হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে পর্ব:১২

0
905

উপন্যাস: হিয়ার মাঝে-লুকিয়ে ছিলে।

কলমে: চন্দ্রা।

পর্ব:১২

তিন দিন পরে সপ্তমী।নিমতলা, বেলতলায় ঘট স্থাপনের মাধ্যমে দূর্গা পূজার শুভারম্ভ হবে। বিদ্যালয়ের ছুটি ঘোষিত হয়েছে।

রিতি একটা কাজে গিয়েছিলো জেলা শহরে।ফিরতে ফিরতেই বিকাল।যখন বাসভবনের মূল দরজা দিয়ে বসার ঘড়ে ঢুকলো তখন দাদুকে দেখে নিজের আবেগ, আর প্রতিজ্ঞা সামলাতে পারলো না।দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো দাদুকে। সেদিন এ বাড়িতে আসার আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলো দাদুর সাথে আর কথাই বলবে না।বুঝবে বুড়োটা ক্যামন লাগে।শুধু তাড়াই তাড়াই করা বের হবে তখন।
শশীশেখর বাবু পৌত্রীকে দেখে আগেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।

ক্যামন আছো দাদুভাই?পিসিমা আসেনি?একাই এসেছো?

এই তো দিদি ভাই গোবিন্দ যেমন রেখেছেন।একটু শান্ত হয়ে বোস।এত প্রশ্নের উত্তর একবারে দেই কি করে বলতো দিদিভাই? রিতি নিজেকে সামলে দাদুভাইকে প্রণাম করলো ঝুঁকে।শশীশেখর বাবুর মনে হলো শূন্য বুকটা বুঝি পূর্ণ হলো বহুদিন বাদে।রিতিরও তাই। কিন্তু হিসেব কষলে হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা দিনের অদেখা। সামনের সেন্টার টেবিলে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ দেখে দাদুর আসার কারণটা বুঝলো রিতি,
দাদু ভাই তুমি বসো আমি এই যাবো আর আসবো।
শশী শেখর বাবুর সম্মতির অপেক্ষা করলো না রিতি তরতর করে উঠে গেলো সিঁড়ি বেয়ে।সেদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ দাদুর চোখ দুটো খুশিতে আদ্র হয়ে উঠলো। এতক্ষণ দাদু নাতনির ভাবের আদান-প্রদান দেখছিলো বিরূপাক্ষ একপাশে বসে।রিতি সরতেই প্রবীণ আর নবীনের অসমাপ্ত গল্পটা আবার সক্রিয় হলো।

দশমিনিটেই বাইরের কাপড় ছেড়ে ঘড়ে পরা সুতির কাপড় পরিধান করে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে তবেই বসার ঘড়ে পা রাখলো রিতি। ততক্ষনে প্রভাকর চৌধুরীও যোগ দিয়েছেন বিরূপাক্ষ এবং দাদুর গল্পের আসরে। অন্নপূর্ণা দেবী এবং জয়াকে হেঁশেলে ব্যস্ত দেখে রিতি সেদিকেই এগিয়ে গেলো।

এরপর টুকি টাকি কথা শেষে খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠে পরলেন শশী শেখর বাবু,,
বিরূপাক্ষ নিজের গাড়িতে করে এগিয়ে দিয়ে আসলো তাঁকে।যাওয়ার আগে শশী শেখর বাবু বললেন প্রভাকরকে,,পূজা পার্বনে নেওয়া থোয়ার একটা ব্যাপার তো আছে তাইনা।এতবছর তেমন পরিস্থিতি ছিলো না তাই হয়নি।এখন দাদুভাই যখন এসেই পরেছে আমি চাই অনন্ত দুজনে মিলে একটা রাত যেনো বেড়ায় আমার বাড়িতে।

প্রভাকর বাবু চিন্তিত হলেন ছেলেকে নিয়ে সেকি যাবে রিতির সাথে ওদের বাড়িতে?তাও আবার একটা রাত থাকার জন্য??

