ছায়াকরী পর্বঃ২৫

0
3338

# ছায়াকরী
# পর্বঃ ২৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি

করিডর দিয়ে হেঁটে যেতেই ভাইয়ের মুখোমুখি হয় তোভিয়া। নুয়ায়াম নিজের মতো করে হেঁটে যাচ্ছিল। তোভিয়াকে ঠাওর করতে পারেনি ব্যগ্রতার দরুন। তোভিয়া পথ আটকে দাঁড়াল। ভ্রূযুগলের মাঝ বরাবর কুঞ্চিত করে বলল—

“কোথায় যাচ্ছ ভাইয়া?”

নুয়ায়াম অন্য দুনিয়াতে ছিল! তোভিয়ার দৈবাৎ কণ্ঠে সে ভিরমি খাওয়ার যোগাড়! এক কদম পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলে বলল—

“তুমি?”

তোভিয়া কপাল কুঁচকাল। ভাইয়ের দিকে সন্দিহান চোখে চেয়ে বলল—

“তুমি কী ভয় পেয়েছ?”

নুয়ায়াম শব্দহীন হেসে বলল—

“না। আসলে আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম।”

“কী ভাবছিলে?”

নুয়ায়াম শুকনো ঢোক গিলে বলল—

“তেমন কিছু নয় তো। জেহেন খেতে আসেনি কেন?”

হাসি ফুটে উঠল তোভিয়ার পদ্মকোমল ওষ্ঠাধরে। চোখ দুটোতে প্রকৃতির নৈসর্গিক স্নিগ্ধতারা জেগে উঠল। অধর বিস্তৃত করে বলল—

“জেহেন ঘুমিয়েছিল। এইতো এখন খাবার নিয়ে যাচ্ছি। তুমি কী কোথাও বের হচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ?”

নুয়ায়াম সরল হেসে বলল—

” অশীতপুর যাচ্ছি।”

তোভিয়া আঁখিপল্লব প্রস্ফুটিত করে চমকিত গলায় বলল—

“কেন?”

নুয়ায়াম ছোট্ট শ্বাস ফেলে রয়ে সয়ে বলল—

“তোমাকে বলেছিলাম না ডাঃ আরইয়াজের কথা! মনে আছে? তিনি অশীতপুর থাকেন। আমি তার কাছেই যাচ্ছি। তিনি একজন ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট। আম্মিজানের কথা আমি তাকে বলেছি। তিনি আমাকে ডেকেছেন।”

তোভিয়া বিস্মিত গলায় বলল—

“তুমি বেগমরাণির সাথে কথা বলেছ?”

“না। আগে ডক্টরের সাথে কথা বলে নিই, তারপর বেগমরাণিকে জানাব। তুমি দুশ্চিন্তা করো না। ”

তোভিয়ার এক হাতে জেহেনের খাবার। অন্য হাত নুয়ায়ামের বুকের ওপর রেখে আদুরে গলায় বলল—

“তুমি সাবধানে যাবে। মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাবে। গাড়ি চালানোর সময় একদম অন্য দিকে মন দেবে না। আর দ্রুত ফিরে আসবে।”

ঝলমলে রোদের মতো হেসে উঠল নুয়ায়ামের দুই চোখ। সে ঠোঁটের আলতো ছোঁয়া আঁকল বোনের ললাটে। তোভিয়ার হাতের ওপর হাত রেখে খুশির ফোয়ারা ঢেলে বলল—

“সাবধানে যাব। মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভিংও করব। একদম অন্যদিকে তাকাব না। আর দ্রুত ফিরেও আসবো।”

মৃদু হাসির কম্পন হয় তোভিয়ার অধরে। নুয়ায়াম ঈষৎ রাগ দেখিয়ে বলল—

“খেয়ে নেবে কিন্তু তুমি। সকালে খাওনি।”

“খেয়ে নেব।”

“তাহলে আমি আসি?”

“হুম। সাবধানে।”

অধর বিস্তৃত করে নুয়ায়াম। চোখ দুটোতে অকপট খুশি।
,
,
,
জেহেনের হাতে সিদ্ধ মাংসের মাটি। তার দিকে অনিমেষ চেয়ে আছে তোভিয়া। কাঁটাচামচের ডগায় করে যখন জেহেন সিদ্ধ মাংস মুখে পুরে দেয়, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে তোভিয়ার। তার এই অভিব্যক্তি আঁচ করতে পেরে নিগূঢ় হাসে জেহেন। গ্রীবাভঙ্গি বদলে তোভিয়ার দিকে সোজা দৃষ্টি রেখে বলল–

“খাবে?”

