#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [২৫]
মোবাইল হাতে ভীতু চোখে সৈয়দ নওশাদের দিকে তাকিয়ে আছে আফিয়া আহমেদ। আফিয়া আহমেদের হাতটা কাপছে, যে কোন সময় তার হাত থেকে মোবাইলটা পরে যেতে পারে। তার সামনেই অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে সৈয়দ নওশাদ। চক্ষু তার লাল বর্ন ধারন করেছে। দুই হাতই শক্ত মুঠি করে রেখেছেন তিনি। চোখ-মুখে ক্রোধ উপছে পরছে তার। কাঁধে ঝুলে থাকা কোটটা নিচে ফেলে দিলেন তিনি। আফিয়া আহমেদ ভীতু চোখে ধীর পায়ে এক পা এগিয়ে এসে বললেন,
– নওশাদ আমি,,,
– এত নীচে তুমি কি করে নামতে পারলে আফিয়া। হাত উঁচু করে আফিয়া আহমেদকে থামিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে তার কাছে এসে ঠাস করে আফিয়া আহমেদের গালে চড় বসিয়ে দেন তিনি। অতঃপর বলেন।
– মেহেরের এত বড় ক্ষতি কেন করলে তুমি। বলেই আরো একটা চড় বসিয়ে দিলেন আফিয়া আহমেদের গালে।
আফিয়া আহমেদ সৈয়দ নওশাদকে ধাক্কা দিয়ে কয়েকপা দূরে ঠেলে দেন। অতঃপর চিৎকার বলে বলেন,
– আমি যা করেছি একদম ঠিক করেছি। ওই মেয়েটার জন্যে তোমার কেন দরদ উতলে উঠছে নওশাদ। নওশাদ ওই মেহেরের জন্যে আমাদের রাহি কষ্ট পেয়েছে। রাহি ওর ভালোবাসা পায়নি। তুমি আমাদের মেয়ের কষ্টটা দেখতে পাওনি নওশাদ।
– মেহেরও আমার মেয়ে আফিয়া। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন সৈয়দ নওশাদ। উপরের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ তারপর আফিয়া আহমেদের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলে উঠেন,
– আল্লাহর কাছে প্রে করো যাতে মেহের তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যায়। না হলে তোমার কি অবস্থা হবে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। এতদিন সৈয়দ নওশাদ আহমেদের ভালোবাসাটা দেখেছো এবার তার বিপরীত টাও দেখতে পাবে। বলেই হন হন করে নিজের রুমে চলে যায় সৈয়দ নওশাদ। সৈয়দ নওশাদ চলে যেতেই স্বস্তিকর শ্বাস ফেলে আফিয়া আহমেদ। গালে হাত রেখে অধোর চেপে হাসে। তারপর হাতে থাকা মোবাইলটা দিয়ে কল লিষ্টের প্রথম নাম্বারে ডায়াল করে বলে,
– সময়মতো টাকাটা পেয়ে যাবে। আমাকে আর কল করবে না। প্রয়োজন হলে আমিই তোমাকে ডাকাবো। কল কেটে দেয় আফিয়া আহমেদ। পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলে,
– ভালোবাসা হাড়ানোর যে কষ্ট সেটা রাহি কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। আমার মেয়ের সুখের জন্যে এটুকু অন্যায় আমি করতেই পারি। নিজের সুখের কথা ভেবে যদি কারো,,, বড় করে শ্বাস ত্যাগ করে আফিয়া আহমাদ অতঃপর সে বাগানের দিকে চলে যায়।
সৈয়দ নওশাদ নিজের রুমের কাছে আসতেই শুনতে পেলেন তার স্ত্রী আফিয়া আহমেদের উৎফুল্ল কন্ঠ। সে উৎফুল্ল হয়ে কাউকে বলছেন, মেহেরকে প্রাণে মেরে ফেলার কথা। অপর পাশে থাকা ব্যাক্তি কথা শুনতে পায়নি সৈদয় নওশাদ কিন্তু আফিয়া আহমেদের কথায় তিনি যতটুকু শুনেছেন তাতেই বুঝতে পেরেছেন আফিয়া আহমেদ কাউকে সুপারি দিয়ে মেহেরেকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। তবে এই কাজে তিনি সফলও হয়েছেন। মেহের এখন হসপিটালের বেডে মৃত্যর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। অপর পাশে থাকা লোকটাকে তিনি বলছেন, কাজটা করে দেওয়ার জন্যে যে টাকা দিতে চেয়েছে, মেয়েটার মৃত্যর খরব এনে দিলে তত টাকাই তাতে উপহার হিসাবে দিবে। আফিয়া আহমেদের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে যায় সৈয়দ নওশাদ। সে সেখানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। আফিয়া আহমেদের কথা শুনে তার আর বুঝতে বাকি থাকে না যে মেহের এত বড় ক্ষতি কে করিয়েছে। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার। ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে যায়। হাতের মুঠি শক্ত হয়ে এলে এক পা সামনে রাখে সে তখনি রুমের বাহিরে থাকা একটা ফুলদানির সাথে পা লেগে যায় তার আর ফুলদানিটা নিচে পরে বিকট শব্দ হয়। এই শক্ত শ্রবণ হতেই পিছনে ফিরে তাকায় আফিয়া আহমেদ। তার পিছনে সৈয়দ নওশাদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আফিয়া আহমেদ চমকে উঠে। কখন যে তার কানে থাকা মোবাইলটা নিয়ে নামিয়ে ফেলছে সেটা বুঝতে পারেনি। ভিতু চোখে সৈয়দ নওশাদের দিলে তাকিয়ে কাঁপতে থাকে সে।
৩৬,
করিডোরের পাশে চিন্তিত মনে অপেক্ষা আছে রাহনাফ আলিহান আর মৌ। অপেক্ষা সময় বুঝি একটু বেশীই দীর্ঘ হয় তাইতো আলিহান করিডোরে পায়চারী করছে আর রাহনাফ বসে বসে একবার মাথায় চেপে ধরছে আর মুখে হাত রেখে বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। তাদের এই অপেক্ষিত সময় যেন শেষই হচ্ছে না। মৌ কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলছে। সে ক্লান্ত শরীর নিয়ে চুপটি মেরে বসে আছে। তার দৃষ্টি স্থির সামনে থাকা অটির দিকে যেখানে মেহের রয়েছে। রাহনাফ যখন আলিহান আর রাহিকে কল করে মেহেরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা বলে তৎক্ষণাৎ ওরা হসপিটালে চলে আসে। রাহি আসার পরেই ওকে কিছু ফলমূল খেতে দেওয়া হয়। তারপর একটা নার্স রাহির রক্তের কয়েকটা পরিক্ষা করে নেয়। রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পরে ডক্টর রাহির শরীর থেকে রক্ত নিয়ে বলে জানিয়ে দেয়। কারন রাহির পিরিয়ড চলছে। এই অবস্থায় কোন ডোনারই রক্ত দিতে পারে না। তখন খুব ভেঙে পরে রাহনাফ ও রাহি, তবে কি তারা মেহেরকে আবার তাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তখনি হসপিটালে উপস্থিত হয় মৌ আর সৈয়দা মাহবুবা। রাহনাফের টিশার্টের রক্ত দেখেই থমকে যায় সৈয়দা মাহবুবা। দুপুর পেরিয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে সন্ধা হতে চলল তবুও বাসায় ফিরেনি মেহের তাই মৌ একটু বেশী চিন্তিত ছিলো। মেহেরকে কল করে পায়নি। যতবার কল করেছে ততবারই সুইচ অফ দেখাচ্ছে। আলিহানকে কল করেছে কয়েকবার কিন্তু সেও কল রিসিভ করে নি তাই মৌ এলমাদের বাসায় চলে যায়। কারন এই সময় সৈয়দা মাহবুবা এলমাদের বাসায় থাকে। সেখানে গিয়ে মৌ সৈয়দা মাহবুবা বলে মেহের এখনো বাসায় ফিরে নি আর ওর মোবাইল বন্ধ ওকে কলে পাওয়া যাচ্চে না। সব শুনে সৈয়দা মাহবুবা চিন্তিত হয়ে পরেন। এলমাদের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে মৌ-কে নিয়ে রওনা দেয় জাতীয় ডিবেট ক্লাবের সামনে। কোন কিছু হাড়ালে যেমন শুরু থেকে খোজা হয় তেমনিভাবে কোন ঘটনা গভীরে পৌঁছাতে হলে সুত্রপাত জানতে হয়। ডিবেট ক্লাব বন্ধ।ফিরে আসছে তারা তখন কাউকে বলতে শুনলো,
