অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-১৬

0
891

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ১৬

ঘন্টাখানেক শাওয়ার নেওয়ার পর নাকীব এসে দরজায় হুলস্থুল নক করতে লাগলো।
“এ্যাঁই আপু, কি হয়েছে তোমার? আর কতক্ষণ শাওয়ার নিবে?”
“আসছি।” বলে তাড়াহুড়ো করে মুখ ধুয়ে নিলাম যাতে চোখের ফোলা ভাবটা কমে। কাঁদতে কাঁদতে এবং বেশিক্ষণ ভেজায় চোখগুলো ফুলে একেবারে ঢোল হয়ে গেছে।

খানিকক্ষণ সময় নিয়ে তাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হলাম। বের হতেই নাকীবের প্রশ্নবিদ্ধ তীর আমার দিকে তেড়ে এলো। চোখজোড়া বড় করে ও বললো,
“তুমি কাঁদছিলে আপু? কেন?”
“কই? না তো!” অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম।

নাকীব চুপচাপ বসে রইলো। সাধারণত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আগে ও যেভাবে বসে। আমিও ফোলা চোখ লুকাতে চুল মোছায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর নাকীব বললো,
“আপু, বৃষ্টি নামার আগমুহূর্তে কিন্তু আকাশ কালোমেঘে ঢেকে যায়। দীর্ঘক্ষণ ধরে মেঘ গাঢ় হতে হতে ঘন কালো রংয়ে রূপ নেয়। এরপর ঝুম বৃষ্টি নামে। আবার বৃষ্টি যখন থামে তখন আকাশ ধবধবে সাদা হয়ে যায়। বোঝা যায় না যে, একটু আগেও এই আকাশে জমেছিল সহস্র অভিমানের মেঘ। কিন্তু পরিবেশ দেখে ঠিক বোঝা যায় খানিক আগেই ঝুম বৃষ্টি হয়েছিল। তোমার অবস্থাও এখন সেইম আপু।”

বলে নাকীব আমার দিকে তাকালো। আমি এতক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছিলাম। ও তাকাতেই ঝট করে চোখ সরিয়ে নিলাম। ও আবার বললো,
“আমি জানি না তোমার কি হয়েছে। তুমি না জানাতে চাইলে জানতে চাইবোও না। বাট এটুকু জেনে রাখো, পৃথিবীতে আমি সবকিছু সহ্য করতে পারলেও তোমার কান্নাভেজা দৃষ্টি আমার কিছুতেই সহ্য হয় না। তোমার মুখে হাসিটাই মানায়, কান্না বড্ড বেমানান।”

আমি জানি এই মুহুর্তে নাকীব আর কিছু বলবে না। আমি না বলা পর্যন্ত কিছু জানতেও চাইবে না। কিন্তু ওকে এখনই আমি সবকিছু খোলাসা করে বলতে চাই না আবার এসব কিছু থেকে আড়ালেও রাখতে চাই না। কারণ ইতিমধ্যেই ও ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে আমি জানি। তাই আকারে-ইঙ্গিতে বললেই যাতে বোঝা যায় সেভাবেই ওকে বিষয়টা জানাতে হবে।

নাকীব চলে যেতে উদ্যত হলেই আমি বললাম,
“রাফিনের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করিস না। ও যেন যোগাযোগ করতে না পারে তোর সাথে…”
“অকে।” কথা না বাড়িয়ে চলে গেল নাকীব৷

টানা তিনদিন আমি ফোন অফ করে রাখলাম। যদিও জানি রাফিন ফোন দিবে না। বাসা থেকেও বের হইনি একবারও। বাসায় বসে ছোটফুফির দেওয়া সব বই পড়ে শেষ করলাম।

সন্ধ্যায় বাবা-মা রুমে বসেছিলো। নাকীব এসে আমাকে ডেকে নিয়ে এলো বাবার রুমে। আমাকে পাশে বসিয়ে বাবা জানতে চাইলেন,
“তোমাকে বড্ড মনমরা দেখাচ্ছে। সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে বসে থাকো, বাইরে যাও না বেশ ক’দিন। কি হয়েছে তোমার?”

নাকীব আমার পাশেই বসেছিল। ও ফিসফিস করে বললো,
“হৃদয়ে রক্তক্ষরণ!”
আকষ্মিক কেঁপে উঠে ওর দিকে তাকালাম। অথচ ও অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে।

মা বাবাকে বললেন, “তুমি নাকি তোমার মেয়েকে কত ভালোবাসো। তোমার মেয়েও তো ভালোবাসে তোমাকে। তো কি সমস্যা সেটা খুলে বলছে না কেন?”

বাবা বললেন, “মেয়েরা সব কথা বাবাদের বলে না। মায়েরা সন্তানের বন্ধু হতে পারলে তবেই সবকিছু তারা মায়ের সাথে শেয়ার করে। বাবা যতই বন্ধু হোক দিনশেষে কিছু কথা তারা বাবাকে বলতে পারে না। সংকোচ থেকেই যায়। নরমাল বিষয়টাও জানো না?”
“তোমার মেয়ে তো সব কথা তোমাকেই বলে। আমাকে তো আর বলে না।”

“সব কথা বলে। এটাও বলবে যদি বলার মতো হয়। বলতো মা, তোর কি হয়েছে?”

