শেষ ইচ্ছে পর্ব-০১

0
1737

০১।
“আজ আমাদের শেষ দেখা। সে আমাকে বলেছে একটা কমলা রঙের শাড়ি পড়ে আসতে। তার আবদার শুনে আমার কপালে ভাঁজ পড়লো। ভাবছি কমলা রঙের শাড়ি কোথায় পাবো? যেখানে এই রঙটিই আমার মারাত্মক অপছন্দের। তাই কারণ ছাড়াই আলমারী ঘেঁটে দেখলাম। জানি সেখানে কোনো কমলা রঙের শাড়ি নেই তবুও। বড় আপার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম,
“আপা, তোমার কাছে কি কমলা রঙের শাড়ি আছে?”

আপা আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো, যেন আমি খুব অযৌক্তিক প্রশ্ন করেছি। আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম,
“এভাবে তাকাচ্ছো কেন? বলো, আছে কি নেই?”

আপা এবার মাথা নেড়ে বললো,
“আমার কি আছে কি নেই, তা তোর চেয়ে ভালো কে বলতে পারবে? আর তুই আমাকে এসে প্রশ্ন করছিস?”

আমি আপার কথায় বিরক্ত হলাম। এমনিতেই এই কমলা রঙের শাড়ি নিয়ে যতো ঝামেলা, তার উপর আবার আপার এমন প্রশ্ন! আরেহ বাবা, আমার অগোচরে একটা শাড়ি কি কিনতে পারে না? হ্যাঁ, আমি মানছি আপার নতুন শাড়ি-জামা, সবকিছুই আমার হাত দিয়ে আপার কাছে পৌঁছেছে। আপার খাওয়া-পরা সবকিছুর প্রত্যক্ষ ভূমিকা আমারই। তবুও….
ইশ! কেন যে জিজ্ঞেস করতে গেলাম। এখন হয়তো আপার প্রশ্নের বাণ আমার দিকেই তীব্র বেগে ছুটে আসবে!”

হীরা জাবিন ফোন হাতে নিয়ে এতোক্ষণ এসব কথা ভয়েস রেকর্ডারে রেকর্ড করছিল। প্রতিদিনের ছোট ছোট ঘটনাই সে ফোনে নিজের কন্ঠে রেকর্ড করে রাখে। মানুষ দিনলিপি লেখার জন্য ডায়েরী ব্যবহার করে, কিন্তু হীরার লেখালিখি করার মতো সময় নেই। আর তার মনের সব কথা লিখতে গেলে কয়েকমাসেই একটা ডায়েরী শেষ হয়ে যাবে। আর সবসময় ডায়েরী সাথেও রাখা যাবে না। তখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই সে সংগ্রহে রাখতে পারবে না। এমনও হতে পারে বাসায় আসতে আসতেই সে ভুলে যাবে। হয়তো বা কলমের কালি শেষ হয়ে যাবে। আবার ডায়েরীর পৃষ্ঠাও শেষ হয়ে যেতে পারে ওই মুহূর্তে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হীরার হাতের লেখা খুবই বাজে। সে যদি শখের বসে দিনলিপি লিখেও ফেলে বড়জোর একমাস, এর মধ্যেই কিন্তু সে ভুলে যাবে, যে আদৌ কি লিখেছিল সেখানে। কারণ হীরা তো নিজের লেখা নিজেই বুঝতে পারে না।

হীরা যেই ফোনে ভয়েস রেকর্ড করে সেটা তার বাবার ফোন। হীরা যখন দশম শ্রেণিতে পড়তো তখনই তার বাবা রোড এক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করেন। এক্সিডেন্টের পর পুলিশ তার বাবার জিনিসপত্রগুলো হীরা আর তার মাকে বুঝিয়ে দেয়। এরপর থেকেই হীরা সেই ফোনটি যত্নের সাথে নিজের কাছে রেখে দেয়৷ আর সেখানেই মেমোরি কার্ড ঢুকিয়ে ব্যবহার করতে থাকে।

০২।

হীরা কমলা রঙের শাড়ি পরে আয়নার সামনে বসে পড়লো। হীরার আপা রূপালী জাবিন হীরাকে দেখে বললো,
“কি রে, তুই কমলা শাড়ি কোথায় পেলি?”

