# ছায়াকরী
# পর্বঃ২৩
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
অস্থির চোখে চেয়ে আছেন বেগমরাণি। তার অশিথিল, অবোধ্য মস্তিষ্ক। তেহজীবের অধরোষ্ঠের কোণে শ্লেষমিশ্রিত হাসি। মেহেক চিন্তিত, ভীত। তেহজীব ফিচেল হেসে বলল—
“নুয়ায়াম এবার সবার কাল হয়ে দাঁড়াবে!”
বেগমরাণি রুষ্ট স্বরে ঝড়ো বৃষ্টির মতো বললেন—-
“তুমি আনন্দিত হচ্ছ?”
তেহজীব বিদ্রুপের সাথে বলল—
“আর কিছুই করার নেই। এতগুলো বছর কী করেছেন আপনারা? নুয়ায়াম এতগুলো বছর ধরে আপনাদের চোখের সম্মুখে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে, আর আপনারা দিব্যি আরামের সাথে বসে আছেন।”
বেগমরাণি তার পদ্মাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তেজী স্বরে বললেন—
“চুপ করো বেয়াদব! নুয়ায়াম একা আসেনি এখানে। জোবায়ের হাসনাত ওকে ওর রক্ষাকবচের সাথে নিয়ে এসেছে। এত সহজ নয় সবকিছু।”
তেহজীব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে হেসে বলল—
“রক্ষাকবচ এক হলে আপনারা কতজন? এতগুলো প্রাণী মিলে একজনকে বিনাশ করতে পারেননি? তাহলে এখন কী করবেন? এতদিন তো নুয়ায়াম নিজেকে রক্ষা করতে পারত না। কিন্তু এখন…. নিজের চোখে আমি ওর চোখ দেখেছি। আর তো মাত্র কিছুদিন। নুয়ায়াম ওর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হবে। তারপর যা হবে…।”
সশব্দে হেসে উঠল তেহজীব। মেহেক ছেলের এহেন কাণ্ডে হতবাক। তবে তিনি তেহজীবের বিরূপ ব্যবহারের কারণ উদঘাটন করেছেন। আর এর কারণ তোভিয়া।
বেগমরাণি কাঠ কাঠ গলায় বললেন—
“তুমি কী করেছ? তোমার ধ্যান-জ্ঞান সব জুড়ে ওই মনুষ্য কন্যা! আমি হতবাক তেহজীব! তুমি আমার উত্তরাধিকারী। আমাদের ফিরে যেতে হবে। যুবরাজ মায়ং এর বিনাশ হলেই সেই সিংহাসন তোমার। আর তুমি কি না একজন অভিশপ্ত কন্যার প্রণয়ে দিশেহারা!
লজ্জিত আমি!”
“আমি ওকে ভালোবাসি।”
“তোমার সেই ভালোবাসা আমাদের পরিকল্পনায় বাধা।”
তেহজীবের রাগে মস্তিষ্ক ফেটে যাচ্ছে। দুই চোখের সাদা অংশ জুড়ে থাকা সুক্ষ্ম লাল রেখাংশগুলো স্পষ্টত হতে শুরু করল। মেহেক জোরালো শব্দে ডেকে উঠতেই তেহজীবের চোখ স্বাভাবিক হয়ে যায়। তেহজীব বদ্ধশ্বাস ফেলল। নাক ফুলিয়ে হিসহিসিয়ে যাচ্ছে। সরোষে বলল—
“যদি আপনারা নিজ কাজে সফল হতে নাই পারেন তাহলে জেহেনকে কেন বাঁচিয়ে রেখেছেন? ওকে কেন চিতায় রূপান্তরিত করলেন? বাবা কেন ওকে হ/ত্যা করল না সেদিন?”
