# ছায়াকরী
# পর্বঃ ৩৫
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
আপাদমস্তক ভিজে আছে জেহেন। কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে সে। শাড়ি বদলে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছে যাচ্ছে তোভিয়া। জেহেনকে দেখেই হকচকিয়ে যায়। সাদা শার্টের বিভিন্ন জায়গায় র/ক্তের ছোপ ছোপ দাগ। তোভিয়া বিচলিত কণ্ঠে বলে উঠে–
“এসব কী করে হলো?”
অধৈর্য হয়ে হাতের তোয়ালে ছুড়ে ফেলে তোভিয়া। জেহেন নির্বিকার, প্রতিক্রিয়াহীন। ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সে। তোভিয়া শশব্যস্ত হয়ে জেহেনের পাশে এসে দাঁড়ায়। উদ্বেলিত গলায় শুধায়—
“আপনার কী হয়েছে জেহেন? এই র/ক্ত এলো কোথা থেকে? আপনি এমন ভিজেছেন কেন?
কী হলো, কথা বলছেন না কেন?
জেহেন শান্ত, সমাহিত। বিছানার ওপর বসল সে। অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় বলল—
“কিছু হয়নি।”
তোভিয়া নাক-মুখ কুঁচকে বিষিয়ে ওঠা গলায় বলল—
“কী বলছেন আপনি? কিছুই হয়নি। এত র/ক্ত! আর আপনি বলছেন কিছুই হয়নি।”
“না।”
তোভিয়া খলবলিয়ে উঠল। তিক্ত গলায় বলল—
“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? কেন জবাব দিচ্ছেন না?”
তোভিয়ার চোখ টলটল করছে। নেত্রপল্লব সিক্ত। জেহেন স্বাভাবিক চাহনিতে বলল—
“চিন্তিত হয়ো না। কিছুই হয়নি আমার।”
“এত কী করে সহ্য করেন আপনি?”
“অভ্যাস হয়ে গেছে।”
ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দিলো তোভিয়া। হাঁটু মুড়ে জেহেনের সামনে বসল। গলা কাঁপিয়ে কাঁদছে সে। দুই হাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে জেহেনের শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে। জেহেন সরল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তোভিয়ার দিকে। কান্নার দমকে মেয়েটার সারা শরীর কাঁপছে। ওষ্ঠাধরের নিগূঢ় কম্পন জেহেনের চোখের দর্পণে হানা দিলো। জেহেন ঘাড় নিচু আলতো করে ছুঁইয়ে দিলো তোভিয়ার ললাট। চোখ বুজে ফেলল তোভিয়া। ছোট্ট শ্বাস ফেলে চোখ খুলে বিনীত স্বরে বলল—
“এমন কেন করেন জেহেন? কেন আমাকে কিছু বলছেন না? ”
জেহেন নিরুত্তর। সে চেয়ে রইল নিষ্কম্প দৃষ্টিতে। তোভিয়া শার্ট খুলতেই আঁতকে ওঠে। তার দেওয়া খামচির দাগ এখনো জ্বলজ্বল করছে। জেহেনের পাশে এসে বসতেই দেখল, তার বাজুতে সুক্ষ্ম, দীর্ঘ গর্তের মতো কিছু! অবাক গলায় বলল তোভিয়া—
“এটা কী করে হলো? এই, কথা বলছেন না কেন আপনি?”
