# ছায়াকরী
# পর্বঃ৪২
লেখনীতেঃ তাজরিয়ান খান তানভি
বৃষ্টি কমে এসেছে। কিন্তু এখনো মলয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে শীতলতা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে নুয়ায়াম। তার দেহের উষ্ণতা বেড়েছে। ব্যালকনির মেঝেতে ঝপঝপ করছে পানি। তাতে নগ্ন পা রেখে আকাশের দিকে বদ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুয়ায়াম।
কৃষ্ণ চাঁদোয়ায় এক ফালি চন্দ্রিমার বিভাসিত অভিরাম। ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে অদূরের গাছপালা। তিমিরাচ্ছন্ন যামবতীর এক রহস্যঘন নিসর্গ। ব্যথিত, ব্যাকুল, বিধুর চিত্তের এক পুরুষ তখন তার অস্তিত্বের সংকটে নিষ্পেষিত।
ইলশেগুড়ি বৃষ্টির পানির ফোঁটা হাতের তালু ভরতেই টুপটুপ করে নিচে পড়ছে। হাওয়ার দমকে এক পশলা বৃষ্টি গায়ে মেখে গেল নুয়ায়ামের। সে দৃষ্টি এলোমেলো করে তাকাল নিচের দিকে। মহলের ছাদের কার্নিশের সাথে লাগানো বাতি থেকে আলো ছড়াচ্ছে। সেই আলোতে নুয়ায়াম স্পষ্ট দেখতে পেল কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে মহলের সামনের প্রাঙ্গণে। নুয়ায়ামের চাহনি আবদ্ধ সেই বস্তুতে। এবার সে স্পষ্ট দেখতে পেল একটা নেড়কে তার দিকে আকুল চোখে তাকিয়ে আছে, যেন কিছু বলতে চায় তাকে। নুয়ায়াম চমকিত হলো। এর আগেও সে এই নেকড়েকে দেখেছে। বহুবার তার চোখে পড়েছে। এমনকি পদ্মদীঘিতে যখন সে ডুবে গিয়েছিল, তারপর যখন হুশ ফিরলে নিজেকে সে ভূমিতে আবিষ্কার করে, তখনও এক ঝলকের জন্য সে এই নেকড়েকে দেখেছিল তার পাশে। আচমকা নেকড়েটি দৌড়াতে শুরু করল। নুয়ায়াম ভ্রূ কুচকে চেয়ে রইল। গাঢ় অন্ধকারে মিলিয়ে গেল সেই নেকড়ে।
নুয়ায়াম কক্ষে প্রবেশ করে। নরম পায়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানায় বসে। একটা ক্লান্ত শ্বাস ফেলে সামনে তাকায়। বড্ড অশান্ত তার মন। এই যে জেহেনের সাথে সে কথা বলছিল, তার মনে হলো জেহেনের মস্তিষ্কে ঘূর্ণায়মান প্রতিটি বিষয় তার চোখের সামনে ভাসছে। জেহেনের অন্তঃকরণে থাকা না বলা সব কথা সে দিব্যশক্তিতে শুনছে। অশ্রুত কথামালাও কোনো এক অদৃশ্য বলে যেন হুরহুর করে তার কর্ণকুহরে ঢুকে পড়ছে। তার বোন ভালো নেই!
নুয়ায়াম তার হাতের দিকে তাকাল। পালক দেখতে পাচ্ছে সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। ক্রমশ তার মানব অবয়ব পরিবর্তন হতে লাগল। পাখির পালকে আচ্ছাদিত হলো সম্পূর্ণ দেহ। চোখের রং রক্তিম। নুয়ায়াম অবিচলিত, অচেষ্ট চোখে তাকাল আয়নাতে। নিজেকে দেখছে সে। ভীত নয় সে, তবে চিন্তিত। কেন সে এমন? সে কী মানুষ নয়? কেন তার এই পরিবর্তন?