প্রভাকরের ভাবনাকে প্রশ্রয় দিলেন না শশী শেখর বাবু,,রূপের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে তবে ফিরলেন বাড়িতে।রিতি দাদুর মনের শান্তির জন্য আশ্বস্ত করে বলে দিলো,,বিজয়া দশমীতে গিয়ে প্রণাম করে আসবে দুজনে।শশীশেখর বাবু নাতনীর কথায় আশ্বস্ত হলেন কারন তিনি জানেন,,মিথ্যা শান্তনা দেওয়ার মেয়ে সে নয় ।তাহলে দুজনের মধ্যে হয়তো বোঝাবুঝি টা হয়েছে।মনে মনে সুখানুভব করলেন তিনি।

******
একটা কথা বলতো অখিল, সেদিন বার বার বলার পরেও আমাকে সি-অফ করতে এয়ার পোর্টে ক্যানো আসলি না? তখন কতটা বিধ্বস্ত ছিলাম জানিস?

তুই যে রাতে আমাকে ফোনে বললি যে,হুট করে বিদেশ চলে যাচ্ছিস।আমি দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম। বাবার বাড়াবাড়ি অবস্থার কথা তোকে তখনো জানাইনি ,তোকে আর কত বিরক্ত করবো এই ভেবে।হাত ফাঁকা অথচ বাবাকে ভালো করে ডক্টর না দেখালেও নয়। তারপরেও ফোন পেয়ে ঢাকায় আসার সকল প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম।মধ্য রাতে বাবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো।আর একেবারেই যন্ত্রনার অবসান ঘটিয়ে বিদায় নিলেন শেষ রাতের দিকে। মায়ের, ভাই বোনেদের কান্নায় পাগল পাগল অবস্থা আমার তবুও তোকে ফোন করছিলাম কিন্তু সুইস্ অফ।আর ফোন করিনি।(একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে নিখিলেশ)
অন্যান্য বন্ধুরা তো দেশে ছিলো ওদের সাথে যোগাযোগ ক্যানো রাখিসনি? অভিযোগ করে বিরূপাক্ষ।

তুই তো জানিস ওরা আমার বন্ধু হলেও তুই ছাড়া আর কাউকে নিজের দারিদ্রতার মাঝে এনে বিব্রত করতে চাইনি।ওরাও প্রথম প্রথম সেধে আসতো আমার কাছে।আমিই ইগনোর করতাম। পরে যার যার কাজে সে সে ব্যস্ত হয়ে পরলো। তাছাড়া সবাই ই কমবেশী সমস্যার মধ্যে ছিলো। নিজের সমস্যার বোঝাটা তাই ওদের কাঁধে দিতে মনে সায় দেয়নি।বন্ধু তো বল?বিরূপাক্ষের কাঁধে হাত রেখে করুন স্বরে বলল অখিলেশ।

হুম। কিন্তু হানিফের কথাটা কি শুনলাম? প্রশ্ন করে বিরূপাক্ষ।

সে তো আরেক বিষাদ কাহিনী।ওর এক খালাতো বোনের সাথে পারিবারিক ভাবে বিয়ে দেওয়া হয়। ভালো চাকুরী পেয়েছিলো হানিফ।মৎস অধিদপ্তরের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা।সে বিয়ে দুটো বছরো টিকলো না।একটা মেয়ে আছে ওদের জানিস?শুনেছি খুব ফুটফুটে হয়েছে মেয়টা! কিন্তু হানিফের সাথে যোগাযোগ রাখতে দেয় না।আমি নিজে দেখিনি তবে হানিফ একদিন বলেছিলো।

ওর কোন খালু মৎস অধিদপ্তরে ছিলো না?

হ্যা ওনার মেয়েকেই বিয়ে করেছিল হানিফ।ওর ঐ চাকুরী পাওয়ার পেছনে সেই খালু মানে শশুড়ের ই কারচুপি ছিলো।ডিভোর্সের আগে নারী নির্যাতন কেস হয়েছিলো হানিফের নামে।মেয়েকেতো ছাড়িয়ে নিয়েছেনই ভদ্রলোক, ছেলেটার চাকুরী টাও খুইয়ে দিলেন।এখন আছে একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ছোট পদে।ভালো নেই একটুও জানিস?অমন উদ্দাম উচ্ছল ছেলেটা মিইয়ে পরেছে একেবারে।
এই ক’বছরের অনুপস্থিতিতে কত কিছুই ঘটে গেছে বন্ধুদের জীবনে।বিরূপাক্ষের ভেতরটা অনুশোচনায় পুড়তে থাকে।একটু খবর অন্তত রাখতে পারতো সে।