আরওয়ার পাখার সূঁচালো দন্ডে সৃষ্ট ক্ষ/ত হতে এখনো র/ক্ত চুইয়ে পড়ছে। তোভিয়া আড়ষ্ট, ব্যথিত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। অল্পবিস্তর সেই গর্তের গভীরতা অনেক। তাতে আলতো করে হাত বুলালো তোভিয়া। চট করে উঠে গিয়ে অগোছালো পায়ে ছুটে গেল দেয়ালে লাগানো সেই বাক্সের কাছে। খুঁজে বের করল নির্দিষ্ট কৌটা। সেটা নিয়েই পলেই এলো জেহেনের কাছে। তোয়ালে হাতে নিয়ে সাবধানে রক্তের দাগ মুছে কৌটা থেকে ঔষধ নিয়ে তার প্রলেপ দিলো সেই ক্ষ/ততে। জেহেন প্রতিক্রিয়াহীন। তার মধ্যে কোনো ভাবাবেশ হলো না। যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। কোনো অনুভূতিরও সৃষ্টি হলো না তার। সে সোজা দৃষ্টিতে চেয়ে রইল।
তোভিয়া জেহেনের গলদেশ আর বাজুতে ঔষধ লাগিয়ে বিছানায় উঠে বসে। জেহেনের মসৃণ পিষ্ঠদেশে ধারালো নখের আঁচড়ে মাংস উঠে যাওয়ার যোগাড়। পিঠের মাঝখানের জায়গা একদম থে/তলে আছে। তোভিয়া সশব্দে কেঁদে ওঠে। জেহেনের কর্ণকুহরে পৌঁছায় সেই শব্দ। তবুও সে নিশ্চল। যেন জাগতিক কোনো কিছুই তাকে এই অবস্থায় ছুঁতে পারছে না। তোভিয়া রোদনভরা কণ্ঠে বলল—
“কথা বলছেন না কেন আপনি? কষ্ট হয় না আপনার? কী করে সহ্য করেন এতসব? ”
তোভিয়ার অগোচরেই হাসল জেহেন। মেয়েটা এখনো শীতের সকালে শিশির সিক্ত নরম মৃত্তিকা! যাতে জোর লাগাতেই অন্যকারো দখলে চলে যায়।
তোভিয়ার গাল, ঠোঁট, গলা সব ভিজে আছে তার চোখের স্রোতে। ধীরে, অতি সন্তর্পণে, প্রগাঢ় আবেশের সাথে নিজের অধরোষ্ঠের গহন ছোঁয়া আঁকে সেখানে তোভিয়া, যেখানে তার প্রণয়ীর লহু জমাট বেঁধেছে। ঠোঁট সরানোর পূর্বেই নিজের কপাল ঠেকায় জেহেনের পিঠের সাথে । ডুকড়ে উঠে সে। তার কপাল, নাক, ঠোঁট সমান্তরালে লেপ্টে আছে জেহেনের অটল, দৃঢ়, প্রশস্ত পিঠের পাটাতনে। জেহেন লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল—
“কেঁদো না তোভিয়া। এখনো অনেক কিছু জানা বাকি তোমার। পদ্মকুমারীর চোখের জল এত মূল্যহীন নয়। শক্ত হও। তোমাকে তোমাকে জন্য লড়তে হবে।”
তোভিয়া মাথা সরিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল—
“কেন লড়াই করব আমি? কীসের জন্য? কেন আপনি নিজেকে এসব থেকে দূরে রাখছেন না?”
“এত সহজ নয় তোভিয়া। বিবাহের পূর্বেই আমি আমার সত্য তোমাকে জানিয়েছি, সাবধান করেছি, সময় দিয়েছি। তুমি নিজ ইচ্ছেতে এ জীবন বেছে নিয়েছ।”
“তাই বুঝি শাস্তি দিচ্ছেন আমাকে? আমার চোখের পানি আপনার হৃদয়ে প্রশান্তি ডেকে আনে?”
জেহেন ছোট্ট করে হাসল। মৃদু গলায় বলল—
“তোমার তাই মনে হয়?”
তোভিয়া তার কাজ শেষ করল। হেঁচকি তুলে যাচ্ছে সে। জেহেন বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে বসল। ভেজা প্যান্টের দরুন বিছানা ভিজে গেছে। জেহেনের পাশে মেঝেতে বসল তোভিয়া। আলগোছে তার মাথা রাখল জেহেনের অনাবৃত বুকের বাম পাশে। জেহেন ঠোঁট ছোঁয়াল তোভিয়ার মাথায়। এক হাতে বুকের সাথে জড়িয়ে রাখল তোভিয়াকে।
তুমুল বর্ষনের সাথে চলছে মেঘমন্দ্র। বিদ্যুতের ঝলকানি খানিক সময় পরপর আলোকিত করছে আঁধার পরিবেশ। ঝড়ো হাওয়ার সাথে বৃষ্টির শীতল পানি। ধরণীকে করেছে হিমশীতল। জেহেনের কায়ার উষ্ণতায় নিজেকে সমর্পিত করেছে তোভিয়া। জেহেন প্রশ্ন ছুড়ল—
“পালিয়েছিলে কেন? তুমি কী ভেবেছ, আমি তোমাকে দেখেনি?”
