মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-২৩

0
2310

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৩]

ছাদে বসে সবাই মিলে গল্প করছে। মৌ আর আলিহান পাশাপাশি বসেছে। আলিহানের একপাশে বসেছে রাহি তারপর রাহনাফ তারপরে মেহের। রাহি কিছুক্ষণ পর পর মেহেরের দিকে তাকাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই মেহেরের। মেহের অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে। রাহনাফ অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে মেহের অন্যমনস্ক। কি এত ভাবছে মেহের সেটা জানার জন্যে সে তার শীতল হাতটা মেহেরের হাতের উপর রাখে। নিজের হাতে শীতল অনুভব করতেই মাথা নাড়িয়ে হাতের দিকে তাকায়। রাহনাফের হাত বরাবর সে তার মুখের দিকে তাকাতেই রাহনাফ চোখের ইশারায় জিগ্যেস করে,

– এত কি ভাবছেন লেখিকা সাহেবা। কোন সমস্যা হয়েছে কি?

মেহের মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। তখনি পাশ থেকে মৌ বলে উঠে,

– সিঙ্গারা খাবো। সিঙ্গারা আর পিঁয়াজু ছাড়া আড্ডা ভরপুর হয় নাকি।

মৌ-এর কথায় সম্মতি জানায় তারা সবাই। আলিহান বাসায় সিঙ্গারা বানাতে চায় কিন্তু মৌ-য়ের কারনে সেটাও হয়ে উঠে না। মৌ আলিহানকে তার পাশ থেকে উঠতে দেয় না। মেহের ও পারে না সিঙ্গারা বানাতে। রাহি রাহনাফ ওরা কেউও সিঙ্গারা বানাতে পারে না। কিন্তু মৌ মেহেরকেই দায়িত্ব দেয় সিঙ্গারা বানাতে। কি করবে মেহের সে তো পারেনা। কিন্তু মৌ খেতে চেয়েছে যখন তো তাকে দিতেই হবে। তাই সে উঠে দাঁড়ায় মাঠের পাশে সেই ছোট্ট খড় পাতার ছাউনিযুক্ত দোকানে যেতে। সেখান থেকে গরম গরম সিঙ্গারা আর পিয়াজু কিনে আনবে সে। দোকানের কথা মনে হতেই আড় চোখে রাহনাফের দিকে তাকায় সে। মনে পরে যায় সেদিনের কথা, রাহনাফ কি ভাবে তার সমস্ত পিঁয়াজু খেয়ে ফেলেছে। মৃদু হাসে মেহের। আজ রাগের পরিবর্তে তার মুখে ফুটে উঠেছে হাসির রেখা। মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ তার দিকে তাকাতেই দুজনের দৃষ্টি সংযোগ হয় আর মেহের লজ্জামখা হাসি দিয়ে সেখান থেকে প্রস্তান করে। রাহনাফ ওর পিছু চলে আসতে চাইলে রাহি ওকে আটকিয়ে দিয়ে সে চলে আসে মেহেরের পিছুপিছু।

মেহেরের সাথে পা মিলিয়ে হাটছে রাহি। সে মেহেরের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোট চেপে হাসছে আর হাতছে। মেহের সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে হেটে চলেছে। ওর পাশে রাহি নামের কেউ আছে কি নাই সেদিকে খেয়াল নেই তার। সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে হেটে চলেছে। হঠাৎ পিছনের দিকে তাকাতেই রাহি লক্ষ করলো একটা বড় ট্রাক দ্রুত স্পিডে ওদের দিকে আসছে। ট্রাকটা দেখা মাত্রই কিছু সময়ের জন্যে জ্ঞান শুন্য হয়ে পরে রাহি। সে থ মেরে তাকিয়ে থাকে গাড়ির দিকে। যখন হুস ফিরে রাহির তখন সে দেখতে পায় ট্রকটা অতি নিকটে চলে আসছে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই ট্রাক আর মেহেরের মাঝে সংঘর্ষণ হবে। এক মিনিটও সময় নষ্ট করে না রাহি। দ্রুত মেহেরকে ধাক্কা দেয়। ঘটনাক্রমে রাস্তার এক পাশে ছিটকে পরে মেহের আর ট্রাক ওকে অতিক্রম করে চলে যায়। রাহি তাকিয়ে থাকে ছুটে চলা ট্রাকের দিকে। ট্রাক চালক তাকিয়ে আছে রাহির দিকে। কিছুসময়ের মধ্যে ট্রাক চলে যায় রাহির চোখের অগোচরে। রাহি গিয়ে মেহেরকে টেনে তুলে বলে,

