# ছায়াকরী
# পর্বঃ২২
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
জলপাই রঙা শাড়িটার আঁচলের ভাঁজ কাধে তুলে নিল তোভিয়া। তার নিতম্ব ছড়ানো চুলে ঢেউ খেলছে। পাতলা, ছিপছিপে দেহের মাঝে ঘন চুলের বহর। আয়নায় নিজেকে দেখেই পেছন ফিরল সে। জেহেন আড়ষ্ট চোখে তাকিয়ে আছে। অভিব্যক্তিতে কোনো হেলদোল নেই। তার নির্নিমেষ চাহনির বদলে চোখের তারায় দৃশ্যমান খুশি উপহার দিলো তোভিয়া। সে উৎফুল্লচিত্তে জেহেনের কাছে এসে দাঁড়াল। অধর বিস্তৃত করে বলল—
“ভাইয়া আপনাকে তার কক্ষে যেতে বলেছে।”
জেহেন সরে এসে ভাবলেশহীন গলায় বলল—
“জানি।”
“তাহলে চলুন।”
“যাব।”
জেহেন তার দেয়ালে লাগানো ঔষধের বাক্স খুলে কী যেন দেখল। তারপর তা লাগিয়ে স্থির হয়ে বলল—
“তুমি থাকো, আমি যাচ্ছি।”
তোভিয়া মৃদু গলায় বলল—
“আমিও যাব।”
জেহেন নীরব সম্মতি দিলো। চোখের পাতা ফেলে তোভিয়াকে আশ্বস্ত করল। চকিতে মৃদুহাস্য অধরে জেহেনের পাশে এসে দাঁড়াল তোভিয়া। জেহেনের হাত আলগোছে বুকের সাথে ধরে বলল—
“চলুন।”
জেহেন ভ্রূ কুঁচকে তাকাতেই খিলখিলিয়ে হেসে বলল তোভিয়া—-
“বিবাহ হয়েছে আমাদের। বদ্ধ কক্ষে আপনি আমার, তেমনি খোলা হাওয়াতেও আপনি আমার। এটা আমার অধিকার।”
জেহেন নির্লিপ্ত। তার প্রগাঢ়, সচেতন, নিমগ্ন দৃষ্টি তোভিয়ার হাসি মাখা বদনে।
,
,
,
ভয়ে ইতিবিতি করছে নুয়ায়ামের অন্ত:পুর। তারা দীর্ঘ কায়া থেকে পালক ঝড়ে পড়ছে। চোখের কোটর হলুদ হয়ে তাতে কমলা মনি জেগে উঠছে। ছায়াকরী জানালার গ্রিলের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আছে। নুয়ায়াম বিবশ নয়নে তাকিয়ে ভয়ে ঢোক গিলছে। তার হাতের নখ পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। সহস্র পালকগুচ্ছ থেকে কিছু পালক ঝড়ে পড়েছে মেঝেতে। তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছে তার পিষ্ঠদেশে। যেন বিদীর্ণ করে বেরিয়ে আসবে কোনো শাণিত হা/তি/য়া/র। নুয়ায়ামের বক্ষের দুইপাশ সংকুচিত-প্রসারিত হচ্ছে। ব্যথায় কাতর সে। পিঠের মাঝ বরাবর অসহনীয় যন্ত্রণায় সে বিধ্বস্ত। বাকহীন, বিধুর চাহনিতে তাকিয়ে আছে ছায়াকরীর দিকে। ছায়াকরী উদাস চোখে চেয়ে আছে। নুয়ায়ামকে আরও অনেক কিছুই সহ্য করতে হবে। সময় হয়েছে তার আসল অস্তিত্বকে উপলব্ধি করার।
