ঘাসেদের ফাগুন শেষ পর্ব (২২)
___________🖌️নাজনীন নাহার
১২.০৪.২০২২
আমার ছেলে ইফতিকে ফোন কল দিয়ে যতটুকু পারলাম আমার ও আমার স্বামী রাশেদের বর্তমান অবস্থাটা বুঝিয়ে বললাম। ইফতি তার বাবা আর দাদার উপর ভয়ঙ্কর ক্ষেপে গেল। এদিকে আমার বুকের মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আমার ছোট্ট মেয়ে মুনিয়া। আমারও মানসিক অবস্থা ভীষণ খারাপ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আর আমি এই সংসারে থাকব না।
তারপরও আমি ইফতিকে শান্ত করে বললাম।
—-এখন বিকেল। তুমি নিজে একটা দিনের জন্য একটু চলে আসো বাসায়। আর তোমার দাদা দাদিকেও জরুরি ভিত্তিতে ঢাকায় রওয়ানা দিতে বলো।
—- কেন মা! তারা কেন আসবে! আমি আসছি তো। আমি এসে বাবাকে…
—তারাও আসবে বাবা। সবাই পরিবারের লোকজন এরা। পরিবারের প্রত্যেক জনের আচরণ আমাদের এক একটা পরিবারের সকলের জীবনে প্রভাব ফেলে। তাই তাদেরকেও উপস্থিত থাকা দরকার। আর তোমার বাবা আজকে আমার সাথে যা করেছে তার পেছনে তাদেরও ভুমিকা আছে।
—–মা তুমি কেনো এতো এতো কিছু চিন্তা করে চলো বলো তো!
—- চিন্তা করতে হয় বাবা। সবাই যদি আমরা অস্থির হই। তাহলে তো কেবলই বিশৃঙ্খলতা হবে পৃথিবীতে। আমি আমার জীবনে এতোটা চিন্তা করে চলেছি বলেই। আজকে তুমি, ইনতি ও মুনিয়া এমন একটা পজিশনে আছো আলহামদুলিল্লাহ।
—–মা তুমি এতো ভালো কেন! কেন মা! তুমি জানো না বেশি ভালো মানুষকে সবাই ডলে পিষে ফেলতে চায় ঘাসের মতো।
—-হ্যাঁ বাবা ডলে পিষে ফেলতে চায় এবং ফেলেও।এটা ঠিক বলেছ। এই নিষ্পেষণের বিষয়টি তো আসলে একদিনে তৈরি হয়নি। এটা হাজার হাজার কোটি কোটি কোটি বছরের সংষ্কার ও সমাজ। যারা পবিত্র ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যাবহার করে নিয়েছে। যারা ক্ষমতাকে অপব্যবহার করেছে। আর জাতির মগজে বুনে গেছে নারী ও দুর্বলদের জন্য অভিশপ্ত জীবন।
—মা আমি তা হতে দেব না। তুমিও দিও না মা।
—- দেবো না বাবা। আমি তোমাদের আদর্শ মা হবো বলেই আমাকে ইলেরা হয়ে বাঁচতে হবে। ইলোরা নামের অর্থ কী জানো! যে নারী সৃষ্টিকর্তাকে নিজের জীবনের পথ প্রদর্শক হিসেবে মনে করে। আমি সেই সৃষ্টিকর্তার প্রদর্শিত পথের পরিব্রাজক। আমার বিজয় সৃষ্টিকর্তার বিশেষ রহমতেই লিপিবদ্ধ হবে ইনশাআল্লাহ।
—-মা তোমার এই আত্মবিশ্বাসটাই তোমার ও আমার সবচেয়ে বড়ো শক্তি। বাবা কেন এমন বদলে যায় হঠাৎ হঠাৎ! বাবা কেন তোমাকে আঘাত করে আনন্দ পায়! আমি এবার বাবাকে ছাড়ব না মা।
——তুমি এক কাজ করে। এখনই তোমার বাবাকে কল দিয়ে বলো। সে যা করেছ করেছ। আর একটা শব্দ বা ঔদ্ধত্য যেন তার দ্বারা এই বাসায় না হয়। বলে দাও তোমার মায়ের সাথে হওয়া আর কোনো অন্যায় তুমি মেনে নেবে না । আর তোমার দাদাকে ফোন দিয়ে বলো এখনই জরুরি রওয়ানা দিতে। আর রওয়ানা না দিতে চাইলে বলো। আপনাদের কারণে আমার মা ও আমরা আপনাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। আর তুমিও এখনই বেরিয়ে পড়ো।
—- মা আমি অলরেডি বাবাকে মেসেজ করে দিয়েছি।
—কী লিখেছ তুমি!