ট্রেতে করে ভর্তি একটা চায়ের কাপ একটা কফির মগ আর কিছু ডালের বড়া,বেগুনি নিয়ে রিতি উঠেছে দোতলার ছাদে।সাথে অভি,তার এক হাতে বিরূপাক্ষের দেওয়া উড়োপ্লেনটা, অন্য হাতে একটা বেগুনির অর্ধাংশ। চিলেকোঠার সিঁড়ির কাছে গিয়ে ডাকলো অভি,,ছোটদা ভাই তোমাদের গলা ভেজানোর ব্যবস্থা হয়েছে নিচে আসো,,
দুজনেই ঝুঁকে দেখলো রিতি হাতে ট্রে নিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

বৌদি উপরে উঠে আসুন। খুব ভালো জায়গা এটা।বললো অখিলেশ।

না না অখিলদা আমি উঠতে পারবোনা আমার ভয় করে আপনারা নেমে আসুন চা কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।

রিতির ভয় পাওয়ার কথাটা কানে আসতেই বিরূপাক্ষের স্মৃতির পাতায় ভেসে আসে একটি দুর্ঘটনা।সেই ছোট বেলায়,,,
একদিন সকালে রিতি এবং ছোট্ট বিরূপাক্ষকে নিয়ে ছাদে উঠছেন অন্নপূর্ণা দেবী।পেছনে চাল কুমড়োর বড়ি দেওয়ার জিনিস নিয়ে এগোলো কাজের বৌ দুটো।

রিতির হাতে পৌষের মেলা থেকে কেনা বেলুনওয়ালা বাঁশি। কাজের ফাঁকে কখন রিতি চলে গিয়েছে চিলে কোঠার কাছে টের পায়নি অন্নপূর্ণা দেবী বা অন্য কেউ। ছোট্ট বিরূপাক্ষ কৌশলে রিতির হাতের বাঁশিটা নিয়ে উঠে গেল চিলেকোঠার ছাদে।রিতি কাঁদছে আর বলছে রূপ দা নেমে আসো না। আমার কাছে আসো।
রূপ উপর থেকে চেঁচিয়ে বললো,,,বুড়ি তুই উঠে আয় না ,তোকে আকাশ ছোঁয়াবো। এখান থেকে আকাশ ছোঁয়া যায়।আয়না আয়! বারবার ডাকে বিরূপাক্ষ।

আমি পারবোনা রূপদা, আমার ভয় করে। কাঁদছে রিতি।

আরে কিছু হবে না উঠে আয় সোনা।সাহস দেয় রূপ।

সেদিন রূপদার কথায় বিশ্বাস করে সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলো রিতি। কিন্তু চার পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়েটার ছোট্ট নরম হাত দুটো থেকে লোহার রডটা সরতে দেরী হয়নি। চার ধাপ সিঁড়ি থেকে ছাদের শক্ত মেঝেতে ছিটকে পরলো রিতি।মাথাটা নিচের দিকে পরায় জ্ঞান হারায় তখনি। বিরূপাক্ষ উপর থেকে জ্ঞানশূন্যের মতো হয়ে দেখতে থাকে নিথর রিতিকে বুকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের ছুটে যাওয়া। সেদিন বাবা কয়েক ঘা মেরছিলো বিরূপাক্ষকে। রিতির চোট সামান্য হলেও ভয়ের জ্বরে ভূগেছিলো বেশ কয়েকদিন।রূপ মনমরা হয়ে থাকতো কারন ওর ছোট্ট পুতুল টা আর আগের মতো রূপদা রূপদ করে পাগল করতো না। খুব পঁচা ভাবতো রূপদাকে।

আস্তে উঠুন পরে না যান,, অখিলেশ এর সতর্ক বাণী কর্ণকুহরে আঘাত আনতেই বিরূপাক্ষের স্মৃতির ঝাপ বন্ধ হয়।তড়িতে নিচে তাকিয়ে দেখে রিতি সবে তিনধাপ ভেঙেছে।
চিৎকার করে উঠল বীরূপাক্ষ,,,এই বুড়ি থাম।আর একটা পা ও বাড়সনে। আগে নাম বলছি।