পালকাবৃত পায়ের দিকে তাকাল নুয়ায়াম। তার পায়ের আঙুল ফুলে উঠেছে। উঁচু ঢিবির আকার ধারণ করেছে পা। নুয়ায়াম শ্বাস আটকে নিয়ে অনুভব করল তার দেহের তাপমাত্রা বেড়ে চলছে। দেহের ভেতর থেকে আগুনের উত্তাপ বেরিয়ে আসছে। ক্রমশ তার সম্পূর্ণ চোখ রক্তিম রং ধারণ করল। যেকেউ দেখলে মনে করবে তার চোখের ভেতর আ/গু/নে/র কুণ্ডলী জ্ব/ল/ছে! নুয়ায়ামের হাতের পাঞ্জা চওড়া হলো। তালুর দাগগুলো মুছে গিয়ে ফুলে উঠল মাংস। গলার শিরা যেন ব্যবচ্ছেদ ঘটাবে কণ্ঠদেশের! অসহিষ্ণু ব্যথায় ধরাশায়ী নুয়ায়ামের ইচ্ছে হলো মেদিনী কাঁপিয়ে চিৎকার করতে। ঠিক সেই মুহুর্তেই দরজায় করাঘাত করল তোভিয়া।নুয়ায়াম শ্বাস ফেলতে ইতস্তত বোধ করছে। তার গালের ভেতর শ্বাস আটকে পড়তেই তা বলয় হয়ে ফুলে উঠল। কাঁপতে শুরু করল সে। তোভিয়া ডেকে উঠল—
“ভাইয়া! দরজা খোল।”
নুয়ায়াম বিভ্রান্ত হলো। কী করবে সে? মেঝের বুকে তার দেহ পরিবর্তনের সকল প্রমান দৃশ্যমান। কালো রঙা চকচকে পালক স্থির হয়ে আছে। এইবার জেহেন আওয়াজ করল—
“নুয়ায়াম, দরজাটা খোল।”
নুয়ায়াম ওষ্ঠাধর ফাঁক করল। এক পশলা তপ্ত শ্বাস নিঃসৃত হলো তার মুখ থেকে। সহসা তার দেহ পূর্বের রূপ ধারণ করতে শুরু করল। নুয়ায়াম ঘনঘন শ্বাস ফেলতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাষ্ঠ হয়ে আছে তার। জিব জড়িয়ে যাচ্ছে। সে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিল জিব দিয়ে। নিজেকে স্বাভাবিক রূপে পেতেই নুয়ায়াম ঠাওর করল মেঝের বুকের পালক। দ্রুত তা সরাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? নুয়ায়াম দৌড়ে এসে কয়েকটা পালক উঠিয়ে পেছন দিকের জানালা দিয়ে বাইরে ফেলল। যা মহলের পেছনের দিক নির্দেশ করে। সে ফিরে এসে মেঝেতে তাকাতেই হতভম্ব হয়ে যায়। মেঝে একদম পরিস্কার। নুয়ায়াম বিভ্রম নিয়ে বলল—
“কী হলো? পালক কোথায় গেল?”
ছায়াকরী তার নিজ অবস্থানে নেই। তা খেয়াল করেনি অধৈর্য, বিচলিত, উদ্বিগ্ন নুয়ায়াম। সে চট করে দরজা খুলল। পেলব ললাটে ভাঁজ তুলে বিরক্তি নিয়ে বলে উঠে জেহেন—
“এতক্ষণ কী করছিলে? সে কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি।”
নুয়ায়াম ঠোঁট চেপে নিল ভয়ে। পরমুহূর্তে বলল—
“দুঃখিত আমি। ভেতরে এসো।”
তোভিয়া ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শঙ্কিত হলো। ঝট করে প্রশ্ন করল —
“তুমি ঠিক আছ?”
নুয়ায়াম ঢোক গিলে শুষ্ক গলা আর্দ্র করে বলল—
“হ্যাঁ, আমি ঠিক আছি। তোমরা বসো।”
জেহেন ঘরময় তাকিয়ে ছায়াকরীকে দেখতে পেল না। সে নিষ্কম্প দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল নুয়ায়ামকে—
“ছায়াকরী কোথায়?”
নুয়ায়ামের মস্তিষ্ক সচেতন হলো। সে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল—
” এএএ এখানেই তো ছিল।”
তোভিয়া স্পষ্ট কণ্ঠে বলল–
“ছায়াকরীকে নিয়ে কেন পড়ে আছ?
