অগত্যা তুলকালাম।’পর্ব-৪৩

0
597

#অগত্যা_তুলকালাম
নাফীছাহ ইফফাত

পর্ব ৪৩

প্রাণহীন, নির্জন এই প্রাসাদে সময় একেবারেই কাটছে না আমার। ঘরের বাইরে যাওয়ার জো নেই। দিন কেটে যাচ্ছে ভীষণ বিরক্তিতে। দিনরাত জানালার কাছে বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। পশ্চিমের জানালা দিয়ে রোজ সূর্যাস্ত দেখি। রুমের বাহিরের লম্বা করিডোর। কিছুদূর গিয়ে পূর্বদিকে মোড় নিয়ে করিডোর শেষ হয়েছে। করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা রুম। শেষ রুমটা তালাবদ্ধ। করিডোরের শেষ প্রান্তে গিয়ে জানালা দিয়ে তাকালে সূর্যোদয় দেখা যায় ভীষণ সাবলীলভাবে।

এশার নামাজ শেষ করে লম্বা সময় কাটাতে ডায়েরি নিয়ে বসলাম। পশ্চিমের জানালার ধারেই বসেছি। মৃদু আলোর একটা লাইট জ্বলছে ডায়েরির সামনে।

“প্রাণহীন স্মৃতি”

“যতই প্রেয়সী দূরে যেতে লাগলো ততই ওর স্মৃতিরা এসে আমায় আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে থাকলো। দিন পেরুলো, রাত পেরুলো, সপ্তাহ পেরিয়ে মাস শেষ হলো। ওর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। কাশবনের গহীনে রেললাইনে বসে নিজের মনে আবৃত্তি করি আজকাল। ফেসবুকে আগে চোখের সামনে ঘুরঘুর করতো হাজার কবিতা, কখনো পড়তাম না৷ আজকাল দেখি সব কবিতাই মিলে যায় আমার ভেতরের অন্য এক আমি’র সাথে। আজও একটা কবিতা পেয়েছিলাম “অদেখার অসুখ।” আসলেই আমাকে অদেখার অসুখে পেয়েছে। বড্ড অসুখ। তাকে না দেখার অসুখ। কবিতাটা এমন—

এইযে এতগুলো দিন গত হয়ে গেল
আমি আপনাকে দেখি না,
আপনি দেখেন না আমায়!
আমার কিন্তু খুব পোড়ে, পুড়ে যায়।

রাত শেষে ভোর এলে—
আমার ইচ্ছে করে সকালের সাথে সাথে
আপনাকেও দেখতে, প্রিয় নাম ধরে ডাকতে।

সন্ধ্যা হলেই মনে হয়;
নীড়ে ফেরা পাখির মতোন
আপনিও ফিরে আসুন।
অদেখার অসুখে ভুগতে থাকা
আমার আমিটাকে সারিয়ে তুলুন।

আপনার ওখানে কি
রাত শেষে সকাল আসে না?
আঁধার কেটে গিয়ে ভোর হাসে না?
সকালের সাথে সাথে আপনারও কি
আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?
সন্ধ্যা পাখির নীড়ে ফেরা দেখে—
আপনারও কি ইচ্ছে করে না;
আমার কাছে ফিরে আসতে? [১]

