ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ২১

0
925

ঘাসেদের ফাগুন পর্ব ২১
________🖌️নাজনীন নাহার
১০.০৪.২০২২

আমার ফেসবুক ও পেইজের বয়স এখন মাত্র দেড় বছর। আমি খুব ভদ্র, শিক্ষিত ও গুণী মানুষদেরকে তাদের প্রফাইল দেখে দেখে আমার আইডিতে এড করলাম। এরা প্রায় সকলেই সাংস্কৃতিক জগতের বেশ ভালো ভালো শ্রদ্ধাভাজন প্রফাইলের মানুষ, গুণী মানুষ। কেউ কেউ অসাধারণ সুন্দর সব ছবি আঁকেন, কারও কারও পেন্সিল স্কেচ দেখার মতো।কেউ আবার ভীষণ সুন্দর সব গল্প উপন্যাস লিখেন।কেউ কবিতায় এতোটাই পারদর্শী যে রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে ইদানীং আমি তাদেরকে পড়ি। কেউ কেউ তার আবৃত্তির মোহন মায়ায় আমাকে মোহমুগ্ধ করে রাখেন। কারও কারও ফ্যাশন ডিজাইনের স্কেচগুলো দেখলে আমি নিমগ্নতায় ডুবে থাকি। অনেকের গানের গলা আমাকে নতুন করে জীবন বোধে উজ্জীবিত করে। এর মধ্যে কিছু উঠতি ও গতানুগতিক লেখক, আঁকিয়ে, শিল্পী, আবৃত্তিকার, কবি, সাহিত্যিকদেরও আমি এড করে নিলাম পেইজের পাশাপাশি আমার আইডিতেও। এর যৌক্তিক ও সুস্বাদু কারণ হলো সংষ্কৃতি জগতের মানুষগুলোর সাথে থাকলে আমি আরও সমৃদ্ধ হবো। আমি তাদের সকলের সৃজনশীলতার সাহচর্যে আরও শিখতে ও জানতে পারব। পারবো নিজের সৃষ্টিকে আরও ঋদ্ধ করতে। আরও শালীন, সুশীল ও পরিশীলিত হবে আমার মনন। খুলে যাবে চিন্তার দ্বার। আচরণ হবে আরও মার্জিত। রুচিশীলতায় আমি হবো আরও পরিপূর্ণ। হবো মানুষ আরও। মানবিকতার গুণাবলী ও বিশুদ্ধ বোধে আমি আরও অনন্য সুন্দর মনের মানুষ হব। কারণ সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি আমাদের সভ্যতার ধারক ও বাহক।

আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকেই অনেক বেশি কনজার্ভেটিভ ও ধর্মীয় গোড়ামির সাহচর্য বেশি পেয়েছি। শ্বশুর বাড়ি, স্বামী তাদের কাছেও সংকীর্ণ মানসিকতার কলুষিত দিকগুলো বেশি দেখেছি। তাই এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনটাকে আমার কাছে একটা পরিমার্জিত পৃথিবী মনে হয়েছে। আমি বিভিন্ন শিল্প সাহিত্যের গ্রুপগুলো থেকেও একটা সহমর্মিতার প্রণয় ও অনুপ্রেরণাও পেয়ে যাচ্ছিলাম।

এরমধ্যেই একে একে ইনবক্সে আসতে শুরু করলো গুড মর্নিং, গুড নাইটের ঝড়। তার মধ্যে দেখি শুভ দুপুর, শুভ অপরাহ্ন, শুভ সন্ধ্যাটাও যোগ হলো। ভাবলাম এটা মনে হয় এই জগতের সৌন্দর্যের বিস্তারিত। থাকুক। জবাব টবাব তো আর দেয়া বাধ্যতামূলক নয়। কিন্তু এরপর শুরু হলো মেসেঞ্জারে অডিও কল ও ভিডিও কল দেয়া। লাভ ইমোজির ছড়াছড়ি। কেউ বলছেন বন্ধুতা করতে চান।চেনা নেই, জানা নেই কেউবা সরাসরি বলে ফেলছেন ভালোবাসি। আমি কী তোমার মা, নানি, খালা না চাচি তার হিসেব নেই। কী এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি!
কেউ কেউ আবার রাগ গোসসা করে লিখে দিচ্ছেন
—–এতো দেমাগ কেন আপনার? এতো ভাব!
কেউ বলছে।
—-কী ব্যাপার! মেসেজের জবাব নাই। নিজেকে কী এমন সুন্দরী মনে করেন!
কেউ আবার!
—একটু কথা বলা যাবে? আপনার মন ভালো? আপনার শরীর ভালো!
কারও আগ্রহ আরও একটু ব্যক্তিগত!
—-এতো রাতে কী করেন!
আবার সরল মায়ার ছড়াছড়িও দেখছি।
—নাস্তা করেছেন?
—— লাঞ্চ হলো!
—-ডিনার করেছ!
এরকম হরেক মেসেজ নিয়ে হরেক মানুষ। এবং এর অধিকাংশই শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনের। কারণ আমি তো বিশিষ্টজনদের সাথেই আছি!

আরও কত কত রোমান্টিক কবিতা লিখে ইনবক্সে দিচ্ছেন কেউ কেউ। কতজন খালি গলায় রোমান্টিক ও স্যাড গান গেয়ে ইনবক্সে পাঠাচ্ছেন ইমপ্রেস করতে।
কেউ কেউ আবার রোমান্টিক কবিতা পড়ে র ভয়েজ ইনবক্সে দিচ্ছেন। ইনিয়ে বিনিয়ে ভয়েস মেসেজ পাঠাচ্ছেন।
ভাই, বাপ, খালু, চাচা, মামু আপনারা আমার প্রফাইলে দেখেন না আমি বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জননী! আমার পাশে আমার জলজ্যান্ত স্বামী উপস্থিত!