—-ওটা আমাদের বাপ ছেলের বোঝাপড়া। সে আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছে মা। তাকে এর শাস্তি ভুগতেই হবে।
—- ইফতি প্লিজ বাবা ঠাণ্ডা মথায় আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। জীবন আমাদের। আমার একটা জীবনের সাথে তোমরা তিনটি ভাই বোনের জীবন ও ভবিষ্যত জড়িত। আর আমি সরি বাবা আমার জন্য তোমাদেরকে এতোগুলা পেইন নিতে হচ্ছে।
—-মা এসব তুমি কী বলছ! আমি বরং তোমার কাছে সরি।তোমার কাছে লজ্জিত মা। আমার বাবা তোমাকে অপমান করছে।
তুমি কী জানো মা! তোমার মতো একজন ভালো মানুষ মায়ের কারণেই আমি আজ এখানে। তোমার মতো মা আমার বাবার জীবনে পেলেও বাবা সত্যিকারের মানুষ হতেন। আমি তো মনে করি তোমার মতো একজন করে মা প্রতিটি ঘরে থাকলে। আমাদের আগামীর প্রজন্ম অনেক উন্নত বোধ ও জীবন পেতো মা।
শোনো মা! আমি এখন রাখছি। তুমি সাবধানে থাকো। আর দরজা খুলে বের হও। বাবা আর কোনো সাউন্ড করবে বলে আমি মনে করছি না।তুমি ফ্রেশ হও। আর কিছু খেয়ে নাও মা। আমি আসছি।
আমার বুকের মধ্যে একটা দূরন্ত সাহস দৌড়াতে লাগল। খুব ইচ্ছে হলো আমি এখনই দরজাটা খুলে গিয়ে রাশেদের গালে নিজের সবটুকু শক্তি একাত্ম করে একটা চড় দিয়ে আসি। খামচে ধরি রাশেদের ছোটো ছোটো চুলের মাথাটা। কেন যেন খুব অস্থির লাগছিল।
আমার বাবা আর মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল। শেষ বয়সে আমাকে এতোটা সাপোর্ট দিয়েও তারা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এই যে আমি এখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। আমি রাশেদকে ছেড়ে চলে যাব। কিন্তু কোথায় যাব! ভাইদের সংসারে! ভাবিদের সংসারে! আমার ছেলেমেয়ের কী হবে! ওদেরকে নিয়ে যাব। নিয়ে গেলে ওদের লেখাপড়া! ওদের ভবিষ্যত! আমি তো চাই না আমার মতো হোক আমার সন্তানদের জীবন। আমি চাই ওরা যেন আমার মতো স্বপ্ন না হারায়।
তাহলে!
তাহলে কি আমাকে আবারও কম্প্রোমাইজ করে এই রাশেদের সংসারেই থাকতে হবে! কিন্তু আমি যে তা চাই না। কেন আমাদের চাওয়াগুলোর সাথে জীবনের এতো কিছু জড়িত থাকে ডালপালার মতো! একটা জীবন কেন আমাদের নিজের করে নিজের মতো হয় না! কেন জন্মের পর থেকে একটা জীবন টুকরো টুকরো করে এর, ওর, তার, সম্মানের, সমাজের ও পরিস্থিতির হয়ে যায়! কেন হয়!
কিন্তু রাশেদকে তো ছাড়া যাবে না। রাশেদকে যে শাস্তি পেতেই হবে।
আসরের নামাজ পড়ে রুমের দরজা খুলতে যেতেই মেয়ে মুনিয়া চিৎকার করে উঠল।
———-মাম্মা দরজা খুলো না। বাবা মারবে।
—- আমি দরজার থেকে ছুটে গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর আবারও মা মেয়ে নিজের ঘরে ঘরবন্দি হয়ে রইলাম। মাগরিবের আজানের কিছুক্ষণ পূর্বে ছোট ছেলে ইনতি কোচিং থেকে ফিরল। ফিরেই আমার বন্ধ ঘরের দরজায় নক করল। মা দরজা খুলো। ক্ষুধা লেগেছে তো। নাস্তা দাও।
মুনিয়াকে তার ভাইয়ার অভয় দিয়ে দরজা খুললাম।
মনে পড়লো আজকে যে ছেলে মেয়ের জন্য বিকেলের নাস্তা রেডি করা হয়নি।
ছেলেকে বললাম ফ্রেশ হয়ে আসো। দ্রুত হাতে ছেলে মেয়ের জন্য নুডলস করে দিয়ে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। সারা ঘরে কোনো শব্দ নেই। সহকারী মেয়েটা দুপুরের পরে ঘুমাচ্ছিল। সে রাশেদের অত্যাচার দেখেনি। তাই ওকেও আমি রাশেদের কথা জিজ্ঞেস করলাম না। মনে হলো রাশেদ বাইরে চলে গেছে।
সময় যেন কাটছিলো না।
বড়ো ছেলে এসে পৌঁছাবে রাতে। শ্বশুর শ্বাশুড়িও আসছেন।
বাসার সহকারী মেয়েটাকে নিয়ে বাড়তি কিছু রান্না করলাম। খুব মানসিক ক্লান্তি লাগছিল। তবুও বাড়ির খাবার রেডি করার দায়িত্বটা যে আমার। তাই অপমান আর দহনের দগদগে ক্ষত নিয়েই সবকিছু করলাম। ফেসবুকে অনেক নোটিফিকেশন এসেছে। এসেছে অভিনন্দন মেসেজ। আগামীকাল সন্ধ্যা সাতটায় রাষ্ট্রপতি পদকের অনুষ্ঠান। আমার জন্য একটা অনেক বড়ো সাফল্যের দিন। অথচ আমি এই সাফল্যের কারণে অত্যাচারিত হয়ে কেমন অনুভূতি শূন্য এখন!