“ছিঃ!”

নাক ছিটকে উঠে তোভিয়া। জেহেন হেসে ফেলে। ভারী ভাবাবেশ ছাড়াই নিজের খাওয়াতে অভিনিবেশ করে। তোভিয়া গাঢ় দৃষ্টি স্থির রেখে বলল—

“কাল ছাদে কেন গিয়েছিলেন?”

জেহেন প্রত্যুক্তি করল না। গোলাপি মাংসের টুকরোতে চিলি সস লাগিয়ে মুখে পুরে চিবুতে লাগল। তোভিয়া কঠিন করল স্বর। বলল—-

“কী হলো? কথা বলছেন না কেন? কাল ছাদে কী হয়েছিল? আপনি কেন গিয়েছিলেন?”

“এমনি।”

তোভিয়া রাগের অনুরণনে তপ্ত। সে বিছানা থেকে উঠে যেতেই জেহেন খপ করে তার হাত ধরে ফেলে।

“হাত ছাড়ুন।”

খাবারের বাটি বামপাশে রেখে উঠে দাঁড়ায় জেহেন। তোভিয়ার উন্মুক্ত চুলের বহরের মাঝে ছোট্ট মুখখানা নিজের শ্বাসের কাছে টেনে নিয়ে এলো সে। আবেশিত চিত্তে তোভিয়ার অধরের কোণে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলল—

“পদ্মকুমারীর এত রাগ কেন?”

তোভিয়াকে ঘুরিয়ে তার পিঠ ঠেকিয়ে নিল নিজে বুকে জেহেন। মেঘচিকুরের অবিমিশ্রি সতেজতায় ঘ্রাণেন্দ্রিয় ডুবিয়ে দিলো। তোভিয়া সরব গলায় বলল—

“আপনি আমাকে মিথ্যে বলেছেন।”

জেহেন নেশাক্ত গলায় বলল—

“কখনো নয়।”

“সত্য লুকানো মিথ্যের শামিল।”

“তুমিই আমার সত্য।”

তোভিয়া নিভে যায়। অজস্র প্রশ্নেরা পথ হারায়। চুলের গহন অরণ্য ভেদ করে তার অনাবৃত পিঠে চুমু আঁকে জেহেন। তোভিয়া আন্দোলিত হয়। অাকাঙ্খীত সুখ হাতছানি দেয় তার সর্বাঙ্গে। বিবশচিত্তে জেহেনের সংসর্গে বিভোর হতেই প্রশ্ন করে জেহেন—

“নুয়ায়াম কোথায়?”

তোভিয়ার চোয়াল শক্ত হয়। দন্তপাটি রেষারেষি শুরু করে একে অন্যের সাথে। জেহেনের দুর্বোধ্য বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কর্কশ স্বরে বলল—

“এই জন্য তো ভালোবাসা দেখাচ্ছিলেন? সবসময় আমাকে ভুলাতে চান। জানি না কোথায় ভাইয়া। আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসুন।”

জেহেন ফিচেল হেসে বলল—

“তাহলে ছায়াকরী কোথায় সেটা বলো।”

নাক ফোলালো তোভিয়া। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরে ভ্রূ কুঁচকে বলল—

“সিদ্ধ মাংস দিয়ে হচ্ছে না, এখন জীবন্ত পাখিও দরকার আপনার? একদম ছায়াকরীর আশেপাশে যাবেন না। বলা তো যায় না, কখন ওকে খেয়ে বসে থাকেন!”