হীরা মুচকি হেসে একটা বক্সের দিকে ইশারা করলো। রূপালী বক্সের দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকানোর পর সেটি হাতে নিয়ে বলল,
“কে পাঠিয়েছে এই শাড়ি?”

হীরা বললো,
“নামটা না হয় না-ই জানলে।”

বলেই রহস্যময় একটা হাসি দিলো হীরা। রূপালী বক্সটা খুলে দেখলো সাথে একটা চিঠিও আছে। হীরা হয়তো শাড়ি পেয়ে আনন্দে উতলা হয়ে থাকায় চিঠিটি খেয়াল করে নি। রূপালী চিঠিটি খুলে দেখলো সেখানে লেখা আছে,

“জানি, তোমার কাছে এই রঙের কোনো শাড়ি নেই। আমি তো জানি তোমার কমলা, হলুদ আর টিয়া এই তিনটে রঙ মারাত্মক অপছন্দের। আর আমিই হয়তো সেই প্রথম ছেলে, যার এই তিনটে রঙই সবচেয়ে প্রিয়। আচ্ছা হীরা, তুমি কি বলতে পারো আমার মতো এই তিনটি রঙ পছন্দ করে এমন কেউ আছে কি-না? আমি তো এখনো পাই নি। হয়তো আমি কম মানুষের সাথে কথাবার্তা বলেছি, তাই আমার জানা হয় নি। তোমার তো অনেক বন্ধু। তুমি কি জিজ্ঞেস করো নি কারো থেকে?……”

এতোটুকু পড়েই রূপালী হীরার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এই শাড়ি কি স্মরণ পাঠিয়েছে?”

হীরা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো। রূপালী হীরার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ওই অবস্থায় সে শাড়ি কিভাবে কিনেছে? আর……”

হীরা রূপালীকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“স্মরণ তো আগেই কিনে রেখেছিলো। এখন শুধু পাঠিয়েছে আমার কাছে। আর আপা, স্মরণ সবকিছুই আগে থেকে ভেবে রাখে। আর এখন এতো প্রশ্ন করো না তো। আমি ওর ব্যাপারে তোমাকে বেশি কিছু বলতে পারবো না।”

হীরা কথাগুলো বলেই আনমনে নিজেকে বকলো। কেন সে আপার কাছে কমলা শাড়ি খুঁজতে গেলো? না সে শাড়ি খুঁজতে যেতো, না আপা জানতো তার এই মুহূর্তে কমলা শাড়ি প্রয়োজন, না এই মুহূর্তে হঠাৎ শাড়িটা গায়ে জড়ানো দেখে কোনো প্রশ্ন করতো, না-ই বা স্মরণের কথা উঠতো।
মূল কথা হলো স্মরণকে নিয়ে প্রশ্ন করা। এই মুহূর্তে স্মরণ সম্পর্কে কেউ প্রশ্ন করলেই সে এড়িয়ে চলে। আর এতোকিছু হওয়ার পরও সে স্মরণকে সংকোচ ছাড়াই ভালোবাসছে, এটা দেখে রীতিমতো সবাই অবাক। এমন ছেলেকে ভালোবাসতে কি হীরার একটুও খারাপ লাগছে না?

রূপালী এই প্রশ্ন হীরাকে করবে না। সে মনে মনে শুধু একটা কথায় ভাবছে, আর তা হলো,
“এই ছেলে এমন মুহূর্তে এসব অদ্ভুত কথাবার্তা বলে কি বোঝাতে চাইছে?”

চিঠি পড়লে হয়তো যেকেউ বিরক্ত হয়ে যাবে। অন্য কেউ হোক বা না হোক রূপালী প্রচুর বিরক্ত হয়েছে। সে হীরাকে বলল,
“এই ছেলের মাঝে কি এমন আছে, যার জন্য তুই এভাবে উন্মাদ হয়ে পড়েছিস?”

