# ছায়াকরী
# পর্বঃ২৮
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
আরওয়া নম্র চোখে তাকিয়ে আছে মেঝেতে। সে হেঁটে আসছে বিড়ালপায়ে। নুয়ায়ামের চোখের দর্পণে অবিশ্বাস্যতা! তার উদ্ভাসিত চাহনি ভেদ করল আরইয়াজ।
“বসো নুয়ায়াম।”
নুয়ায়াম বিবশ। তার কোনো বোধ নেই। সে চেয়ে রইল অনিমেষ। আরইয়াজ গলা খাঁকরি দিয়ে বললেন—
“নুয়ায়াম, শুনতে পাচ্ছ?”
নুয়ায়াম ভেতর থেকে কেঁপে উঠল। তার চাহনি আবদ্ধ আরওয়ার অপার্থিব অভিরামের ওই মোহমুগ্ধ চোখে। নীল রঙের সুডোল চোখ দুটো নুয়ায়ামকে আচ্ছন্ন করে ফেলল এক কুহক মায়ায়। সে বিভ্রম নিয়ে বলল—
“ও…ও… ও কে?”
আরইয়াজ ছোট্ট করে হেসে বললেন—
“ও আমার ভাগ্নী। আরওয়া।”
“আরওয়া, আরওয়া, আরওয়া….।”
বারকয়েক আওড়াল নুয়ায়াম। শুভ্র বসনে আবৃত অঙ্গনা তার নীলাক্ষীতে ঘা/য়ে/ল করেছে নুয়ায়ামকে। আরইয়াজ নুয়ায়ামের ধ্যান পাওয়ার জন্য বললেন—
“বসো, নুয়ায়াম।”
আড়ষ্টের মতো বসল নুয়ায়াম। যেন সে কোনো যন্ত্রচালিত মানব। তার প্রস্ফুট আঁখিদ্বয় বাকহীন, অটল। আরওয়া তার স্নিগ্ধ স্বরে বলল—
“মামা, আপনাদের চা।”
আরইয়াজ আরওয়ার হাত থেকে ট্রে নিয়ে গোল টেবিলটির ওপর রাখলেন। বললেন—
“তুমি যাও।”
দুটো শব্দেই কেমন ছ্যাঁত করে উঠল নুয়ায়ামের অবশ হৃদয়। হৃদমোহিনী তার চোখের সম্মুখ থেকে আড়াল হয়ে যাবে! সহ্য হবে তো তার!
আরওয়া একটিবারের জন্যও মনোযোগ দেয়নি নুয়ায়ামের দিকে। কিন্তু তার মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ু এই পুরুষেই আবদ্ধ। আরইয়াজ চলে যেতে বলায়, আরওয়া তার লোচন জোড়ার দীর্ঘ পল্লব মেলে ধরে চাইল নুয়ায়ামের দিকে। নুয়ায়াম যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল!
আরওয়া তাকাতেই তার চোখে -মুখে অকপট আনন্দের ফোয়ারা ঝরঝর করে বইতে লাগল। অধর বিস্তৃত হলো পলেই। আরওয়া কিছুক্ষণ চেয়ে রইল নুয়ায়ামের চোখে। চোখের রং বদলাতে শুরু করেছে নুয়ায়ামের। আরওয়া গূঢ় হাসল। সেই হাসিতে এক পসলা ঝমঝম বৃষ্টির হিমশীতল অনুভূতিতে শিউরে উঠল নুয়ায়াম। সে মুগ্ধ হলো। মনুষ্য জাতির প্রেমময় অনুভূতি তাকে জাগিয়ে তুলল। সে চোখ সরাতে পারছে না। আরওয়ার অধরোষ্ঠের নিটোল, নিখুঁত ভাঁজ, চোখের বিদ্ধ করা চাহনিতেই কেমন আবিষ্ট হয়ে রইল নুয়ায়াম। তার ভাবনার ব্যবচ্ছেদ ঘটল মিনিট দেড়েক বাদে। যখন সেখান থেকে আরওয়া চলে যায়। নুয়ায়াম তার সলজ্জ মুখটা নত করে লুকোতে ব্যস্ত হয়। আরইয়াজ নরম চোখে চেয়ে বলল—
“পৃথিবী বড়ো অদ্ভুত জানোতো? যা আমরা দেখিনি, তা আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু, সত্য এই যে, আমাদের বিশ্বাসের আড়ালেও অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে। এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু আছে যার অস্তিত্ব আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু তা সত্য।
এই যে আজ তুমি অবচেতন মনে যা দেখেছ, ভাবতো, তা যদি সত্য হতো তাহলে তোমার কী হতো?”