রাত এগারোটায় ইফতি বাসায় এসে পৌঁছাল। ফ্রেশ হয়ে আমাকে নিয়ে খাবার খেয়ে ওর রুমের দরজা বন্ধ করে আমাকে আর দুই ভাই বোনকে নিয়ে বসল। ইনতিকে ইফতিই সব জানাল। এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করল।
—-মা তুমি বলো তুমি নিজে কী চাও?
—-আমি আর তোমাদের বাবার সাথে থাকব না। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
—গুড মা।পারফেক্ট ডিসিশন। ইনতি তুমি কী বলো! বাবার এই সকল আচরণের পড়ে মায়ের কী করা উচিত!
—-মা যা করবে আমি মায়ের সাথে আছি। কারণ বাবা এটা কোনো মানুষের কাজ করেনি।
—-তুমি কী মায়ের সাথে যাবা? নাকি বাবার সাথে?
— যাবো মানে! মা ও আমরা এখানেই থাকব। বাবা চলে যাবে। কারণ আমরা এমন বাবাকে চাই না। আমরা সবাই বাবার সাথে থাকব না ভাইয়া। মুনিয়া তুমি কী বলো!
মুনিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। আমি ও ইফতিও তাকিয়ে থাকি ইনতির দিকে। ইনতিটা ছাত্র হিসেবে বড়ো ভাইয়ের মতো হলেও। স্বভাবে আমার বা ইফতির মতো শান্ত হয়নি। একটু সোজাসাপটা কথা ও চিন্তা তার। ইনতির চিন্তা ভাবনা হলো। কেউ আমাকে একটা ধাক্কা দিলে। আমিও আগে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে নেব। তারপর দেখব সে কে বা কী!
আমি আমার তিনটি সন্তানকে দেখি আর নতুন করে জীবন শিখি। আমি আসলে সব রকমের মানুষের আচরণ দেখে দেখে জীবন চিনেছি।এখনও চিনছি। কত কী দেখলাম এইটুকু জীবনে! কত কী শিখলাম নিত্যদিন।
রাশেদ বাসায় আসল রাত দেড়টায় আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে সাথে নিয়ে। ইফতি তাদেরকে বলে দিয়েছিলো গাড়ি ছাড়ার পরে যেন তারা রাশেদকে কল দিয়ে বলে স্টেশন থেকে তাদেরকে তুলে আনতে। ইফতি তাদেরকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলল এবং নিজ দায়িত্বে তাদেরকে খাবার বেড়ে খাওয়ালো। আমি সামনে যাইনি। ইফতি আমাকে নিষেধ করেছে।
খাওয়ার পরে আমাদের বেডরুমে ইফতি সবাইকে ডেকে নিলো। আমাকেও নিয়ে বসাল। এবার বলতে শুরু করল।
—- মা, দাদা, দাদি বাবা তোমরা এখানে সবাই আমার বড়ো। এখানে আমার ছোটো ইনতি ও মুনিয়াও আছে। আচ্ছা দাদাভাই, দাদুমনি তোমরা বলো তো এমন কী ঘটেছে বা হয়েছে! যেই কারণে তোমরা দু’জন মুরব্বি মানুষ আজকে বাবার কাছে আমার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলা?
রাশেদ ইফতিকে ধমকের সুরে বলল।
—-এসব তুমি কী শুরু করেছ ইফতি! মুরব্বিদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় তা কী তুমি শিখো নাই!
—- বাবা আমি যা শিখেছি মুরব্বিদের কাছ থেকেই শিখেছি। তুমি কার কাছে শিখেছ বাবা?
—-বেয়াদব ছেলে! তোমার মায়ের কারণে এমন বেয়াদব হয়েছ।
—- বাবা তুমি ভুল করছ। আমি শুধুমাত্র আমার মায়ের ভালোবাসা, শিক্ষা, ধৈর্য ও সহনশীলতার কারণেই আজকেও তোমাদের সামনে একজন মানুষের আচরণ করছি। কারণ আমি এতোটুকু ভালো ও সফল মানুষ হয়েছি শুধুমাত্র আমার মায়ের কারণে।
—-তোমার মা তোমাকে আমাদের সাথে বেয়াদবি করতে শিখিয়েছে।
——বাবা তোমার মনে আছে! আমি যখন যখন ভালো রেজাল্ট করে বাসায় ফিরতাম তখন তুমি আমার ভালো রেজাল্ট ও ভালো সব কাজের ক্রেডিট তোমার বংশের গৌরব বলে প্রচার করতা। তাহলে আমার খারাপ দিকটার দায় কেন আমার মা’কে দিচ্ছ!