জেহেন গা দুলিয়ে হেসে উঠে। তার নিঁখাদ, অকপট, শুদ্ধ হাসিতে আটকে যায় তোভিয়ার চোখ। জেহেন কখনো মন খুলে হাসে না। তোভিয়ার মনে হতো মানুষটা বোধহয় হাসতেই জানে না। তবে এখন সে জানে, হাসতে জানা মানুষটা কতটা কষ্ট করে নিজের হাসিকে লুকিয়ে রাখে ওই হিং/স্রস/ত্তাতে। কতটা নিষ্পেষিত হয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখে মানুষের ভিড় থেকে। কতটা অসহায় হয়ে বরণ করে নিয়েছে নিজের একাকিত্বকে। তোভিয়ার নিষ্পলক চাহনিতে হাসির দরিয়া সহসা শুকিয়ে গেল জেহেনের। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে ধীর পায়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। তোভিয়া এগিয়ে আসে বিড়ালপায়ে। জেহেনের পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত মুঠোবন্দি করে। জেহেন একরাশ দ্বিধা নিয়ে তাকায় তোভিয়ার দিকে। তোভিয়া এক চিলতে হাসির ঝিলিক দেখিয়ে বলল—

“আপনার এই হাত আমি কখনো ছাড়ব না জেহেন। আপনি আমার ছায়াকর হলে আমি আপনার ছায়াকরী। আমৃত্যু আপনার ছায়া হয়ে থাকব। আপনার লুকায়িত সত্তার ছায়াকরী।”

চোখের কোটরে কিছু একটা চিকচিক করে উঠে জেহেনের।
,
,
,
চকিতে থমকে গেল নুয়ায়ামের গাড়ি। সে ভড়কে গিয়ে সামনে তাকাল। বারকয়েক চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করাতে পারল না সে। চোখ, মুখ শক্ত করে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।

শুভ্র মেঘের ভেলা ভেসে চলছে আকাশ জুড়ে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে মেঘের ভাঁজ থেকে। নীলাভ আকাশ হাসছে। রাস্তার দুইধারে গাছের সারি। পিচঢালা পথ ছাড়াতেই মৃত্তিকার পাটাতন।

নুয়ায়ামের গাড়ি রাস্তার কোণেই থামে। সে পিচঢালা সড়ক পথ থেকে মাটির রাস্তায় নেমে দাঁড়ায়। রাস্তার ওপাশে জঙ্গল। তবে ততটা ঘন নয়। এপাশটায় বিস্তর জায়গা জুড়ে বৃহদাকার গাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে। নুয়ায়াম সেই গাছের মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। তার ডানপাশে দুই হাত, বামপাশে তিনহাত দূরত্বে দুটি গাছ। বেশ হৃষ্টপুষ্ট। দুটো গাছের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে আছে নুয়ায়াম। নুয়ায়াম উপলব্ধি করল, রাস্তার ওপাশে কিংবা এই জায়গাটা থেকে খানিক দূরেও ছোটো, বড়ো গাছের সন্নিবেশ থাকলেও; এখানে শুধু বড়ো বড়ো গাছ। পরিষ্কার মৃত্তিকার বুক বিদীর্ণ করে তারা জেগে উঠেছে। কোনো ঘাস, লতাপাতার অস্তিত্ব নেই। নুয়ায়াম সপ্রতিভ হতেই দেখল দূরেই একটা কুটির। ছনে ছাওয়া কুটির দেখে নুয়ায়াম অবাক হলো। এই রাস্তায় সে আগেও এসেছে। তবে কখনো এখানে নামেনি সে। এই জনমানবশূন্য জায়গায় কুটির দেখে নুয়ায়াম একটু স্বস্তি পেল। তার গাড়ির অবস্থা ঠিক নেই। বের হওয়ার আগে সবকিছু দেখে নিয়েই বের হয়েছিল সে। কিন্তু এখন…..।

নুয়ায়াম এক পা এক পা করে এগোতে লাগল। যখনই মাটির ওপর থেকে তার পা সরিয়ে সামনে দিচ্ছে, ঠিক ওই মুহূর্তে সেই স্থানে বুনো লতাপাতারা মাটি ভেদ করে বেরোচ্ছে। নুয়ায়াম আচ্ছন্নের মতো চলতে লাগল। কুটিরের কাছে পৌঁছাতেই সে থমকে গেল। একটা হিসহিসানো শব্দ শুনতে পেল সে। নুয়ায়াম চোখের পল্লব ঝাঁকি দিয়ে পেছন ফিরল। আঁতকে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। একটা বিশালাকার কালো কুচকুচে সা/প তার সামনে ফণা তুলে আছে। নুয়ায়ামের আত্মারাম কেঁপে ওঠে। সে ব্যস্ত হয়ে কুটিরের দিকে তাকায়।
চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here