নুয়ায়াম জবাব দিলো না। আরওয়ার ঘোর এখনো সে কাটাতে পারেনি। আরইয়াজ একটু কেঁশে বললেন—
“তুমি কী আমাকে শুনতে পাচ্ছ?”
নুয়ায়াম সম্মোহিত কণ্ঠে বলল—
“জি।”
আরইয়াজ নুয়ায়ামের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালেন। সে তাকিয়ে আছে সেই সিঁড়ির উড়ন্ত পর্দার দিকে। আলতো হাসলেন আরইয়াজ। ভাবলেন, মানুষের মাঝে থেকে থেকে, নুয়ায়ামের মাঝেও মানুষের অনুভূতি, অভীপ্সার পাহাড় জমেছে। তিনি গাঢ় গলায় বললেন—-
“তোমার কী আমার কথা বিশ্বাস হয়?”
“জি।”
“তুমি কী এখন চলে যাবে?”
“জি।”
ফট করে হেসে ফেললেন আরইয়াজ। নুয়ায়াম সম্বিৎ ফিরে পেল আরইয়াজের হাসিতে। সে ব্রীড়াতে ডুবে গেল।
আরইয়াজ হেসে হেসে বললেন—
“টেক ইট ইজি নুয়ায়াম।”
নুয়ায়াম লজ্জামিশ্রিত হেসে বলল—-
“দুঃখিত আমি।”
“ইটস ওকে। চা ঠান্ডা হচ্ছে।”
“জি।”
চায়ের কাপ হাতে নিল নুয়ায়াম। মনে তার অদ্ভুত চিন্তা উদ্ভূত হলো। আরওয়ার আছোঁয়া স্পর্শ অনুভূত হলো তার। চায়ের কাপ নয়, যেন আরওয়াকে এক মুহুর্তের জন্য ছুঁয়ে ফেলল সে!
আরইয়াজ প্রশ্ন করলেন—
“চা কেমন?”
নুয়ায়াম সহজ উত্তর দিলো—
“চমৎকার !”
“না পান করেই?”
নুয়ায়াম এবার সত্যিই নিজের কাজে অনুতপ্ত। সে চট করে চায়ের কাপে চুমুক বসাতে হোচট খেলে। চা থেকে সুন্দর ঘ্রাণ বেরোচ্ছে। চায়ের রং আশ্চর্যজনক সুন্দর! সাধারণ রং চা থেকে এর রং আর স্বাদ দুটোই আলাদা। নুয়ায়াম প্রসন্ন হেসে সন্দিহান গলায় বলল—
” এটা কীসের চা? এর রং ও অদ্ভুত সুন্দর। কেমন একটা নীলচে ভাব! ”
আরইয়াজ নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তিকর শ্বাস ফেলে বললেন—
“এটা এক ধরনের নীল রঙের ফুল দিয়ে তৈরি করা। আরওয়া নিজের হাতে তৈরি করেছে এই চায়ের রেসিপি।”
“নীল রঙের ফুল!”
নুয়ায়ামের কণ্ঠে জিজ্ঞাসু ভাব ঝড়ে পড়ল। আরইয়াজ সরল গলায় বললেন—
“হ্যাঁ। বনোসা নাম তার। এই জঙ্গলেই পাওয়া যায়। সম্মোহন করার ক্ষমতা রাখে এই ফুলের ঘ্রাণ! দেখতে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের অধিকারী। আরওয়া প্রায়ই এই ফুল নিয়ে আসে জঙ্গল থেকে। আজও গিয়েছিল। সেখানেই তো তোমাকে অচেতন অবস্থায় দেখতে পায় সে। আমার তো মনে হচ্ছে তুমি বনোসাতে নিজের চেতন হারিয়েছ!”