আমি মৃদু হেসে মনে মনে বললাম, “আমার কখনোই ইচ্ছে করে না আপনার কাছে ফিরতে৷ আপনাকে হারিয়ে আমি আল্লাহকে পেয়েছি। আল্লাহকে আর হারাতে চাই না। যখন সময় ছিল তখন আপনি আমায় সত্যিটা জাননানি, জানাননি আপনার অপারগতার কথা। সেটা আমার ভুল নয়, আপনার ভুল। সেই ভুলের দায় আমি কখনোই নেবো না। সকাল হলে আমার আর আপনাকে দেখার ইচ্ছে জাগে না, সকাল হতেই এখন মেসেজ চেক করি না, সকাল হলেই এখন আর ফেসবুকে আপনার প্রোফাইলে ঢু মারি না। এসব বদঅভ্যাস আমি ত্যাগ করেছি বহুবছর আগে। এখন আমার সকাল হয় স্নিগ্ধ ভালোলাগায়৷ রাতভর আমার প্রিয় রবের সাথে কথোপকথনের পর আমার মনটা অন্যরকম বিশুদ্ধতায় ছেঁয়ে যায়৷ তখন আর আপনার সাথে কাটানো অবৈধ মুহুর্তগুলো মনে আসতে চায় না। তবে হ্যাঁ, আপনাকে একেবারেই মনে পড়ে না বললে ভুল হবে। আপনাকে আমার মনে পড়ে মধ্যরাতে। যখন আমি আল্লাহর সাথে কথা বলি তখন আপনাকেও স্মরণ করি। স্মরণ করে অবৈধ সেই মেলামেশার জন্য পরম করুণাময়ের কাছে পানাহ চাই। আর চাই আপনার জন্য হেদায়েত। আপনাকে যেন আল্লাহ হেদায়েত দান করে একজন পরিপূর্ণ মুসলিমরূপে কবুল করেন তাঁর দরবারে। এরবেশি কিছু আপনাকে নিয়ে আমার ভাবা হয় না আর।
কথাগুলো চট করে একটা কাগজে টুকে নিয়ে ডায়েরির ভাঁজে রেখে দিলাম। বাসায় গিয়ে সরিয়ে ফেলা যাবে।

ডায়েরিতে মনোযোগ দিলাম আবার।

“বড় আপ্পিকে আগেই ওর কথা জানিয়েছিলাম। সম্পর্কের শেষ দিন যখন বলেছি, ও হারাম সম্পর্কের ইতি চায় তখন বড় আপ্পি বললো, যে যেমন থাকতে চায় তাকে তেমনই থাকতে দেওয়া উচিত। তাই আমিও ওর মতের বিরুদ্ধে যাইনি। আল্লাহর ওপর ভরসা করে ওর হাত ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানি না কখনো পাবো কিনা। বড্ড ভয় হচ্ছে।

ও আমার কাছে নেই। কখনো আমার বাড়িতেও আসেনি। কিন্তু আমার বাড়িভর্তি ওর স্মৃতি। ওর সাথে যেখানে যেখানে ফোনে কথা হয়েছে সেখানে গেলেই আমার ওকে মনে পড়ে বুক ভেঙ্গে আসে। ইদানিং রাতে বারান্দায় যেতে পারি না। ওখানে বসেই যে প্রায় রাতে আমাদের কথা হতো। একটা বাস হর্ণ বাজিয়ে গেলে পর্যন্ত আমার ওকে মনে পড়ে। আমরা যখন রাতে কথা বলতাম তখন দূর থেকে বাস ও গাড়ির আওয়াজ আসতো। মাঝেমধ্যে রেল যাওয়া-আসা করতো হুইসেল বাজিয়ে। স্মৃতিতে সেসব গেঁথে গেছে, চাইলেও ভুলতে পারি না। সম্পর্কের শুরুতে কত স্বপ্ন বুনেছিলাম। এমনও একটা দিন ছিল আমার মনে আছে, আমরা রাত দুটোর সময় কথা বলছিলাম ফোনে। হঠাৎ দূর থেকে রেলের হুইসেল শোনা গেল। আমি বললাম, চলো আমরা দুজন রেলের ছাদে উঠে পড়ি। শুধু আমরা দুজন আর কেউ না৷ ফোনের ওপাশে ও লজ্জায় লাল হচ্ছিল আমি বুঝতে পেরেছিলাম। সেই স্মৃতিটা আমার বুকে, ব্রেইনে এমনভাবে গেঁথে গেল যে ইদানিং রেলের হুইসেলের শব্দ কানে আসলেই আমি ধড়ফড় করে উঠি। হাত দিয়ে কান চেপে রাখি। এত অসহ্য ব্যাথা কেন?