তবে কিছু কিছু নারী পুরুষ শিল্পীরা নিজেদের ফ্যামিলির ছবি, স্বামী-স্ত্রীর ও বাচ্চাদের ছবি প্রফাইলে দেয় না। তাদের বিষয় আলাদা। নিশ্চয়ই তাদের একটা সিঙ্গেল সিঙ্গেল ভাব নিয়ে বিখ্যাত নায়ক নায়িকাদের মতো জনপ্রিয়তা বেশি পাবার ইচ্ছে বা বিশেষ কিছু কারণ ও নিয়ত থাকে। থাকুক। কিন্তু আমি তো ভরপুর ফ্যামিলি নিয়ে আমার ফেসবুকে আছি। তারপরও কেন আমার মতো রমনীগণকে কিছু পুরুষ টাইম পাসের সরঞ্জাম মনে করে তা আল্লাহই জানেন।

আমি অবশ্য এমন সব মেসেজ আসে আর ডিলিট করি।আসে আর ডিলিট করি। অনেককে আনফ্রেন্ড আর ব্লক করি। একদিন রাত বারোটার দশ। সেল ফোনটা বন্ধ করে ঘুমাব। তাই হাত থেকে বালিশের পাশে সেলফোনটা রেখে মাথার কাছে রাখা পানির বোতল নিয়ে পানি খাচ্ছিলাম। এমন সময় এক ভিডিও কল। তাও আবার পুরুষ। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল এক পুরুষের প্রফাইল পিকচার। বিষয়টি পাশ থেকে চোখে পড়ল রাশেদের। আমি অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াতাড়ি লাইন কেটে দিলাম। ব্যাস শুরু হলো আমার সাথে রাশেদের চিৎকার চেঁচামিচি আর আমাকে অপমান ও অপবাদ। আমি ওকে খুব বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তারপর সে শান্ত না হওয়া অবধি চুপ করে রইলাম।

রাশেদ শান্ত হলে এবার আমি বললাম।
—–এই নাও আমার মোবাইল। এক সপ্তাহ তোমার কাছে রাখো। তুমি দেখো বিষয়গুলো কী হচ্ছে।
—-আমার আর দেখার কিছু বাকি নেই। রাত দুপুরে বেটারা তোমাকে কেন কল দেয় আমি তা বুঝি!
তখন আমি নিজের কণ্ঠ কিছুটা দৃঢ় করে বললাম।
—–অযথা তর্ক করো না। সেল ফোনটা রাখো নিজের কাছে। ফেসবুক ও পেইজের কন্ডিশনটা তুমি চেক করো। তাহলেই বুঝবে এখানে আমার কোনো রকম সম্পৃক্ততা নেই। আসলে সকল সমাজেই কিছু কুলাঙ্গার আর চরিত্রহীন পুরুষ মানুষ থাকে। এদেরকে আল্লাহ শরীরে কিছু অঙ্গ প্রতঙ্গ দিয়েছে বলে তারা মনে করে এগুলো তাদের নোংরামি আর নষ্টামী করার জন্য দিয়েছে। তাই তারা মনের বিচিত্র সব অনুভূতির বাহানায় ভর করে। এই সকল অঙ্গ প্রতঙ্গের বিবিধ ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া শুরু করে। তারই একটা নমুনা এই ভিডিও কল। এটা নিশ্চয়ই কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয় রাশেদ।
—-তুমি কেন এই অভদ্রলোকদেরকে তোমার ফেসবুকে জায়গা দিয়েছ!
—-আরে ভাই! আমি কী বুঝতে পেরেছি বলো! এরা সবাই ভদ্রবেশধারী শিল্প সংস্কৃতির লোক। এদের অধিকাংশের ঘরে স্ত্রী আছে। আছে পুত্র কন্যা। কেউ কেউ তো খালু, দাদা ও বাবার বয়সি! মা মা বলে মেসেজ করে।
তুমি জানো না! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এই সমস্ত লুচ্চাদের মুখোশ আমিও খুলে দেই। এরা হলো রিপু বুঝলে রিপু! নিজেদের মনে আর ঘরে শান্তি নেই। নিজের স্ত্রীকে ভালো লাগে না। তাই আমাদের মতো নারীদের সংসারে অশান্তি লাগাতে আসে। নইলে কেউ এভাবে একজন বিবাহিত রমনীকে ভিডিও কল দেয়! এরা নাকি শিক্ষিত! এরা নাকি সংষ্কৃতিমনা! আজব!