নুয়ায়াম কিছু একটা ভাবল। হাত উঠিয়ে তার তালুতে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। ক্ষণকাল চেয়ে থেকে হাতের তালু বুজে নিয়ে তুরিতে বল নিক্ষেপের মতো ছুড়ে দিতেই, তাতে এক অগ্নিবলয়ের সৃষ্টি হলো। তা গিয়ে পড়ল দেয়ালে। অচিরেই দেয়াল কালো বর্ণ ধারণ করল। অদৃশ্য হয়ে গেল আ/গুন। নুয়ায়াম পূনরায় সেভাবেই আ/গুন ছুড়ল। দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার। চতুর্থবারে দেয়ালে জ্বলে উঠল অনল। ইট-সিমেন্টের দেয়ালে আ/গুন!
নুয়ায়াম শশব্যস্ত হয়ে ওয়াশরুমে গেল। পানি এনে ঢালতে লাগল সেখানে। আ/গুন নিভে যেতেই শ্বাস ফেলল সে। সম্পূর্ণ মেঝেতে পানি ছড়িয়ে পড়ল। নুয়ায়াম ধীর পায়ে পেছতে থাকে। দর্পণে চোখ রেখে নিজের চোখের কোটর দেখছে। যেন রক্ত ঝরে পড়বে! চকিতে সে অনুভব করল, তার মেরুদণ্ডে কিছু একটা হচ্ছে। পিষ্ঠদেশের মাঝ বরাবর চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে, যেন মাংস ভেদ করে কিছু বেরিয়ে আসবে। হলোও তাই। নুয়ায়াম কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই তার পিঠের মধ্যখান থেকে বেরিয়ে এলো দুটো বৃহদাকার পাখা, যার পুরোটাতেই গনগন করে জ্বলছে আ/গুন। নুয়ায়াম উচ্চকিত চোখে তাকাল। উফর ফাঁফর অন্তরিন্দ্রিয়। ভয়ে কাঠ হওয়া তার দেহের দিকে সে চেয়ে রইল অপলক। দৈবাৎ পট করে পাখা দুটো তার পিঠের মধ্যে ঢুকে গেল। তার দমকে সামনে এগিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ওপর গিয়ে পড়ল নুয়ায়াম। কপাল কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝড়তে লাগল।
,
,
,
থমথমে মুখে বসে আছে তেহজীব। ক্রোধে তার মস্তিষ্ক ফেটে যাওয়ার উপক্রম। বেগমরাণির কোলে তখন চড়ে বেরাচ্ছে তার প্রিয় মূষিকটি। তেহজীব হিসহিসিয়ে বলল—
“নুয়ায়াম তার ক্ষমতা সম্পর্কে ধীরে ধীরে অবগত হচ্ছে। আর বেশি বিলম্ব নেই যখন সে, যুবরাজ হওয়ার সকল ক্ষমতা আয়ত্ত করে ফেলবে।”
বেগমরাণি নির্মল গলায় বললেন—
“তার পূর্বেই মুক্তি পাবে কৈরবরাজ। ”
“আর যদি তা না হয়?”
বেগমরাণি আড় চোখে তাকালেন তেহজীবের দিকে। তেহজীব ক্ষোভিত নজরে চেয়ে রইল। বেগমরাণি নির্মোহ গলায় বললেন—
“এই বিলম্বের জন্য তুমি দায়ী। আমি বোকা নই।”
তেহজীব তার মায়ের দিকে তাকাল। মেহেক গরগর করে বলল—
“আমি কিছু বলিনি, আমি কিছু বলিনি।”
বেগমরাণি চিৎকার করে বললেন—-
“চুপ করো নির্বোধ নারী!”
তেহজীব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল—
“আর একবার আমার আম্মিকে এই সম্মোধন করবেন না। তাহলে আপনার জন্য তা সুখকর হবে না।”
বেগমরাণি যারপরনাই অবাক হলেন। পদ্মফুলের আকৃতির আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—
“তুমি আমার সাথে বেয়াদবি করছ? এর ফলাফল ভালো হবে না তেহজীব।”
তেহজীব তাচ্ছিল্য হেসে বলল—
“তাহলে আপনাকে আরও পাঁচশত বছর অপেক্ষা করতে হবে। আপনি নিশ্চয় এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবেন না?”
