়েছিল রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে।
– তুবা কেন যাবে না রুমে?
– তুমি কি নির্বোধের মতো প্রশ্ন করলে না? নাকি কমনসেন্স পুরোটাই গুলিয়ে খেয়েছ? হতে পারে তুবা তোমার ওয়াইফ, লিগ্যালি। কিন্তু যে সিচুয়েশনে বিয়েটা হয়েছে, ওটা মেনে নেবার মতো নয়।
– তাহলে তুমি কী করতে চাচ্ছ?
– আমি চাই, তুবা ওর বাসায় চলে যাবে। দিবা আর সাইফুলকে এজন্যই ডেকে আনা হয়েছে। ওরা তুবার বোন-দুলাভাই। ওরা ওর অভিভাবক। ওদের হাতে আমি তুবাকে দিয়ে দিব।
– তারপর?
– তারপর মানে?
– তারপর কী হবে? তুবা নিশ্চয়ই আজীবন ওদের বাসায় থাকবে না। কোনো একদিন ওকে আবার এই বাসায় নিয়ে আসা হবে। সেই একদিনটা কবে?
শফিকুল চৌধুরী কোনো কথা বললেন না। এই পর্যায়ে সাইফুল বলতে চেষ্টা করল,
– দেখ, ভাই। তুই যা বলতেছিস, কথাটা আমি বুঝছি। আমরা সবাই বুঝতে পারছি। কিন্তু এভাবে তো হুট করে কেউ বিয়েটা মেনে নিবে না। সামাজিকতার ব্যাপার আছে। কিছু ফরমালিটিস আছে। তুই কি বুঝতেছিস না, তুবার বাসায় ওর বাবা-মা কীরকম টেনশন করতেছে? মানে আমি নিজেও ঠিক বুঝতেছি না। মানে ফুপাজান, ঘটনা আসলে কী? শারার কি চাচ্ছে না তুবাকে ওর বাসায় যাক? নাকি…
শফিকুল চৌধুরী গম্ভীর সুরে বললেন,
– শারার, তোমাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কতটা অসুস্থ। এজন্য উল্টাপাল্টা কী বলে যাচ্ছ, নিজেও বুঝতে পারছ না। ইউ নিড রেস্ট। মাথার আঘাতটা কিন্তু হেলাফেলা করার মতো না। তুমি যাও। তোমার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও। সারাদিনে কিছু খাওনি। খাওয়া-দাওয়া করো। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি তুবাকে নিয়েই ভেতরে যাও।
শোনামাত্রই শারার সোফা ছেড়ে উঠল। তুবাকে বলল,
– চলো আমার সাথে।
তুবা কথা বাড়াল না। চুপচাপ ওর পিছু নিল। লুৎফুন্নেসার চেহারায় উৎকন্ঠা দেখা যাচ্ছে। স্বামীর মনোযোগ আকর্ষণের নীরব চেষ্টা চালাচ্ছেন। শফিকুল চৌধুরী ইশারায় তাকে শান্ত থাকতে বললেন। শারার-তুবা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর দিবা আর সাইফুলের দিকে ঘুরলেন তিনি। বললেন,
– শারার কী চাচ্ছে সেটা আমার দেখার বিষয় না। আমি চাচ্ছি না, এই বিয়েটা টিকে থাকুক। একটা খারাপ সিচুয়েশনে পড়ে বিয়ে হয়েছে। তার মানে এই নয়, সেটা আজীবন টানতে হবে। অ্যাডজাস্টমেন্ট বলেও একটা ব্যাপার আছে।
বসার ঘরে বোধহয় নীরব বোমা ফাটল। দিবা আর সাইফুল বাকরুদ্ধ, কিছুটা হতবাক। দিবা বিস্ময়ের চুড়ান্তে পৌঁছে গেছে। কেবল লুৎফুন্নেসার মুখে স্বস্তির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। এতক্ষণ দম বন্ধ করে বসেছিলেন তিনি। এবারে খানিক নড়েচড়ে উঠলেন।
শফিকুল চৌধুরী দিবার উদ্দেশ্যে বললেন,
– তোমাকে আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। তুমি তুবাকে নিয়ে যাও। তোমার বাবা-মাকে যেভাবে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে সুবিধা হয়, সেভাবেই বলো। এই বিয়েটা কয়েকদিনের মাত্র। আমি খুব দ্রুতই উকিলের মাধ্যমে ডিভোর্স পেপার রেডি করে ফেলব। শারারও সাইন করে দেবে। এরপর তোমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেব।
দিবা ক্ষীণ সুরে বলল,
– কিন্তু ফুপা…
– কিছু বলবে তুমি?
– জি মানে, এখানে তো তুবার কোনো দোষ ছিল না। ও কেন সাফার করবে?
– সাফার করার প্রসঙ্গ আসছে কেন?
– কারণ একটা মেয়ের লাইফে বিয়ে কেবল কাজির সামনে বসে সাইন করা নয়। এর সাথে ওর সারাটা জীবন জড়িত। এই বিয়েটা যদি না টিকে, মানে আপনারা যদি ছেলের বউ হিসেবে মেনে না নেন তুবাকে, তাহলে বিয়েটা করালেন কেন?