ভাইয়া, তুমি না জেহেনের সাথে কথা বলবে?”
নুয়ায়াম মনে করার ভঙ্গিতে বলল—
“ও হ্যাঁ। আসলে…।”
অতর্কিতে ভয়ংকর ঘটনা ঘটল। নুয়ায়াম দুই হাতে তার মাথা চেপে ধরল। ঝড়ো হাওয়ার দাপুটে ধাক্কার অনুরূপ ছিটকে পড়ল সে বিছানায়। নুয়ায়াম কাতরাতে থাকল। তীব্র, অসহিষ্ণু যন্ত্রণায় তার দেহ, মস্তিষ্ক সব চুরচুর হচ্ছে। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে দলিয়ে ফেলল চাদর। শশব্যস্ত তোভিয়া ছুটে গিয়ে নুয়ায়ামের বুকের ওপর হাত রেখে উদ্বেলিত গলায় বলল—
“ভাইয়া! ভাইয়া! কী হয়েছে তোমার?”
জেহেনের মুখ থমথমে। মেঘহীন আকাশে হঠাৎ বর্ষার মতো অবাক হলো সে। বিছানায় কাছে এলো তড়িৎ গতিতে। এক হাঁটু বিছানায় ঠেকিয়ে নুয়ায়ামকে থামানোর জন্য দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরল। নুয়ায়ামের দেহে অস্বাভাবিক কম্পন শুরু হয়েছে। তার চোখের দিকে তাকাতেই ভয়ে আঁতকে উঠল তোভিয়া। নুয়ায়ামের চোখের রঙ গাঢ় লাল। আগুন ঝরা সেই চোখ দেখেই মুখ চেপে ধরল তোভিয়া। জেহেন হতবিহ্বল!
সে বিমূঢ় দৃষ্টিতে তোভিয়ার দিকে চাইল। তোভিয়া ভয়কাতুরে কণ্ঠে চোখ ঝাঁপিয়ে কেঁদে বলল—
“ভাইয়া! ভাইয়া!
কী হয়েছে তোমার?”
নুয়ায়ামের অস্থিরতা বাড়তে লাগল। উন্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করল সে। বিছানায় তড়পাচ্ছে । তোভিয়া উঠে দাঁড়াল। তার দিঘীসুলভ চোখ থেকে উপচে পড়ছে শীতল জলের প্রস্রবণ। নুয়ায়ামের মুখ থেকে অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে। তদ্দণ্ডে সেখানে এসে উপস্থিত হলো তেহজীব। তার উদ্ভাসিত চাহনি নুয়ায়ামের জ্বলন্ত চোখে।
,
,
,
ঝরঝর করে কাঁদছে তোভিয়া। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে জেহেন। অসহ্য যন্ত্রণায় জর্জরিত নুয়ায়াম এক সময় অচেতন হয়ে পড়ে। তাকে বিছানায় শুইয়ে রেখে নিজ কক্ষে ফিরে এসেছে জেহেন। তোভিয়া ক্ষুব্ধ, ক্রোধিত। সে কক্ষে ফিরেই উচ্চ কণ্ঠে প্রশ্ন করল—
“চুপ করে আছেন কেন আপনি? কিছু করছেন না কেন?”
জেহেন জবাব দিলো না। সে স্থবির, স্তব্ধ, সমাহিত। দ্বিগুন আক্রোশ নিয়ে তেড়ে এসে ফের বলল তোভিয়া—
“আপনি এখনো চুপ করে আছেন? কিছু করবেন না?”
জেহেন মহাচ্ছায়া জঙ্গলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল—-
“কী করব?”
