প্রজাপতি উৎসব
#প্রেমের_গল্প #প্রজাপতি_উৎসব
পর্ব ১৬
কাল রাতে মিতি হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। দিলশাদ আর অতন্দ্রিলা আমার রুমে এসেছিল মিতিকে দেখতে। মিতি জানালো ও পানিতে পড়ে যাবার সময় রায়হান ওর সঙ্গে ছিল। অতন্দ্রিলা উত্তেজিত কন্ঠে জিগেস করলো,
-রায়হান কি তোকে ধাক্কা মেরে ফেলেছে?
অতন্দ্রিলার ক্ষুব্ধ প্রশ্নের জবাবে মিতি বললো,
-ইচ্ছে করে ফেলেনি হয়তো।
-মানে কী?
-আমারও দোষ আছে।
-কী দোষ।
-আমি রায়হানকে বলেছি, চলো আমরা রেজিস্ট্রি অফিসে গোপনে বিয়ে সেরে ফেলি।
-তারপর কী হবে?
-তারপর ও এডিনবরা চলে যাক। আমি সেপ্টেম্বর সেশনে ওখানে গিয়ে কোন একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামে জয়েন করবো। তাহলে তো সব সমস্যা মিটে গেলো, কে কী বললো সেই ভয় থাকলো না।
-ভালোই তো, তোমরা আমরা একসঙ্গে থাকতে পারবে, চাইলে বাচ্চাও রাখতে পারবে।
-হুম।
-রায়হান ভাই কী বললেন?
-রায়হান আমার কথা শুনে ক্ষেপে গেলো। বললো, এত বাচ্চা বাচ্চা করছো কেন? বাচ্চা বড় না আমি বড়?
-কী বিশ্রী হিংসুটে প্রশ্ন, তুই কী বললি?
-আমি বললাম, বাচ্চার সাথে নিজের তুলনা করছো কেন। ও বললো, বাহ বেশ, এখুনি তো দেখছি ওই বাচ্চা তোমাকে কন্ট্রোল করা শুরু করেছে। জন্মালে তো রায়ট লাগিয়ে দেবে।
-ইস, কী ছোট মন, তারপর কী হলো?
-হরমোনাল চেঞ্জের জন্য আমার কদিন ধরে মুইড সুইং হচ্ছিল। রায়হানে কথা শুমে মাথায় আগুন ধরে গেলো। আমি হঠাৎ হাতের পার্সটা ওর গায়ে ছুঁড়ে মারলাম।
-ইস কী একটা অবস্থা।
-হুম। রায়হান তখন আমাকে উল্টো ধাক্কা দিলো নাকি ছুঁলো নাকি আমিই কাদায় স্লিপ কাটলাম, নিজেই বুঝতে পারলামনা। আমি তখন আনন্দ দীঘির ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
-তুই পানিতে পড়ে গেলি?
মিতি এবার উদাস কন্ঠে বললো,
-পড়ে গেলাম কিন্তু…
-কিন্তু কী?
-সেবার যখন রায়হানের সঙ্গে মেঘনা ভ্রমণে গেলাম , বলেছিলাম আমি সাঁতার জানি না, ভয় করে। রায়হান বললো সে ভালো সাঁতার জানে, হঠাৎ লঞ্চ ডুবে গেলে সে-ই আমাকে উদ্ধাব করবে।
-সেটাই তো ভাবছি, তুই যখন আনন্দ দীঘিতে পড়ে গেলি, রায়হান ঝাঁপ দিলো তোকে বাঁচাতে?
হঠাৎ মিতির বাঁধভাঙ্গা কান্না এলো, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,
-আমি ডুবে যাচ্ছি, ও দেখছে, কিন্তু কী আশ্চর্য, ও হেঁটে অন্যদিকে চলে গেলো। কীভাবে পারলো এটা?