সশব্দে হেসে উঠলেন আরইয়াজ। নুয়ায়াম বাকি চা টুকু বিনা সময় ব্যয়ে পান করল। এর স্বাদ আর ঘ্রাণ দুটোই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আরইয়াজ নিজের চায়ের কাপ টেবিলে রেখে একটু সচেতন হয়ে বসলেন। সন্ধ্যার ঘন তমসা রাত নামিয়েছে। সময় সম্পর্কে জ্ঞান হারিয়েছে নুয়ায়াম।
আঁধার আকাশে উদিত হয়েছে বিধুমতি। তার বুক ভরা আলো ধরণীর কোলে ঢেলে দিচ্ছে। জঙ্গল থেকে পোঁকাদের ঝাঁ ঝাঁ শব্দ ভেসে আসছে। নুয়ায়াম সচল চোখে তাকাল। আরইয়াজ বললেন—
“তোমার আম্মির কী অবস্থা?”
নুয়ায়াম ব্যথিত হলো। রাদিয়াতের কথা মনে পড়তেই তার অন্তঃপুরে অগোছালো কষ্টরা জমাট বাঁধতে শুরু করল। সে ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল—
“আপনাকে তো সব জানিয়েছি।”
“আমি তাকে দেখতে চাই।”
“আপনার সময় হবে?”
নুয়ায়ামের কণ্ঠে আবেগের সাথে আগ্রহ ফুটে উঠল। আরইয়াজ শীতল গলায় বললেন—
“হ্যাঁ। তবে তার আগে তুমি তার বাকি ইনফরমেশন আমাকে পূনরায় ই-মেইল করবে। আমি আরেকবার তাকে স্টাডি করতে চাই। ”
“জি, অবশ্যই।”
“তাহলে উঠা যাক? রাত হয়ে এসেছে।”
নুয়ায়াম গ্রীবাভঙ্গি বদলে জঙ্গলের দিকে তাকাল। গাঢ় অন্ধকার দেখে তার দেহ শীতল হয়ে এলো। তার ভয়ভীত চাহনির বিপরীতে বলে উঠলেন আরইয়াজ—
“চিন্তা করো না। তোমার সাথে রাস্তা পর্যন্ত যাবে আরওয়া। এই জঙ্গলের প্রতিটি গাছ ওর চেনা।”
নুয়ায়াম মসৃণ কপালে রেখা টেনে অসহিষ্ণু গলায় বলল—
“আরওয়া বাবা-মা কোথায়? তিনি কী আপনার সাথেই থাকেন? কতদিন ধরে?”
আরইয়াজ হেসে প্রত্যুত্তর করলেন—
“ওর বাবা-মা বাইরে থাকে। আরওয়া ওর চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমার সাথে থাকে। প্রফেশন ছেড়ে হঠাৎ করে এই জঙ্গলের মায়ায় পড়ে গেলাম। প্র্যাকটিস শুরু করেছি আরওয়ার অনুরোধে। সে হিসেবে তোমার আম্মি আমার প্রথম পেশেন্ট।”
নুয়ায়াম চিন্তাহীন হেসে বলল—
” লোকালয় ছেড়ে এই জঙ্গল কেন বেছে নিলেন?”
আরইয়াজ চমৎকার করে হেসে বললেন—
“সব প্রশ্নের উত্তর একসাথে… নো। দেখা হবে আবার। নিচে চলো। আজকের এই জঙ্গলের পথে, আরওয়া তোমার সঙ্গী হবে। ”
নুয়ায়ামের পুরুষ মনে অকস্মাৎ নবযৌবনের এক জাজ্বল্যমান মশাল জ্বলে উঠল।
চলবে,,,