– এটা কি করছিলে তুমি আপু। দেখে চলবে তো।

রাহির মুখে আপু ডাক শুনা মাত্রাই চোখ-মুখ শক্ত করে মেহের। কপালে কয়েকটা ভাজ ফেলে শক্ত গলায় বলে উঠে,

– তোমাকে আগেও বলেছি, আমাকে আপু ডাকাবা বা। শুনতে পাওনা তুমি। আর হ্যার আমাকে এক্সিডেন্ট থেকে বাচানোর জন্যে ধন্যবাদ। তাই বলে তুমি আমার বোন হবে যাবা না। আমার একটাই বোন সেটা মৌ। অনলি মৌ, বুঝতে পারছো তুমি।

– তুমি সমসময় আমার উপর রাগ দেখাও কেন? অভিমানী সূরে বলে রাহি।

– তুমি আমাকে বিরক্ত কেন করো। দেখ তুমি আলিহান ভাইয়ের বোন আর আলিহান ভাই আমার দুলাভাই, সেই হিসাবে তোমাকে আমার বাসায় থাকতে দিয়েছি তোমাকে সম্মান দিয়েছি। তাই বলে ভেবোনা তুমি আমাকে বিরক্ত করলে আমি তোমাকে কিছু বলবো না । কেন এসেছো আমার পিছু পিছু? চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে প্রশ্ন করে মেহের।

– তুমি একা আসছিলে তাই ভাবলাম যদি তুমি একা একা বোরিং ফিল করো।

– একা কোথায় আমি। আমার সাথে চারিপাশের এই বিশাল সুন্দর প্রকৃতি আছে তো। উপরের দিকে তাকিয়ে বলল মেহের। তুমি চলে যাও রাহি। আমার ধর্যের পরিক্ষা নিও না। চলে যাও। রাহির দিকে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে মেহের। রাহি অশ্রুসিক্ত নয়নে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সে মেহেরকে প্রশ্ন করে, বাবার অন্যায়ের শাস্তি আমায় কেন দিচ্ছো? তুমি আমার বড় বোন হয়েও আমাকে মেনে নিতে পারছো না। আমার কি দোষ বলো। আমাকে মানে নিতে তোমার কিসের এত প্রবলেম।

মেহের শুধু তাকিয়ে থাকে রাহির মুখ পানে কোন কথা বলে না সে। তারপর নিরবে সেখান থেকে প্রস্থান করে।