বেগমরাণি গাঢ় স্বরে বললেন–
“মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে তোমার। জেহেনের কিছু হলে, সেদিন ফারাজ কোনোভাবেই এই মহলে প্রবেশ করতে পারত না। জুহায়েরকে তো হ/ত্যা করা হয়েছেই। জেহেনকে জীবিত রাখা হয়েছে, শুধু এই মহলের মানুষগুলো যেন বিশ্বাস করে, ফারাজই জুহায়ের।”
তেহজীব বক্র হেসে বলল—
“তা বাবা এমনিতেও করতে পারতেন। নিজেকে তো তিনি বদলে ফেলেছেন। এই মহলের মানুষ এত বুদ্ধিমান নয় যে বাবাকে চিনে ফেলত। জেহেনকে হ/ত্যা করলেই ঠিক হতো। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলত, মহাচ্ছায়া জঙ্গলের চিতা খেয়ে নিয়েছে ওকে। কিন্তু আপনারা….ওর মধ্যেই চিতাকে প্রতিস্থাপন করে এই মহলে ফিরিয়ে নিয়ে আসলেন। বিপরীতে কী হলো? মানুষগুলোকে ধোঁকা দিতে পারলেও ওই জেহেনের চোখ আর নাক সর্বত্র সচল। ও আজ পর্যন্ত আমাদের অস্তিত্ব ধরতে পারেনি কারণ, ওকে এই রূপ দেওয়া হয়েছে আর আমরা জন্ম থেকেই।”
ক্রোধান্ধ তেহজীব চরমতম উশৃঙ্খল কাণ্ড ঘটায়। বেগমরাণির তোয়াক্কা না করে তার সামনেই একটা চেয়ারে সজোরে লাথি বসায়। দেয়ালে ছিটকে পড়ে তা। কাঠের চেয়ার ভেঙ্গে কয়েক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। বেগমরাণির বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলেন। তেহজীবের চোখ দুটো লালাভ হলদেটে রঙে রূপ নিল। গলার স্বরে অস্বাভাবিকতা। মেহেক ছেলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন—
“শান্ত হও তেহজীব।”
তেহজীব তার ভয়াল চোখ দুটো দিয়ে চাইল। অদ্ভুত ভ/য়ং/কর গলায় বলল—
“বাবাকে ফিরে আসতে বলুন আম্মি। মায়াস্বর্গে এখন তার প্রয়োজনের চেয়ে এখানে তার প্রয়োজন বেশি।যুবরাজ মায়ং তার সত্তা ফিরে পাচ্ছে। আর সময় নেই। তিঁনি যদি একবার জানতে পারেন, আমরা কে, কী হবে বুঝতে পারছেন? ছায়াকরী কে জানেন?”
বেগমরাণির চোখ জ্বলে উঠল। তিনি তীর্যক গলায় শাসিয়ে উঠলেন মেহেককে—-
“বুদ্ধিভ্রষ্ট নারী! সাজ-সজ্জা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তোমার। ওই একরত্তি মেয়ে নুয়ায়ামকে সিঁড়ি বানিয়ে এই মহলে প্রবেশ করেছে, আর তোমরা এতদিনেও টের পাওনি। মায়াস্বর্গের রাণি হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই তোমার। ”
মেহেক চুপসে গেলেন। তেহজীবের রক্তকণিকা যেন যুদ্ধের ময়দানে উত্তীর্ণ হবে! তপ্ত দেহের সাথে বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ু টগবগ করছে।
তেহজীব কটাক্ষ করে বলল–
“মায়াস্বর্গের রাজ্ঞী, এই মহলের বেগমরাণি, এত ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে আপনি কী করেছেন? এক শিশুকে হ/ত্যা করার জন্য নিজের রাজ্য থেকে এই পৃথিবীতে এসেছেন। আজ এত বছর ধরে তাকে হ/ত্যা করার সমস্ত চেষ্টা নিস্ফল হচ্ছে, একমাত্র ওই রক্ষাকবচের জন্য। প্রথমে ছায়াকরীর মা, এখন ছায়াকরী নিজে নুয়ায়ামকে রক্ষা করছে। সেদিন গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট থেকেও বেঁচে গিয়েছে নুয়ায়াম। আম্মি… আপনি আসলেই বুদ্ধিভ্রষ্টা! না হলে মায়ারাজ্যের ভবিতব্য রাজ্যেশ্বরকে হ/ত্যা করার জন্য আপনি এই ধরনের নিচ কাজ করবেন আমি ভাবতেও পারছি না। আর তোভিয়ার ওপর হা/ম/লা কেন করিয়েছেন আপনি? ওর কিছু হলে আমি কিন্তু….।”
