মেঘ ভাঙ্গা রোদ্দুর পর্ব-৩৭

0
1958

#মেঘ_ভাঙ্গা_রোদ্দুর। [৩৭]

রাহনাফ মেহেরকে নিয়ে শহর ছেড়ে একটু দূরে একটা মেলায় চলে যায়। মেলার সামনে বড় করে ব্যানারে সাঁটানো হয়েছে, নবান্ন উৎসব। লেখাটা দেখে মেহের প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাহনাফের দিকে। রাহনাফ মৃদু হেসে জবাব দেয়,

– সাত দিনের মেলা, আজই শেষ।

– ওহ আচ্ছা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলে, আপনি কি আগেও এখানে এসেছেন?

– গতকাল এসেছিলাম। আচ্ছা চুড়ি নিবে চুড়ি? চল ওদিকে যাই।

এত মানুষের ভীড়ে রাহনাফ মেহেরের হাতটা ধরে চুড়ির দোকানে নিয়ে যায়। তারপর নিজের পছন্দমত কিছু চুড়ি মেহেরের দু-হাতে পরিয়ে দেয়। মেহের চুড়ি পরে নিজেই দু-হাত নাড়িয়ে খিলখিল করে হাসে। রাহনাফ মুগ্ধ হয়ে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেহেরের এমন প্রাণ উচ্ছল হাসি দেখলে রাহনাফের মনটা শীতল হয়ে যায়। তারপর ঝিনুকের কানেরদুল পরিয়ে দেয় মেহেরের কানে। মেহের মিররে নিজেকে দেখতে ব্যাস্ত আর রাহনাফ চুড়ি কানের দুলের দাম মিটিয়ে নেয়। ওয়ালেটটা পকেটে পুরে মেহেরের হাত শক্তকরে ধরে মেলার অন্যপান্তে নিয়ে যায়। সেখানে ছিলো অনেক মানুষের ভীড়। এত মানুষের ভীড় দেখে মেহেরের মনে উৎসাহ জাগে ওখানে কি হচ্ছে সেটা জানার জন্যে। মেহের বেশ উৎসাহ নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ব্যপারটা রাহনাফ লক্ষ করতেই স্মিত হেসে বলে,

– ম্যাজিক দেখবে?

– কিসের ম্যাজিক!! পাল্লাপ্রশ্ন মেহেরের।

ভ্রুদ্বয় সংকোচিত করে মেহেরের দিকে তাকায় রাহনাফ। অতঃপর বলে,

– প্রশ্নটা আমি আগে করেছি। ম্যাজিক তো ম্যাজিক-ই হয় তাইনা লেখিকা সাহেবা।

– দেখবো। ইনোসেন্ট মুখ করে বলে মেহের।

রাহনাফ সামনের ভীড় ঠেলে দু-হাতে মেহেরকে আগলে সামনে চলে যায়। সামনে যেতেই অবাক হয়ে যায় মেহের। সেখানে দুজন মাধ্যবয়স্ক মহিলা আর কয়েকজন বাচ্চা মিলে সবাইকে ম্যাজিক দেখাচ্ছে। মেহের মনোযোগ দিয়ে দেখছে। বাচ্চাগুলোর ম্যাজিক তার কাছে বেশী ভালো লাগছে। তারা ম্যাজিকের সাহায্যে একে অপরকে ভয় দেখাচ্ছে। মেহের ম্যাজিক দেখছে আর হাত নাড়াচ্ছে। নিজের কৌতুহল দমাতে না পেরে সে বলে উঠলো, আমিও দেখাবো ম্যাজিক। কথাটা জোরে না বললেও একজন ম্যাজিশিয়ান সেটা শুনতে পায়। সে হাতের ইশারায় মেহেরকে তার কাছে ডাকে। মেহের রাহনাফের দিকে করুন চোখে তাকায়। সে ওই মাধ্যবয়স্ক মহিলার কাছে যেতে ভয় পাচ্ছে । রাহনাফ আলতো করে মেহেরের হাত ধরে ওকে চোখের ইশারায় শান্ত হতে বলে ম্যাজিশিয়ানের কাছে নিয়ে যায়। মাধ্যবয়স্ক ম্যাজিশিয়ান মেহেরকে পা থেকে মাথা অব্ধি অবলোকন করে নিয়ে মেহেরকে তার পাশে বসিয়ে দেয়। অতঃপর সুধায়,

– কে হয় এটা তোর! বর??

