#তিতির পাখির বাসা(পর্ব-২০)
#জয়া চক্রবর্তী।
‘পুকুর থেকে একটা ডুব দিয়ে ঘরে ঢুকলেই তো হয়’,অনুশ্রীর কথায় তিতির আঁতকে উঠলো।’সেকি মামনি পুকুরে ডুব দেবো মানে!আমি তো সাঁতারই জানিনা’।অনুশ্রী বললো,’তাতে কি?ডুব দিতে গেলে আবার সাঁতার জানতে হয় নাকি?’
তিতির এবার উদ্বিগ্ন মুখে সুদর্শনের দিকে তাকালো।সেটা দেখে অনুশ্রী ও সুদর্শন নিজেদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো।হাসতে হাসতেই অনুশ্রী বললো,’গঙ্গাজল ছিটিয়ে দেওয়ার পর সোজা গিয়ে বাথরুমে ঢুকবে’।সুদর্শন বললো,’আর তাড়াতাড়ি কোরো।আমরাও কিন্তু লাইনে’।
কলিংবেলে হাত রাখার সাথে সাথেই বেশ বিরক্ত মুখে দরজা খুললো তৃণা।গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতে দিতে বললো,’আমাকে তো একবার বলে যেতে হতো বাবিন।এতো কেয়ারলেস তো আগে কখনো ছিলিস না’।
অনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,’বিয়ের একবছর পূরণ না হলে কেউ অশৌচ বাড়ীতে যায়না এ তোমার থেকেই শেখা দিদি।এখন বাবিনদের ক্ষেত্রে কি সব নিয়ম বদলালে?’
অনুশ্রী বললো,’অনুমতি নিয়ে তো আর যায়নি।হঠাৎ গিয়ে হাজির।’তুমি কিছু বললে না দিদি?একটা মঙ্গল অমঙ্গলের ব্যাপার তো আছে নাকি?’তৃণা বেশ রাগের সাথেই কথাগুলো বললো।
তিতির ভাবলেশহীন মুখ করে ব্যাগ খুলে নাইটি আর টাওয়াল বের করলো।কলঘরের দিকে এগিয়ে গেলো ধীর পায়ে।তারপর দরজা বন্ধ করলো।তিতির জানে ওর প্রতিটি কাজেরই এখন পোস্ট মোর্টেম চলবে বাইরে।
তিতির শাওয়ার চালিয়ে চোখ বুজে নিলো।চোখ বুজতেই শুনতে পেলো মেঘের ডাক,বৃষ্টির একটানা শব্দ।বৃষ্টির দানারা তিতিরের মাথা গড়িয়ে খোলা বুকউঠোনে এসে পরলো।বিদ্যুৎ চমকে উঠলো বুকের এক দিগন্ত দূরত্বে।
মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে নাইটি পরে বেড়িয়ে আসতেই সুদর্শনের সামনে।
তিতির সুদর্শন কে পাশ কাটিয়ে যেতেই হাতে টান পড়লো তিতিরের।
সুদর্শন তিতিরের কানের সামনে নিজের মুখটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘আরো একবার বৃষ্টি নামুক
ভিজুক তোমার মন
আরো একবার দিন দুপুরে
আঁধার নামুক আকাশ জুড়ে
আরো একবার নেশায় মাতুক
মেঘলা আমন্ত্রণ’।
তিতির হেসে বললো,’হয়েছে হয়েছে।এবার স্নানে যাও’।
খাওয়ার টেবিলে তৃণা তিতিরকে বলে উঠলো,’প্রমীলার দায়িত্ব নিয়েছো শুনলাম’।
‘প্রমীলা কে কাকিয়া?তিতিরের প্রশ্নের উত্তর দিলো অনুশ্রী,’কেন নিজেই তো সবার সামনে শিউলিকে বলে আসলে ওর মেয়ের দায়িত্ব তোমার’।
‘ও শিউলি মাসীর মেয়ের নাম প্রমীলা।বাহ ভারী মিষ্টি নাম তো’।তিতিরের কথায় অনুশ্রী বললো,’দায়িত্ব নেওয়ার মানে বোঝো তুমি?তাও একটা মেয়ের দায়িত্ব!প্রতি পদে পদে বিপদ মেয়েদের সেটা জানো?’