আচ্ছা তুমি এক কাজ করো। আজকে থেকে সাতদিন একটু কষ্ট করে আমার ফেসবুকটা অপারেট করো প্লিজ রাশেদ। এটা আমার অনুরোধ।
—–আমার এতো সময় নাই। তোমাকে আমি বারবার বলতেছি তুমি ফেসবুক টেসবুক চালানো বন্ধ করো। তা তো কথা শুনবা না। তোমার এতো দরকার কী বেটাদের সাথে কথা বলার! ফেসবুকে এড করার!
—–এটা একটা ভালো কথা বলেছ। আসলেই আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। আমি এদেরকে মানুষ ভেবেছিলাম।তবে আমি খুব শীঘ্রই এই সকল লুচ্চা পুরুষগুলোকে আমার ওয়াল থেকে বিদায় করব। তবে খুব ভালো মানুষগুলোও তো আছে। সত্যিকারের শিল্পী ও গুণী সৎ পুরুষ মানুষ। কৈ তারা তো জীবনেও একবার বিরক্ত করে না! তবে আমি কিছু কিছু ভণ্ড গুণীদের আসল চেহারা উন্মুক্ত করবই।
—–কেন! তুমি কী দেশের প্রধানমন্ত্রী! পুলিশ অফিসার!
—না রাশেদ আমি একজন নাগরিক। সচেতন নাগরিক। তাই আমার কিছু দায়িত্ব আছে। আমি আমার সৃষ্টির মাধ্যমে এই নোংরা চরিত্রের পুরুষগুলোকে ছবক শেখাব।
—- নিজের ঘরে মনোযোগ দাও। এতো দেশ উদ্ধার করার কোনো দরকার নাই।
—-কেন রাশেদ! নিজের ঘরের কোন কাজটা অপূর্ণ রেখেছি বলো! আমি আমার অবসরে ছবি আঁকি।
আমার ছবির বিষয়বস্তুগুলো মানবিক শিক্ষা ও মনুষ্যত্বের বার্তা নিয়ে মানুষকে মানবিক হতে উজ্জীবিত করে।
—–হইছে তোমার প্যানর প্যানর রাখো।
—-আচ্ছা রাখছি। তবে তুমি আমার মোবাইল আমাকে সাতদিন পরে ফেরত দিবা। প্রয়োজনে আমি ফেসবুক বন্ধ করে দেব। কিন্তু সমাজের এই সকল নোংরারির চিকিৎসা করে তারপর।

তুমি কী জানো রাশেদ! অনেক পুরুষরা তার নিজের স্ত্রী, সন্তান ও নিজেদের মা বাবার খবর রাখে না। তারা খেলো কিনা! তাদের মন ভালো আছে কিনা! অথচ আমাদের মতো নারীদেরকে তারা প্রেম নিবেদন করে। এমন অরুচির পরিচয় দিয়ে রাত দুপুরে ভিডিও ও অডিও কল দেয়।গুড মর্নিং গুড নাইটের ঝড় তুলে। কী আজব!
বন্ধু হবে।প্রেম করবে! ভালোবেসে ফেলছে বলবে!
আরে ভাই বন্ধু কী মুখের কথায় হয়! প্রেম ভালোবাসা কী বিজ্ঞাপন দিয়ে হয়! আর সবকিছুর জন্য বয়স ও পরিস্থিতি একটা জরুরি বিষয়। একজন বিবাহিত নারীর সাথে কেন এতো প্রেম করতে হবে! কেন একজন বিবাহিত পুরুষ হয়ে এর ওর ইনবক্সে প্রেম নিবেদন করতে হবে! কেন অন্য এক অপরিচিত নারীর সঙ্গে নিজের সুখ দুঃখের গল্প করতে হবে! কেন রাশেদ! এরা এই মনোযোগ, এই প্রেম ও ভালোবাসা যদি নিজের স্ত্রী ও সন্তানদেরকে দিতো। তাহলে আমাদের সমাজ, সভ্যতা, সংস্কৃতি আরও মানবিক হতো। আরও আনন্দময় হতো। আমাদের আগামীর প্রজন্ম আরও মানুষ হতো। আচ্ছা রাশেদ কিছু কিছু পুরুষ মানুষের নিজের স্ত্রী রেখে অন্য নারীদের প্রতি এতো কেন আসক্তি বলতে পারো!

আমি খেয়াল করলাম রাশেদ একটু নড়েচড়ে বসল! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল।
—- এটা তো কিছু নারীরাও করে! শুধু পুরুষকে টানছ কেন!
—- হুম ঠিক বলেছ। আছে আমাদের মধ্যেই কিছু বিকৃত মননের নারীও আছে।তবে তা হাতে গোনা দু’চার জন। আর বেশির ভাগ ভিকটিম নারীরা এই ধরনের বিকৃত চরিত্রের পুরুষ দ্বারা প্ররোচিত। এই পুরুষরা নিজের নানারকম স্বার্থ হাসিলের জন্য নানান কূটকৌশল বুনতে থাকে নারীর মস্তিষ্কে। যার নাম দেয় তথাকথিত প্রেম, ভালোবাসা, বন্ধুতা। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের একাকিত্ব দূরে করতে পারে না। অথচ সূতা নাইলি সাপের মতো ঢুকে পড়ে বহু সহজ সরল বেহুলার অন্তর ধামে! আর এই সকল মন ও শরীর দেয়া নেয়ার ভয়ঙ্কর খেলায় বিদগ্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারীরাই বেশি।

তুমি টেনশন নিও না।
আমি আপাততঃ ফেসবুক বন্ধ করব না। তুমি এক সপ্তাহ অবজার্ভ করে আমাকে দাও। আমি খারাপ কিছু করছি না ভাই। ফেসবুক জগতকে খারাপ করছে কতিপয় বাজে মানুষ। তাদের জন্য আমি তুমি ভালো মানুষ কেন ভালো কাজ থেকে পালিয়ে যাব!
চলো এখন ঘুমাই। সকালে আবার মুনিয়া আর ইনতির স্কুল আছে।
—- ইলোরা! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি খুবই ভাগ্যবান একটা মানুষ। আমি তোমার মতো একজন স্ত্রী পেয়েছি। পেয়েছি আমার সন্তানদের একজন আদর্শ মা। জীবনে আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায়ও করেছি। ভুল মানুষেরই হয়। আমার মতো তুমি কোনো ভুল করো না ইলোরা। নাও তোমার মোবাইল। যা করো সাবধানে করো। নিজের আর আমাদের বিপদ ডেকে এনো না।
—-না রাশেদ তা হবে না। তাহলে এই এক সপ্তাহ তুমি তোমার মোবাইল থেকেও আমার আইডি লগ-ইন করে রাখবা। এটা আমি চাই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সবকিছুর স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে নাজুক সম্পর্ক এই স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক। তাই এই সম্পর্ককে বিশ্বাস, ভালোবাসা, সম্মান আর স্বচ্ছতার বিশেষ কেয়ারে রাখতে হয়।
চলো এখন ঘুমাই।