বেগমরাণি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন—
“তেহজীব!”
তেহজীব বিদ্রুপের চোখে তাকিয়ে আবার চাহনি ফিরিয়ে নিল। কঠোর স্বরে বলল—
“নুয়ায়াম আরওয়াকে পছন্দ করে।”
গূঢ় হাসলেন বেগমরাণি। বললেন—
“তা শুধুই তার মনুষ্য অনুভূতির ভ্রম। যুবরাজের দুর্বোধ্য হৃদয়ে প্রেম-ভালোবাসার অঙ্কুরোদ্গম হওয়া এতটা সহজ নয়। কারণ, তিঁনি তোমার মতো বোধহীন নন।”
তেহজীব কটমট করে চাইল। দপদপ করে পা ফেলে বেগমরাণির কক্ষ থেকে বের হলো। বেগমরাণি ক্ষিপ্ত চোখে তাকালেন মেহেকের দিকে। মেহেক ফাটা বেলুনের মতো চুপসে আছেন।
,
,
,
নারীটির দেহ কম্পিত হলো। সে তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল—
“জোহায়ের কোথায়?”
জেহেন তুষ্ট হেসে বলল—
“বলেছি তো, যতক্ষণ না আপনি আমাকে এইসব কিছুর রহস্য বলছেন, ততক্ষণ আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবো না।”
“ছাড়ব না আমি তাকে। প্রতারণা করেছেন তিনি আমার সাথে। আমাকে বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা ভঙ্গ করেছেন। ছল করে বন্দি করে রেখেছেন আমাকে। ”
ফোঁস ফোঁস করছে নারীটি। শুভ্র অঙ্গে শুভ্রতার চাদর। একটা দুধ সাদা রঙের গোলাকার জামা পরেছেন তিনি। পেছন দিকে আলাদা কাপড় আছে, যা দুই কাঁধের সাথে সংযুক্ত। বাড়তি কাপড়টুকুর বিস্তৃতি তার পরিধেয় থেকেও বেশি। লাল টকটকে অধরোষ্ঠ তীব্র রোষে কেঁপে যাচ্ছে। বরফের মতো সফেদ দাঁতগুলোর নিষ্পেষণে কিড়মিড় করে শব্দ হচ্ছে। জেহেন দুষ্ট হেসে বলল—
“এত রোষ না দেখিয়ে সত্য বলুন আমাকে।”
“কিছুই বলব না তোমাকে আমি। আমার জোহায়েরকে চাই।”
“চাইলেই যে সব পাওয়া যাবে তা তো নয়। ও, আপনি কিন্তু আপনার নামও আমাকে বলেননি।”
“তুমি উপহাস করছ আমার সাথে?”
“একদম নয়। আপনি বলুন, আমি কী করে বিশ্বাস করি, এসব বাবা করেছেন? একজন মানুষের পক্ষে আদৌ এসব করা সম্ভব? এই মূর্তি, এই কক্ষ, আপনাকে বন্দি করে রাখা, কী করে সম্ভব তার পক্ষে? কে তাকে সাহায্য করেছে? আপনি?”
নারীটি ক্ষুব্ধ হয়ে কাঁচের দেয়ালের কাছে এগিয়ে এলো। তিরিক্ষি স্বরে বলল—
“তুমি ভুল করছ। মুক্তি দাও আমাকে।”
জেহেন শ্বাস ফেলল। বলল—
“এটা কাচের তো? আমি কিন্তু স্পষ্ট আপনার কথা শুনতে পাচ্ছি। আচ্ছা, একটা কথা বলুন তো, আপনি আমাকে চিনলেন কী করে? সেদিনের পূর্বেও কী আমি এখানে এসেছিলাম?”