‘জানি বলেই তো দায়িত্বটা যেচে নিলাম।ওই টুকু মেয়ে একা রেখে শিউলি মাসি কাজে যাবে।কত খারাপ লোক তাদের অসুস্থ মানসিকতার সাথে মেয়েটাকে খুবলে খাবে।সে কারনেই তো…’।
তিতিরের কথার গুরুত্ব বুঝে অনুশ্রী বললো,’সে না হয় থাকলো এখানে।কিন্তু ওকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করিয়ে দেবে সে আবার কেমন কথা?টাকা পয়সা লাগবে না বুঝি?’
তিতির বললো,’লাগবে তো’।
‘সেটা আমাদের বাবিনের ঘাড় ভেঙেই আদায় করবে তাইতো?’
তৃণার কথায় হেসে ফেললো তিতির।
বললো,’আরে না না কাকিয়া।সেই কারনেই তো ঠিক করেছি টিউশানি করবো’।
একটু থেমে বললো,’আমাদের পেছনের দিকের ঘরগুলো তো বন্ধই থাকে।যদি আমাকে অনুমতি দাও তাহলে ওর একটাতেই না হয় পড়ানো যাবে। সেক্ষেত্রে অন্য কোথাও আমাকে ঘর ভাড়া নিতে হয়না’।
‘ও ঘর ভাড়া করবে বলেও ভেবেছো!ভালো!’
অনুশ্রীর কথায় তিতির বললো,’সে তো তোমরা রাজি না হলে।তাছাড়া আমি নিজের পড়াটাও কন্টিনিউ করতে চাই’।
অনুশ্রী বললো,বুঝেছি ছেলের বৌয়ের কাছ থেকে আর কিছুই সেবা পাওয়া যাবেনা’।
‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’কথাটা তো তুমিও জানো মামনি।আর যদি তেমন অসুবিধে হয় সেক্ষেত্রে না হয় আরো একটা লোক রেখে নেবো’।
তিতিরের কথায় অনুশ্রী রেগে গেলেও মুখে কিছু বললো না।কিছুক্ষণ ভাত নাড়াচাড়া করে বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
অনুশ্রীকে দেখে তৃণাও না খেয়েই উঠে পড়লো।
এতো কিছুর মধ্যেও সুদর্শনের মধ্যে কিছু হেলদোল লক্ষ্য করা গেলোনা।
সে দিব্বি ভাত গ্রাস করে মুখে তুলছে।
তিতির হাতের কনুই দিয়ে ঠেলা মেরে জিজ্ঞেস করলো,’কিগো কিছু তো বলো’।
সুদর্শন খেতে খেতে বললো,’কোন ব্যাপারে বলবো বলোতো?’
‘যাও কিচ্ছু বলতে হবেনা তোমায়?’,তিতিরের কথায় হেসে ফেললো সুদর্শন।বললো,’দেখোই না কি হয়!তোমার কথা তো তুমি বলেই দিয়েছো।বাকীটা সময় বলবে’।
দেখতে দেখতে একবছরে পড়লো সংশপ্তক।
যাদের পয়সা আছে তারা যেমন এখানে পড়ছে তেমনি বিনা মাইনার পড়ুয়াও কম নেই সংশপ্তকে।
প্রমীলা ছাড়া ওদের পাড়ার আরো অনেকেই বিনা মাইনায় তিতিরের কাছে টিউশন পড়তে আসে সকালবেলায়।যদিও প্রমীলার উপর তিতিরের মায়াটা বেশী।
তিতির নিজের কাছেই প্রমীলা কে রাখে।রাতের বেলাতেও তিতিরের প্রায় সব ব্যাচেই প্রমীলাকে দেখতে পাওয়া যায়।শিউলি রাত দশটায় মেয়েকে নিয়ে যায় নিজের কাছে।
হ্যাঁ তিতিরের তৈরি প্রতিষ্ঠানের নাম সংশপ্তক।আপাতত একাই পড়াচ্ছে তিতির।সঙ্গে নিজেও এম.এ এর প্রস্তুতি নিচ্ছে।তবে ওর ইচ্ছে আছে আরো কয়েকজন কে নিয়োগ করবে সংশপ্তকে।কিন্তু মাইনে বেশী দিতে পারছে না বলে কেউই সেভাবে রাজী নয়।
এক বছর আগে তিতির এই পড়ানোর বিষয়টা নিয়ে নিজের জ্যাঠার ছেলের সাথে কথা বলেছিলো। বড়দাভাই সব শুনে নিজেই বোর্ড বানিয়ে নিয়ে এসেছিলো তিতিরদের বাড়ীতে।