আমি ইলোরা স্বামীকে বড়ো করার জন্য নয়।স্বামীর কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য নয়। আমার নিজের আত্মসম্মান আরও ঋদ্ধ করার জন্য আমার স্বামীর হাতে সেলফোনটা তুলে দিয়েছিলাম।
আমাদের সমাজে কিছু ভাদাইম্মা পুরুষ আছে বিভিন্ন বয়সের। যাদের বয়সের কোনো নির্দিষ্টতা নেই। বিশ বাইশ থেকে শুরু করে আশি বছরেরও কিছু বিকৃত পুরুষ আছে। যারা কুকুরের মতো জিভে রসালো নারী খেকো লোভ নিয়ে রাস্তা ঘাট, স্কুল কলেজ, অফিস পাড়া, আত্মীয়তার সম্পর্ক, ফেসবুক সব যায়গায় ওৎ পেতে থাকে। এদের আসলে কোনো সত্যিকারের নৈতিকতা নেই নেই কোনো মনুষ্যত্ব। এরা নিজেদের বেহায়ামি দিয়ে নানান কৌশলে নারীদেরকে বিব্রত করে। কিছু কিছু নারী এদের ভুল প্রহসনে পা দিয়ে নিজের জীবন ধ্বংস করেও দেয়।
কিছু কিছু বিবাহিত নারীরা তাদের জীবনের একটা মস্ত বড়ো ভুল করে বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের সাথে বিবাহ বহির্ভূত প্রেম ও বন্ধুতা করে ফেলে।
আমার কাছে মনে হয় একজন বিবাহিত নারীর তো এতোটুকু জ্ঞান ও বিবেচনা রাখা প্রয়োজন যে, যেই স্বামীকে নিজের জীবন, যৌবন, সন্তান ক্যারিয়ার সব দিলাম সেই স্বামীই যখন পরিপূর্ণ আপন হলো না। আর বাইরে থেকে একজন দরদী পুরুষ এসে ফেসবুকে, অফিসে বা রাস্তায় পেয়ে গিয়ে আমাদের জীবনের পরিপূর্ণতা দেবে কীভাবে! এটা কেবলই একটা হাস্যকর ও পেইনফুল সিদ্ধান্ত ও সম্পর্ক। যার ফাঁদে পড়ে পুরুষ নয় নারীরা বেশি ভুক্তভোগী হয়। আমি এমন অনেককে দেখার ও জানার সুযোগ পেয়েছি আমার বাচ্চাদের স্কুল ও ফেসবুকের কল্যাণে।

আমার আর রাশেদের সম্পর্ক আগের চেয়ে সহজ যাচ্ছিল। আমি আমার সন্তানদের বড়ো হওয়ার সাথে সাথে কিছু স্পষ্ট উচ্চারণ করতে ও নিজের মতামত দিতে শিখে নিয়েছি। নিজের দৃঢ়তা আরও যেন বৃদ্ধি পেয়েছে সংসারে। এটা সময়, বয়স, নিজের ব্যক্তিত্ব নাকি পরিস্থিতি আমি ঠিক বলতে পারব না। রাশেদ হয়তো ভাবলো ইলোরা আর এমন কী করবে! বয়স হয়েছে। তাছাড়া বুদ্ধিমান ইলোরা। নাকি রাশেদ আমাকে নিয়ে অন্য কিছু ভেবেছে আমি ঠিক জানি না।

তবে আমার তো মনে হয়।একজন পুরুষের চাইতেও একজন নারীকে বেশি ধীর স্থীর প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী হতে হয় সংসার জীবনে। তাহলেই বদের হাড্ডি পুরুষদেরকেও মোটামুটি সুশীতলায় সাইজ করে রাখা যায়। আদিযুগের শোনা কথা নারীর নাকি ষোলোকলা জানতে হতো সংসার করার জন্য। আমি তো বলব এই উত্তর আধুনিক যুগে নারীকে তিন ষোলো আটচল্লিশ কলা নয় কৌশল জানতে হয় সংসারে সুশান্তি আনয়ন করতে।

আমি কিছুদিনের মধ্যেই আমার আইডি থেকে অনেক লুচ্চাদেরকে বিতারিত করলাম। বেশ ভালোভাবেই চলছিলো ঘর সংসার সন্তান সাথে ছবি আঁকা ফ্যাশন ডিজাইনিং, গ্রুপে গ্রুপে পোস্ট।
এরপর শুরু হলো আরেক উৎপাত। আসলে জীবন যেমন নানান রঙে রঙিন। ঠিক তেমনি জীবনের এই নানান রঙের মধ্যে নানান সময় ঢুকে পড়ে নানান বর্ণের প্যারা।
শুরু হয়ে গেল শিল্প সংস্কৃতির গ্রুপগুলো থেকে ইনবক্সে নক ও ফোন কল। বেশ মায়া মায়া আদুরে আবদার। আমাকে মডারেটর হতে হবে। আমাকে এডমিন হতে হবে। আমাকে উপদেষ্টা হতে হবে। আমিও তাদের চাইতে অধিকতর বিনয়ের সাথে নিজের ব্যস্ততা ও অনাগ্রহের কথা জানাতে থাকলাম। কেউ কেউ খুব সহজ করেই নিলেন আমার ইচ্ছেকে।কেউ কেউ আবার ভীষণ বিরক্তিটা উগ্রভাবেও প্রকাশ করলেন। আমি চমকে যেতে লাগলাম এই জগতের কিছু শিক্ষিত মানুষের আচরণে!