হীরা মুচকি হেসে বললো,
“শান্তি আছে। ও আমার পাশে থাকলে আমার খুব শান্তি লাগে, আপা। তুমি ওসব বুঝবে না। স্মরণকে বোঝার ক্ষমতা আমারই আছে। আজ পর্যন্ত কোনো মানুষই ওকে বুঝে উঠতে পারে নি।”

“তাহলে তুই কিভাবে বুঝেছিস? তোর আর ওর পছন্দ-অপছন্দের মধ্যেও কতো অমিল!”

“একটা সরু পাহাড়ের চূড়ায় যদি একটা কাঠ রেখে আসা হয়, আর তার দুই প্রান্তে যদি আমি আর স্মরণ দাঁড়িয়ে থাকি, তাহলে কি হবে বুঝতে পারছো?”

“কি আর হবে, ভারসাম্য হারালে দুজনেই পড়ে যাবি।”

“এক্সেক্টলি আপা, তুই আসলেই ব্রিলিয়ান্ট।”

রূপালী ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো হীরার দিকে। হীরা রূপালীর দিকে ফিরে এবার খুব গম্ভীরমুখে বললো,
“আপা, আমাদের ভালোবাসার গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো। আমরা একে অপরকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছি বলেই আমরা ভালোবাসতে পেরেছি।দূরে থেকেও কিন্তু ভালোবাসা যায়৷ আমরা একই বৃত্তের দুই মেরুর মতো ছিলাম। হয়তো আমাদের বিন্দুটাও একদিন মিলে যেতো। কিন্তু এখন স্মরণ আর আমি সেই কাঠের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি মানুষ৷ আমি তার কাছে আসতে চাইলে সে অতলে হারিয়ে যাবে। আর সে আমার কাছে আসতে চাইলে আমি হারিয়ে যাবো। তাই দূরে থেকেও আমরা ভালো আছি, ভালো থাকবো। আমাদের ভালোবাসার গল্পটা একটু ভিন্ন। আমাদের কাছে আসায় অনেক বাঁধা। অনেক বারণ। তবুও তাকে ভালোবাসি। বরং ভালোবাসতে ভালোবাসি। আর ভালোবেসেই আমি বেঁচে আছি।”

“কিন্তু স্মরণ যা করেছে……”

হীরা রূপালীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“তোমার দৃষ্টিতে স্মরণ যা করেছে সেটা অন্যায়। আমার দৃষ্টিতে তখন অন্যায় হতো যখন আমি ওর দোষগুলোকে গুণের উর্ধ্বে রাখতাম। আপা, আমি ওকে এতো এতো এতো বেশি জেনে ফেলেছি যে, আজ যদি পুরো পৃথিবীর সবাই এক পক্ষ নিয়ে বলে, স্মরণ অন্যায় করেছে, এমনকি সে নিজেও যদি এই কথা বলে, আমি তবুও বলবো, সে যা করেছে একদম ঠিক করেছে। তুমি জানো আপা, আমার ভালোবাসা এখন আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ওকে বড্ড ভালোবাসি আপা। আমি ওকে হারিয়েও কষ্ট পাবো না। ওর সুখস্মৃতিই নিয়ে বেঁচে থাকবো।”

“তোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে, হীরা।”

হীরা দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করতে করতে বললো,
“আমি অনেক আগেই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কাউকে দেখায় নি।”