তারপর তো বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তিতির বাবাই আর দুই কাকাইকে রাজী করিয়ে বাড়ীর বাইরে সেই বোর্ড টানিয়ে ছিলো।
দেওর নীলের বন্ধুদের সাথে কথা বলে কিছু হ্যান্ড বিলও বিলি করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলো সংশপ্তকের।
তিতির আজকাল সকাল হওয়ার অনেক আগেই বিছানা ছাড়ে।এখন আর সুদর্শনকে তিতিরের ঘুম ভাঙাতে হয়না।
তিতির ঘুম থেকে উঠেই চট করে স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢোকে।চা করে ফ্লাস্কে রেখে আটা মাখতে বসে।রুটি করে হটপটে রাখে।সবজি গুলো কেটে ধুয়ে,বাটনা বেঁটে নিজেই রান্না চাপায়।
তৃণা আজকাল মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকায়
রান্নাঘরে তার দর্শন কমই পাওয়া যায়।
অনুশ্রী বলেছিল অর্না,পর্ণাকে তিতিরের কাছেই পড়াতে।কিন্তু তৃণা রাজী হয়নি।টানতে টানতে মেয়ে দুটোকে নিয়ে এই জায়গা,সেই জায়গা ছুটছে।
তাতে অবশ্য তিতিরের সুবিধাই হয়েছে।অনুশ্রীর সাথে থেকে যেমন কাজ শিখে যাচ্ছে ,তেমনি দুজনে বেশ ভালো বন্ধুও হয়ে গেছে।
রবিবার করে তিতিরের সংশপ্তক বন্ধ থাকে।অনুশ্রী খেয়াল করেছে আজকাল রবিবার হলেই তিতির একটু উদাস থাকছে।
‘তিতির বাড়ীর জন্য মন খারাপ তোমার?ঘুরে তো আসতে পারতে বাড়ী থেকে”,অনুশ্রীর কথায় তিতিরের গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।অনুশ্রী বললো,’এতে কাঁদবার কি হলো আবার?’
তিতির চোখ মুছতে মুছতে বললো,’জানো মামনি প্রতি শনিবার রাতে তোমার বাবিনকে বলি আমায় কাল বাড়ী ঘুরিয়ে আনবে?রাতে রাজী থাকে কিন্তু সকাল হলেই বলে,পরের রবিবার নিশ্চয়ই নিয়ে যাব,আজ অনেক কাজ’।
অনুশ্রী মুখে কিছু বলেনা।কিন্তু নিজেও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।কৌশিক ও ঠিক এমনটাই করতো।
দিনের পর দিন,মাসের পর মাস অনুশ্রীর যাওয়াই হতোনা বাপেরবাড়ীতে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া পর্ব সাড়া হলে অনুশ্রী তিতিরকে বলে,’আমরা দুজন বের হবো।চটপট তৈরি হয়ে এসো’।তিতির বলে,’আমরা কোথায় যাচ্ছি মামনি?’অনুশ্রী বললো,’এখনো ঠিক করিনি।বেড়িয়ে ঠিক করবো।একটু তাড়াতাড়ি কোরো’।
তিতির তৈরি হয়ে আসতেই অনুশ্রী ওকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।
মাঝ রাস্তায় রিক্সা থামিয়ে মিষ্টির দোকান থেকে মিষ্টিও কিনলো।তারপর স্টেশনে এসে তিতিরকে দাঁড় করিয়ে নিজেই গেলো টিকিট কাউন্টারে।
টিকিটটা এনে তিতিরের ব্যগের চেন খুলে রাখতে রাখতে বললো,’আপ-ডাউন কাটা আছে।আর মিষ্টির প্যাকেট টা মাঝের চেনে রাখলাম।মনে করে দিয়ে এসো’।
তিতির অবাক হয়ে তখনো তাকিয়ে আছে অনুশ্রীর দিকে।অনুশ্রী একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে তিতিরের হাতে গুঁজে দিলো।তিতিরের হা মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,’এর মধ্যে সব ট্রেনের নাম লেখা আছে।তাও একটু দেখেশুনে জিজ্ঞেস করে উঠো’।
তিতির বললো,’আমি কি একা কোথাও যাচ্ছি মামনি?’