নারীটি নিরুদ্যম গলায় বলল—
“হ্যাঁ। জোহায়ের তোমাকে একবার এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তুমি তখন খুব ছোটো। এরপর, তিনি আর কখনো এখানে আসেননি।”
“কারণ, এরপর বাবা আমাকে নিয়ে নিরুদ্দেশ ছিলেন। বলেছি আপনাকে আমি। বাবা ফিরলে আমাদের আবার কথা হবে। আসি আমি। আমার স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর শব্দ করবেন। ও ভয় পেয়ে যাবে আপনাকে দেখে।”
নারীটি রুষ্ট চোখে চেয়ে রইল। জেহেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়েও আবার পেছন ফিরে বলল—
“আপনার থেকেও সুন্দরী ওই প্রাণহীন মূর্তি। কিন্তু বুঝতে পারলাম না, আপনাদের দুইজনের মধ্যে আমার আম্মি কী করে চলে এলো! আপনি তো জানেন, আপনি আমার আম্মি নন। তারপর ছোটো বেগম চলে এলো। কিন্তু আপনি…।”
জেহেন অধর কোণে হাসল। নারীটি প্রবল বিতৃষ্ণার সাথে বলল—
“আমার সাথে প্রতারণা করে জোহায়ের ঠিক করেনি। তাকে বিশ্বাস করে আমি সবচেয়ে বড়ো ভুল করেছি। এর প্রতিদান তাকে দিতেই হবে। তোমাকেও ছাড়ব না আমি। কাউকে না।”
জেহেন বাচ্চাদের মতো মাথা দুলিয়ে বলল—
“আমি অপেক্ষা করব। আপনার এবং আপনার প্রণয়ীর আসল সত্য জানতে। আমিও জানতে চাই, কীসের জন্য তিনি আমার আম্মির সাথে ছল করেছেন। সত্যিই যদি আপনি আমার আম্মির পূর্বে তার জীবনে এসে থাকেন, তাহলে কেন তিনি আপনাকে তার জীবনে স্থান দেয়নি। সেই সত্য উন্মোচনের অপেক্ষায় রইলাম আমি।”
জেহেন বেরিয়ে এলো পর্দার আড়াল থেকে। তোভিয়া দরজা ধাক্কাচ্ছে তা সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। তাক থেকে দুটো কাচের পাত্র নিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় জেহেন। ঘাড় ঘুরিয়ে মূর্তিটিকে দেখল। বিমোহিত সে!
দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল জেহেন। উদ্বিগ্ন গলায় বলল তোভিয়া—
“কার সাথে কথা বলছিলেন আপনি?”
জেহেন দরজা বন্ধ করতে করতে বলল–
“কারো সাথে নয়।”
“আমি শুনতে পেয়েছি।”
জেহেন ছোট্ট হাসল। ভাগ্যিস, দরজা ভেজানোর সময় সে লক করে দিয়েছিল।
“ভুল শুনেছ। বসো ওখানে।”
তোভিয়ার উচাটনচিত্ত শান্ত হলো না। বিছানার ওপর বসল সে। প্রশ্ন করল—
“এগুলো কী আপনার হাতে?”
“দেখাচ্ছি।”
টুক করে বাতি নিভিয়ে দিলো জেহেন। তিমিরাচ্ছন্ন কক্ষে তোভিয়া দেখতে পেল টিপটিপ করে কী যেন জ্বলছে, আর তা জেহেনে বুকের কাছে। জেহেন পাত্র দুটো বিছানার ওপর রাখল। তোভিয়া সেই টিপটিপ আলো অনুসরণ করে তাকাচ্ছে। জেহেন পাত্রগুলোর ঢাকনা খুলতেই তরতর করে বেরিয়ে এলো সেই আলোর পরীরা। জোনাকি পোকারা উড়তে লাগল বাধাহীন। সাথে ডানা মেলেছে প্রজাপতিরা। তাদের ডানাতেও নুরের ঝলক। তোভিয়ার মন বাক বাকুম করে উঠল। উল্লাসিত গলায় বলল—
“এগুলো কোথা থেকে এনেছেন?”
“মহাচ্ছায়া জঙ্গল থেকে।”
“আপনি?”