“তেহজীব! ”
বেগমরাণির কণ্ঠে থমকে যায় তেহজীব। তার চোখ দুটো ক্রমশ ভ/য়ং/কর হয়ে যাচ্ছে। বেগমরাণির হাতে থাকা মূষিকটির দিকে তাকায় তেহজীব। মূষিকটি ভয়ে বেগমরাণির কাপড়ে মুখ গুঁজে দেয়। তেহজীব সেখান থেকে চোখ সরিয়ে বলল—
“জেহেন যদি একবার টের পায় জোবায়ের হাসনাত মৃত, তাদের এতদিন ভ্রমে রেখেছেন আপনি…উন্মাদ হয়ে উঠবে সে। এই ইঁদুরকে চি/বি/য়ে নেবে জেহেন। যার প্রাণ আপনি নিজ প্রয়োজনে জোয়াবের হাসনাতের প্রাণহীন দেহে প্রতিস্থাপন করেন। এই জন্যই তো এত আদর, যত্ন এর। ”
বেগমরাণি সংক্ষুব্ধ গলায় বললেন—
“দিনদিন তোমার এই আস্ফালন আমার ধৈর্যের বাইরে চলে যাচ্ছে তেহজীব।”
তেহজীব কুটিল হেসে বলল—
“সহ্য করতে শিখুন বেগমরাণি।”
ফুঁসে যাচ্ছেন বেগমরাণি। চকিতে ঠান্ডা গলায় বলে উঠেন মেহেক—-
“মানে বলছিলাম, জেহেন আর তোভিয়ার বিবাহ হয়েছে দুই দিন হয়ে গিল। এখনো কিছু হলো না কেন?”
বেগমরাণি প্রকুপিত চোখে তাকালেন। তেহজীব বিরক্তি আর রাগের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। বেগররাণির চাহনিতে থিতিয়ে গেল মেহেক। গজরাতে গজরাতে বেগমরাণির কক্ষ থেকে বের হলো তেহজীব। বেগমরাণি উৎকণ্ঠিত চোখে চেয়ে আছেন। মেহেক ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললেন—
“আমি তো শুধু…।”
“নির্বোধ নারী! কোথায় কী বলতে হয় তাও জানো না! ওই অভিশপ্ত কন্যার প্রণয়ে উন্মত্ত হয়ে আছে তোমার পুত্র। আর তার সামনেই..!”
মেহেক মাথা নিচু করে অপরাধী কণ্ঠে বলল—
“ক্ষমা করবেন বেগমরাণি। আমি তো শুধু জানতে চাচ্ছিলাম। জেহেন আর তোভিয়ার মিলনেই তো কৈরবরাজ ( কৈরব অর্থ পদ্ম। কৈরবরাজ অর্থ পদ্মরাজ) রাজকুমার হিমালয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু এখনো তিনি কোনো পদক্ষেপ নিলেন না যে….! তাহলে কী ওদের মিলন হয়নি?”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বেগমরাণি। রোষানলে জ্বলে বললেন—
“তুমি আমার সামনে থেকে যাও। সহ্য হচ্ছে না তোমাকে আমার। যাও বলছি।”
মেহেক তড়িঘড়ি পা চালালো। কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে বুকে থু থু ছিটিয়ে স্বগতোক্তি করলেন—
“কৈরবরাজ এলেই ওই জেহেনের মৃ/ত্যু অনিবার্য। আর ওই নুয়ায়ামের মৃ/ত্যু আমার পুত্রকে মায়ারাজ্যের রাজসিংহাসন পাইয়ে দেবে।”
মেহেক তৃপ্তিকর হাসলেন।
,
,
,
মৃদু, কোমল আলোর অবিশ্রান্ত বিচরণ জেহেনের কক্ষে। ফিনফিনে সমীরণ ঢুকছে জানালার পর্দা উড়িয়ে। চাঁদের অবাধ কিরণ টুকটুক করে উঁকি দিচ্ছে জানালার ফাঁক গলিয়ে। জেহেনের বক্ষস্থলে গুঁজে আছে তোভিয়া। খানিক সময় পরে উঠে বসল সে। পালঙ্কের হেডবোর্ডের সাথে হেলান দিয়ে থাকা আধশোয়া জেহেন সোজা হয়ে বসল। তার শার্টের বোতামের সাথে আটকে থাকা তোভিয়ার শাড়ির আঁচল খুলে নিল। তোভিয়া স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জেহেনের দুই চোখে। তোভিয়ার শাড়ির আঁচল তার কাঁধে তুলে দিলো জেহেন। তোভিয়া নতমস্তকে বিষণ্ণ গলায় বলল—
“ভাইয়ার সাথে এমন কেন হলো?”