এরপর আবার শুরু হলো বিভিন্ন অনলাইন শিল্প গ্রুপ, অনলাইন রডিও চ্যানেল, অনলাইন টিভি চ্যানেল থেকে লাইভে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ। আমি বিনয়ের সাথে লাইভ করতেও অপারগতা জানালাম।এখানেও বিড়ম্বনা। কেউ বলে অহংকারী, কেউবা আমার অপারগতা মেনে নেয় সুন্দরভাবে, কেউ আমার অগোচরে ভয়ঙ্কর সমালোচনা করে আমার। আমি এদের মধ্যে থেকে কতিপয় গ্রুপ ক্রিয়েটর, এডমিনদের আচরণে বিস্মিত ও ব্যথিতও হতে থাকলাম।
কারও কারও বীভৎস আচরণে আমার হাসিও পায়।মনে হয় ডেকে বলি।
—আরে ভাই আমি লাইভ প্রোগ্রাম করলে তো আমার পরিচিতি বাড়বে। আমার লাভ হবে। আমার জনপ্রিয়তা বাড়বে। লাইভে না গিয়ে লস তো আমার হচ্ছে।তা আপনারা ক্ষেপেন কেন! আপনাদের সাফল্যে তো আর আমি ভাগ বসাচ্ছি না!
কিন্তু বলি না। চুপচাপ অনেককিছু দেখি, শুনি আর সহজ করে নেই ও নেয়ার চেষ্টা করি। মনে হয় আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। আমার সৃষ্টিও খুবই সাধারণ। আমি আরও পরিপক্ব হই।আরও সমৃদ্ধ হোক আমার কাজ।তারপর দেখা যাবে। আর তাছাড়া আমি তো এখনও লাইভের জন্য কমফোর্ট না। নিজের ভালোলাগা থেকে আঁকাআঁকি করি। সেখানে কেন আমি ভালোলাগার বিপরীতে যাব।আমার সৃষ্টি ভালো হলে সে তার যোগ্যতায় কথা বলবে। আমি নই।

সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আঘাতটা আসলো কিছু শিল্পীর কাছ থেকে আর কতিপয় গ্রুপ ক্রিয়েটরের কাছ থেকে। তা হলোঃ
প্রথমত কিছু শিল্পী নামের কলঙ্ক হয়ে আমার পেইজ ও আইডিতে যুক্ত হলো কতিপয় চোর। এরা কয়েকজন আমার ছবি, আমার করা ডিজাইনগুলো চুরি করে নিয়ে নিজেদের নামে চালাচ্ছে। আমাকে আমার প্রিয় ফলোয়ার ও ওয়েল উইশাররাই এসব চোরদেরকে ধরিয়ে দিচ্ছে। কিছু চোর ভুল স্বীকার করছে।কিছু আমাকে ব্লক দিয়ে আমার কিছু সৃষ্টি নিয়ে ভেগে যাচ্ছে। কিছু চোর আবার আমাকে হুমকি ধামকি দেয়ার পাশাপাশি আমার আইডিতে ও পোস্টে গ্রুপ করে করে রিপোর্ট মেরে পোস্ট উড়িয়ে দিচ্ছে। আমি মেনে ও মানিয়ে নিচ্ছি। আমি ধৈর্য ও সহনের সাথে আমার সৃষ্টিতে ডুবে থাকছি।
দ্বিতীয়ত কিছু শিল্পী কালাকার আমার সাফল্য ও সৃজনে জেলাস হয়ে আমাকে নানান রকম বুলিং এর অভিশাপে জর্জরিত করছে। আমি দেখছি আর চেষ্টা করছি এড়িয়ে যাবার। চেষ্টা করছি ক্ষমা দিয়ে তাদের মননের কিছু পরিবর্তন করার। কারও কারও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু আবারও যেই লাউ সেই কদুই হচ্ছে। কারণ লেজ বলে কথা!
তৃতীয়ত কিছু শিল্পী কালাকার বোন হয়ে আমার জীবনে আন্তরিক সম্পর্কে জড়িয়ে নিয়েছে আমাকে। আমিও নিয়েছি নিজের যতটুকু সাধ্য তার অনুপাতে আপন করে। বুকের কোটরে যায়গা দিয়েছি ভালোবেসে, আন্তরিকতায় ও বিশ্বাসে। নির্ভরতার আশ্রয় হয়েছি একে অপরের। কিছুদিন পরে আমার জন্য জান দিয়ে দেয়া বোন। আমার বুকে বসে বুকে ছুরি মেরে দিয়ে নিজের কিছু ফায়দা হাসিল করে গেল। কী বীভৎস বাস্তবতা! আমি দেখি, ভুগতে থাকি আর শিখি। শিখি এই জগত থেকেও। শিখি সাফল্যের সাথে কিছু দহন সত্য!
চতুর্থত আমাকে সম্মাননা দেয়ার মোটামুটি প্রতিযোগীতা শুরু হলো কিছু গ্রুপের মধ্যে। এই অনুষ্ঠানে আমাকে বিশেষ অতিথি করা হচ্ছে, ওই অনুষ্ঠানে আমাকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হবে। তমুক অনুষ্ঠানে আমাকে সম্মানের উত্তরীয় পরিয়ে দেয়া হবে। তমুক অনুষ্ঠানে আমাকে বিশেষ সম্মাননা ক্রেস্ট দেয়া হবে। আমি ভাবলাম এগুলো সব আমাকে সম্মান জানাচ্ছে বা জানাতে চাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। আমি বিনয়ের সাথে তাদেরকে জানাতে থাকলাম। আমি কোথাও যেতে পারব না। আমাকে এখনও আমি যোগ্য মনে করছি না।ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে যাব। আপাতত ক্ষমা চাচ্ছি। কোথাও কোথাও নাছোড়বান্দা ক্রিয়েটর। আপু আসুন আসুন।আসতেই হবে ইত্যাদি। চেষ্টা করলে অবশ্যই পারবেন। আমাকে তখন বলতে হচ্ছে চেষ্টা করব। পারলে আসব না পারলে দুঃখিত।