দিলশাদ রেগে বললো,
-শয়তানটা জানতো তুই সাঁতার জানিস না, ডুবে মরবি। ও সেই সুযোগটা নিয়েছে।
মিতি কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-আমি জানি না, রায়হান কেন এমন করলো। ও এত খারাপ হতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।
এবার আমি বললাম,
-অথচ রায়হান ভাই আমাকে বললেন উনি অ্যাম্ফিথিয়েটারে তোর জন্য ওয়েট করছেন, কিন্তু তোকে পাচ্ছেন না। তার মানে উনি মিথ্যে কথা বলেছেন।
দিলশাদ বললো,
-তুই কী করবি এখন মিতি ? মানে অ্যাবরশনের কথা ভাবছিস?
-আবরশনের কথা কেন ভাববো।।এমন অবস্থায় পড়তে হবে জানলে রায়হানের সঙ্গে মিশতামই না।। রায়হান বাচ্চা না চাইলে আরও সাবধান হতে পারতো, সব সময় প্রটেকশন ইউজ করতে পারতো।
অতন্দ্রিলা উত্তেজিত হয়ে বললো,
-তুই কি একটা গাধা? প্রটেকশন ইউজ করেনি মানে? তাহলে ওকে তোর শরীর ছুঁতে দিলি কেন?
-ও বলেছিল লেকচারশিপ হয়ে গেলেই আমাকে বিয়ে করবে।
-এখন কী করবি তাহলে?
-আপার সঙ্গে কথা বলেছি। শুধু আপাই পুরো ঘটনা জানে, বাসায় আর কাউকে বলিনি।
-তোর আপা সুইডেন থাকে না?
-হুম। আপা বলেছে একটা মাস্টার্স কোর্সে অ্যাডমিশন নিয়ে ওখানে চলে যেতে।
-ওখানে বাচ্চাকে বড় করবি?
-হুম।
অতন্দ্রিলা বললো,
-রায়হানকে কিন্তু ছাড়বি না। ডিএনএ টেস্ট করাবি। রায়হান যেন পিতৃত্ব অ্যাভয়েড করতে না পারে।
-হ্যাঁ, আপাও তাই বলেছে।
আজ সকালে ইন্সপেক্টর লাবণি রঞ্জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিটেকটিভ ব্র্যাঞ্চে নিয়ে এসেছে। আমিও দিলশাদকে রিকোয়েস্ট করে ইন্সপেক্টর লাবণির সঙ্গে ডিবির অফিসে এসেছি। একঘন্টা হয়ে গেছে ওরা ওকে একটা ঘরে নিয়ে প্রশ্ন করছে। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। আজ যদি লাবণি প্রমাণ করেন রঞ্জন ওই সব জঘন্য রেপের সঙ্গে জড়িত ছিল, আমি জানি না আমার কী হবে।
আমি অন্যদিন ম্যাগাজিনের ঈদ সংখ্যা হাতে নিয়ে একটা গল্প পড়বার চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার হাত কাঁপছে, গল্পে মন বসাতে পারছি না। একজন আর্দালি ভদ্রতা করে বললো, আপা, চা দিই? আমি মাথা নেড়ে না করলাম। এই অবস্থায় কি চায়ের কাপে চুমুক দেয়া সম্ভব? আমি তো পারবো না, ভকভক করে বমি হয়ে যাবে। একঘন্টা পর ইন্সপেক্টর লাবণি ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। আমি প্রশ্নাতুর চোখে ওনার দিকে তাকালাম,
-রঞ্জনকে অনেক প্রশ্ন করলাম।
-কী বললো রঞ্জন?
-ওই আন্ডারগারমেন্টস ভরা টিনের ট্রাংক ওর না।
আমার ভেতর থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেলো। বললাম,
-তাহলে ওটা কার?
-আপনাদের ভার্সিটিতে রাজনৈতিক কিছু ব্যাপার আছে, সে প্রসঙ্গে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছি না। আপাতত এটুকু জেনে রাখুন, রঞ্জনের রুমে অন্য যে ছেলেটি ছিল সে একাট পলিটিকাল পার্টির কর্মী, সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ হল ছেড়ে চলে গেছে।
-ট্রাংকটা কি ওই ছেলের?