মেহের শান্ত দৃষ্টিতে রাহনাফের দিকে তাকায়। রাহনাফ ও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেহেরের মুখ পানে। মেহের কি জবাব দেয় সেটা দেখার জন্যে। অধোর চেপে হাসছে রাহনাফ। মেহের তার দৃষ্টি শক্তকরে ফেলে। রাহনাফের হাসি যেন আরো বেড়ে যায়। সামনের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়,

– আমরা বিবাহিত ন,,,

পুরো কথাটা বলার আগেই অর্ধবয়স্ক মহিলা বলে উঠে,

– নতুন বিয়ে হয়েছে মনে হচ্ছে। তাকা আমার চোখের দিকে। মেহের তার কথামতো তার চোখের দিকে ভীতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। অর্ধবয়স্ক ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক করে মেহেরকে মিষ্টি কালারের শাড়ি পড়িয়ে দেয়। বিস্মিত হয়ে দু-হাতে মুখ চেপে ধরে মেহের। উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মেহেরের দিকে। রাহনাফের চোখ যেন মেহেরের উপর থেকে সরছেই না।

শাড়ি পরে মেলার ঘুরে মেহের। রাহনাফ সব সময় মেহেরের হাত ধরে ওকে আগলে রেখেছে। বাড়ি ফেরার সময় রাহনাফ একটা বেলী ফুলের মালা কিনে নেয় মেলা থেকে আর সেটা মেহেরের চুলে গুজে দেয়। মেহেরকে মেহেরের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সে দুদিনের জন্যে শহরের বাইরে চলে যায়। রাহনাফ তার পৈতৃক বাড়িতে ফিরে যায়। কোন সমস্যার সমাধান করতে হলে আগে গোড়া থেকে জানতে হয়। রাহনাফ তার পৈতৃক বাড়িতে থেকেই সব সমস্যার সমাধান করবে।

৪৭,
রাতের আধার কাটিয়ে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।
এক সোনালি সকালের দেখা মিলেছে। যদিও হসপিটালে সকাল দুপুর রাত এটা বুঝা বড় দায়। নিচে কিছু পরার শব্দে ঘুৃম ভাঙে রাহির। চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পায় তার বাবা হাত নাড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে পাশ থেকে গ্লাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলো সে আর তখন গ্লাসটা নিচে পরে যায়। খুশিতে চোখে পানি এসে যায় রাহির। দুদিন ধরে তো এই দৃশ্য দেখার জন্যে সে হসপিটালে পরে আছে। সেদিন রাতে সৈয়দ নওশাদ হার্ট এট্যাক করেন। দুদিন পর আজ চোখ মেলে তাকিয়েছে। রাহি দ্রুত পায়ে সৈয়দ নওশাদের কাছে গিয়ে জিগ্যেস করে,

– বাবা তুমি পানি খাবে?

সৈয়দ নওশাদ কোন জবাব দেয়না শুধু ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে থাকে রাহির দিকে। রাহি কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তাই সে বোতল থেকে অন্য একটা গ্লাসে পানি দিয়ে সৈয়দ নওশাদকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু সৈয়দ নওশাদ খেতে পারে না। কিন্তু মেয়ের মন রাহির। বাবা পানি খেতে চেয়েছে এমতাবস্থায় কোন মেয়েকি পারে তার বাবাকে পানি না দিয়ে থাকতে। রাহি নিজের হাতে পানি ঢেলে একটু একটু করে সৈয়দ নওশাদের মুখে পানি ঢেলে দেয়। তারপর সে সৈয়দ নওশাদের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসে। চোখের পানি মুছে বলে,

– আমি ডক্টরকে ডেকে নিয়ে আসছি।

লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে যায় রাহি। সৈয়দ নওশাদ রাহির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে সৈয়দ নওশাদকে কিছু টেষ্ট করিয়ে নেয়। টেষ্টের রিপোর্ট সরুপ রাহি জানতে চাইলে ডক্টর চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ততক্ষণে রাহির দাদিও হসপিটালে পৌছে যায়। ছেলের জ্ঞান ফিরার কথা জানতে পেরে তিনি আর বাড়িতে বসে থাকতে পারেন নি।