অনেক সম্মানিত গ্রুপের ক্রিয়েটর ও এডমিনরা খুব সুন্দর ভাবে আমার সিদ্ধান্ত সম্মানের সাথে মেনে নিলেন। মনটা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গেলো। কিন্তু কতিপয় ক্রিয়েটর আমার জাত গুষ্টি শিক্ষা ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে আমাকে যা তা অপমান করতে ছাড়ল না। আমার সামনাসামনি ও আমার অগোচরে তাদের কুট কথা, কুটচালে এবং তাদের মতো গৌরবময় উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ বংশীয় বলে প্রচার করা কিছু ব্যক্তিদের জেলাসি, আচরণ, ভাষা ও অপমানে আমি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে লাগলাম। হতে লাগলাম শঙ্কিত! হায় এ কোন জগতে আমি এসে পড়লাম! এ তো দেখছি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের চর্চা হচ্ছে মিষ্টি মুখের আড়ালে!

আমার মানসিক অবস্থায় খুবই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে লাগল। শুরু হলো আমার আরও একটা ভয়ানক মানসিক ও সম্মানের যুদ্ধ। আমি এই সকল বীভৎস কিছু বিকৃত রুচির মানুষের এই শিল্প সংস্কৃতি অঙ্গনে পদচারণা দেখে এবং নিজে ভুক্তভোগী হয়ে একরকম আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম।নিজে নিজে নিজের মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম।নাহ্ আর না। আমি এখানে আর থাকব না। এমন জগত আমার জন্য না। এমন নোংরা প্রতিযোগীতায় আমি টিকতে পারব না।

আর তাছাড়া এটা আমার ঘর সংসার নয় স্বামী ও শ্বশুর বাড়ি নয়। যেখানে শত কম্প্রোমাইজ করে রহনে সহনে নিজেকে টিকিয়ে নিয়েছি। কিন্তু এখানে কেন ওভাবে নিজেকে টেকাবো!
এখানেও দেখতে পাচ্ছি শিক্ষিত স্যোসায়িটির নামে কত কত ভণ্ডামী।কত কত নোংরামি। কত কত মানসিক বিকৃতি ও প্রহসন! একটা শিল্প সংস্কৃতির অনলাইন গ্রুপ ক্রিয়েট করে, একটা অনলাইন টিভি বা রেডিও চ্যানেল খুলে। তার একজন ক্রিয়েটর হয়ে এডমিন হয়ে তিনি মনে করছেন যে তিনি একটা সাম্রাজ্যের মালিক হয়ে গেছেন! কেউ কেউ এটা করছেন! আর সবাইকে তার এম্পায়ারের চামচা বা অধিনস্ত মনে করছেন। কেউ কেউ তো তার গ্রুপের এডমিন, মডারেটরদেরকেও নিজের হুকুম তামিলের গোলাম ও কর্মচারি ভাবতে শুরু করেছে। আরে ভাই আপনি কী তাদেরকে বেতন দিচ্ছেন! তা তো দিচ্ছেন না। উল্টো বিভিন্ন উছিলায় এই সকল এডমিন, মডারেটর ও সদস্যদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আপনারা কতিপয় আপনাদের এই তথাকথিত সাম্রাজ্য চালাচ্ছেন। সবাই তো আপনাদের মতো করছে না। আরও তো অনেক গ্রুপ আছে কত মার্জিত আর সৃজনশীল! তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু শেখেন। তা নয়। চলছে এক বীভৎস খেল!

মনে হচ্ছিল কোথায় যাবে মানুষ! কোথায় আমাদের সুশীল সমাজ! কোথায় সত্যিকারের সংষ্কৃতি! কোথায় সুসভ্যতা! এতোদিন নিজের জীবনের ও স্বপ্নের শত্রু ও প্রতিপক্ষ মনে করেছিলাম বাবাকে, স্বামীকে, শ্বশুর বাড়ির লোকজনকে! ভেবেছিলাম তারা কম শিক্ষিত। তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারা গোড়া!
কিন্তু আজ আমি এই শিক্ষিত ও সুসভ্য পরিচয় দেয়া মানুষের এ কী রূপ দেখছি। এরা তো আসলে কাগজে পত্রে সার্টিফিকেটে শিক্ষিত হয়েছে। কিন্তু কার্যত ডুবে আছে আদিম সভ্যতায়।সেখানে শকুনির মতো শান্তির শরীরে বিষাক্ত নখ বসিয়ে শুষে নেয় প্রশান্তি আর আত্মসম্মান। তাহলে কোথায় মুক্তি! কোথায় যাবে মানুষ! কবে কখন কীভাবে আমরা সত্যিকারের মানুষ হবো!