আজকাল বারান্দায় গেলেই শুধু সেসব স্মৃতি মনে পড়ে। আফসোসও হয়, কেন ওর সাথে বাড়াবাড়ি করতে গেলাম? খুব কড়া শাসনে রাখতে গিয়েছিলাম কেন? অন্যদের মতো প্রেম করে না বেড়ালেও একটু তো ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারতাম। অতটা বাড়াবাড়ি না করলে হয়তো আমাকে ছেড়ে যেতে ওর অনেকখানি কষ্ট হতো। হয়তো ছেড়েই যেতো না। আবার মনে হয়, ও তো আল্লাহর জন্য ছেড়েছে আমাকে। যদি আমাদের ভালোবাসা সৎ হয় আল্লাহ নিশ্চয়ই মঙ্গলজনক কিছুই ঘটাবে আমাদের জীবনে। ওকে এখন রবের কাছে চাওয়া ছাড়া আর কোনো অপশন আমার কাছে খোলা নেই। মেসেজ দিয়েছিলাম, সিনও করেনি। কতদিন ফেসবুক মেসেঞ্জারে ঢোকে না কে জানে? আইডিটাও মৃতপ্রায়। আমাকে কি একটুও মনে পড়ে না ওর? নাকি আমাকে ভুলতেই ফেসবুকে আসে না? আগে তো রোজ একটিভ থাকতো। আমাকেই জোর করে অফলাইনে যেতে বাধ্য করতে হতো। ওহ, ও তো এখন আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়েছে। হয়তো ইবাদত-বন্দেগিতেই ভালো আছে।

ওকে যেসব সাইকোলজিক্যাল কাজ করতে বারণ করতাম সেসব না চাইতেই আমি করে ফেলছি। কি আজব দুনিয়া। ভেবেছিলাম ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। অথচ আমিই পারছি না, ও দিব্যি ভালো আছে আমাকে ছাড়া।

প্রিয়তমা একসময় আমায় একটা কবিতা শুনিয়েছিলো। তখন তেমন পাত্তা দিইনি৷ কারণ তার অজান্তে তখনও আমি তাকে গভীরভাবে ভালোবাসতাম কিন্তু বুঝতে দিইনি কখনো। কবিতাটা মেসেজেও লিখে পাঠিয়েছিলো সে। পুরোনো কনভারসেশন ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ কবিতাটা চোখে পড়লো। যেটা আজকের আমি’র সাথে সম্পূর্ণ মিলে যায়। কবিতাটার নাম ‘পালাবদল’।

তারপর আপনার অবসরে দেখবেন;
ব্যস্ততায় ডুবে গেছে সে!
এখন যেমন আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকে,
এমন করে আপনিও তখন অপেক্ষা করবেন।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস
এইভাবে বছর কেটে যাবে।
আপনাদের কথা হবে না।

প্রথম প্রথম অপেক্ষারা অভিমান হবে।
তারপর উপেক্ষা, তারপর অভিযোগ।
একটা সময় হয়তো অপেক্ষা করতেই ভুলে যাবে।
ভুলে যাবে পরিচিত ‘হ্যালো’ বলার শব্দটাও।

হঠাৎ কালেভদ্রে ফোন এলে,
ওপাশ থেকে সালাম দিলে—
কিংবা উত্তরে হ্যাঁ এর জায়গায় ‘হ’ বললে
অতীতের অদৃশ্য সুতায় টান পড়বে।
কিন্তু ততদিনে যুগ পেরিয়ে যাবে,
পেরিয়ে যাবে সময়ের ব্যাপ্তিকাল।

আপনার তখন—
কিছুই মনে পড়বে না।
হয়তো তারও! [২]

আজ আসলেই সময় পেরিয়ে গেছে। সময় থাকতে তার কাছে আমি ভালোবাসার কথা প্রকাশ করিনি৷ নিজেকে আজ এই ভেবে স্বান্তনা দিই যে, সে তো আল্লাহর জন্য আমায় ছেড়েছে। কালেভদ্রে কখনোই আর আমাদের কথা হবে না৷ যে দুনিয়া ছেড়ে আল্লাহকে সত্যিকারের ভালোবাসে সে আর আল্লাহকে ভুলে দুনিয়াকে ভালোবাসতে পারে না৷ যে আল্লাহকে ভুলতে পারে সে পুরো দুনিয়াকে ঠকাতেও পারে৷ তার আমাকে ভোলা কোনো ব্যাপার না। কেউ যদি আল্লাহকে ভুলে আল্লাহর সৃষ্টির কাছে আসে তাহলে সেই সৃষ্টিকেও সে স্বার্থে আঘাত লাগলে ভুলতে দেরী করবে না। এসব আমার কথা না। আমার প্রেয়সী একটা সময় বলেছিলো আমায়।