০৩।

কপালে একটা কালো টিপ লাগিয়ে চুলগুলো বেঁধে ফেললো হীরা। স্মরণের খোলা চুল একদম ভালো লাগে না। এর একটা গুরুতর কারণ আছে। যদিও সেটা স্মরণ কখনোই হীরাকে জানায় নি। হয়তো আজ জানাবে তাই। হ্যাঁ, আজ অনেক কিছুই জানাবে স্মরণ। যা যা আজ হীরাকে জানানোর আছে সবই নিজের মনে গেঁথে ফেলেছে সে। দুই দিন ধরেই সে ভাবছে, হীরাকে এখনো কি কি জানানো বাকী।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্মরণ একটা কালো রঙের পাঞ্জাবী পরলো। তার গায়ের রঙের সাথে পাঞ্জাবিটা একেবারেই মিশে গেছে। কালো রং তার একদমই অপছন্দের। কারণ এই রঙের জন্য সে তার মাকে আর নিজেকে অবহেলিত হতে দেখেছে। আর পাঞ্জাবি বলতে তার দু’টোই আছে। সেটিও কমলা আর টিয়া রঙেরই। ইসলামে হলুদ রঙ ছেলেদের জন্য নিষিদ্ধ, তাই এই রঙের কোনো পাঞ্জাবি আর জামা তার নেই। তবে হীরাকে দিয়েই তার এই রঙের তৃষ্ণা মিটিয়েছে।

হীরার কালো রং খুব পছন্দের। আর বিশেষত পাঞ্জাবী পরা ছেলেদের দিকেই মেয়েটা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। যদিও হীরা কখনোই নিজের পছন্দটা স্মরণের উপর চাপিয়ে দেয় নি। তবুও হীরা মনে মনে চাইতো স্মরণকে একবার নিজের পছন্দের পরিসাজে দেখতে। কিন্তু স্মরণ হীরার সব পছন্দের ব্যাপারে জেনেও কখনোই কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিনে হীরার পছন্দমতো নিজেকে তৈরী করে আসে নি। হয়তো আজকের এই দিনটির জন্য। তবে স্মরণ মাঝে মাঝেই তার পছন্দে হীরাকে সাজার জন্য আবদার করতো। তাহলে হীরা কেন করতো না? হয়তো মেয়েটা অতীতের ধাক্কাগুলো এখনো হজম করতে পারে নি। তাই আবদার শব্দটি থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে তার। তবে হীরা জানে স্মরণ মন থেকেই চায়, হীরা তাকে একটু আবদার করুক। আর হীরাও বুঝে সব। তবুও করে নি। হয়তো আজ একসাথে অনেকগুলো আবদার করবে তাই।

শাড়িটা পরে স্মরণের চিঠিটা হাতে নিলো। পড়তে লাগলো স্মরণের শেষ চিঠি। স্মরণ কি তাহলে আর চিঠি লিখবে না? আর বেশিদিন তো সময় নেই। হয়তো লেখা হবে না। লেখার সময়ও পাবে না। পেলেও হয়তো লিখবে না। কারণ স্মরণ বলেছিলো, এটাই তার শেষ ইচ্ছে। হয়তো তার আরো ইচ্ছে আছে। কিন্তু সব ইচ্ছে পূরণের ক্ষমতা তার নেই। এতোটুকু যে পাচ্ছে এর চেয়ে আর বেশি কি চায়?

রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই চিঠিটা পড়া শেষ করলো। তারপর চিঠিটা ভাঁজ করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখলো। এই চিঠির উত্তর কি দেবে সে জানে না। মনে মনে ভাবছে, স্মরণ হয়তো তাকে দেখলে প্রশ্ন করবে এই চিঠির উত্তর কি? তখন কি বলবে হীরা? সে জানে না। এই মুহূর্তে সে কিছুই জানে না। একটাবার সে শুধু স্মরণকে দেখবে, তারপরই মনটা শান্ত হবে। আরো জোরে জোরে পা চালালো হীরা। রিকশা-গাড়ি কিছুই নেবে না সে। হাঁটলে তার ক্লান্তি আসবে। আর সে স্মরণের সামনে ক্লান্ত বেশেই যাবে।

হীরা একদিন ক্যাম্পাস থেকে ফিরে স্মরণের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। সেদিন অতিরিক্ত গরমে তার মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিলো। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার পুরো মুখটা মুক্তোর মতো চকচক করছিলো। আর স্মরণ তাকে দেখে অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। স্মরণকে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হীরা বলেছিলো,
“কি হলো, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