অনুশ্রী হেসে বললো,’হ্যাঁ তোমার বাপেরবাড়ীতে যাচ্ছ।আমি চাইনা সামান্য একটা বিষয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে থাকো’।
একটু থেমে বললো,’আমি সাথে যেতেই পারতাম।কিন্তু আমি গেলে আত্মবিশ্বাস টা আসবেনা,তাই একাই যাও।আর সাবধানে যেও আমি কিন্তু চিন্তায় থাকবো।আর অসুবিধা হলে ফোন করতে ভুলোনা যেন’।
তিতিরের চোখ জলে ভরে গেলো।অনুশ্রী বললো,’এটা স্টেশন তিতির।কাগজটা দেখে নিজেই ট্রেনে উঠো।আমি আসছি’।
অনুশ্রী তিতিরকে স্টেশনে রেখে আবার উলটো দিকের রিক্সা ধরলো।তিতির কাগজটা মেলে ধরলো চোখের সামনে।তারপর অপেক্ষা করতে থাকলো ট্রেন এনাউন্সের।
অনুশ্রী বাড়ীতে ঢুকে দেখলো ডাইনিং প্রায় জমজমাট।সবাই খোশ মেজাজে গল্প করছে।অনুশ্রীকে দেখে কৌশিক বলে উঠলো,’তোমার সাথে তো তিতির ছিলো,সে কোথায়?’
অনুশ্রী বললো,’বাপের বাড়ীতে গেছে।তবে রাতেই ফিরে আসবে’।
সুদর্শন বলে উঠলো,’সেকি একা একা ট্রেনে করে গেছে?স্কুল কলেজে শুনেছি ওর দাদার সাথেই যাতায়াত করতো,তাও বাইকে চেপে’।
কৌশিক বিরক্ত সহকারে বলে উঠলো,’কোন আক্কেলে তুমি ওকে একা একা যেতে দিলে শুনি?’
অনুশ্রী কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,’বাবিন তোমার মতোই নেচার পেয়েছে তা জানো? প্রতি শনিবার রাতে তিতিরকে কথা দিয়ে বলে,ওকে ওর মায়ের সাথে দেখা করিয়ে আনবে।কিন্তু রবিবার হলেই নেক্সট রবিবারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দেয়”।
একটু থেমে সুদর্শনের দিকে তাকিয়ে বললো,’আমাকে কম চোখের জল ফেলতে হয়নি এই বাড়ীতে।আমি চাইনা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক।আর একা না গেলে আত্মবিশ্বাসটা আসবে না’।
সুদর্শনের মাথা নীচু করে বললো,’বুঝতে পারছি মামনি আমার ভীষণ ভূল হয়ে গেছে।আর কখনোই এমনটা করবো না।আমি বরং তিতিরকে একটা ফোন করে দেখি ও কতদূর পৌঁছলো!’
অনুশ্রী বললো,’না না রাস্তায় ফোন করে ওকে বিব্রত করতে হবেনা।তিতিরকে সব বলা আছে।অসুবিধা হলে ও নিজেই ফোন করে নেবে’।
না তিতিরের কোনই অসুবিধা হয়নি।মামনির দেওয়া ভরসা আর মনের জোরকে সঙ্গী করে তিতির একা একাই দিব্যি ঘুরে এলো বাপের বাড়ীর থেকে।(চলবে)