—-দেখেন আব্বা! কী বেয়াদব হয়েছে ইফতি!
–না বাবা! দাদাভাই যদি দেখে তাহলে আগে তোমাকে দেখুক। কারণ তারা বাবা-মা হিসেবে ব্যর্থ হয়েছে। কিংবা তুমি সন্তান হিসেবে। কারণ তাদের ছেলে তুমি মানুষ হওনি।হয়েছ পুরোপুরি একজন অমানুষ!
এমনসময় রাশেদ ইফতিকে মারার জন্য এগিয়ে গেলে আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াই। রাশেদের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম।
—–খবরদার রাশেদ! আমার ছেলের গায়ে হাত তুলবে না। ইফতি কিছুই অন্যায় বলেনি। তোমার আসলে লজ্জা বলে কিছুই নেই। তাই তুমি যা খুশি তাই করে যাচ্ছ।
রাশেদ রাগে গজগজ করতে লাগল।
ইফতি তখন আমার শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বলল।
—-হ্যাঁ দাদাভাই বলেন তো! কেনো আমার মায়ের নামে অভিযোগ করলেন বাবাকে?
আমার শ্বশুর বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন।
—-কেন তুমি জানো না! তোমার মা হাজি বাড়ির বউ হয়ে কী করেছে! আজকে তার ছবি টিভিতে, পেপারে! কেন! আমাদের বংশের তো আর কোনো মান ইজ্জত থাকল না!
—-আপনাদের মান ইজ্জত এতো হালকা কেন দাদাভাই! আমার মা আপনাদের হালকা মান ইজ্জত আরও শক্ত করেছে তা কী আপনারা জানেন!
আমার মা কী করেছে জানেন! প্রতিবন্ধী মানুষদের জন্য খুব সহজে পরতে পারে এমন কিছু জামাকাপড়ের ডিজাইন মানে ছবি এঁকেছে। আরও কী হয়েছে জানেন আপনাদের হাজি বাড়ির বউকে সরকারের পক্ষ থেকে এই অসাধারণ কাজের জন্য সম্মান দিয়েছে। আর ওই সম্মানের খবরটা মায়ের নাম নিয়ে প্রচার করছে সব মিডিয়া। আমার মায়ের মাথায় তো হিজাব বাঁধা আছে দাদাভাই। তাহলে বলেন এটাতে ইজ্জত গেলো কীভাবে! এটাতে তো আপনাদের ও আমাদের ইজ্জত আরও বাড়লো!
সবাই চুপ! ইফতি আবারও বলতে লাগল।
—আপনারা এমন একটা সম্মান ও খুশির খবরটা পেয়ে আমার বাবাকে মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে উস্কে দিলেন।
আপনাদের অভিযোগ শুনে আমার বাপ পুরোপুরি অমানুষ হয়ে গিয়ে আমার মা’কে মারধর করল। মায়ের হাত ভেঙে দিতে গিয়ে মুচড়ে দিয়েছে। দেখেন মায়ের হাত কতটা ফুলে গেছে। আমার বাবা আমার মায়ের চুলের মুঠি ধরে আমার মা’কে থাপ্পড় মেরেছে।
এবার আপনি বলেন দাদাভাই! অসম্মানের কাজটা কে করেছে! আমার মা! নাকি আপনাদের ছেলে!
—-ইফতি তুমি অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করছ! তুমি আমার বাবাকে অপমান করছ।
কথাটা ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল রাশেদ।সাথে সাথে ইফতি জবাব দিল।
—-অপমান এখনও করিনি বাবা। আমি যদি তোমার মায়ের গায়ে হাত তুলি! তাহলে তোমার কেমন লাগবে বাবা! তোমার যেমন লাগবে আমারও ঠিক তেমনই লেগেছে আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছ বলে। তুমি মানুষ হওনি বাবা। আমি তোমাকে আর বাবা হিসেবে চাই না।
–কী চাও! ফাজলামো করতে এসেছ! আমারটা খেয়ে আমারটা পরে আবার বড়ো বড়ো কথা!
—–আমি আমার অধিকার খাই বাবা। দাদাভাই আপনি বলেন! সন্তানকে খাইয়ে পরিয়ে যে বাবা খোঁটা দেয় ও এভাবে অধিনস্ত করে রাখে। সেই বাবার জন্য আল্লাহ কী বিধান রেখেছে! আর এটা কী আল্লাহ পছন্দ করেন!