“কিছু না বাবা। এমনি ভালো লাগছে না আমার।” আমি বললাম।
“এমনি ভালো লাগবে না কেন? এমনি এমনি আবার ভালো না লাগতে পারে নাকি?”

নাকীব বললো, “থাক না বাবা, ওকে ওর মতো থাকতে দাও। কয়েকদিন পর ও নিজেই নিজেকে সামলে নিবে। তাছাড়া আমি তো আছিই।”
“তুই চুপ কর। দু’দিনের ছেলে হয়ে তুই কি বুঝবি এসবের?” বাবা বললেন।

মা বললেন, “তুমি আমার ছেলেকে একদম ধমকাবে না তো।”
নাকীব বিরক্ত চোখে তাকালো বাবা-মায়ের দিকে। আমি শান্তস্বরে বললাম,
“বাবা, মা তোমরা তোমাদের ঝগড়াঝাঁটি কি কোনদিন বন্ধ করবে না? এভাবেই তুলকালাম চালিয়ে যাবে আজীবন?”

মা সাথে সাথে বললেন, “ঝগড়া করে তোর বাবা।”
বাবা হাত তুলে মাকে থামালেন। বললেন,
“আমরা তো সবসময় ঝগড়া করি। এটা নিয়ে তো কখনো তোমাদের সমস্যা হয়নি। দরজা বন্ধ করে বসে থেকেছো এমনটা তো কখনো হয়নি। তাছাড়া আমরা ঝগড়া করলে তুমি জিনিস ভাঙ্গো, রাগটা সামনাসামনি উগরে দাও। এভাবে দরজা বন্ধ করে তো কখনো থাকো না। তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?”

“বাবা, সবসময় রাগ উগরে দেই আর কোনো অভিযোগ করি না বলে কিন্তু এই না যে, তোমাদের ঝগড়াঝাঁটি নিয়ে আমাদের কোনো প্রবলেম ফেস করতে হয় না। বরং আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলের কাছে আমরা প্রায়সময় তোমাদের ঝগড়াঝাঁটির জন্য প্রবলেমে পড়ি।” নাকীব বললো।

“তোমরা সবসময় ঝগড়া করো নরমাল কিছু বিষয় নিয়ে। যেটা একজন সেক্রিফাইস করলেই সল্ভ হয়ে যায় সেরকম বিষয়কেও তোমরা টেনে টেনে ঝগড়ার মাধ্যমে লম্বা করে ফেলো। তোমাদের ঝগড়াগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। আনলজিক্যালি ঝগড়া করেই যাও। তোমাদের এসব আনলজিক্যাল ঝগড়ার জন্য আমাদেরকে কতটা প্রবলেম ফেস করতে হয় বোঝোই না তোমরা। সারাক্ষণ তো ঝগড়াই করো। কখনো আমাদের সিচুয়েশন বোঝার ট্রাই করেছো? আমাদের ফ্রেন্ডদের সামনেও ঝগড়া করেছো তোমরা৷ তোমাদের এসব ঝগড়ার জন্য কত কি ফেস করতে হয় আমাদের জানো? জীবনের কত গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোও শুধুমাত্র তোমাদের ঝগড়ার দোহাই দিয়ে জীবন থেকে হারিয়ে যায়। ঝগড়ার সময় আমাদের এই উইক পয়েন্ট ধরে কথা শোনাতে ভোলে না। তোমরা প্লিজ এসব বন্ধ করো, প্লিজ!”

এই পর্যায়ে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। কান্না করে দিলাম। রুমে এসে দরজা আটকে বালিশে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদলাম সারা সন্ধ্যা। রাতে বাবা-মা, নাকীব, ছোটফুফি একে একে সবাই ডিনারের জন্য ডেকে গেলেন। কিছুতেই দরজা খুললাম না। সারারাত বসে বসে কাঁদলাম। কোনোকিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

গভীর রাতে ফোন অন করলাম। অন রেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর চারটার দিকে ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে। সারারাত কান্না করায় চোখগুলো ফুলে আছে ভীষণভাবে। অনেক কষ্টে চোখ না মেলেই ফোন কেটে দিলাম। এত ভোরে কল করার মতো আহামরি কেউ আমার জীবনে নেই। যে আছে তার জন্যই আমার এই ক্রন্দন। চোখ বুজেই ছিলাম। আবার কল আসলো। এবার বেশ বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলাম।
“কি সমস্যা? এত রাতে বারবার ফোন দিচ্ছেন কেন? আর কোনো কাজ নেই? বেকার নাকি? রাতে-বিরেতে কল দিয়ে মেয়েদের ডিস্টার্ব করা। ফালতু লোক!” বলে ফোন কেটে দিলাম।

একটু পর আবার কল এলো। আজব তো! এত অভদ্র কোনো মানুষ হয়? এবার উঠে বসে তারপর রিসিভ করে বললাম,
“কি সমস্যা আপনার? কল কেটে দিচ্ছি তাও কল করেই যাচ্ছেন? কে আপনি?”
“নাম্বারও ডিলিট করে দিয়েছো এরমধ্যেই?”

