অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৩৯

0
576

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৩৯

“বাড়িতে ঢোকামাত্র কি শুরু করেছো বুবু? এসব নিয়ে পরে আলাপ করা যাবে।” আমার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বললেন মা।
খালামণি আমাদেরকে রুম দেখিয়ে দিলেন। এ’বাড়িতে যথেষ্ট রুম রয়েছে। প্রত্যেকে আলাদা রুমে থাকলেও অনেকগুলো রুম রয়ে যাবে। মান্ধাতা আমলের বিশাল বাড়িটা আমার বেশ পছন্দ হলো। আমার রুম দেখিয়ে দিতে খালামণি তানভীর ভাইয়াকেই পাঠালেন। যদিও তানভীর ভাইয়া আসতে চাননি আমার সাথে। খালামণির এসব বাড়াবাড়ি তানভীর ভাইয়ারও পছন্দ না। এখানে এসে এভাবে ফিতনার জালে আটকা পড়বো ভাবতেই পারিনি৷

সিঁড়ি বেয়ে উঠে তানভীর ভাইয়ার পাশাপাশি হাঁটছি। সিঁড়ির পর লম্বা করিডোরের দু’পাশে একটা করে রুম। অনেক লম্বা করিডোর। ঘর কয়টা আল্লাহ ভালো জানে। তানভীর ভাইয়া মোবাইল টিপতে টিপতে আসছেন আমার সাথে। বলা বাহুল্য, একবারও তাকাননি আমার দিকে। এতক্ষণ যা-ও একটু স্বাভাবিক ছিলাম কিন্তু খালার কথা শোনার পর থেকে অস্বস্তি লাগছে। যার সাথে আমার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই জন্মা-জন্মান্তর থেকে তার সাথে…? বুক ফুঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

“কেমন আছো জেদি?” এতক্ষণে কথা বললেন তানভীর ভাইয়া।
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
কিছুক্ষণ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
“জেদি বললাম রাগ করলে না তো?”
“আমি যেটা না সেটা শুনে রাগ করার কি আছে?”
“অনেক বুঝতে শিখেছো। ভালো।”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন,
“বাট তুমি আসলেই জেদি।”
“আচ্ছা।”

আমার কাটখোট্টা জবাব পেয়ে ভাইয়া আর কোনো কথা বললেন না। রাফিন কথা বলতো এইভাবে। মেজাজ খারাপ থাকলে সব কথার কাট কাট জবাব দিতো। ওর তো বারোমাসি মেজাজ খারাপ। এত জেদ কোথা থেকে পায় কে জানে? তানভীর ভাইয়া আমায় জেদি ডাকে। রাফিনকে দেখলে আমাকে জেদি বলার অপরাধে পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতো। ধুর! এখন আবার রাফিনের কথা ভাবছি কেন? আমার ভাবনায় চড়ে রাফিন এই এতদূরেও চলে এলো? এরকম বাড়ি বড়লোকের ব্যাটা চোখে দেখেছে কিনা কে জানে? সে থাকতে পারবে বিলাসবহুল পুরোনো, জীর্ণশীর্ণ এই রাজপ্রাসাদে? ধুরর! আবার ভাবছি ওর কথা? অসহ্য যন্ত্রণা তো!

“কোন ঘরে থাকবো আমি?”
“এই তো এই রুমটায়, পাশের রুমে নাকীব৷”
”আচ্ছা।”

ভাইয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে ঢুকে গেলাম। পাশের রুমে যদি নাকীবই হয় তাহলে তানভীর ভাইয়াকে আমার সাথে পাঠানোর মানে কি? কতগুলো গুনাহ স্বেচ্ছায় অর্জন করে নেওয়া। যত্তসব! এজন্যই আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। ছোটফুফি থাকলে বেশ ভালো হতো। এসব মাহরাম-গায়রে মাহরাম ছোটফুফিই সবচেয়ে ভালো ম্যানেজ করতে পারে৷ দুনিয়ার এক কোণায় এসে আমার শহরের সব মানুষের কথা মনে হতে লাগলো।
ভাইয়া রুমের বাইরে থেকে বললেন,
“কিছু লাগলে মাকে বলো হৃদি।” বলেই চলে গেলেন।