ইসলামের এই বিধানগুলো আমার বাবাকে সঠিকভাবে শেখাননি বলেই বাবা আমাদেরকে ও মা’কে নিজের অধিনস্ত মনে করে সবসময়। মা’কে যখন তখন ছোটো করে।
বাবা তোমাকে বলছি শোনো।
আমার বা মায়ের তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু অভিযোগ তোমার মানসিকতা, চিন্তা ও আচরণে। আমি তোমারও অংশ বাবা। আমি তো তোমায় দেখেও শিখব। এটা কী কখনও ভাবো বাবা!
—– মায়ের মতো লেকচার দেয়া শিখেছ। পারলে নিজের জীবন নিজে চালিয়ে দেখো!
—–অবশ্যই চালাব বাবা। আমি দু’টো টিউশনি করলে মিনিমাম যে টাকাটা পাবো আমার আপাতত চলে যাবে। ওটা তুমি ভেবো না বাবা। গাড়ি বাড়ি জীবনে দরকার কিন্তু তারচেয়েও বেশি দরকার আত্ম সম্মান।
আর আমার মায়ের কাছ থেকে শুধু লেকচার শিখিনি বাবা। শিখেছি মানুষ হতে। শিখেছি মানবিক হতে। শিখেছি ধৈর্য ও সহ্য। শিখেছি জীবন বোধ।
আরও শোনো বাবা টাকা ইনকাম করো তুমি। আমাদের জন্য খরচ করো তুমি। সবকিছুতে ক্ষমতা ও আধিপত্য দেখাতে চাও তুমি। অথচ দেখো আমার মা একটা টাকাও ইনকাম করে না। আমাদের জন্য তোমার কাছে টাকা চেয়ে নেওয়া ছাড়া কিছু করতেও পারে না। আমার মা কখনোই কোনো আধিপত্য দেখায়নি আমাদের সাথে। তারপরও আমরা কেন তোমার মতো হতে চাই না! কেন আমরা মায়ের মতো হতে চাই। কেন আমরা অনেক বেশি মা’কে ভালোবাসি ও বিশ্বাস করি এবং মান্য করে চলি! বলো বাবা!
—– খুব হয়েছে। এখন যাও আমরা ঘুমাব।
—-না বাবা আমরা কেউই আজ ঘুমাব না। আগে আমার মায়ের গায়ে হাত তোলার ও মা’কে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করার বিচার হবে। তারপর সব।
—-তুমি এখন তোমার বাবার বিচার করবে! বেয়াদব কোথাকার!
—-এতোটা উত্তেজিত হওয়ার কিছুই নেই বাবা। আমি বা দাদা দাদি তোমার বিচার করব না। বাইরের আইন ও বিচারও তোমার বিচার করবে না। বিচার করবে আমার মা। তোমার স্ত্রী।
——–আব্বা আপনি শুনলেন আমার ছেলের কত আস্পর্ধা! এই সবই ওর মা করেছে।
—-কৈ মা! তুমি এই পাশে আসো। এবার সবার সামনে তুমি বাবাকে শাস্তি দিবা। ঠিক যেভাবে যেভাবে বাবা তোমার উপর আজ বিকেলে অত্যাচার করেছে ঠিক সেভাবে সেভাবে। কারণ তুমি তার স্ত্রী। তোমার অধিকার আছে মা। তোমরা দু’জন দু’জনার জন্য সমান। তুমি তোমার অধিকার বুঝে নাও মা।
—-ইফতি তুমি এসব কী বলছ! তোমার বাবাকে এভাবে অসম্মান করা ঠিক না দাদু ভাই।
—-তাহলে দাদা ভাই! আমার মা’কে এভাবে অপমান করা কী ঠিক হয়েছে? কোথায় কোন আইনে আছে নিজের স্ত্রীকে এভাবে অত্যাচার করার অধিকার! বলেন দাদাভাই বলেন। এখানে তো আপনিই সবচেয়ে মুরব্বি মানুষ। আপনি বিবেক দিয়ে চিন্তা করুন। ভাবুন আল্লাহর সত্যিকারের নির্দেশনা।
সবাই চুপ! আমি আমার স্বামী ও শ্বশুর-শ্বাশুড়ির মুখগুলো দেখছি। ইফতি আবারও বলে উঠল।
—– মা তুমি বলো তুমি কী চাও!তোমার কী সিদ্ধান্ত!
—–আমি আর তোমার বাবার সাথে থাকব না। আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাব।
—-দাদাভাই, দাদুমনি, বাবা তোমরা শুনেছ! আমার মা আর তোমার সাথে থাকবে না।
—-চলে যাক! কে আটকে রেখেছে!