মুখোমুখি বসে আছে ডক্টর আর রাহি, ওর পাশেই বসে আছে আলিহান । রাহির চোখ অশ্রুতে ভরে গেছে। ঠোঁট কাপছে। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। আলিহান রাহির এক হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। তারও কস্ট হচ্চে খুব। ডক্টর তাকিয়ে আছে রাহির মুখের দিকে। মেয়েটাকে দেখে তার মায়া লাগছে খুব। দুদিন ধরে একা একা তার বাবার জন্যে কত কষ্ট করেছে তাইতো ডক্টর রাহিকে এমন একটা খবর দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু কি আর কারার! সত্যিটা তো সবাইকে জানাতে হবে। রাহি কান্নামিশ্রত সূরে বলে উঠলো,

– আমার বাবাকি আর কখনো হাটতে পারবে না ডক্টর।

সৈয়দ নওশাদের প্যারালাইজড হয়ে গেছে। তার বা পাশটা প্যারালাইজড হয়েছে। এমন একটা খবর যে কোন সন্তানের কাছেই দুঃখজনক। রাহির কাছেও তাই। ডক্টর রাহির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

– হয়তো। বড় করে শ্বাত ত্যাগ করে অধোর কামড়ে নিয়ে তিনি আবার বলতে লাগলেন, পক্ষাঘাতগ্রস্থ মানুষের দেহের অভ্যন্তরের স্নায়ুগুলোকে ‘পুনর্বহাল’ করে বা বলা যায় ‘জোড়া লাগিয়ে’ আবারো তাদের হাত ও বাহু নাড়ানোর ব্যবস্থা করা গেছে, এমনটা বলছেন একজন অস্ট্রেলিয়ান শল্য চিকিৎসক।
ব্রিসবেনের ৩৬ বছর বয়সী পল রবিনসন বলছেন যে, এই উদ্ভাবনী অস্ত্রোপচার তাকে এমন এক ধরনের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে যেটি তিনি কখনো কল্পনাও করেননি।
সম্পূর্ণ স্বাভাবিক কাজকর্ম করার ক্ষমতা হয়তো এর মাধ্যমে আনা সম্ভব নয়, তবে ডাক্তাররা বলছেন এতে করে জীবনের পরিবর্তন আনা সম্ভব।
মেরুদণ্ডে কোন আঘাত প্রাপ্তির ফলে মস্তিষ্ক থেকে কোন সংকেত শরীরের অন্য কোন অংশে আর যেতে পারে না। আর এই অবস্থার ফলেই পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস হয়।
যাদের বিশেষ করে কোয়াড্রিপ্লেজিয়া এফেক্ট ঘটে প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে তাদের বেশিরভাগ অঙ্গই সাড়া দেয় না।তবে কিছু ক্ষেত্রে তাদের উপরের বাহুর পেশী নাড়াচাড়া করার মতো অবস্থা থাকে।তখন মেরুদণ্ডের সাথে সেইসব সচল স্নায়ুগুলোর সংযোগ ঘটানো হয়। ফলে পেশীগুলো আবারো সাড়া দিতে পারে।মেলবোর্নের অস্টিন হেলথ এর ডা. নাতাশা ভ্যান জিল বলছেন, “আমার বিশ্বাস করি নার্ভ ট্রান্সফার সার্জারি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্যে একটি দূর্দান্ত বিকল্প। প্রতিদিনের কাজগুলো করতে হাতের কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার সম্ভাবনা তাদের জীবনে আরো স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনে। তবে পেশেন্টের সুস্থতা নির্ভর করে সময়ের উপর। আপনি কত দিনে রোগীর চিকিৎসা করাচ্ছেন। ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে চিকিৎসা করালে রোগীর ভালো হওয়ার সম্ভবনা বেশী।

– তাহলে কি বলতে চাইছেন আপনি, আমার বাবা ভালো হয়ে যাবে! উৎফুল্ল হয়ে বলল রাহি।

– উনার ভাগ্যের উপর নির্ভর করে সেটা।

রাহি মনে মনে প্রতিঞ্জা করে এই অশ্রপ্রচার সে তার বাবাকে করাবে। যে করেই হোক তার বাবাকে সুস্থ করে তুলবে সে। আলিহান আর রাহি দুজনেই ডক্টরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে সৈয়দ নওশাদের কাছে চলো আসে। আফিয়া আহমেদ এখনো বাড়ি ফিরে নি। সে কোথায় আছে সেটা এখনো সবার অজানা। তবে আফিয়া আর ফিরবে না?

চলবে,,,,,,

#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here