খাবার টেবিলে গিয়ে হলো আরেক জ্বালা। আমাকে আর তানভীর ভাইয়াকে পাশাপাশি চেয়ার ছাড়া বসতে দিবেন না খালা। নাকীবটাও যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে? ওকে নিয়ে ওসব ভাবা একদম উচিত হয়নি। একবার কাছে পেলেই আদর করে দিবো। উফ! আমার আদরের ভাইটা। চোখের একদম কাছ ঘেঁষে হঠাৎ কারো মুখ দেখে ‘আহ!’ করে চেঁচিয়ে পেছনে সরে আসতেই নাকীব বললো,
“আদর করবে ভাবছিলে তো তাই গাল বাড়িয়ে দিয়েছি।”
ঠোঁট গোল করে বড় একটা শ্বাস ছেড়ে আস্তে করে বললাম, “ওহ।”
“আদর করে দাও, বাকিটা আমি ম্যানেজ করছি।”

এত ন্যাকা… ভাবতে গিয়ে ভাবনা স্টপ করে ওকে গাল টেনে দিয়ে মুচকি হাসলাম। বুঝলাম না, আমি কি ভাবি সেটা ও কিভাবে জানে? এমন কেন হয়? জ্বিন আছে নাকি সাথে?
“যেটা ভাবতে গিয়েছিলে সেটা ভুলেও আর ভেবো না। এতক্ষণ যা খারাপ ঘটেছে তারচেয়েও খারাপ কিছু ঘটবে আমি পাশে না থাকলে। সো, বি কেয়ারফুল।”
“অকে, অকে ব্রো।”

নাকীব আমার হাত ধরে বললো,
“আপু পাশে না থাকলে আমি ভাত খেতে পারি না। আর আপুই আমাকে সবসময় খাইয়ে দেয়। আজকেও আপুর হাত ছাড়া খেতে পারবো না।”
মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই বাবা বলে বসলেন,
“তাই তো, তাই তো!”
“আমরা নাহয় ভাত নিয়ে রুমে চলে যাই। আপুর তো সবার সামনে আমাকে খাওয়াতে লজ্জা লাগবে তাই না?”

আমি উপর-নিচ মাথা নাড়ালাম। অগত্যা খালামণি আমাদের খাবার রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। উফ! বাঁচা গেল। একটা ভাই যে আল্লাহর কতবড় নেয়ামত হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
“শুকরিয়া আপু।” খেতে খেতে বললো নাকীব।
“কেন?”
“আমি যে আল্লাহর বড় নেয়ামত এটা বুঝতে পারার জন্য।”
“উফ! কিভাবে পড়িস মন?”
“তোমার চোখ দেখলেই সব পড়া যায়৷ এত বোকা বোকা চেহারা তোমার। এখানে এসে আরও বেশি বুঝতে পারছি।”
“ভীষণ ফাযিল তুই। বাই দ্যা ওয়ে, তানভীর ভাইয়ার সাথে আমার.. মানে এসব কি? এসবের সাথে কি কোনোভাবে তুইও জড়িত?”
“ট্রাস্ট মি আপু, তোমাকে রাফিন ভাইয়ার সাথে ছাড়া কারো সাথে কখনো ভাবিওনি আমি। তখন মায়ের মুখ দেখে মনে হচ্ছিলো খালামণির বাড়ি যাওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। শুধু সুযোগ খুঁজছিলো কথাটা কিভাবে বলা যায়। দেখলে না আমি বলামাত্র কিভাবে কথাটা লুফে নিলো?”
“তাও ঠিক।”
“তাছাড়া আমিও তো আসতে চাইনি।”
“তুই যদি সবটা আগেই বুঝে যাস তাহলে মায়ের এই মতলবটা বুঝলি না কেন?”
“আমি সব বুঝি না আপু। আমি শুধু তোমার হাবভাব দেখে তোমার মনের কথাটা বুঝে যাই। চিন্তা করার সময় তোমার এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে যায়। চিন্তার সাথে খাপে খাপ মিলে যায় চেহারার ভাব। আর তাছাড়া তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে যে কেউ তোমার মনের কথা বলে দিতে পারবে, যারা তোমাকে বুঝে আর কি! তুমি কোনোকিছু চেপে রাখতে চাইলেও তোমার চোখমুখে সেই আভাস ফুটে উঠে। বুঝলে এখন?”
“হু।” দূর্বল গলায় বললাম।