রাশেদকে নিজের এই অসহনীয় পীড়নের কিছুই বলতে পারি না। আপন অন্তরের দহন পীড়ন সয়ে সয়ে আমি আবারও উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছি।ইফতি ওর মেডিকেলের হস্টেল থেকে কয়েকদিনের জন্য বাসায় এলো। আমার কাছে সব শুনল। এবার আমাকে বুঝতে লাগল।
—–মা তুমি তো অনেক স্ট্রং লেডি। তুমিই তো আমার প্রেরণা। আমাদের সাহস।আর সত্য। তুমি এভাবে হেরে গেলে তো হবে না মা। তুমি তোমার এই দহনকে আরও শক্তিতে পরিনত করো। তুমি পারবে মা।আর তুমিই জিতবে।

—–কিন্তু বাবা ওরা তো ভীষণ নোংরা। আমার তো সব বাদ দিয়ে তোদের নিয়েই শান্তিতে থাকতে ইচ্ছে করছে।
—–শান্তিতেই থাকবা মা। আমরা তো তোমার জন্য শান্তির দূত হে মাতামহী আমার! হা হা হা আমার কলিজা মা।
দেখি দেখি এটা কী ডিজাইন করেছ মা! একদম অন্যরকম!দারুণ তো!
—– এটা একটা পোশাকের ডিজাইন বাবা।
—–সে আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু একটু আলাদা ধরনের। আবার ডিজাইনের নামটাও খুব সুন্দর।
—- হুম “সহজিয়া পরিধেয় “। নাম ও ডিজাইনটা আমারও খুব ভালো লেগেছে। এই পোশাকের ডিজাইনটা আমি করেছি বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের জন্য। সব বয়সের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নারী, পুরুষ, শিশু এবং বৃদ্ধরা এই পোশাক সহজে পরিধান করতে ও খুলতে পারবে আর খুব আরামদায়কও হবে।
—–ওয়াও মা তুমি গ্রেট! তুমি তো একটা বিশাল কিছু সৃষ্টি করে ফেলেছ মা। আমি সত্যি তোমাকে নিয়ে প্রাউড। দেখবা পুরোটা পৃথিবী একদিন তোমাকে নিয়ে প্রাউড হবে ইনশাআল্লাহ। ডিজাইনটা তুমি পোস্ট করেছ মা!
—–না বাবা। কিছু মানুষ আর কিছু গ্রুপের মানসিক অত্যাচারে আমি অতিষ্ট আছি।তাই পোস্ট করিনি। ভাবছি আর পোস্ট করবই না।
—-মা তুমি না মাঝে মাঝে খুবই বাচ্চা হয়ে যাও। বিড়ালের কারণে মাটিতে ভাত কাবে! হলো কিছু! এসব তো তুমিই আমাকে শিখিয়েছ মা।
কৈ দেখি তোমার ফোনটা দাও তো মা। আমি পোস্ট দিচ্ছি। ছবিটা আমি বিভিন্ন খবরের কাগজের মেইলেও পাঠাচ্ছি। সবাই জানুক, দেখুক আর তোমার আইডিয়াটা কাজে লাগিয়ে মানুষের উপকার হোক।

এভাবেই শুরু হয়েছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সাফল্য “সহজিয়া পরিধেয় ” নামের ডিজাইনটির জন্য প্রেসিডেন্ট পদক পাবার সূচনা লগ্ন। এই বছরের নারী দিবস উপলক্ষ্যে আমি ইলোরা রাশেদকে রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত করতে যাচ্ছেন সরকার। ঘোষণাটা অলরেডি পাবলিস্ট হয়ে গেছে। তবে ঘোষণাটা আসার পরই আমার ফেসবুকের ওয়াল থেকে আমার ছবি কালেক্ট করে করে আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে নিউজ হচ্ছে। সাথে আমার হিজাব পরা ছবিও ছাপা হচ্ছে। এই ডিজাইনটা পোস্ট দিয়ে ও মেইল করে আমার বড়ো ছেলের ফোন নাম্বারটা দেয়িছিলো পত্রিকার মেইলে। ইফতি এখন আবারও হস্টেলে চলে গেছে। মেডিকেলের পড়া বলে কথা। তবুও সবাই ছেলের সাথেই যোগাযোগ করছে। কিছু টিভি চ্যানেলও নিউজ করছে আমার সম্মাননা পদকের বিষয়টি নিয়ে।
“ঘরের চারদেয়ালে বসবাস করে পৃথিবী জয় করলেন গৃহবঁধু ফ্যাশন ডিজাইনার ইলোরা রাশেদ”। এরকম সংবাদ শিরোনামে ছেয়ে গেছে চারিদিক। আমার স্বামী ও শ্বশুর বাড়িতেও পৌঁছে গেছে নিউজটা।

আমার ছেলে মেয়ে ভীষণ খুশি আমাকে নিয়ে। আজ বাবা মা বেঁচে নেই। তারা বেঁচে থাকলে হয়তো তারাও খুব খুশি হতেন। শেষবার আমার বাসা থেকে যাওয়ার পর এক বছরের মধ্যেই দু’জন মারা গেলেন। আব্বা স্ট্রোক করে মারা যাবার চার মাসের মাথায় মা চলে গেলেন। আমার জন্য খুব করে খুশি হওয়ার মতো বাকি রইলো আমার সন্তানরা। আমিও ভীষণ খুশি ছিলাম। অথচ আমার সব খুশি ধূলিসাৎ করে দিলো কিছু মানুষ। ধূলিসাৎ করে দিলো ধর্মীয় কিছু গোঁড়ামি ও তথাকথিত সামাজিক সম্মান! ধূলিসাৎ করে দিলো কিছু আত্মীয় স্বজনরা, আমার হাসবেন্ডের কিছু বন্ধুরা ও আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি।

