#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-১৯)
#জয়া চক্রবর্তী।
ট্যাক্সির ধারে বসে চলন্ত রাস্তাটার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সুদর্শন।
‘কী অতো দেখছো বলোতো?’
তিতিরের কথায় সম্বিৎ ফিরে আসলো সুদর্শনের।
বললো, ‘দেখো পাখি প্রতিদিন কতো লরি,ট্রাক,ট্রাম,বাস,প্রাইভেট গাড়ী,ট্যাক্সি অনবরত চলছে ওর বুকের ওপর দিয়ে।ক্ষতবিক্ষত করছে ওকে।
তবু দেখো কেমন নির্বাক,নিশ্চল হয়ে জেগে আছে ও’।
তিতিরের হাঁ মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শন বললো,পথের সাথে পথিকের সম্পর্ক কি জানো?’তিতির কথা না বলে মাথাটা এলিয়ে দিল সুদর্শনের কাঁধে।
সুদর্শন বললো,আমরা সবাই নশ্বর কিন্তু পথ অবিনশ্বর’।
একটু থেমে বললো,’দেখো আবহমান কাল ধরে কত তিতির-সুদর্শন ওর বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে,আরো কত আসবে যাবে।ও কিন্তু ওর নিজের জায়গাতেই থাকবে।হয়তো কাঠামো বদলাবে তবু থাকবে।থাকবে নতুনদের আপ্যায়নে’।
তিতির সুদর্শনের কথা শুনে নিজেও রাস্তার দিকে তাকালো,তবে এবার সেই তাকানোর ভাষা বদলে গেছে।
সুদর্শন ড্রাইভারকে রাস্তা চিনিয়ে বাড়ীর সামনে এনে দাঁড় করালো। তিতিরের আঙুল গুলো মুঠোয় ভরে আলতো চাপ দিয়ে বললো,’আবার দুজন হারিয়ে যাব পাহাড়ে,সমুদ্রে অথবা জঙ্গলে’।
তারপর বেড়িয়ে এসে তিতিরের দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,’ওয়েলকাম ম্যাডাম’।
তিতিরের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে গেলো।তিতির গাড়ী থেকে নেমে এসে কলিংবেলে হাত রাখলো।
দরজা খুলেই তৃণা তিতিরকে দেখে বলে উঠলো,’এমন বেআক্কেলে বৌ দেখিনি জন্মে,একটা ফোন তো করতে হতো।এদিকে আমরা এখানে ভেবে মরি’।
সুদর্শন লাগেজগুলো ঘরে ঢোকাতে ঢোকাতে বললো,’টাওয়ার ছিলোনা কাকিয়া’।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আর বাহানা দিতে হবেনা।আগের বার যখন বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলিস,তখন তো দিব্বি টাওয়ার ছিলো’।
কাকিয়ার কথায় সুদর্শন বললো,সে তো কল্লোলের ফোন থেকে করেছিলাম।আমাদের মধ্যে একমাত্র ওর ফোনেরই টাওয়ার ছিলো’।
ডাইনিং এ সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে সুদর্শন বললো,’আজ বাড়ী এতো শান্ত কেন?নীল,অর্না,পর্না বাড়ী নেই?’
‘না নেই।নীল কলেজে গেছে।আর অর্ণা,পর্ণা স্কুলে’,কথাটা শেষ করেই তৃণা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো।
ঠিকে-ঝি শিউলির বর মারা যাওয়ার খবরটা পাওয়ার পর থেকেই মাথাটা গরম তৃণার।এক সিঙ্ক বাসন জমে আছে।ঘর মোছা হয়নি।তার ওপর দিদি রান্নাটা সেরে দিয়েই শিউলিদের বাড়ীতে গিয়ে বসে আছে।মনে মনে বলে উঠলো তৃণা,’আদিখ্যেতা’।
কাকিয়ার দুই মেয়ে অর্ণা,পর্ণা আর সুদর্শনের নিজের ভাই নীলের ভারি ভাব।তিনজনে বাড়ী থাকলে নিজেরাই হইচই করে খুব।তিতিরের সাথে ওরা কেউই আগবাড়িয়ে ভাব করেনি।একটু এড়িয়েই চলে তিতিরকে।সুদর্শনের সাথেও ওদের ভাব নেই বিশেষ।একটু যেন ভয়ই পায় সুদর্শনকে।
‘তুমি আবার দাঁড়িয়ে কেন,যাও গিয়ে ফ্রেশ হও’,কাকিয়ার কথায় তিতিরের ভাবনায় ছেদ পরলো। বললো,হ্যাঁ যাচ্ছি,আচ্ছা কাকিয়া মামনি কোথায়?’।
‘দিদি গেছে শিউলি দের বাড়ীতে।সকালে ওর বর মারা গেছে’,কাকিয়ার কথায় তিতিরের মুখ কালো হয়ে গেলো।
বললো,’সেকি!!মারা গেছে!শিউলি মাসী বলেছিলো বর অসুস্থ হওয়াতেই নাকি ঠিকে কাজে নেমেছে,আগে অবস্থা সাধারণ হলেও কোনরকমে চলে যেত’।
একটু থেমে বললো,’আচ্ছা শিউলি মাসীর মেয়েটা তো ছোট’।তিতিরের কথার উত্তর দিলো না তৃণা।
নিজের মনেই গজগজ করে বলে উঠলো,’এখন কত দিন কামাই করবে কে জানে!