৩৪,
জাতীয় ডিবেট ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেহের। মেহেরের এক হাতে ওইনারের ট্রফি আর কয়েকটা কাজগ। অন্যহাত দিয়ে গলায় ঝুলানো মেডেলটা ধরে হাসি মুখে সকলের সাথে কথা বলছে সে। মেহেরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ আহমেদ। তার দৃষ্টি স্থির মেহের অধোরে লেগে থাকা হাসির দিকে। এই মেয়েটার হাসি দেখলে যে কারো প্রাণ জুড়িয়ে যায় সেখানে সৈয়দ নওশাদ তো তার বাবা। মেয়ের মুখের হাসি যে স্বর্গের চেয়েও দামি। সব বাবারাই চায় তার মেয়ের মুখে অফুরান্ত হাসি লেগে থাকুক সারাটা জিবন। সৈয়দ নওশাদ ও এমনটাই চেয়েচে কিন্তু সে আর সব বাবার মতো না। সে এক মেয়েকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে লালন পালন করলেও অন্য মেয়টা পায়নি তার আদর স্নেহ ভালোবাসা। এমনি সে তার পরিচয়টুকুও পায়নি। পেয়েছে সমাজের মানুষের অবহেলা অপমান লাঞ্ছিত আর কটু কথা। একদিন যে সমাজ তাকে বিতাড়িত করতে চেয়েছিল আজ সেই সমাজই তাকে একটা সম্মান দিয়েছে। মেহের আজ ডিবেট প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হয়েছে। মেহেরে আজকের ডিবেট ছিলো #আধো_রাতে_যদি_ঘুম_ভেঙে_যায় এই বিষয় নিয়ে। আজ মেহেরের বক্তব্য শুনে বিচারক সহ সমস্ত প্রতিযোগীই কেঁদেছে। কারন সে আজ বক্তব্যে রেখেছিলো তার জিবন নিয়ে। তর সাথে ঘটে যাও ঘটনা গুলো নিয়ে। তার অসহায়ত্ব নিয়ে সকলে যখন তার সামনে তাকে সান্তনা দিয়ে চোখের আড়াল হতেই তাকে নিয়ে সমালচোনার মেলা বসায় সেটা নিয়ে। মেহের আজ তার বক্তব্যের মধ্যে দেশে সিঙ্গেল বাবা মা শব্দের প্রচলন আনার কথা উল্লেখ করেছে। যাতে কোন সন্তানকে আর মানুষের কটু কথা শুনতে না হয়। সিঙ্গেল বাবা মা-রা মাথা উচু করে বাঁচতে পারে। কারন পারিবার ভাঙ্গার গল্পটা সবার অগোচরে থাকে। পরিবার ভাঙ্গা সংসার ভাঙ্গা বাবা মায়ের বিচ্ছেদ সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে সন্তানের উপর। এতে করে সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সৈয়দ নওশাদের অবহেলা সৈয়দা মাহবুবার আত্নসম্মানে গেলেছিল তাই হয়তো তিনি এমন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ না হয়ে একজন সিঙ্গেল মাদার প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি। মেহেরের বক্তব্য শুনে বিচারকগন কেঁদেছেন। টেলিভিশনে সরাসরি মেহেরের বক্তব্য শুনে রাষ্ট্রপ্রতি নিজে এসে মেহেরের সাথে দেখা করেন। পুরুস্কার হিসাবে তাকে দুই লক্ষ টাকার চেক একটা গোল্ড মেডেল আর সম্মাননা প্রধান করেন। সৈয়দ নওশাদ ও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। মেহেরের বক্তব্য শুনে সে কেঁদেছেন। সকলের সামনে যখন মেহের নিজেকে একজন সিঙ্গেল মাদারের মেয়ে হিসাবে পরিচয় দিচ্ছিল তখন সৈয়দ নওশাদের বলতে ইচ্ছে করছিলো মেহের আমার মেয়ে আমি মেহেরের বাবা। কিন্তু সে সেটা করতে পারেন নি কারন মেহের তাকে বাবা হিসাবে স্বীকার করে না।

প্রায় দশ মিনিট আগে রাহনাফকে কল করে এখানে আসতে বলেছে মেহের। এতক্ষণে হয়তো রাহনাফের এখানে চলে আসার কথা। মেহের রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিকে তাকাতাকি করছে। আজ মেহেরের জিবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন এই দিনে রাহনাফের সঙ্গ না দিলে কি করে হয়। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে রাহনাফকে কল করে মেহের। মেহেরের থেকে কিছুটা দূরত্বে কল বেজে উঠে তবুও রাহনাফ কল রিসিভ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায়। রাহনাফ মোবাইল কানের কাছে ধরে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে মেহের মুখের উপর দৃষ্টি রেখে। মেহেরও মোবাইল কানে নিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহনাফের চোখের দিকে।

চলবে,,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

[রিচেক করা হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here