স্মরণ মুচকি হেসে বলেছিলো,
“কোনো মেয়েকে ঘর্মাক্ত শরীরে, ক্লান্তির বেশে এতো চমৎকার লাগতে পারে সেটা তোমাকে না দেখলে আমার কখনোই জানা হতো না।”

স্মরণের এই একটা কথায় যথেষ্ট ছিল। হীরা এরপর আর কখনই ক্লাস শেষে নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে স্মরণের সামনে যায় নি। সে যেভাবেই ছিল সেভাবেই স্মরণের সাথে দেখা করতে যেতো। তবে বাসা থেকে বের হলে একটু সেজেগুজে বের হতো। তাও আবার কটকটে লাল লিপস্টিক দিয়ে।
স্মরণ থেকে শুনেছে, স্মরণের মা, তসলিমা বেগম কোথাও গেলে লাল লিপস্টিপ দিয়ে নিজেকে সাজাতেন। হীরাও তাই একটা লাল লিপস্টিক সবসময় ব্যাগে রাখতো। গোলাপী ঠোঁট দুটিকে ঘষেমেজে লাল করেই স্মরণের সামনে আসতো।
আর স্মরণ হীরাকে দেখে মনে মনে হাসতো আর বলতো,
“এই মেয়ের প্রেমে পড়তে এতো ভালো লাগে! ইচ্ছে করে এখনই তাকে নদী বানিয়ে দেয়, আর আমি সেই নদীর মাঝি হয়ে যায়। সেই নদীর বুকে আমার লাল রঙের নৌকাটি ভাসবে, আর আমি গান গাইবো। বৈঠা হবে আমার হাত। আর আমি সেই হাত ডুবিয়ে দেবো নদীর জলে। মনে হবে যেন আমি তার চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কি চমৎকার অনুভূতি!”

০৪।

সাজলে যে নারীদের কতোটা রূপবতী লাগে, তা মাকে না দেখলে স্মরণ কখনোই বুঝতে পারতো না। সে অনেক মেয়েকেই সাজসজ্জায় দেখেছিল। কিন্তু সেই টকটকে লাল লিপস্টিকের সাজে কোনো নারীকেই তার ওতোটা সুন্দর মনে হয় নি। আর হীরাকে দেখে সে দ্বিতীয়বার এই সৌন্দর্যের সংকর রূপ দেখেছে। পার্থক্য শুধু এইটুকুই তসলিমা বেগম শ্যাম বর্ণের ছিলেন, আর হীরার গায়ের রঙটা সৃষ্টিকর্তা চাপা হলুদ আর গোলাপীর সংমিশ্রণে তৈরী করেছিলেন। তাই সাধারণের ভীড়ে মেয়েটা অসাধারণ সুন্দরী। শুধু তার মায়ের রূপটা গায়ের রঙের জন্যই ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো। তবুও স্মরণের দৃষ্টিতে একমাত্র তসলিমা বেগমই প্রথম ও শেষ সুন্দরী নারী। কিন্তু সে অবাক হয় এটা ভেবে যে, তার বাবার চোখে তার মায়ের সৌন্দর্যটা ফিকে ছিলো। হয়তো বাবা অন্ধ, হয়তো-বা তিনি ধবধবে ফর্সা মেয়েদের মাঝেই সৌন্দর্য খুঁজে পেয়েছিলেন।
মা যদি আরো কিছুদিন ধৈর্য ধরতেন, তাহলে স্মরণ বাবাকে শিখিয়ে দিতো প্রকৃত সৌন্দর্য মূলত গায়ের রঙ নয়। প্রকৃত সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে মনের গহীনে। যা যে কেউ দেখবে না, এই সৌন্দর্যের মূল্য দিয়ে যে কাছে এগিয়ে যাবে শুধু সে-ই দেখবে।

হীরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো তাদের সেই পরিচিত জায়গাটিতে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো স্মরণ এখনো আসে নি৷ আজ প্রথম হয়তো হীরাই স্মরণের আগে এসেছে। হীরা মনে মনে ভাবছে,
“স্মরণ কি আজ সত্যিই আসতে পারবে? যদি আসতে না পারে? যদি তারা স্মরণের শেষ ইচ্ছেটা অপূর্ণ রেখে দেয়?”