এমনিতেই ওর কাজকর্ম নোংরা।কতবার বলেছি ওকে ছাড়িয়ে দিয়ে অন্য লোক রাখো।তা আমার কথা শুনলে তো’।
তিতির বলে উঠলো,’শিউলি মাসীর বাড়ী কোথায় কাকিয়া?’।
তৃণা তিতিরের কথার উত্তর না দিয়ে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,’বাবিন ফ্রেশ হয়ে আমাকে ডাকিস,খেতে দেবো’।বলেই রান্নাঘরে শিকল তুলে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
তৃণা ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই তিতির বললো,’আমি শিউলি মাসীর বাড়ীতে যাব।কোথায় বাড়ীটা?’সুদর্শন বলে উঠলো,’ওখানে তুমি গিয়ে কি করবে?শুনেছিলাম টালি দেওয়া মাটির ছোট্ট ঘরে থাকে।আর মা তো গেছেই ওখানে’।
তিতির বললো,’থাক বলতে হবেনা,আমি ঠিক খুঁজে নেবো’।তিতির ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতেই সুদর্শনও দরজা টেনে বন্ধ করে ওর পিছন পিছন বেড়িয়ে আসলো।
বললো,’রাগ দেখাতে হবেনা।আমার সাথে চলো।শুনেছিলাম বাগচী পাড়ার দিকে থাকে।ওখানে গিয়ে খোঁজ করলে পেয়ে যাব’।
সুদর্শনের সাথে তিতির গিয়ে হাজির হলো শিউলিমাসীর বাড়ি।অনুশ্রী তিতিরদের দেখে আকাশ থেকে পড়ার মতো।
‘কিরে বাবিন,তোর কি মাথা খারাপ হলো নাকি!বিয়ের একবছরের মধ্যে কোন অশৌচ বাড়ীতে আসতে হয় নাকি?একটা মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপার আছে তো’।
তিতির বললো,’ওর দোষ নেই মামনি।খবরটা শুনে আমিই আসতে চাইলাম।আর তুমি থাকতে আমাদের কোন অমঙ্গল হতে পারেনা’।
কথাটা বলেই তিতির এগিয়ে গেলো শিউলির দিকে।হাত চেপে ধরে ভরসা দিলো।
তিতিরকে দেখে আরো জোরে কান্নায় ভেঙে পড়ল শিউলি। বললো,’নতুন-বৌ আমার মেয়েটাকে এখন কে দেখবে?আমি তো ওর বাবার ভরসাতেই মেয়ে রেখে কাজে যেতাম’।
তিতির হাত বাড়িয়ে শিউলির মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো।বললো,’আমি তোমার মেয়েকে দেখবো।তুমি আমার কাছেই ওকে রেখে কাজে যেও।আমি ওকে পড়াবো,মানুষ করবো’।
অনুশ্রী শিউলিকে পছন্দ করলেও তিতিরের এই মেয়ের দায়িত্ব নেওয়ার কথাটাকে সমর্থন করতে পারলেন না।বেশ বিরক্তিই লাগলো।
কি দরকার ছিলো তিতিরের এসব কথা বলবার!
কথায় বলে গরিবের দুঃখের দিনে পাশে এসে দাঁড়াও,কিছু টাকা হাতে গুঁজে দাও।
যেমন আমাদের দেশের নেতা নেত্রীরা করেন।
আরে তবেই না এরা কৃতজ্ঞ থেকে সারাজীবন দলের পক্ষে থাকবে।
এই যে তিনি শিউলির হাতে দুটো পাঁচশো টাকার নোট গুঁজে দিলেন।তিনি জানেন এরপর শিউলি যেখানেই কাজ ছাড়ুক,অনুশ্রীদের কাজটা ঠিক ধরে রাখবে।
তেমন হলে বাবিনের থেকে টাকা নিয়ে তিতিরও দিতে পারতো। তা নয় ওর মেয়েকে মানুষ করবে,পড়াশোনা করাবে।যেন টাকা পয়সা লাগবে না এসবে।বোঝেনা তো কত ধানে কত চাল!
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে অনুশ্রীর মনে হলো,আমাদের দেশের নেতা,নেত্রীরাও তো কত প্রতিশ্রুতি দেন,’এই করে দেবো’,’সেই করে দেবো’।কিন্ত ওগুলো সব ফাঁকা আওয়াজ।
বাড়ীতে গিয়ে সময় করে তিতিরকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে হবে।এসব দায়িত্ব ফায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে ওর ঝেড়ে দিতে হবে।কথাটা মাথায় আসতেই স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল অনুশ্রীর।
শিউলিদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে অনুশ্রী বললো,’বাবিন তোর কাকিয়াকে একটা ফোন করে বল ঠাকুরঘর থেকে গঙ্গাজলের বোতলটা নিয়ে গেটের কাছে রাখতে।ঢোকার সময় যেন একটু ছিটিয়ে দেয়’।
একটু থেমে তিতিরের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,’স্নান না সেরে কেউ যেন ঘরে না ঢোকে’।
তিতির হেসে বললো,তোমার চিন্তা নেই মামনি।স্নান করেই ঢুকবো’।
সুদর্শন তিতিরের এই নতুন রূপটার সাথে পরিচিত ছিলোনা।
যেভাবে রাগ দেখিয়ে একাই বেড়িয়ে পড়েছিলো শিউলি মাসীর বাড়ীতে আসবে বলে,তারপরে যেভাবে শিউলি মাসীকে ভরসা দিলো…সব মিলিয়ে একটা ভালো লাগা ছেয়ে গেছে সুদর্শনের মনে।
‘তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন/তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে ওঠে মন’…গানটা মনে মনে গুনগুন করতে করতে মা আর পাখির পেছনে এক বুক গর্ব নিয়ে এগিয়ে চললো সুদর্শন।(চলবে)