এমন একটা সাফল্য ও আনন্দের সংবাদে কোথায় আমি ইলোরা আমার স্বামী ও শ্বশুর বাড়িতে সম্মানিত হবো! তা নয়।হলাম নিগৃহীত। আমার প্রিয় স্বামী রাশেদ এই বিকেল বেলা হঠাৎ করে অফিস থেকে রাগান্বিত হয়ে এসে আজকে আমার গায়ে হাত তুলল। স্বামীর হাতের মাইর খাওয়া থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জীবনে কত কী কত সময় মুখ বুজে সহ্য করেছি। সেই মাইরটা আমাকে খেতে হলো আজ এই বয়সে! তাও আবার জীবনের এতো বড়ো একটা সাফল্য পাওয়ার কারণে!
কেমন করে রাশেদ পারলো আমাকে মারতে !একবারও ওর বিবেক ওকে বাঁধা দিলো না! মুখেও তো বলতে পারত! না হয় আগের মতো কিছু কটুকথা শোনাতো। কিন্তু স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা! এটা কতটা অসম্মানের তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে।

আমি তো এমনিতেই কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাই না। আমার নিজেরই তো যেতে ভালো লাগে না এরকম কোনো কিছুতে! আমি এখানেও না হয় না যেতাম। আমার ছেলে পদকটা কালেক্ট করত। না হয় পরবর্তীতে আমার ঠিকানায় পৌঁছে দিতেন তারা। না দিলে ওনাদের কাছেই থাকত। কী হতো পদক নিতে না গেলে! আমাকে কী সরকার জেল দিতো! ফাঁসি দিতো! তা তো দিতো না। তাহলে!

যেই হাতে আমি ডিজাইন করেছি আমার সেই হাত মুচড়ে ভেঙে দিতে চাইল রাশেদ! আমার চুলের মুঠি ধরে আমাকে সজোরে থাপ্পড় দিলো আমার নয় বছরের মেয়ে মুনিয়ার চোখের সামনে! আমার মৃত বাবা-মাকে নিয়ে পর্যন্ত নোংরা ভাষায় গালাগালি করল আমার স্বামী। একটা সামান্য কারণে!

কেন!
এটা কী পুরুষতান্ত্রিকতার নিষ্পেষণ! নাকি ইগো! নাকি তার বাবা-মাকে খুশি করা! সামান্য একটা হিজাব পরা ছবি পত্রিকা ও টিভিতে প্রকাশ পাওয়ায় কী করে হাজি বাড়ির সম্মান চলে গেল! কেন আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এমন ভাবে ক্ষেপিয়ে দিলেন আমার স্বামীকে আমার বিরুদ্ধে! এখানে কী আসলেই ধর্মের কঠিন বিধিনিষেধ! নাকি তাদেরকে পেছনে ফেলে আমার সামনে এগিয়ে যাওয়া!

আমাকে আমার জীবন নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। আমার সন্তানদের সাথে কথা বলতে হবে। আর না! আমি নারী বলে সব পাপ আমার ঘড়ায় তুলে দেবে পুরুষ, সমাজ ও ধর্ম! আর তুমি তোমরা পুরুষ বলে সব জায়েজ! তুমি পুরুষ যতদিন নারীদেরকে প্রতিপক্ষ ভাববে। যতদিন তোমরা নারীদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে না পারবা। যতদিন নারীদেরকে মানুষ না ভাববা। দহন, পীড়ন ও প্রহসন করবা।ততদিন অধিকাংশ নারীরাও তোমাদেরকে করুণা করে যাবে। তোমাদের জন্য নিজেদের অন্তরধামে ভয়ানক ঘৃণা পুষে রেখে তোমার সবচেয়ে নিকটতম নারী তোমার ঠোঁটে, গালে করুণার চুমু খাবে। এটাই তোমাদের জন্য এক অভিশপ্ত শাস্তি হে বিকৃত, নরপশু পুরুষ যারা।
আর শুনে রাখো হে নষ্ট পুরুষ! ভবিষ্যতে তুমি নারীর গায়ে হাত তুললে নারীও তোমার গায়ে হাত তুলবে। তুমি থাপ্পর দিলে পায়ের সেন্ডেল তুলে তোমার গালে মারবে। তুমি থাপ্পড় দিলে তোমাকে বটি দা দিয়ে কুপিয়ে জখম করবে।সেই দিন হয়তো বেশি দূরে নাই। সুতরাং সাধু সাবধান! বহুত হয়েছে। এবার থামো।

আমি রাশেদের সামনে থেকে আমার মেয়ে মুনিয়াকে নিয়ে আলাদা রুমে চলে এলাম।রুমের দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে আমার ছেলে ইফতিকে কল দিলাম।

—-হ্যালো মা। আবারও তোমাকে কনগ্রাচুলেশনস মা। কী হলো মা তুমি চুপ কেন! মা কী হলো!
আমি নিজেকে মোটামুটি সামলে নিয়ে আমার ছেলেকে বললাম…….

(চলবে।
পরবর্তী পর্বে আসছে ঘাসেদের ফাগুন উপন্যাসের শেষ পর্ব ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here