বিরূপাক্ষকে উত্তেজিত হয়ে নামতে দেখে রিতি নেমে দাঁড়ায়।বিরূপাক্ষের কন্ঠে বহুবছর বাদে বুড়ি ডাকটা শুনে হৃদয়ের কোথাও কাঁটার মতো ফুটে ওঠা যন্ত্রণা টের পায়।

তুই উঠতে গেলি ক্যানো?যদি পরে যেতিস?
বিরূপাক্ষের আঁখিতে নিজের জন্য ভীতি দেখে মনের মধ্যে প্রশান্তিময় হাওয়া বহে রিতির।তথাপি কথার বাণ মারতে ছাড়ে না।

বিদ্রুপের হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে বলে,,
আপনি কি ভয় পেয়েছেন? ঘাবড়াবেন না,মুখ ফসকে দু চারটে ছোট বড়ো কথা অগত্যা বেড়িয়ে গেলেও হাত ফসকায় না এখন আর।তাল সামলাতে জানি এখন। এগুলো নিন। আমার কাজ আছে নিচে।
বলার মতো আর কোনো কথা জোগায় না বিরূপাক্ষের মুখে।ট্রেটা হাতে নিয়ে রিতির চলে যাওয়া দেখে আধোমুখে।
একটা জিনিস সে একয়দিনে ভালোই বুঝেছে,শিক্ষার দৌড় যাই হোক না ক্যানো,বুদ্ধি,বাকপটুতা এবং আত্মসন্মান বোধে অনেক দূর এগিয়েছে রিতি।মিষ্টস্বরে কথার ফুলঝুরি এমন ভাবে ছোটাবে যে,ফুলের সাথে কাঁটার আঘাত লাগলেও কিছু বলার অবকাশ থাকবে না অপর পক্ষের।
****
কথায় আছে অধিক সন্যাসীতে গাজন নষ্ট।তেমনি কোনো বাড়িতে যদি হঠাৎ করে অধিক লোকের বসবাস শুরু হয় সেখানে বাড়ির মানুষগুলোর নিজস্ব কর্ম কান্ড গুলোয় একটু হলেও ব্যঘাত ঘটে। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ হলো অভিরাজ।একয়দিনে পড়া শোনা তার শিকেয় উঠেছে।সন্ধ্যায় অভিকে খুঁজে খুঁজে পেলো বিরূপাক্ষের ঘড়ে।বিরূপাক্ষ বেরিয়েছে প্রদীপের সাথে।অখিলেশ আর অভি আছে সেখানে।একটু কড়া সুরেই বললো রিতি,,অভি তুই যে পড়াশোনা ছেড়ে এগুলো করছিস।পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়ার ইচ্ছা নেই নাকি?বিরূপাক্ষের ল্যাপটপে গেম খেলা লিখছিলো অখিলেশের কাছে।অখিলেশ খানিক অপ্রস্তুত হলো।রিতি সেটা বুঝতে পেরে কথার টোন পাল্টে বললো,, নিজের পড়াশোনা গোল্লায় উঠিয়ে অখিলদার কাজের সব্বনাশ ক্যানো করছিস?চল পড়তে বোস।তারা দেয় রিতি।আর আপনাকেও বলি দাদা ভর সন্ধ্যায় গেইম টেইম না শিখিয়ে কানটা ধরে বই নিয়ে তো বসাতে পারেন।বড়ভাই হয়েছেন অথচ কাজ করছেন উচ্ছন্নে যাওয়া বন্ধুদের মতো।

বিস্ময়ে হা হয়ে আছে অখিলেশ।মনের মধ্যে আবেগ এসে ভর করলো নিজের ছোট বোনদের মনে করে।এমন শাসন শুধুমাত্র আপনার লোকে ছাড়া করে না।
বড়ো ভাই হলো আবদারের আরেক নাম।বড়ো ভাই হলো ত্যাগ আর স্বার্থহীনতার আরেক নাম।বড়ো ভাই হলো নিজের সর্বস্ব দিয়ে ছোট ভাই বোনকে খুশি করার আরেক নাম। সর্বশেষে বড়োভাই হলো বাবার ছায়ার আরেক নাম।
সামনে দাঁড়ানো অতি অল্প পরিচিত মেয়েটি মুহুর্তের মধ্যে অখিলেশের মধ্যে ছোট বোনের জায়গাটা করে নিলো।