জেহেন আশ্বাস দিয়ে বলল—
“চিন্তা কোরো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তোভিয়া উদ্বেলিত গলায় বলল—
“আপনি ভাইয়ার চোখ দেখেছেন?”
জেহেন কথা লুকোনোর জন্য বলল—
“চোখের কী হয়েছে?”
“ভাইয়ার চোখে…..।”
জেহেন অচিরেই নিজের মুখ ডোবাল তোভিয়ার কণ্ঠদেশে। জমে গেল তোভিয়া। ওষ্ঠাগত শ্বাস কণ্ঠনালীতেই ঘুরপাক খেতে লাগল। জেহেন ঘোরগ্রস্তের ন্যায় বলল—-
“এত ভেবো না। কিছু হয়নি নুয়ায়ায়মের। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
তোভিয়ার শাড়ি ভেদ করে তার অনাবৃত উদরে নিজের পুরুষালী হাতের অবাধ্য বিচরণ ঘটাচ্ছে জেহেন। তোভিয়া আবেশে চোখ বুজে নেয়। তার কটিদেশ চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো জেহেন। একান্ত কাজে বিভোর হয়ে বলল—-
“ভয় পেয়ো না পদ্মকুমারী। তোমার ছায়া হয়ে থাকব আমি। ”
তোভিয়া নিমীলিত চোখে শ্বাস ভারী করে বলল—
“ভালোবাসেন আমাকে?”
“প্রমান চাও? তোমাকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। ছায়াকর আমি তোমার। ”
জেহেনের গলা জড়িয়ে ধরল তোভিয়া। তার ভয়ংকর দুই সবুজ নেত্রের দিকে সম্মোহিতের ন্যায় চেয়ে থেকে বলল—
“তাহলে পরিপূর্ণ করুন আমাকে। ”
জেহেন হাসল। গাঢ় মোহিত হাসি। কাঁপন উঠল তোভিয়ার কোমলাঙ্গ দেহে। তোভিয়ার ঘন চুলে হাত গলিয়ে দিলো জেহেন। অধরোষ্ঠের আলতো স্পর্শে জাগ্রত করে তুলল তোভিয়ার নারী হৃদয়। তোভিয়া আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল জেহেনকে। সহসা নিজেকে তোভিয়ার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিল জেহেন। প্রণয়ে বিভোর তোভিয়া বুঝতে পেরেই হকচকিয়ে বলল—
“কী হয়েছে?”
জেহেন দাঁতে দাঁত চেপে আঁখিপল্লব বন্ধ করে নিল। কোনো কিছুর সুক্ষ্ম আওয়াজ ভেসে আসছে তার কর্ণরন্ধ্রে। তাপিত হলো তার দেহ। জেহেন উঠে দাঁড়াল। তোভিয়া হাত আঁকড়ে ধরল জেহেনের। প্রেমাত্মক চাহনিতে বলল—
“এখন কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
জেহেন দৃঢ় গলায় বলল—
“হাত ছাঁড়। যেতে দাও আমাকে। তুমি এখানেই থাকো।”
জেহেন তোভিয়ার হাত ছাড়িয়ে চঞ্চল পায়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। তোভিয়া রাগ, অনুরাগের সংমিশ্রন ঘটিয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলল—
“আমাকে সময় দিতেই এলেই তার সব মনে পড়ে। অসহ্যকর!”