বিকেলে আমাদের তিনজনকে বাইরে যেতে বললেন খালামণি৷ মাথা ব্যাথার অযুহাতে বাড়িতে রয়ে গেলাম একাই। তানভীর ভাইয়া ও নাকীব একসাথে বেরিয়ে গেল। খালামণি, খালু এবং আঙ্কেল (খালুর বড় ভাই) মা-বাবাকে নিয়ে কোথায় যেন বেরুলেন। এই ফাঁকে আমি ডায়েরি নিয়ে বসলাম। হাতে অফুরন্ত সময়৷ আজ পুরো দুটো অধ্যায় শেষ না করার আগে উঠছি না ইন শা আল্লাহ। ডায়েরিটা যত দ্রুত সম্ভব শেষ করে রেখে দিতে হবে। এক ডায়েরি নিয়ে নষ্ট করার মতো এত সময় নেই আমার৷।

“ভালোবাসার আরেক নাম অসহায়ত্ব” অধ্যায়ের অর্ধেকাংশ পড়েছিলাম।
“রাতে আরেকবার চেষ্টা করলাম প্রেয়সীর সাথে যোগাযোগ করার। শেষরাতের দিকে হলোও যোগাযোগ। এতদিন ফোন বন্ধ ছিল। হুট করে কল ঢুকে গেল। কিন্তু কল রিসিভ না হয়ে কেটে গেল। আবার কল দিলাম। এবার তার বেশ বিরক্তিকর কন্ঠস্বর শোনা গেল। বিরক্তিতে একগাদা কথা শুনিয়ে ফোন কেটে দিলো। আমি আবার কল করলাম। এবারও রিসিভ করে গালমন্দ করছিলো। আমার কন্ঠ শুনে হঠাৎ যেন থেমে গেল সে। সেই রাতে প্রথমবারের মতো সে ভীষণ বাজে ব্যবহার করেছে আমার সাথে। যেটা আমি সবসময় তার সাথে করে এসছি এতদিন যাবৎ ঠিক সেই ব্যবহারটা সে সেই রাতে করলো আমার সাথে। ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আমি, ভীষণ। কষ্টও পেয়েছি সীমাহীন। সে নিজের মতো আমার প্রত্যেকটা কথার কাটকাট জবাব দিয়ে ফোন কেটে দিয়েছিলো। আমার কোনো কথা শোনার প্রয়োজন অব্দি মনে করেনি৷ কি যে অসহায় লাগছিলো আমার বলে বোঝাতে পারবো না। তাকে বলেছিলাম পরদিন যেন দেখা করে আমার সাথে। সে কিছুতেই রাজি হলো না। সকালে আবার কি যেন ভেবে টেক্সট করলো যে বিকেলে মিট করবে। আমিও কাশবনে বসে আছি তার অপেক্ষায়। সে এলো। আবার বিজনেস, বিয়ে, ক্যারিয়ার এসব নিয়ে কথা তুললো। ফলাফল হলো ভয়াবহ। আবার তুমুল ঝগড়া হলো আমাদের। তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বললো। ওকে কিভাবে বোঝাই এই সময়ে আমার বিয়ে কিভাবে সম্ভব? বাবা কখনোই মেনে নিবে না। এই সমাজে যিনা করা সহজ; বৈধ উপায়ে বিয়ে অসম্ভব। এসব কি ও বোঝে না? ও তো আমাকেও বোঝে না। একবারও চেষ্টা করেছে আমার সিচুয়েশন বোঝার? রাগে, ক্ষোভে বললাম, যাও বিয়ে করে নাও। মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ করে সিদ্ধান্ত নিলাম যা হওয়ার হোক, ওকে আমার জীবনের সাথে আটকে রেখে কোনো লাভ নেই। বাবার মতিগতির কোনো ঠিক নেই। আদৌ আমার ব্যবসায় সফল হওয়ার পরও ওকে মেনে নিবে কিনা আমার জানা নেই। ওর প্রত্যেকটা কথার জবাব দিয়েছি রাগের সহিত। ওকে বললাম, আমার পক্ষে কখনো সম্ভব না কোনো মেয়ের বাবার কাছে গিয়ে হাত পাতা। বরং মেয়ের বাবা আসবে আমার কাছে। এসব বলেছিলাম মূলত ও আমায় ভুল বুঝে সরে যাওয়ার জন্য। এত অনিশ্চিত জীবনের সাথে ওকে আমি কিছুতেই জড়িয়ে রাখতে চাইছিলাম না। ও আমাকে ভুল বুঝলোও। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলেছিলো,