অভি ইতিমধ্যে ঘড় ত্যাগ করেছে।

অখিলেশ দা এত ভাবনা চিন্তা করার কিছু নেই।আমি এরকমই।ভাব ভনিতা পছন্দ নয় আমার।আপনাকে দাদা বলে ডেকেছি অথচ ব্যাবহার করবো পর মানুষের মতো সে হবে না।দাদা তো দাদা ই। বুঝলেন কিছু?ভ্রু নাচায় রিতি।

অখিলেশ কোনো মতে তাড়াহুড়ো করে বলে,,হ্যা হ্যা বুঝতে পেরেছি।

এবার বুঝবেন ঠ্যালা। আমার দাদা হওয়ার ঝক্কি অনেক।জেনে নেবেন দাদাভাইয়ের কাছ থেকে।

তার আর দরকার হবে না বোনটি ,,আমি বেশ বুঝেছি।

বোনটি যখন বললেন তখন আর আপনি আজ্ঞে ক্যানো দাদা?তবে হ্যা বড়মা জেঠুর সামনে একটু বৌদি টৌদিও বলবেন না হলে আবার ঝামেলা হতে পারে।

সে দেখা যাবে।তাহলে যাই এখন অভি বাবুকে পড়াটা দেখিয়ে দি গে।

না না অখিলেশ দা।ওটা তো এমনিতেই বললাম। আপনি নিজের মতো করে সময় কাটান।

চমৎকার মিশুকে ছেলে অভি।ওকে পড়াতে ভালোই লাগবে।ছেলেটার মনটা তো খারাপ করে দিলে,যাই গিয়ে একটু পড়াই।তুমি ওর ঘড়টা দেখিয়ে দাও।

ঠিক আছে। যাবেনই যখন, তখননিচে চলে যান।স্টাডি রুমেই পাবেন।ওই যে,গেষ্ট রুমের বাঁ সাইডের রুমটা।আর হ্যা আজ প্রদীপদার সাথে যেখানে গেলেন ক্যামন লাগলো?কাজ পছন্দ হয়েছে?

বুনু আমার একটা কাজ প্রয়োজন। পছন্দ অপছন্দ তো ঢেড় দূরের ব্যপার। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুসকা বিক্রি করতে যে পিছুপা হয়না তার এই কাজ অপছন্দ হবে বলে তো মনে হয়না।ক্যামন করুন শোনালো অখিলেশের গলাটা।

অখিলেশ দা,নিজেকে কখনোই ছোট ভাববেন না। তাহলে কিছু মানুষ আপনাকে পেয়ে বসবে। উচ্চাশা করতে তো দোষ নেই।স্বপ্ন দেখা অপরাধ নয়। আচ্ছা আপনি এগোন আমি আসছি।

অখিলেশ আচ্ছা বলে বেরিয়ে যায় ঘড় থেকে।রিতি নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে থাকে সেদিকে।
প্রথম দেখায় তেমন একটা সুবিধার মনে না হলেও সেদিন যখন বিরূপাক্ষ রঘুনাথকে বলছিলো অখিলেশের জীবন যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার কথা।তখন একজন মানুষ হয়ে আরেক জন দুঃখী মানুষের দুঃখ নাড়া দিয়ে গেলো রিতিকে। মানুষ কতটা অসহায় হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে ফুচকা বেচে।মনে মনে ভাবে রিতি।

মা,,, ওমা,,কই তুমি? এদিকে আসো না?ভাতের হাঁড়ির ফ্যানটুকু গেলে দিয়েই রান্নাঘর থেকে ছুটে শোয়ার ঘরে আসেন সাবিত্রী দেবী। আটপৌরে করে পরা সুতির শাড়ির আঁচল টা কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে বললেন ব্যস্ত হয়ে,,কি হইছে বাপ এত চিল্লাইতেছো ক্যান?