পুরো মহলে ব্যাকুলচিত্তে, তটস্থ পায়ে ঘোরাঘুরি শুরু করে জেহেন। শব্দের প্রগাঢ়তা তাকে টেনে নিয়ে যায় ছাদে। বিধুর নির্লিপ্ত আভাতে জেহেন স্পষ্ট দেখতে পেল জ্বলজ্বলে দুই চোখের ভয়ংকর সেই ইগলকে। ছাদের বাউন্ডারি দেয়ালে বসে আছে সে। ছাদের মাঝে থাকা স্থির পদ্মফুলের প্রতিকৃতির সমান্তরালের বসে আছে ইগলটি। জেহেনের চোখের উজ্জ্বলতা বাড়ল। সে ছাদের দরজা বন্ধ করে দাঁড়াল। আচমকা বিশাল দেহী ইগলটি পাখা ঝাঁপটিয়ে উড়ে এসে আক্রমণ করে বসল জেহেনকে। জেহেন দরজার কাছ বিদ্যুৎ বেগে সরে যায়। ইগলটি দরজার পাটাতনে ধাক্কা লেগে জেহেনের দিকে তেড়ে আসতেই ছাদের বুকে ধপাস করে পড়ে যায় জেহেন।
বেশ সময় ধরে জেহেনের সাড়া না পেয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে তোভিয়া। ছাদের ওপর থেকে শব্দ কর্ণকুহর হতেই সে দ্রুত পা চালায়। সিঁড়িঘর দিয়ে উঠার সময় তোভিয়ার উপস্থিতি টের পেয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় জেহেন। দরজা বন্ধের আওয়াজ কানে পৌঁছাতেই ওপরের দিকে তাকায় তোভিয়া। ত্রস্তে পা চালিয়ে ছাদের দরজার কাছে এসে তাতে চাপড় বসায়।
তোভিয়ার উপস্থিতি ভীত করে জেহেনকে। সে অন্যমনষ্ক হতেই ইগলটির তার বিশাল দেহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জেহেনের ওপর। জেহেন অতর্কিত হা/ম/লা সামলাতে নিস্ফল। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছায়াকরী। সে তার নারী অবয়বে। জেহেন ছাদের পাটাতনে চিৎ হয়ে শুয়ে বিভ্রান্ত চাহনিতে দেখল ছায়াকরীকে। ছায়াকরী তার দুটো পাখা একসাথে করে ইগলটিকে প্রতিহত করতে ঢাল সৃষ্টি করেছে। চটজলদি দাঁড়িয়ে যায় জেহেন। ছায়াকরীর শুভ্র ডানায় শোণিতের ছাপ। ইগলটি তার ধা/রা/লো ঠোঁট দ্বারা ঠুকরে দিয়েছে ছায়াকরীকে। ছায়াকরী উঠে দাঁড়ায়। একপাশে জেহেন অন্যপাশে ছায়াকরী। ছায়াকরীর শুভ্র আলখাল্লা ভেদ করা পাখাতে মৃদু কম্পন। তাদের দুইজনের মাঝ বরাবর ছাদের বুকে বিশাল পা দুটোতে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে ইগলটি। ছায়াকরীর নীলাক্ষী শান্ত।
তোভিয়া ডেকে উঠে—-
“জেহেন! আপনি এখানে?”
জেহেন ছায়াকরীর দিকে তাকায়। ছায়াকরী মাথাটাকে ঝট করে নিচু করে জেহেনকে ইশারা করে। জেহেন শব্দ করে বলে উঠে—
“তুমি যাও এখান থেকে তোভিয়া। দ্রুত যাও।”
তোভিয়ার কণ্ঠে সায়র নেমে আসে। সে কাতর হয়ে বলল—
“দরজা খুলুন জেহেন! কী হয়েছে আপনার? দয়া করে দরজা খুলুন।”
“তোমাকে যেতে বলেছি। আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াবে না এখানে।”
ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল তোভিয়া। তার শাড়ির আঁচল সিঁড়িতে দোল খেলছে। নিতম্ব ছাড়ানো চুল অবিন্যস্ত। ক্রন্দনের জলে কেশ লেপ্টে গেছে মুখে। তোভিয়া দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। চুলে ঢেকে যায় তার মাথা। কঁকিয়ে উঠে সে। জেহেন শ্বাস আটকে নিজেকে শান্ত করে। সে সব শুনতে পাচ্ছে। তোভিয়া ধাতস্থ হতেই খেয়াল করে তার আঙুলের ডগা ফেটে রক্ত ঝরছে। সেই রক্তে ভেজা হাত দিয়ে চোখে মুছে উঠে দাঁড়াল তোভিয়া। তার উদ্দেশ্য এখন নুয়ায়ামের কক্ষ।
লালাভ হলদেটে বর্ণের চোখ দুটোতে আকাশসম ক্ষোভ। ইগলটি এক পা এগিয়ে আসতেই জেহেন আর ছায়াকরী এক কদম পিছিয়ে যায়। ফোঁস ফোঁস করছে ছায়াকরী। ইগলটির চোখে কেমন অদ্ভুত তাচ্ছিল্য! সে ছায়াকরীর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে উড়ে গেল জেহেনের কাছে। ছায়াকরী চকিতে চিৎকার করে উঠে—
“জেহেন!
সামলান নিজেকে।”
চলবে,,,