“হুম।”
তোভিয়া মাথা উঁচু করে চেয়ে আছে। ঝিকিমিকি করছে অন্ধকার ঘর। তার মনে হচ্ছে আকাশের বুকে এক ঝাঁক তারা। তোভিয়ার চোখ হাসছে। তা দেখতে পাচ্ছে জেহেন। মেয়েটা অনেক সময় পর হেসেছে। আমোদিত হলো সে। তোভিয়া সেই আলোকরাজি দেখতে দেখতে নমনীয় গলায় প্রশ্ন করল—
“আপনার ভয় করে না জেহেন? মানুষ বলে মহাচ্ছায়া জঙ্গলে নাকি মানুষখেকো গাছ আছে!”
জেহেন দুষ্ট হেসে ছোট্ট কামড় বসাল তোভিয়ার কণ্ঠদেশে। চমকে উঠল তোভিয়া। জেহেন হাসতে হাসতে বলল—
“আছে তো। এই যে আমি।”
আঁধারের একরত্তি আলোতে জেহেনের দিকে গাঢ় চোখে তাকাল তোভিয়া। জেহেনের চোখে অদ্ভুত হৃষ্টতা।
বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে জেহেন আর তোভিয়া। জোনাকি পোকা আর প্রজাপতিদের ওই মিটিমিটি আলোতে আত্মহারা তোভিয়া। সে স্বপ্নাবিষ্ট নেত্রে চেয়ে আছে। জেহেন ছোট্ট করে প্রশ্ন করল—
“এখন কেমন লাগছে তোমার?”
তোভিয়া আবিষ্ট গলায় বলল–
“ভালো।”
“কত ভালো?”
“খুব ভালো।”
জেহেন দেহভঙ্গিমা বদলালো। তোভিয়ার গলায় মুখ গুঁজে বলল—
“খুব বেশি ভালো?”
তোভিয়া আনন্দের সাথে বলল—
“হুম।”
জেহেন আলতো স্পর্শ করল তোভিয়ার কানে। তোভিয়া আনমনে হাসল। কাত হয়ে ফিরে তাকাল জেহেনের দিকে। নিজেদের দূরত্ব ঘুছিয়ে নিয়ে অচ্ছেদ্য করল বন্ধন। তোভিয়ার চোখের পাতায় চুমু আঁকল জেহেন। তারপর নাকে, গালে। গভীরভাবে ছুঁয়ে দিলো প্রিয়তমার ওষ্ঠাধর। হাতের বেপরোয়া বিচরণে তোভিয়ার কাঁধের শাড়ি নামিয়ে নিল।
জ্বলজ্বল করে জ্বলছে জোনাকিরা। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে প্রজাপতিরা। ভারী শ্বাসের উদ্দামতায় দুই মানব- মানবী তাদের উষ্ণতা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে।
বরফকক্ষে বন্দি নারীটি চকিতে তাকাল। একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। বরফের তৈরি বেদিতে বসে আছেন তিনি। ক্রুর হেসে বললেন—
“সে ফিরেছে, জোহায়ের। দেখুন, তার সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে! আপনিও ফিরে আসুন। ফিরে আসুন।”
হা হা করে হেসে উঠল শুভ্র নারীটি। আচমকা সহস্র প্রজাপতিতে রূপান্তরিত হলো তার দেহ। রঙ বেরঙের প্রজাপতি উড়তে লাগল বরফাচ্ছন্ন কক্ষে। পরমুহূর্তে দেয়ালে দেয়ালে ঘাপটি মেরে বসল সব প্রজাপতি। তারপর তাতে প্রবেশ করল অবলীলায়।
মূর্তিটির পেছনের সেই চিত্র ক্রমশ জীবন্ত হচ্ছে। পদ্মফুলটিকে ঘিরে থাকা বলয়ে আলোর প্রকাশ ঘটছে। চক্রাকারে ঘুরতে লাগল সেটি। পদ্মফুলের পাঁপড়িতে অঙ্কিত প্রজাপতি প্রাণ পেল। তারা সগর্বে চিত্র থেকে সরে এসে মূর্তিটির চারপাশে আপন ছন্দে উড়তে লাগল। সুবাসে উন্মত্ত তারা। মূর্তিটি থেকে অদ্ভুত সুগন্ধ বেরোচ্ছে।