মা এদিকে আসতো।দ্যাহ কি আনছি। পছন্দ হয় কি না কও তো?মাকে হাত ধরে খাটের উপর বসায় প্রদীপ।সদ্য কিনে আনা শাড়ি দুইটা মেলে ধরে মায়ের সামনে।

কত টাকা দিয়া আনছো?এহন কি পয়সা খরচ করার সময় কও? সামনে কত খরচা হইবো,,আমি বুইড়া বিধবা মানুষ এত সোন্দর কাপড় পইড়া কই যাবো?

টাকার হিসাবে তোমার কি কাম মা?আমি হাউশ কইরা আনলাম তুমি পরবা ব্যাস।দৃঢ় স্বরে বললো প্রদীপ।
সে মায়ের সাথে সবসময় আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।লেখা পড়া বেশী দূর করতে না পারলেও একটা বাক্য খুব মানে সে,,”বিনে স্বদেশী ভাষা,মিটে কি আশা?
মায়ের সাথে মায়ের ভাষায় কথা না বলতে পারলে কি শান্তি মেলে?

সে না হয় পরলাম কিন্তু সেদিন তোমারে কইলাম না সুমির লাইগা পূজায় কিছু কিন্না দিবা?তার কি হইলো আনছো কিছু?

আমি ফাও টাকা খরচ করতে পারবো না মা।তারে ক্যান পকেটের পয়সা খরচ করে জামা কাপড় দিতে যাবো।আগে আসুক এইখানে তহন তুমি দিও যা মন চায়।

তাইলে এগুলা আমার পছন্দ হয়নাই তুমি ফিরায় দিয়াসো। হাতের শাড়িটা খাটের উপর রেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন সাবিত্রী।প্রদীপ পেছন থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে,,
চ্যাতো ক্যানো মা। আমার মায় একটা কথা কইবো আর আমি শুনবো না এইটা হয় কও? বালিশের নিচে থেকে দুইটা ব্যাগ বের করে মাকে দেখায়,,এই যে দ্যাখো তোমার আদরের সুমির জন্য।কাল নিজের হাতে দিয়া দিও।আইতে বলবো ওকে।নাও ধরো।রাইখা দাও এগুলো আমি গেলাম। মুরগীর খাবার দেওয়ার সময় হইলো।