পরক্ষণেই হীরা বললো,
“না, না। কি যা তা ভাবছি। বি পজিটিভ হীরা। স্মরণ আসবে। ওকে আসতেই হবে।”

হীরা নদীর ঘাটের কাছে এসে দাঁড়ালো। ঘাটের সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে পুরো নদীর দৃশ্য একবার দেখে নিলো। এই নদীটিই তার আর স্মরণের প্রেমের সাক্ষী হয়ে আছে। চোখ বন্ধ করতেই স্মৃতির পাতা উঁকি দিতে লাগলো হীরার মনে। তার ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগলো সেই রঙিন দিনের পেছনের ইতিহাসটি। কারণ একটি কালো অধ্যায় এসেই তো তার বর্ণহীন জীবনটাকে রঙিন করে দিয়েছে।

হীরার ভালো নাম হীরা জাবিন। সে উচ্চ মধ্যবিত্ত সমাজেই বাস করে। তার বাবার মৃত্যুর পরও তাদের সংসারে কোনো অভাব ছিলো না। কারণ সঞ্চয় করে চলাটা তারা ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছে। বর্তমানে সে মা আর এক ভাই-এক বোনকে নিয়ে শহরে ভাড়া বাসায় থাকে। হীরার মা, জায়িদা আক্তার, যদিও স্বামীর মৃত্যুর আগে গৃহিণী ছিলেন, কিন্তু এখন বাসার পাশের একটি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। চাকরীটা অবশ্য হীরার মামা খুঁজে দিয়েছিলেন। আর প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে হীরার বাবার আগে থেকেই একটা সম্পর্ক ছিলো। যেহেতু একই এলাকায় থাকতেন, কথাবার্তাও ভালোই হতো তাদের।

হীরার ছোট ভাই মাসুম জাবেদ এবার দশম শ্রেণিতে উঠেছে। আর হীরা জাবিন অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্রী। আর তাদের বড় আপা রূপালী জাবিন তিন বছর আগেই মাস্টার্স শেষ করেছে। বর্তমানে অনলাইন বিজনেস করছে।
একমাত্র রূপালী জাবিনের জন্যই জায়িদা আক্তারের চিন্তার শেষ নেই। কারণ রূপালী শারিরীক প্রতিবন্ধী। প্রায় সাত-আটবছর আগেই তার পায়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে। যার ফলে ডাক্তারের পরামর্শ মতো সেই পা-টি দ্রুত কেটে ফেলে দিতে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়েছিলো, তাই ক্যান্সারটি পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে নি। আর বর্তমানে রূপালী সুস্থ আছে।
এতোটুকুই হীরার পরিবার। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তারা সুখে আছে।

বাবার মৃত্যুর পর হীরা মাকে ভেঙে পড়তে দেখে নি। কিন্তু নিজেই একটা কালো অধ্যায় জীবনে আসায় ভেঙে পড়েছিলো। হীরা জানে তার মা কতোটা ভালোবাসতো তার বাবাকে। কিন্তু তিনি এতোটা শক্ত মনের মানুষ দেখেই হয়তো আজ তিনটা সন্তানকে একা মানুষ করার সাহস দেখিয়েছেন।
হীরা মায়ের কাছ থেকেই শিখেছে কিভাবে শক্ত থাকতে হয়। আর স্মরণকে দেখে সেই শক্ত মনোবল গড়ার চর্চা করেছিলো।

#শেষ_ইচ্ছে
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০১

চলবে—-

(আবার নতুন গল্প নিয়ে এলাম। কেমন লাগলো জানাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here