—-কেন বাবা! মা কেন এই বাইশ তেইশ বছর পরে নিজের সংসার ছেড়ে চলে যাবে! অন্যায় তুমি করেছ।তুমি চলে যাবে। আমরা সবাই এই বাসাতেই থাকব মায়ের সাথে।
—-বাঃ খুব ভালো প্লানিং করছ তোমরা।
—না বাবা এটা প্লানিং নয়। এটা করতে তুমি আমাকে বাধ্য করেছ। তোমার মতো বিকৃত মানসিকতার মানুষের সাথে আমরা আর থাকব না।
—– ইফতি তুমি অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করছ দাদু ভাই! তোমার বাবার সাথে এই ধরনের আচরণ করো না। মানুষের ভুল হয়। আবার মিটমাট হয়। রাশেদ আর এরকম করবে না। আমি কথা দিলাম। ভুলটা আসলে আমাদেরও। বউমার এতো ভালো একটা কাজ করল। এতে সম্মান অর্জন করল। আর আমরা তার সাথে অন্যায় করলাম। তাকে ভুল বুঝলাম! বউমা তুমি আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও।
—আব্বা আমি আর রাশেদকে বিশ্বাস করি না। আপনাদেরকেও বিশ্বাস করি না। তাই আমি আর আপনাদের বাসা, বাড়ি, সংসার, অর্থ ও আধিপত্যে থাকব না। আমি চলে যাব এটাই ফাইনাল। বিয়ের তেইশ বছর পরেও যে স্বামী তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলে। যে শ্বশুর শ্বাশুড়ি ছেলেকে ছেলের বউয়ের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। সে সংসার আমার না। আমি সর্বান্তঃকরণে এমন অধপতিত সংসার বর্জন করলাম।
আমার কথাটা শেষ হতে না হতেই ইফতি যেন ফুঁসে উঠল।
–মা তুমি যাবে না। তুমি আগে তোমার বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়ের বিচার করবে।
—না ইফতি। তোমার বাবার চুল মুঠিতে খামচে ধরে তার গালে চড় মেরে আমার পবিত্র হাত আমি নোংরা করব না। আমার আল্লাহ আমাকে এতোটা নিচে নামতে শেখায়নি। শেখায়নি আমার মা বাবা।
আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ি ও তোমার বাবার আল্লাহ হয়তো তাদেরকে এভাবেই শিখিয়েছে। হয়তো শিখিয়েছে একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনা মানে তার সাথে যা খুশি তাই করার বিধান।
—-বউ মা! এর মধ্যে তুমি আল্লাহকে ডাকছ কেন!
—কেন নয় আব্বা! আপনারাই তো কথায় কথায় আপনাদের অন্যায় দাবি ও আচরণকে আল্লাহর নাম নিয়ে অন্যায়ভাবে বৈধতা দিয়ে ফেলেন। তার মানে আপনাদের বোধে আল্লাহ ওই রকমই।
আর আমার বোধে আল্লাহ মহান। তিনি পরাক্রমশালী হয়েও আমাদেরকে কত কত ক্ষমা ও রহমতে রাখেন। আমি আমার পবিত্র আল্লাহর অনুসারী হয়েই আপনাদের অন্যাকে ক্ষমা করে দিয়ে গেলাম। আপনাদের সাম্রাজ্য ও আধিপত্য আপনাদের জন্য মোবারক।
—- মা তুমি এভাবে কেন চলে যাবা! এটা তোমার ঘর তোমার সংসার।
ইফতি আমাকে আটকাতে চেষ্টা করছে। আমি তবুও বললাম।
—– না বাবা। তোমার দাদা ভাইকে জিজ্ঞেস করো। ইসলামের বিধান মোতাবেক স্বামী স্ত্রী একে অপরের থেকে আলাদা হলে সেখানকার সংসারে স্ত্রীর কোনো অধিকার থাকে না। শুধু মোহরানার টাকাটা আর তিনমাসের ইদ্দতকালীন ভরনপোষণ পায়। আমি নিজে যেহেতু চলে যাচ্ছি। তাই আমি মোহরানার টাকা ও ভরনপোষণের টাকাটাও তোমার বাবাকে স্বেচ্ছায় মোবারক দিয়ে গেলাম।
—-মা তাহলে আমরাও সবাই তোমার সাথে যাব। চলো মা।
আমার তিনটি জানের টুকরা সন্তান তৎক্ষনাৎ আমার সাথে রওয়ানা দিল। আমি খুব দরকারি কিছু কাগজপত্র নিয়ে সন্তানদেরকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম।
হঠাৎ আমার শ্বাশুড়ি এক প্রকার দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বেড়িয়ে যাব। এমন সময় আমার শ্বশুর এসে আমার হাত দু’খানা চেপে ধরলেন।
— ইলোরা।মা তুমি যেও না। তুমি ছাড়া আমার ছেলে আর নাতি নাতনিদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।
—-না আব্বা।আমার পক্ষে এমন অমানুষের সাথে থাকা সম্ভব না।
—-আমি তোমার বাবার মতো। আজকে তোমার বাবা বেঁচে থাকলে তার কথা কী তুমি ফেলতে পারতে মা। ভুল আমাদেরই সব। আমরা ভুল সমাজে ভুল শিক্ষায় মানুষ হয়েছি। পবিত্র ধর্মের সঠিক জ্ঞান না নিয়ে ভুল জ্ঞান নিয়েছি। আমাদেরকে তুমি মাফ করে দাও মা। মাফ করো এই অপরাধী বাবাকে।
—-আসলে কী জানেন আব্বা! মাফ করে দাও। এই তিনটি শব্দের জবাবে তিনটি শব্দ মাফ করে দিলাম হয়তো বলা যায়।আর অনেকেই বলে। কিন্তু অপমানের বীভৎস দহন কী এতে করে ভোলা যায় আব্বা! আজকে আমি যদি এটা করতাম আপনাদের ছেলের সাথে তাহলে! তাহলে কী বিধান করতেন আপনি!