কন্ঠ শুনে বোবা হয়ে গেলাম আমি। চট করে ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি রাফিনের নাম্বার। আশ্চর্য! আমি এতক্ষণ নাম্বার না দেখেই কথা বলছিলাম? সেন্স কোথায় ছিল আমার?
কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বললাম,
“এত রাতে মানুষ ঘুমে থাকে। ঘুমের ঘোরে ফোন পেলে নিশ্চয়ই মানুষ বিরক্ত হবে। ঘুম ভাঙ্গিয়ে এতরাতে কল করাটা কোনো ভালো মানুষের কাজ না। বেকারদের কাজ।”

রাফিন স্মিত হেসে বললো, ”ইউ মিন, বেকাররা খারাপ মানুষ?”
“না, বেকাররাও ভালো। যারা সারারাত গেইমস খেলে তাদের মাথার স্ক্রু তো কয়েকটা ঢিলে হয়ে যায়। তখন তারা ভাবে অন্যদের স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে। তারা যখন বেকার হয় তখন এরকম উল্টাপাল্টা কাজ করে। তারা সারারাত জেগে থাকে তো তাই ভাবে অন্যরাও জেগে আছে।”

“আরোহী স্টপ ইট! কি প্রবলেম তোমার? এতরাতে ফোন করেছি এটাই প্রবলেম তো? ফাইন, রেখে দিচ্ছি। দিনে কথা হবে।”

“তোমার কথামতো না সব? তুমি বললেই আমাকে তোমার লাইফ থেকে চলে যেতে হবে, তুমি বললেই ফিরে আসতে হবে। আবার তুমি চাইলে রাতে-বিরেতে কল দিতে পারবে, আমি চাইলেই সেন্টিমেন্টাল কাজ-কারবার হয়ে যাবে। তুমি চাইলেই আমাকে যখন তখন ডাকতে পারবে আর আমি বললে কত কাজ থাকে তোমার। খেলো তো সারাদিন গেইমস। কাজের দোহাই দিতে লজ্জা করে না?”

রাফিন ভীষণভাবে ধমকে উঠলো।
“স্টপ ইট আরোহী! হোয়াট’স রং উইথ ইউ?”
“রং শুধু আমি করি, তুমি কিছুই করো না। আসলে কি জানো তো, যাদের বাবার টাকার জোর আছে তারা মানুষকে নিজের কিনে নেওয়া ভাবে। নিজের তো দু’টাকা কামাবার মুরোদ নেই আবার আসে বাপের টাকার জোর দেখাতে। অন্যের বাবা-মাকে নিয়ে যা নয় তাই বলতে।”

“আরোহী, আই সেইড স্টপ। ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট।” দাঁতে দাঁত চেপে বললো ও।
“আমি লিমিটের মধ্যেই আছি।”

“ওকে লিসেন। তোমার সাথে এভাবে কথা বললে হবে না। তুমি আমার সাথে আজই মিট করবে। সকাল সকাল।”

আমি হো হো করে হেসে বললাম,
“রিয়েলি? তুমি এখনো এক্সপেক্ট করো যে আমি তোমার সাথে মিট করবো? মনে আছে লাস্ট ডে কি কি বলেছিলে? এরপরও তোমার মনে হয় আমি তোমার কথায় উঠবো আর বসবো? আমি একা ভালোবেসেছি তো তাই একাই সেক্রিফাইজ করছিলাম এতদিন। তুমি তো কোনদিনও সেক্রিফাইজ করোনি। শুধু অর্ডার করে গিয়েছো, আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনেছি। ব্যাপারটা এমন, তুমি গুরু আমি শিষ্য।”

রাফিন অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর বললো,
“আমি সেদিন রাতেই তোমাকে কন্টাক্ট করার ট্রাই করছি। বাট তোমার ফোন সুইচড অফ। আজ কিভাবে যেন ঢুকে গেল। এতদিন পর ফোনে পেয়ে ভাবলাম…”

“কি ভাবলে? ভাবলে আরেকটু ধমকে নিই। সেদিন কম হয়ে গিয়েছিল। শুধু বাবা-মাকে বলা উচিত হয়নি, চৌদ্দ গুষ্টিকে বলা উচিত ছিল। বলো বলো?”

“আমাকে এক্সপ্লেইন করতে দাও প্লিজ?”
“নো নিড টু ইউর এক্সপ্লেনেশন। আমি ঘুমাবো এখন। রাখছি।”

রাফিন দূর্বল গলায় ডাকলো, “আরোহী!”
আমি খট করে লাইন কেটে দিলাম। আমি নিজেই অবাক এত রুড ব্যবহার করে। জীবনে প্রথম মনে হয় রাফিনের সাথে এত রুডলি কথা বলেছি।

#Be_Continued__In_Sha_Allah ❣️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here