,
,
,
ঝড়োবৃষ্টি থেমে গেছে। সবকিছু শীতল, শান্ত, সমাহিত। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে অকৃত্রিম, মোহনীয়, নেশাক্ত সুগন্ধ। সহসা ভেসে উঠল দীঘির মাঝে এক আলোকিত সুবিশাল পদ্মফুল। তার আলোয় আবেশিত হয়ে জড়ো হতে লাগল প্রজাপতির দল। পদ্মদিঘীতে ঘূর্ণন সৃষ্টি হলো। ভ/য়ং/কর আক্রোশিত শব্দে তা পদ্মদিঘীর শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করে তুলেছে। পানির ঘূর্ণন এতটাই তীব্র যে, দীঘির বুকে ভেসে থাকা কয়েক শত পদ্মফুল নিমিষেই প্রলীন হয়ে গেল। তা ডুবিয়ে অতল গহ্বরে টেনে নিল সেই ঘূর্ণন। ঘূর্ণায়মান সেই পানির ঝড়টি ধীরে ধীরে সিঁড়ির সন্নিকটে এসে মন্থর হলো। কিছু সময় যেতেই তা থেমে গেল। তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি হলো অশান্ত ঢেউ। দিঘীর পানি আঁছড়ে পড়তে লাগল সিঁড়ির কোলে। প্রমত্তা ঢেউ সিঁড়ির কয়েক ধাপ সিক্ত করল তার শীতল ছোঁয়ায়। পাড় ভেঙে পানি উঠে এলো ডাঙায়। সমীরণে ক্রন্দনের আভাস। ক্ষণকাল ধরে চলা সেই ঢেউয়ের ছলাৎ ছলাৎ ধ্বনি যেন কারো বুক বিদীর্ণ করে দেবে! থেমে গেল ঢেউ। শান্ত, নির্বাক, ক্রিয়াহীন পদ্মদিঘী।
চকিতে সিঁড়ির দিকের পানিতে বুদ বুদ তৈরি হলো। ধীরে ধীরে প্রকট হতে লাগল তা। একসময় ফুটন্ত পানির ন্যায় ফুটত লাগল পানি। পটপট শব্দে বুদ বুদের ধ্বনিতে কেঁপে উঠল প্রাণহীন সিঁড়ি। দৈবাৎ সেই বুদ বুদ থেকে এক খাবলা পানি সিঁড়িতে উছলে পড়ল। সেই পানি সিঁড়ির সাথে লেপ্টে সরীসৃপের মতো ওপরে উঠতে থাকে। যখন পানির দলাটি সিঁড়ির ধাপ শেষ করে মৃত্তিকার সংস্পর্শ পায়, ঠিক তখনই সেই পানির দলা থেকে দুটো হাত বেরিয়ে আসে। ধীরে ধীরে পানির দলাটি একটা মানুষের অবয়ব ধারণ করে প্রকট হয়। চুইয়ে পড়া পানির অবয়ব ক্রমশ রূপ নেয় এক দীর্ঘকায়, সুদর্শন পুরুষে।
____________________________
(বি.দ্র: প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি। আশা করব যারা এতদিন নিয়মিত পড়েছেন, তারা সকলে এই পর্যন্ত উপন্যাসটি আপনাদের কেমন লেগেছে তা কিছু বাক্যের মাধ্যমে প্রকাশ করবেন। আপনাদের ভালোবাসা পেলেই “ছায়াকরী” দ্রুত ফিরবে। সেই পর্যন্ত পাশে থাকুন। ধন্যবাদ।)
উপন্যাস সম্পর্কিত যেকোনো আলোচনা করার জন্য আমার গ্রুপ:
https://m.facebook.com/groups/575775953721303/permalink/636911427607755/