“কত যে যোগ্যতা তোমার জানা আছে। শত শত মেয়ের বাবারা আসবে তোমার কাছে সেই আশায় বসে আছো। এদিকে আরেকজন মেয়ে যে তোমার অপেক্ষায়, তোমাকে পাওয়ার জন্য বসে আছে তাকে পায়ে ছুঁড়ে ফেলছো। এতই যদি যোগ্যতা থাকতো তাহলে এখনই সেটা প্রমাণ করতে। তুমি না যাও, অন্তত তোমার যোগ্যতা দেখে বাবাকে তো তোমার কাছে পাঠাতে পারতাম। এখন কি যোগ্যতা আছে তোমার? কি দেখিয়ে আমি বাবাকে পাঠাবো?”
“পাঠিও না। পাঠাতে বলছে কে? আফটারঅল, আমি বিয়ে করবো সেটাইবা তোমায় কে বললো?”
“তাহলে আমাদের সম্পর্কের মানে কি?”
“কোনো মানে নেই। আমরা জাস্ট বন্ধু।”
“হোয়াট? এতদিন পর তুমি এটা বলছো?”
“আগেও বলেছি। তুমি কানে তোলোনি। কেন আগে বলিনি, তুমি বরং রিলেশনটা ব্রেক করে দাও? পরে আবার আমার কাছে এই সময়গুলো ফেরত চাইলে আমি কি দিবো তোমাকে? বলিনি বলো?”

সে আর কোনো কথা না বলে চলে গেল। নিজেকে কি ভীষণ অসহায় লাগছিলো বোঝাই কি করে? ওকে কতটা ভালোবাসি তা তো আমার চেয়ে বেশি ভালো আর কেউ জানে না। যদি বৃদ্ধ বয়সেও আমার সুযোগ হয় ওকে বিয়ে করার, কাছে পাওয়ার তবে আমি তাই করবো। তবে আজ শুধু ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই। ও আমাকে একটুও বুঝলো না সেটাই আমার কাছে আফসোসের। এতদিন সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার পরও ও ভাবছে, আমাদের ভালোবাসা একতরফা। ও একাই শুধু আমায় ভালোবাসে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছে কখনো? আমার চোখে তো ওর জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা বিরাজমান। ওকে যদি সত্যিটা বলতাম, যদি জানাতাম আমার সিচুয়েশন ও আমার জন্য অপেক্ষা করতো। ওর জীবনটা তখন অনেক কঠিন হয়ে যেত। ও না জানলেও আমি জানি ও আমাকে কতটা ভালোবাসে। আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না এ-ও জানি। কিন্তু সেটা না করে ওকে ভুল বোঝার সুযোগ করে দিলাম। ভুল বুঝলোও আমায়৷ আমার উদ্দেশ্য সফল। বুক ভাঙ্গা কষ্ট নিয়ে, চোখ ভরা জল নিয়ে ঠাঁই বসে রইলাম কাশবনে।”

কি ভুলটাই না বুঝেছিলাম রাফিনকে। ভাবতেই শিউরে উঠছি। শুধুমাত্র আমি ভালো থাকার জন্য ও এতকিছু করেছে? অথচ ওকে আমি এতদিন ধরে ভুলই বুঝে আসছি। কেন এত চাপা স্বভাব ছেলেটার?

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here