– মেয়েটা বাঁচবে তো। ছেলেটাকে দেখলাম পাজা কোলে করে হসপিটালে নিয়ে গেলো। গাড়ি তাকতেও গাড়িতে উঠলো না। একটা মেয়ের জিবন কি এতটাই ঠুনকো, মেয়েটার জিবন মরনের প্রশ্ন এখানে আর ছেলেটা কি করবো! মেয়েটার কথা না ভেবে নিজের জেদটাকে বজায় রাখতে হেটে হেটে গেলে।
একজন পথিকের কথা শুনে অপরজন বলে উঠে,
– ঠিকই বলছো ভাই। মেয়েটার জন্যে আমারও ভিষন খারাপ লাগছে। কি সুন্দর কথাগুলো বলছিলো সে।
পথিকদের কথা শুনে সৈদয়া মাহবুবা তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে জিগ্যেস করে তারা কোন মেয়েটার কথা বলছে। কিন্তু পথিকরা সেটা বলতে পারে না। সৈয়দা মাহবুবা সবার মতো স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে না যে তাদেরকে মেহেরের ছবি দেখাবে। মৌ-কে দেখাতে বললে সে বলে মোবাইল বাসায় ফেলে এসেছে। মন খারাপ হয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবার। তখনি সেখানে একটা লোক আসে আর সে সৈয়দা মাহবুবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চট করে বলে উঠে,
– আপনিই তো সেই যাকে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় ফেলে রেখে স্বামি দ্বিতীয় বিয়ে করেছে।
লোকটার কথা শুনে সৈয়দা মাহবুবা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এই লোকটাকে সে চিনে না, আজকের আগে কখনো তাকে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না তাহলে সে এসব কথা কি করে জানলো। অবাকের সূরে জিগ্যেস করে সৈয়দা মাহবুবা বলে উঠে,
– আপনি এসব কি করে জানেন।
– আপনাকে দেখে। আসলে আজকাল কোথাও কালো মেয়ে দেখা যায় না সেই হিসাবেই বললাম।
লোকটার কথা শুনে মৃদু হাসে সৈয়দা মাহবুবা। প্রতিউত্তরে কিছু বলে না সে। তখনি সে আবার বলে উঠে,
– আপনার মেয়ের কি অবস্থা! জ্ঞান ফিরেছে তার। অনেক রক্ত বের হয়েছে।
লোকটার ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবা। মেহেরের জ্ঞান ফিরেছে মানে কি? কি হয়েছে মেহেরের! সৈয়দা মাহবুবা উল্টা প্রশ্ন করে,
– কি হয়েছে আমার মেহুর! কোথায় আমার মেহু?
একজন মেহেরের সম্পর্কে তাকে বলতে চাইলে অন্যজন তাকে থামিয়ে দিয়ে তাদের নিয়ে সোজা হসপিটালে চলে যায়। কারন সে মেহেরকে হসপিটালে এডমিশনের সময় সেখানে ছিলো।
সৈয়দা মাহবুবাকে দেখে অবাক হয়ে যায় রাহনাফ আলিহান আর রাহি। তারাতো সৈয়দা মাহবুবাকে জানায় নি তাহলে সে এখানে আসলো কি করে। রাহনাফ টিশার্টে রক্তদেখে বেহুশ হয়ে যায় সৈয়দা মাহবুবা। মেহের কোথায়! কি হয়েছে মেহেরের সেটা জানার জন্যে বেকুল হয়ে পরেন তিনি। এরপর আলিহান সৈয়দা মাহবুবা করিডোর বসিয়ে সবটা বলে। সব শুনে সৈয়দা মাহবুবা সেখানেই তার জ্ঞান হাড়িয়ে ফেলে আর মৌ কান্নাশুরু করে দেয়। সৈয়দা মাহবুবাকে কেবিনে নিয়ে সেলাইন করা হয় আর মৌ-কে সামলাতে থাকে রাহি।
অবশেষে হসপিটাল কর্তিপক্ষ রক্তের ব্যাবস্থা করে মেহেরকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। আর ওরা সকলে অটির বাহিরে অপেক্ষা করতে থাকে।
অটির আলো নিভে যেতেই দাঁড়িয়ে যায় মৌ। ডক্টর বেড়িয়ে আসতেই রাহনাফ আলিহান আর মৌ আর রাহি তার কাছে গিয়ে জিগ্যেস করতে থাকে।
সবার প্রশ্ন শুনে মাথা নিচু করে ডক্টর। সে সবাইকে অবলোকন করে নেয়।
চলবে,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।