একদিন এই তীক্ষ্ণ ব্যাথা-বেদনা আর সইতে না পেরে ওকে ফোন দিয়ে বসলাম। ভাবলাম যে, আমার লুকানো সব কথা বলে দিবো অনায়াসে। ও আর ভুলের মাঝে না থাকুক। জানুক, আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। ভালোবেসে পাগল হয়ে যাচ্ছি আমি। প্রথমে অনেকক্ষন রিং হওয়ার পরও ফোন রিসিভ হলো না। একদম শেষ মুহুর্তে, লাইন কেটে যাবে এমন মুহুর্তে ফোনটা রিসিভ হলো। আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললাম। একদম বোবাবনে গেলাম। অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কবে সে কথা বলবে। কিন্তু সে আগে একটা কথাও বললো না। আমিই প্রথমে সালাম দিলাম। তারপর তার কাঁপা কন্ঠ শোনা গেল। গলা যেন জমে বসে গেছে। প্রথমে খুব আনন্দ হলো এই ভেবে যে, সে এতদিন পর আমার ফােন পেয়ে উত্তেজনায় কাঁপছে। পরমুহুর্তেই মনে পড়লো, সে আল্লাহর ভয়ে কাঁপছে। সেদিন আমি ষোলো মিনিট কথা বলেছিলাম। হ্যাঁ, ষোলো মিনিট আমি একাই কথা বলেছি। সে শুধু চুপচাপ শুনেছে। মাঝে শুনছে কিনা জিজ্ঞেস করায় শুধু হু, হা করছিলো। দাঁতের ব্যাথায় তখন আমার নাজেহাল অবস্থা। আমি সেসব কথা ওকে বলেছিলাম। অথচ ওর কোনো ভাবান্তর নেই। আগে আমি অসুস্থ জানলে ছটফট করতো, কবে ভালো হবো সেই নিয়ে টেনশন করতো, সময়ে সময়ে ঔষধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতো। অথচ আজ যেন শুনেও শুনছে না কিছুই।

শেষে বললাম, “তুমি আমার ওপর রাগ করে নেই তো?” ও বললো, “রাগ করার তো কোনো কারণ নেই।” সব শর্টকাট জবাব। তারপর থেকে আর কোনোদিন আমি ওকে কল দিইনি। ভালোই একটা শিক্ষা হয়েছে আমার।”

ডায়েরি বন্ধ করে রুমে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা আলোটাও নিভিয়ে দিলাম। ডায়েরিটায় আর মন বসছে না। একদমই পড়তে ইচ্ছে করছে না আমার৷ পড়ছি কয়েকটা কারণে। প্রথমত, ডায়েরিটায় আর মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠা বাকি। এতদূর পড়ার পর সেগুলো না পড়ায় কোনো ফায়দা নেই। বরং পুরোটা পড়ে নেওয়াই উচিত আমার মনে হয়। দ্বিতীয়ত, গতকাল পৃষ্ঠা উল্টাতে গিয়ে শেষ পেইজে অসম্পূর্ণ একটা লেখা পেয়েছি। লিখতে গিয়ে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়লে বা ভয় পেলে যখন কলম নড়ে গিয়ে খাতায় লম্বা দাগ পড়ে যায় সেরকমই লম্বা একটা দাগ ঐ লেখাটার শেষে। এরপর আর কোনো লেখা নেই। আমি ধাপে ধাপে পড়ে সেই অসম্পূর্ণ লেখাটায় যেতে চাই। আর আমার স্মৃতি কিভাবে শেষ হলো তাও জানার আছে। এছাড়া ডায়েরিটার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। অবৈধ পুরোনো স্মৃতিকে চাঙ্গা করে কোনো লাভ নেই।

রেফারেন্স:
[১] কবিতা: অদেখার অসুখ। লেখা: সালমান হাবীব
[২] কবিতা : পালাবদল। লেখা: সালমান হাবীব

#Be_Continued_In_Sha_Allah 🥀

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here