তিতির পাখির বাসা পর্ব-৬

0
584

#তিতির_পাখির_বাসা(পর্ব-৬)
#জয়া_চক্রবর্তী

‘চা-কফি’,’ডিম-পাউরুটি’ করে হাঁক দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক ফেরীওয়ালা।ওদের হাঁকডাকে অনেকক্ষন আগেই ঘুমটা কেঁচিয়ে গেছে তিতিরের।তবু আরো একটু ঘুমের আশায় নিজেকে কম্বলের ওমে মুড়িয়ে নিলো তিতির।

নীচে বেশ জমাটি আড্ডার আমেজ,সুদর্শনেরও গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।ওদের কথাবার্তায় বুঝলো,এই কামরায় আরো একটি হানিমুন কাপল আছে,যাদের বিয়ের তারিখ আর হানিমুন প্লেস তিতিরদের সাথে মিলে গেছে।
তিতির একটু ঝুঁকে পরে ওদের মুখ গুলি দেখে নেওয়ার চেষ্টা করলো।দেখলো দুটো ছিপছিপে ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে অনর্গল কথা বলে চলেছে।

আরো দেখলো মেয়েটি কারনে-অকারনে হেসে লুটিয়ে পরছে ছেলেটির গায়ে।মাথার চুল ঘেঁটে দিচ্ছে,ছেলেটিও বেশ উপভোগ করছে বিষয়টি।হয়তো বহুদিনের প্রেম পরিণতি পেয়েছে।
আড়মোড়া ভেঙে তিতির উল্টো দিকে ফিরে শুলো,ঘুমিয়েও পরলো একসময়।

ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁইছুঁই,তাই আর তিতিরকে না ডেকে পারলোনা সুদর্শন।মেয়েটা কাল রাতে সেই যে একটা পরোটা খেয়ে ঘুমোচ্ছে,এখনো দাঁতে একটা দানা কাটেনি।এতোক্ষন খালি পেটে থাকাটা ঠিক নয়।

দ্বিরাগমন থেকে ফেরবার সময় শ্বশুরমশাই হাত দুটো ধরে বলেছিলেন,’ছোট থেকেই বড্ড খাওয়া নিয়ে জ্বালায় মেয়েটা,দেখো যেন খাওয়া-দাওয়াটা ঠিক মতোন করে’।সুদর্শন ওনার হাতে আলতো চাপ দিয়ে আশ্বস্ত করেছিলো যে ও বিষয়টা অবশ্যই খেয়াল রাখবে।
কিন্তু যৌথ পরিবারে এমন কাজ করা যে কঠিন সেটা অচিরেই বুঝে গিয়েছিলো সুদর্শন।একদিনতো কাকিমুনি বলেই বসলো,’আমাদেরও নতুন বিয়ে হয়েছিলো,তোমার কাকাই, বাবা কিন্তু কখনোই আমাদের খাওয়া নিয়ে এমন আদিখ্যেতা দেখায়নি’।
সুদর্শন কি করতে পারে ওর কাকাই,বাবা যদি কেয়ারিং না হয়!!তাছাড়া সময়ে তিতির খেয়েছে কিনা শুধু এটা জানতে চাওয়ায়,কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে?

তিতির বাঙ্ক থেকে নেমে ঘুম চোখে তাকালো।
সুদর্শন কফি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,চুমুক দিয়ে নাও,ঘুমটা কেটে যাবে।পাশের মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো,’সেকি ঘুম কাটেনি এখনো?ট্রেনে এতো ঘুমোনো যায়?আমার তো ট্রেনের আওয়াজ,আর হকারদের জ্বালায় ঘুমই আসেনা’।

তিতির ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,’ আমিও উঠেছিলাম,কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পরেছি,আমার নাম তিতির,তোমার?’
মেয়েটি হেসে বললো,’আমার নাম দিয়া,আর ও হলো অচিন্ত্য’।ছেলেটি হাত নাড়ালো তিতিরের দিকে তাকিয়ে।তিতির মিষ্টি হেসে এক চুমুকে কফি শেষ করে বললো,ফ্রেস হয়ে আসছি।