– আজকে ওই রেস্টুরেন্টে যা ঘটেছে, তাতে এটাই ছিল একমাত্র সলিউশন। এই বিয়েটা না হলে কাল মিডিয়াতে আমার ফ্যামিলির সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হতো। তাতে তোমাদের খুব একটা প্রবলেম না হলেও আমার হতো। আমি সোসাইটিতে অনেক মানুষের সাথে উঠবস করি। আমাকে সোসাইটির সাথে তাল দিয়েই চলতে হয়। আমি এই ব্যাপারটা সাইফুলকে আগেই বুঝিয়ে বলেছি। বিয়ের আগেই। এরপর সাইফুলের মতামত নিয়েই বিয়ে পড়ানো হয়েছে।
দিবা এবারে সাইফুলের দিকে তাকাল। সাইফুল মিনমিন করে বলল,
– ফুপা, আমি বিয়েতে মত দিয়েছিলাম শারারের জন্যই। ও আমার কাজিন। ছোটবেলা থেকে ওকে চিনি। আমার মনে হয়েছে, তুবা ওর সাথে ভালো থাকবে।
– তোমার কি এটা মনে হলো না, এখানে তোমার ফুপুর দ্বিমত থাকতে পারে? কিংবা আমার সোশ্যাল স্ট্যাটাস ভলনারেবল হয়ে যেতে পারে? দিবা না জানে, তোমার তো জানা উচিত আমার সম্পর্কে। তোমার কীভাবে ধারণা হলো, তুবাকে আমি ছেলের বউ হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করে নেব?
দিবা প্রায় কাঁদো-কাঁদো সুরে বলল,
– ফুপা, প্লিজ। বিয়েটা যেহেতু হয়ে গেছে। আপনি আর ফুপি মেনে নিন। দরকার পড়লে তুবা কয়েক বছর আমাদের বাড়িতে থাকুক। পরে একসময় অনুষ্ঠান করে ওকে তুলে আনবেন। প্লিজ বিয়েটা ভেঙ্গে দিবেন না। তুবার লাইফে অনেক বড় একটা আঁচ পড়বে।
এই পর্যায়ে লুৎফুন্নেসা মুখ খুললেন,
– ন্যাকা কান্না বন্ধ করো। তোমার কি মনে হয় আমরা বোকা? আমাদের যা খুশি তাই বুঝিয়ে দিতে পারবে? তুবার লাইফে আঁচ পড়ার প্রসঙ্গ তখনই আসবে, যখন বাইরের মানুষ ঘটনা জানবে। কেউ তো জানেইনি এখনো। তোমার শ্বশুরবাড়িতেও খবর পৌঁছায়নি। কোথাও যাতে এই খবর না যায়, সেজন্যই তোমাকে ডেকে আনা হয়েছে। এবং আজকের পর এই বিয়ের খবর চার দেয়ালের বাইরে কখনোই যাবে না। বিয়েটা যেমন লোকচক্ষুর আড়ালে হয়েছে, তেমন করে ডিভোর্সও হয়ে যাবে। নাইবা শারারের সাথে তুবার কোনো সম্পর্ক হবে। তবে তোমরা যদি ঢালঢোল পেটাও, মানে তোমার মা, উনার তো বড় গলা। কথা বলার সময় মনে হয় যেন ঝগড়া করছেন। উনি যদি গলাবাজি করে সবাইকে জানান দেয় এই বিয়ের কথা, সেটার দায় সম্পূর্ণই উনার একার। আমাদের না। যদি মনে করো, চারদিকে জানাজানি করে আমাদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করবে, সম্মানহানির ভয় দেখাবে, তাহলে শুনে রাখো ওসব করলে আমাদের কিছুই আসবে যাবে না। শারার ছেলে। ওর উপর আঁচ আসলেও যা, না আসলেও তা। আমাদের আত্মীয়মহলে যারা আছে, তারা কখনোই তোমাদের কথা বিশ্বাস করবে না। উলটো তোমাদেরকে, মানে তোমাকে দুষবে। বুঝতে পারছ তো, দিবা? শ্বশুরবাড়িতে এসেছ বেশিদিন হয়নি। এর মধ্যে নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট পড়ে গেলে তোমারই লস। আজীবন ভুগতে হবে। কারণ, কিছু কিছু ব্যাপার আছে, যা মানুষ কখনোই ভুলে না। আর তোমার বোনের কথা কী বলব? জানি না, তোমাদের ফ্যামিলিতে আদব-কায়দা কীরকম শেখানো হয়। এই বয়সের একটা মেয়ে কলেজ ফাঁকি দিয়ে এক ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে সময় কাটাচ্ছে। শুনতেই তো কেমন লাগে! আর আজকের ঘটনা নিশ্চয়ই শুনেছ। তোমার বোন কতটা ধোঁয়া তুলসীপাতা, তার উপর যেমন কোশ্চেন মার্ক চলে আসে, তেমনি তোমাদের ফ্যামিলির উপরও। বাকিটা তোমাদের ব্যাপার।
দিবা হতভম্ব ভঙ্গিতে কথাগুলো শুনে যাচ্ছে। তার চোখ বিস্ফারিত প্রায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটার শব্দ হচ্ছে। মাথা আগেই বনবন করে ঘুরছিল। এখন গতি বেড়েছে। আরেকটু বাদে বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। কারণ হাত-পায়ে কোনোরকম জোর পাচ্ছে না। খপ করে সাইফুলের হাত চেপে ধরল সে।
(চলবে)
আগামীকাল শেষ পর্ব দেয়া হবে।