স্বাবিত্রী দেবী যখন বৈধব্য দশাগ্রস্থ হন তখন কতই বা বয়স? একুশ কি বাইশ মাত্র মেয়েটার বয়স তিন আর ছেলেটা মানে প্রদীপ তখনো পৃথিবীর আলো দেখেনি।আত্ম ভোলা মানুষ ছিলেন প্রদীপের বাবা।নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরতো বর্ষার মৌসুমে আর অন্য সময় চাষাবাদ করেই চলতো জীবিকা।সামনে নতুন সদস্য বাড়বে সংসারে।আয় বাড়াতে তৎপর হন তিনি। তখনো প্রভাকর চৌধুরী উপজেলা চেয়ারম্যান হননি।প্রথম প্রথম রাজনীতিতে পদার্পনের কৃপায় বন্ধু আর শত্রুর সংখ্যায় পার্থক্য রইলো না বেশী।এক রাতে একদল দুর্বৃত্ত ঢুকলো মথুরাপুর গ্রামে। উদ্দেশ্য চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে প্রভাকর চৌধুরীকে নিজেদের পথ থেকে চিরতরে নির্মূল করা। কিন্তু তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সদ্য রাজনীতি তে জড়িয়ে পরা প্রভাকর চৌধুরীর বিচক্ষণতার কাছে হার মানতে বাধ্য হলো। মথুরাপুর এবং চন্ডিনগরের লোকজন তাদের ঘিরে ফেললো তিন দিক দিয়ে। পালানোর একমাত্র পথ নৌপথ। তখন মধ্য রাত পেরিয়েছে।জাল ফেলে বাড়িতে ফিরছেন প্রদীপের বাবা।সবে ঘাটে নোঙর করেছেন নৌকা অমনি ছয় সাত জনের একটি দল ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁর উপর। তিনি বৈঠা ছাড়তে নারাজ হওয়ায় একজন ধারালো অস্ত্র টা বসিয়ে দিল উনার মাথায়।তিনি ছিটকে পরলেন নদীর কাঁদা মাটির উপর। দুইজন দুর্বিত্ত ধরা পড়লো।আর তাদের নির্মমতার শিকার হতে হলো এক অসহায় পরিবারকে।বাইশ বছর বয়সে বিধবার বেশ নিলেন সাবিত্রী দেবী,তিন বছরের মেয়েটা হারালো তার বটবৃক্ষের ছায়াকে আর পিতার মুখ দেখার ভাগ্য হারালো এক গর্ভজাত শিশু। বাবার মৃত্যুর মাত্র দের মাসের ব্যবধানে জন্ম নিলো প্রদীপ।বাবা কি জিনিস জানে না ও। ছোটবেলায় যেমন তেমন বড়ো হতেই বুঝলো প্রদীপ ” যার বাবা নেই, তার কোনো আবদার নেই”
****
রিতি,অভি রূপ, কইরে তোরা।গেলি কোথায় সব। উচ্চ স্বরে ডাকতে ডাকতে ঘরে ঢুকছে রঘুনাথ। দুহাত ভর্তি শপিং ব্যাগ তার। রিতি জয়ার সাথে রাতের রান্নার জোগাড় করছিলো।বেসিনে হাত ধুয়ে দৌড়ে আসে রন্ধনশালা থেকে।রঘুনাথের পেছনে ড্রাইভারের হাতেও শপিং ব্যাগ বোঝাই।রিতি রঘুনাথ এর হাত থেকে দ্রুত কিছু প্যাকেট নিয়ে নিলো।সোফায় রেখে হাঁক ছাড়ল জোরে।সবাই হাজির বসার ঘরে। অন্নপূর্ণা দেবী নামতে নামতে বললেন,বড় খোকা এই ভাবে টাকা নষ্ট ক্যানো করছিস বাবা?এত কিছু কিনতে নিষেধ করছি না তোকে?কথা মোটে শুনবি না।

মামিমা এমন ক্যানো করছো বলোতো?সবসময় কি আনি? হেসে বলে উঠলো রঘুনাথ।

করো আরো বেশি করে অপচয়।এত বড়োটি হয়েছিস এখনো হিসেবি হলি না আর কবে হবি বাবা? সোফায় স্বামীর পাশে বসতে বসতে বললেন তিনি।

সে কি গিন্নি তোমার এই কথা যদি আমাদের পার্টির ছেলেপেলেরা শোনে নির্ঘাত পাগল ভাববে তোমাকে। আমাদের রঘুর পকেট থেকে এককাপ চায়ের জন্য পাঁচটি টাকাও বের করা যায়না জানো?ওরা তো ওকে কিপ্টে দাদা বলে আড়ালে।

মামাবাবু এমন কথা টা কে বলেছে শুধু নামটা বলে দ্যাখো।রাগে তেতে উঠল রঘুনাথ।

হ্যা বাবা সেইটি তোমাকে বলি আরকি তাহলে তার গর্দান নিতে সুবিধে হয় বৈ কি তোমার।সেবেলায় যে কার্পন্য করবেনা সেটা সবাই জানে।হাসার তালে বললেন প্রভাকর।

সবার সামনে প্রেস্টিজের দফা রফা হওয়ায় মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে রঘুনাথ।রিতি ব্যাপার টাকে সামলাতে বললো,,দাদা ভাই আরো কিছু শাড়ি আনতে আমার জন্য।আমি একটা প্ল্যান করেছি বুঝলে?সবাই তাকায় রিতির দিকে।