-হ্যাঁ, সেটাই মনে হচ্ছে। আশপাশের রুমেও খোঁজ নেয়া হয়েছে। একজন বলেছে ট্রাঙ্কটা ওই ছেলের।
-তাহলে ওকে ধরছেন না কেন?
-ধরবো, একটু সময় লাগবে। ও কোর্স শেষ করে সম্ভবত গাইবান্ধা চলে গেছে।
-তাহলে রঞ্জনের চেহারার সাথে যে কার চেহারার মিল পেয়েছিলেন?
-ওটা আবার নতুন করে ভাবতে হবে। একই গড়নের অন্য কেউ হতে পারে। যা হোক, ওই ট্রাংক রঞ্জনের না।
পুলিশের ভ্যানে যখন আমাকে আর রঞ্জনকে ভার্সিটি পৌঁছে দিচ্ছিল, আমার খুব লজ্জা লাগছিল। ইস রঞ্জনকে কী একটা নোংরা ব্যাপারে সন্দেহ করে বসেছিলাম। এত খারাপ কি রঞ্জন হতে পারে? ও কি জানে আমিও ওকে সন্দেহ করেছি? আমি রঞ্জনের দিকে তাকালাম। ওর চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ও জানালার কাচ দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ডিটেকটিভ অফিসে নেয়ায় সে ভীষণ অপমানিত বোধ করছে।
আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না। ডান হাতটা আলতো করে রঞ্জনের বাঁ হাতের উপর রাখলাম। রঞ্জন ওর হাত সরিয়ে নিলো না। আবার কোন সাড়াও দিলো না। আহা, বেচারা, একদিন দু দিন যাক, আপনাতেই ওর অভিমান কেটে যাবে। হলে ফিরে আমি কম্পিউটারে ইমেইল চেক করলাম, টিটু ভাই জবাব দিয়েছে,
-প্রিয় রূপা,
তোমার শেষ চিঠি পড়ে মনে হলো তুমি আমায় মিশ্র বারতা পাঠাচ্ছো। আমার হৃদয় দুয়ারে কড়া নাড়বে কি নাড়বে না এমন দ্বিধায় ভুগছো । রবীন্দ্রনাথে দুটো লাইন মনে এলো,
হে মাধবী, দ্বিধা কেন, আসিবে কি ফিরিবে কি
আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি৷
তোমার অমন মিক্সড সিগ্ন্যালকে অনেকে ভুল বুঝতে পারে। ভাবতে পারে তুমি আমায় দ্বিতীয় পছন্দ হিসেবে ঝুলিয়ে রাখছো। কিন্তু আমি জানি সেটা সত্য নয়, তুমি সে রকম মেয়ে নও।
তোমার হৃদয়কমলবনে আমাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব দিয়ে কখনোই অপমান করবে না তুমি। তুমি যেদিন আসবে সব নিয়েই আসবে।
এ কারণে তোমার দ্বিধাই আমাকে আশা যোগাচ্ছে।
অনেক নদী আছে, বইতে বইতে যার একসময় নতুন ধারা জন্মায়। মানে নদীটি দুটো ধারায় ভাগ হয়ে যায়। এক সময় দেখা যায় পুরনো ধারাটি শুকিয়ে সব জল নতুন ধারায় বইছে।
তোমার দ্বিধার পথ কেটে আমিও সেই নতুন ধারাটি হতে চাই। হয়তো একদিন আমার দুকুল ভেসে যাবে তোমার মনের অলকানন্দা জলে।
ইতি,
আপাত বিভ্রান্ত টিটু
(চলবে, কিন্তু এ লেখায় দু সপ্তাহের ছুটি নেবো অন্য একটি লেখা শেষ করবার জন্য )
পর্ব ১৭
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1361441201037570/