“তাহলে চুপ করে ছিলেন কেন?”
“পদ্মকুমারী এত বোকা কেন?”
তোভিয়া মাথা তুলল। জেহেনের দিকে সোজা দৃষ্টি রেখে বলল—
” আম্মিও আমাদের সাথে ছল করল! আপনিও সব জেনে নীরব ছিলেন। আমাদের মিথ্যাচারে আবদ্ধ করে রেখেছিলেন আপনারা দু’জন।”
“যা করেছি তোমার জন্য করেছি তোভিয়া।”
“আমার জন্য?”
বিস্ময় আকাশ ছুঁল তোভিয়ার। সে চমকিত চোখে চেয়ে রইল। জেহেন মোলায়মে কণ্ঠে বলল—
“হ্যাঁ, তোমার জন্য। পদ্মকুমারীর জন্য।”
“কেন? ”
“আম্মির সাথে কথা বলবে?”
“না। তিনি কেন এমন করলেন?”
চট করে তোভিয়ার ফুলকো নাকের ডগায় ছোট্ট কামড় বসাল জেহেন। হেসে হেসে বলল—-
” পদ্মকুমারীর রাগ হচ্ছে?”
“আপনারা সবাই আমাদের সাথে প্রতারণা করেছেন।”
“আমরা যা করেছি তোমার ভালোর জন্য করেছি। আমি একা নই তোভিয়া। তোমার আশেপাশে আরও অনেকে আছে আমার মতো। তারা সবাই তোমার বন্ধু নয়। ”
“এসব আপনি কী বলছেন?”
তোভিয়ার গলায় অনুরণন। চোখের পাল্লা অস্থির। তার দীর্ঘ কালো চুল মেঝের বুকে সরীসৃপের মতো একেবেঁকে আছে। জেহেন সেদিকে তাকাল। ফিচেল হেসে বলল—
“তোমার পেছনে কী তোভিয়া? সাপ!”
তোভিয়া ভড়কে গেল পলেই। পেছনে না তাকিয়ে হামলে পড়ল জেহেনের বুকে। জেহেন তার স্বরে হেসে উঠল। হাসির কারণে তার গা দুলছে। তোভিয়া বুঝতে পারল জেহেন তাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য মিথ্যে বলেছে। তার এই দুর্লভ হাস্যোজ্জ্বল মুখটা খুব আকাঙ্ক্ষীত তোভিয়ার কাছে। সে গুঁজে রাখা মুখটা হালকা উঠিয়ে চাইল। জেহেন শূন্যে তাকিয়ে হাসছে। মুহূর্তেই চওড়া হলো তোভিয়ার অধর। চকচকে চোখে চেয়ে বিড়বিড় করল, ” আপনি এভাবেই হাসুন জেহেন। আপনাকে আমি আজীবন এভাবেই দেখতে চাই।”
জেহেন অকস্মাৎ বলে উঠল—-
” তোমার হাসিতে আমার হাসি,
চন্দ্রাননে মাখামাখি
অবিনাশী অনুরক্তি
তোমার প্রণয়েই আমার আসক্তি।”
তোভিয়া ঝলমলে হেসে জেহেনকে আবদ্ধ করে নিল নিজের বাহুতে।
,
,
,
রাদিয়াতের সামনে বসে আছে তোভিয়া। সহজ, স্বাভাবিক। মেয়ের চোখে, মুখে আদর এঁকে দিলেন তিনি। তোভিয়া প্রসন্ন হলো। আনন্দে তার হৃদয়ের উষরতায় ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। এক ঝাঁক প্রজাপতি উড়তে লাগল এলোমেলোভাবে। রঙধনুর রঙে রঙিন হলো তার বিবর্ণ অনুভূতি। মায়ের গলায় নিজেকে ঝুলিয়ে রেখে আদুরে গলায় বলল তোভিয়া—
“আপনি এমন কেন করলেন, আম্মি?”
জেহেন দাঁড়িয়ে আছে অদূরে। গাঢ় স্বরে ডেকে উঠল—
“তোভিয়া!”