আমার কথা শেষ হতেই আমার শ্বশুর আমার হাত ধরে একরকম জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন রাশেদের সামনে। আর সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমার শ্বশুর রাশেদের গালে সজোরে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আমার ছেলেমেয়ে ও শ্বাশুড়ি চমকে উঠল! আমি কেমন স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার শ্বশুর রাশেদকে সকলের সামনে চুল ধরে টেনে এনে আমার সামনে মাফ চাইতে বললেন। নয়তো বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বললেন রাশেদকে। আমার আত্মায় কেমন একটু শান্তি পাচ্ছিলাম। রাশেদ সকলের সামনে আমার কাছে ক্ষমা চাইল। আমি তখন সকলের সামনে আমার একটা সিদ্ধান্ত জানালাম।
—-ঠিক আছে আমি এই সংসারে থাকব। তবে আপনাদের ও আমার সন্তানদের আমার একটা সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। আমি আজ থেকে রাশেদের সাথে এই বাসায় এক ঘরে থাকব না।আমি আলাদা ঘরেওর থেকে সেপারেশনে থাকব। আব্বা আপনার নতুন শিক্ষায় আগে আপনার ছেলে শিক্ষিত হোক। মানুষ হোক। তারপর দেখা যাবে।
আমার ছেলে ইফতি খুব অস্থির হয়ে উঠল।
—–মা তুমি পারবে! তোমার কষ্ট হবে না মা!
—-পারবো বাবা। আমাকে পারতে হবে। আমি যে সবার আগে একজন মা। সন্তানের জন্য পৃথিবীতে বহু বহু মা তাদের জীবন পর্যন্ত কুরবান করেছেন। আর আমি তো কেবল দহনকে সহন করছি। তবে কী জানো বাবা!
সেই সকল মায়েরা তোমার মতো আদর্শ সন্তান পায় না সবাই। আজকে আমি আসলে তোমার বাবাকে শোধরানোর সুযোগ দিলাম তা নয়! আজকে আমি তোমাদেরকে সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নিজেকে আরও একটা কঠিন পরীক্ষায় পাশ করিয়ে নিলাম। কারণ আমি কিছু আদর্শ সন্তানের জননী হতে চাই। হতে চাই নতুন এক শান্তিময় পৃথিবী নির্মাণের কারিগর। যেখানে নারী পুরুষ উভয়েই মানুষ হবে।হবে মানবিক। সকলে সকলকে সম্মান করবে। প্রতিটি মানুষ হবে সহনশীল, ধৈর্যশীল, ক্ষমাশীল, প্রজ্ঞাবান ও সু-আচরণকারী।
যেখানে কোনো বাবা , কোনো স্বামী, ভাই, সন্তান, বন্ধু, প্রতিবেশী, সহকর্মী ও সহপাঠী পুরুষ কোনো নারীকে ঘাসেদের মতো দলিত মথিত করতে না পারে। প্রতিটি ঘাসের বুকে ফুল ফোটে। হলুদ, বেগুনি, লাল রঙের বসন্ত খেলে যায়। প্রতিটি ঘাসের বুকে ফাগুন আসে। পৃথিবীর আলো বাতাসের পরিপূর্ণ নেয়ামত গ্রহণ করে প্রতিটি নারী কেবল নরম কোমল ঘাস হয়ে নয়। এক একটি শক্তিশালী ও দৃঢ়চিত্ত বটবৃক্ষ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় পৃথিবীর মানচিত্রে।
বাবা তোমরাই হবে আমাদের মতো বটবৃক্ষসম মায়েদের মানবিক সন্তান। তোমাদের হাতেই থাকবে আগামীর সুসম্পর্কের সৌহার্দ্য ও শান্তিময় পতাকা।
তোমরা যে আমারই সন্তান। তোমাদের ও আমার জীবন মূলত বাস্তব জীবন। এটা কোনো সিনেমা বা নাটকের পাণ্ডুলিপি নয়। যেখানে কলমের এক খোঁচায় ফাঁসিতে ঝুলানো যাবে অপরাধীকে। যেখানে দু’লাইন লিখেই একটা মানুষকে হুট করে বদলে দেয়া যাবে শব্দের জাদুতে! যেখানে অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল টাইপ সমাপ্তির গল্পগ্রন্থ লিখে ফেলতে পারব আমরা এক নিমিষে।
এটা জীবন!