যে শাড়ি চুড়ি গুলো পেলাম এগুলো নিলামে বিক্রি করবো। অর্ধেক দামে বেচলেও পূজোর মেলার খরচ সহ আরো দুইমাস নির্দিধায় চলে যাবে।কি বলো?ভ্রু নাচায় রিতি।রঘুনাথ চোখ বড়ো করে তাকায় রিতির দিকে।বসার ঘড়ে হাসির রোল পরে রিতির বলার ভঙ্গিতে।রিতিও হাসছে শব্দহীন হাসি। বিরূপাক্ষ নিজের হাসি থামিয়ে সেদিকে চেয়ে থাকে মুগ্ধ নয়নে।মনে মনে বলে,,এই হাসিতে তো মরনও ভালো রে।যে মরবে সেই হবে ভাগ্যবান।
*****
আজ ঘুম ভাঙতে একটু বেলা ই হলো বিরূপাক্ষের।কাল অনেক রাত পর্যন্ত গল্প গুজব চলেছে বসার ঘড়ে। নিজের ঘড়ের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আড়মোড় ভাঙছিলো সে হঠাৎ রাস্তায় গাড়ির শব্দে সেদিকেই ফিরে তাকায়।গেট দিয়ে ঢুকলো বাড়ির বড়ো সাদা গাড়িটা। মন্দিরে যাওয়ার রাস্তায় থামলো গাড়িটা।ড্রাইভিং সিট থেকে নামলেন স্বয়ং প্রভাকর রায় চৌধুরী।অবাক হলো বিরূপাক্ষ বাবা তো কখনো নিজে ড্রাইভিং করেন না।অপর পাশের দরজা খুলে বেড়িয়ে এলেন প্রভাকরের বয়সি এক ব্যাক্তি।স্যুট বুটে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাঁর আভিজাত্যের ছটা। অবশেষে চিন্তে পারলো বিরূপাক্ষ ,আগেও যেমন দেখেছে এখনো ঠিক তেমনি আছে প্রায়।ঐ ভদ্রলোক তার বাবার কলেজ জীবনের অন্তরঙ্গ বন্ধু নিহার রঞ্জন দেবনাথ। ছোটবেলায় কয়েকবার দেখেছে বিরূপাক্ষ।অনেক বছর দেখা হয়না। গাড়ির পেছনের দুই দরজা দিয়ে বেরোলো আরো তিনজন।একটু বয়স্কা যিনি তিনি নিজের বয়স ভুলে পোশাক -আশাককে প্রাধান্য দেন বেশি তা দেখেই বুঝা গেলো।অল্প বয়েসী মেয়েটা তো আরো একধাপ এগিয়ে। কিন্তু যে যুবকটি এসে অন্নপূর্ণা দেবীকে প্রণাম করলো সে ফরমাল ড্রেসে আছে বাবার মতো।জয়া,রিতি, অন্নপূর্ণা মন্দিরেই ছিলো ওদের দেখে এগিয়ে গেলো হাসি মুখে।তারপর কুশল বিনিময় ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরূপাক্ষের মনে পরলো তার বাবার বলা গতরাতের কথাটা।তিনি বলেছিলেন এবারের পূজো উপলক্ষ্যে তার বিশেষ বন্ধু স্বপরিবারে আসছেন ইন্ডিয়া থেকে তবে তাঁরা যে এই সাত সকালে কাক ডাকা ভোরে হাজির হবেন সেটা ভেবে একটু বিরক্ত হলো বিরূপাক্ষ।বেশি লোকজন মানেই তো সেই গ্যাঞ্জাম, চেঁচামেচি।হঠাৎ একটা বিষয় দেখে ভ্রুদ্বয় আপনা আপনি কুঁচকে গেলো বিরূপাক্ষের।রিতি ঐ অচেনা যুবকটির সাথে হেসে হেসে করমর্দন করছে?তার সাথে কথা বলতে গেলেই যত রামগরুরের মতো গোমড়া মুখো বাঁদরী সাজে আর অন্যের বেলায় রসের হাঁড়ি?আমি হাত ধরলে ফোসকা পড়ে আর এখন? শয়তান মেয়ে কোথাকার। বিরক্তি সূচক একটা শব্দ প্রয়োগ করে ব্যালকনি থেকে ভেতরে ঢুকে যায় বিরূপাক্ষ।এতসব হেসে হেসে কথা বলার সময় মুখের উজ্জ্বল লাবণ্য দুজনেরই সহ্য হয় না বিরূপাক্ষের।বাথরুমে গিয়েও বুকের খচখচানিটা বন্ধ হয়না তার।ফাউল মেয়েটার জন্য বোধহয় বাথরুমের বিশেষ কাজটাও আজ হবে না ঠিকমতো।

চলবে,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।
ভালো থাকবেন সবাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here