তোভিয়া তাকাল। জেহেন চোখের ইশারায় তাকে নিষেধ করল যেন রাদিয়াতকে কোনো প্রশ্ন না করে। যা হয়েছে, বা হচ্ছে তার বিস্তারিত এখনই তোভিয়াকে জানাতে ইচ্ছুক নয় জেহেন। তোভিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বলল—
“আপনি চুপ করুন। একদম আমাদের মাঝে কথা বলবেন না।”
রাদিয়াত অতলান্ত মায়ার সাথে মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে বললেন—
“এমন করে না পদ্মকুমারী। সে তোমার অর্ধাঙ্গ, স্বামী, পতি। তার সাথে এরূপ ব্যবহার নয়। ”
“স্ত্রীকে ভালোবাসাও তো স্বামীর দায়িত্ব। তিনি কী সেই দায়িত্ব পালন করেন?”
রাদিয়াত আড়চোখে তাকাল জেহেনের দিকে। জেহেন ক্লান্ত শ্বাস ফেলে মাথা নিচু করল । তোভিয়া ভেঙচি কেটে মায়ের দিকে মনোনিবেশ করে গালভর্তি হেসে বলল—
“আপনি সুস্থ আম্মি। আমার আর কিছু চাই না।”
তোভিয়া মায়ের বুকে মাথা রাখল। জেহেন মাথা তুলে। তোভিয়াকে নিজের সাথে চেপে রেখেছে রাদিয়াত। তা দেখে চোখে হাসল জেহেন। নিজের মা’কে তার মনে নেই। হ্যাঁ, চেহারাটাও মনে করতে পারছে না। কারণ, ফিরে আসার পর মায়ের জন্য সন্তানের যে আবেগ, অনুভূতির থাকে, তা জন্ম নেওয়ার পূর্বেই সবকিছু রঙহীন হয়ে গেল তার কাছে। নিজের পশু সত্তার সাথে লড়াই করতে করতে নিজের মনুষ্য অনুভূতির মৃ/ত্যু ঘটিয়েছে সে। কিন্তু সবকিছুতে নতুন করে প্রাণ দিলো তোভিয়া। তার মৃ/ত অনুভূতিকে জাগ্রত করল। হিং/স্র চিতার বুকের সেই কম্পিত হৃৎপিণ্ডে ছোট্ট ভালোবাসার এক টুকরো মহল গড়ে তুলল। সেই মহলের ছায়াকর এখন জেহেন। তার আচ্ছাদন হয়ে রয়েছে। এখন শুধু পূর্ণতা। আচানক দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল নুয়ায়াম। তোভিয়াকে রাদিয়াতের বুকে এত শান্ত ভঙ্গিতে দেখতে পেয়ে অবাক বিস্ময়ে বলল—
“তোভিয়া! তুমি? আম্মিজান !”
ভাইকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হলো তোভিয়া। মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে এসে গদগদ গলায় বলল—
“জানো ভাইয়া, আম্মি….।”
তোভিয়াকে কথা শেষ করতে দিলো না জেহেন। অকস্মাৎ তাকে টেনে নিল নুয়ায়ামের কাছ থেকে। সবকিছু দেখে হতভম্ব নুয়ায়াম। সে তীক্ষ্ম চোখে তাকাল জেহেনের দিকে। জেহেন মৃদু স্বরে বলছে তোভিয়াকে—
“নুয়ায়ামকে কিছুই বলবে না।”
নুয়ায়াম পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। তার চোখ রং বদলে ফেলল। ঠিক তখনই চোখ বন্ধ করে নিল নুয়ায়াম। তার চোখে ভাসতে শুরু করল একটু আগে এই কক্ষে ঘটে যাওয়া কাহিনি, কিন্তু তা অস্পষ্ট। নুয়ায়ামের দিব্যদৃষ্টিতে তা স্পষ্ট করে ধরা দেওয়ার পূর্বেই ছায়াকরী উড়ে এসে নুয়ায়ামকে ছুঁয়ে যায়। চোখ খুলে ফেলে নুয়ায়াম। জেহেন সোজা চাহনি আবদ্ধ করল ছায়াকরীর দিকে। বিভ্রান্ত হলো নুয়ায়াম।
চলবে,,,