তোভিয়ার গায়ে যেন কেউ গরম তেল ঢেলে দিলো! সে কণ্ঠ ফাটিয়ে বলল—
“কিছুই করার নেই? ভাইয়ার কী হয়েছে দেখেছেন? আম্মির অবস্থার দিনদিন অবনতি হচ্ছে। আজ কতগুলো বছর দাদাজান আমাদের সাথে কথা বলছে না। আপনি কেন চুপ করে আছেন জেহেন? কেন বেগমরাণিকে জানাচ্ছেন না? কেন এই অসুস্থ মানুষগুলোকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন না? কেন খোঁজ নিচ্ছেন না কাকারাজ কোথায়?”
জেহেন বিনা ভাবাবেশে গ্রীবাভঙ্গি বদলালো। তোভিয়ার বর্ষণস্নাত আননে চেয়ে বলল—
” আমার কিছুই করার নেই।”
ঝাঁঝিয়ে উঠল তোভিয়া। বলল—-
“হ্যাঁ, কিছুই করার নেই আপনার। কারণ, আপনি কিছু করতে চান না। আপনি কখনো কাউকে নিয়ে ভাবেননি জেহেন। শুধু নিজেকে নিয়ে ভেবেছেন। আজও আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবছেন। আপনি কখনো এই মহলকে ভালোবাসেননি। ভালোবাসেননি এই মহলের মানুষদের। আপনি আমাকেও ভালোবাসেননি জেহেন।”
জেহেন গাঢ় শ্বাস ফেলে বলল—
“তুমি যাও এখান থেকে।”
এই কথায় যেন মজা পেল তোভিয়া। কাকে কী বলছে সে? এক পশুকে মনুষ্যত্ব শেখাচ্ছে। অধর কোণে শ্লেষপূর্ণ হাসল তোভিয়া। তাচ্ছিল্যের সাথে বলল—-
” চলে যাব। আপনার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাব। সেদিন আপনি আমাকে খুঁজবেন।”
দুই চোখের লবণাক্ত জলের ধারা স্ফীত হলো তোভিয়ার। দরজা ঠেলে এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে এলো কক্ষ থেকে।
,
,
,
পদ্মদিঘীর স্বচ্ছ পানিতে চেয়ে বুক কাঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে তোভিয়া। চোখ জোড়া ঘোলাটে হতেই মুছে নিচ্ছে অশ্রুকণা। আচানক হাতের সাথে লেগে গেল গলার লকেট। তোভিয়া বিক্ষুব্ধ হলো। কিছু না ভেবেই গলার লকেট খুলতে গেলে অসতর্কতায় তার পা পিছলে যেতেই পেছেন দিকে হেলে পড়ে সে। তাকে বুকের পাটাতনে আশ্রয় দেয় জেহেন। কিছু বোঝার আগেই তোভিয়াকে ক্রোড়ে তুলে নিল সে। জেহেন গম্ভীর স্বরে বলল—
“কী করছিলে তুমি? লকেট সামলে রাখতে বলেছি।”
তোভিয়া ঝুমঝুম করে ঠোঁট উলটে কেঁদে বলল–
“নামান, নামান আমাকে। আপনার দেওয়া সবকিছু ফেলে দেবো।”
সিঁড়ি বেয়ে সতর্ক পা রেখে উঠছে জেহেন। আষাঢ়ে মেঘ সরে তার ওষ্ঠাধরে স্মিত হাসির এক পশলা রোদ ঝিলিক দিয়ে উঠল। মৃদু গলায় বলল—-
“বেশি কথা বললে দিঘীতে ফেলে দেবো।”
“দিন ফেলে। আমার মৃ/ত্যু হলেই আপনি খুশি হবেন।”
বিস্ময়কর কাজ করল জেহেন। তোভিয়াকে বাকহীন করে তার অধরে ছোট্ট কামড় বসাল। সরল গলায় বলল—
“আরেকবার মৃ/ত্যু/র কথা বললে, আমি নিজেই মে/রে ফেলব তোমাকে।”
তোভিয়ার চোখ ডুবে গেল অথৈ সায়রে। সে ব্যথাতুর স্বরে বলল—
” আপনি আমাকে মে/রে ফেলতে পারবেন?”
“কয়েক সেকেন্ড সময় লাগবে আমার। জানো তো আমি কে?
চলবে,,,