তিতিরের স্বাভাবিক আচরনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো সুদর্শন।ফ্রেশ হয়ে তিতির এসে পাশে বসতেই দিয়া বলে উঠলো,’তিতির তো পাখি,ধরে না রাখলে কিন্তু ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে’।
ভারি দুষ্টু মেয়ে তো😃।মজা পেয়ে সুদর্শন তিতিরের নরম হাতটা নিজের মুঠোয় ভরে নিলো।
তিতির ছাড়িয়ে নিতে চাইলো।
কিন্তু সুদর্শনের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়াতে পারলোনা।দিয়ার দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বলে উঠলো ,’উড়ে যেতে দিলে তো,এ পাখি মনের খাঁচায় রাখা’।

তিতির প্রসঙ্গ ঘোরাতে দিয়াকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোথায় থাকো?’
এই একটা প্রশ্নের উত্তরে দিয়া অনেক খবর একসাথে দিয়ে দিলো,যেমন ও বালিগঞ্জের মেয়ে,বিয়ে হয়েছে দমদম,ওরা দুই বোন,আগামী বছর ও পার্ট-টু তে বসবে।ওর বিষয় হলো ইতিহাস।
অচিন্ত্যর মা নাকি দিয়াকে কোন এক বিয়েবাড়িতে দেখে পছন্দ করেছে সে কথাও জানালো।তার মানে,সম্বন্ধ করে বিয়ে। তিতির একটু অবাকই হলো।

তিতির বললো,’বাহ ইতিহাস নিয়ে পড়ছো যখন,তখন তোমার এলেম আছে বলতে হবে,আমার আবার সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় হলো ইতিহাস,খুবই কঠিন।আমি পড়েছি জিওগ্রাফি নিয়ে’।

হঠাৎ অচিন্ত্য বিজ্ঞের মতো মুখ করে বলে উঠলো, ‘ইতিহাস আবার কি এমন কঠিন?ঘ্যানঘ্যান করে শুধু মুখস্থ করো আর খাতায় বমি করে দাও,আর মুখস্থ না হলেও চাপ নেই,উত্তরের প্রথম আর শেষ দিকটা মুখস্থ করে মাঝে কোন অন্য গল্প লিখে দিলেও নাম্বার পেয়ে যাবে,ভীষন বোরিং বিষয়’।তিতির হেসে ফেললো ওর কথা বলার ধরনে।

দিয়া কিন্তু রেগে গুম গুম করে কিল মারতে থাকলো অচিন্ত্যকে,আর অচিন্ত্য হা হা করে হাসতে থাকলো।বেশ মজার জুটি,ভালো লাগলো তিতিরের।

হঠাৎ ভাবগম্ভীর গলায় সুদর্শন বলে উঠলো,’যদিও আমি বিজ্ঞানের ছাত্র,তবু ইতিহাস কিন্তু আমার প্রিয় বিষয়।বিজ্ঞানের মতো ইতিহাস ও সত্যানুসন্ধান করে’।
দিয়া এবার অচিন্ত্যকে কিল মারা বন্ধ করে দিয়ে বললো,’একদম ঠিক বলেছো দাদা’।

সুদর্শন বললো,’আমি তো মনে করি,অতীতের চেতনা ছাড়া যেমন বর্তমানকে উপলব্ধি করা যায়না,তেমনি ভবিষ্যৎ কেও নির্মাণ করা অসম্ভব’।দিয়া বলে উঠলো,’অতীত মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের বর্তমান আর আগামীর জন্য খুব প্রয়োজন’।
সুদর্শন বললো,বিশিষ্ট রুশ ইতিহাসবিদ মন্তব্য করেছিলেন,”ফুলকে অন্ধরা দেখছে না,এর জন্য ফুল দায়ী নয়,মানুষের অন্ধত্বই দায়ী”।

দিয়া বললো, ‘তাছাড়া সাহিত্যের ক্ষেত্রেও কিন্তু ইতিহাসের ভূমিকা থাকে’।সুদর্শন বললো,’অবশ্যই, সাহিত্যিকদের লেখা থেকে আমরা সেই বিশেষ সময়ের সামাজিক,অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক অবস্থা জানতে পারি’।

ভাগ্যিস খাওয়ার চলে এসেছিলো,নাহলে হয়তো ইতিহাসের সাথে ভূগোলের সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা শুনতে হতো।কোন কুক্ষনেই যে তিতির ইতিহাস কে অপছন্দের বিষয় বলেছিলো।নিজের পিঠেই এবার গুম গুম কিল লাগাতে ইচ্ছে হলো ওর।আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো।(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here