এখানে পোড় খেয়ে খেয়ে কয়লা হয়ে বুকে আগুন নিয়ে টিকে থাকতে হবে। টিকে থাকতে হবে আগুনমুখা হয়ে অশুভকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করার জন্য। লড়াই করেই জিততে হবে আমাদেরকে আমাদের পথের প্রতিটি বাঁধার সাথে। প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, ধৈর্য, ক্ষমা, কর্ম ও আচরণ দিয়ে সুদীর্ঘ কালের ঘুণেধরা বিকৃত নিয়মকে বদলাতে হবে। বদলাতে হবে সমাজ ও সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে থাকা প্রহসনকে। নারীদেরকে আরও সাহসী হতে হবে। মুনিয়াকে আমি আমার মতো নারী হিসেবে তৈরি করব না। তোমাদেরকে আমি রাশেদের মতো পুরুষ হিসেবে তৈরি হতে দেব না। তোমাদের প্রজন্মের মস্তিষ্কে আমি ইলেরা বুনে দেব মানবিকতার বিশুদ্ধ গুণাবলি। তোমরা নৈতিকতার পুঁথি পাঠেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তোমরা কার্যতঃ নীতিবান হবে। সঠিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। প্রতিটি পরিবারের মায়েরা এক একজন ইলোরা হয়ে গড়ে উঠবে। আমাদের মুনিয়ারা মানুষ হবে। নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখবে। নারী পুরুষ প্রতিপক্ষ হবে না। সহযোগী হবে। বন্ধু হবে। এভাবে পৃথিবীর মানচিত্র বদলের নেতৃত্ব দেবে আমাদের মুনিয়ারা। আমাদের মহীয়সী নারীরা। মুনিয়ার সকল সহপাঠী, বন্ধু, আত্মীয় মেয়েরা আস্তে আস্তে নিয়মিত প্রাকটিস করে করে প্রজ্ঞা ও যত্নে তৈরি হবে আমার তৈরি করা মুনিয়ার মতো। মুনিয়ার মতো সাহসী ও বিশুদ্ধ বোধের ধারক হবে সকল মেয়েরা। তুমি, ইনতি তোমাদের সকল বন্ধু, সহপাঠী, আত্মীয় পরিজন ছেলে সন্তানরা এক একজন ইফতি হবে।
মুনিয়া পাবে ইফতির মতো আদর্শবান একজন স্বামী রূপে বন্ধু ও সহমর্মি। তুমি পাবে আমার গড়া মুনিয়ার মতো আদর্শবান একজন স্ত্রী রূপে বন্ধু। তোমাদের মধ্যে ভালোবাসার সাথে সম্মান থাকবে সম্পর্কের মেরুদণ্ড হয়ে।
—নো নো নো মা। আমি ঠিক তোমার মতো একজন জীবনসঙ্গী চাইব।
—-মা আমিও ভাইয়ার মতো করে তোমার মতোই একজনকে চাইব।
—-মাম্মা আমিও তোমার মতোই একজন মায়ের সাথে থাকব।
—-দেখেছ ইলোরা মা। আমার দাদু ভাইয়েরা তোমার আদর্শ ও শিক্ষায় কত ভালো মানুষ হচ্ছে। আমি আর তোমার শ্বাশুড়িও আমাদের জীবনের শেষ পর্যন্ত তোমাকেই চাই।
আমি এক ভীষণ আত্মসম্মান ও পরিতৃপ্তি নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম রাশেদের মাথা নিচু করা মূর্তিটার দিকে।
রাশেদ ঘরের এক কোনে চুপ করে বসেছিলো। সকলের মাঝে থেকেও তার এক অলিখিত নির্বাসন হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। এরচেয়ে বড়ো শাস্তি আর কী হতে পারে একজন মানুষের জন্য! কখনও কখনও ফাঁসির চেয়ে যাবজ্জীবন হয়তোবা এজন্যই বেশি ভয়বহ হয় কারও কারও জন্য!
নিজের আপনজনের রাশেদ এখন তেমন কেউ না। বাসা থেকে বের করে দিলে অবশ্যই। দু’দিন পরে নিশ্চিত কোনো মেয়েকে ফুসলিয়ে আরেক উৎপাত তৈরি করত সন্তানদের জীবনে। তার চেয়ে থাকুক নিজের ঘরে পরবাসী জীবন নিয়ে। যদি তার একটুও বিবেক তৈরি হয় এতে! যদি সে একটুকুও সত্যিকারের মানুষ হয়! তাহলে হয়তো তার পাপমোচন হবে কিছুটা। নয়তো নিজের আপনজনরাই তার জীবন অভিশপ্ত করে দিবে অপমানের নরক যন্ত্রণা ঢেলে ঢেলে।
প্রকৃতি কী আজ অবধি কাউকে পুরোপুরি ক্ষমা করেছে! করেনি। রাশেদকেও করেনি ও করবেও না। এটা আমি নিশ্চিত। তাইতো রাশেদ নিজের বাবা-মা ও সন্তানদের অন্তরে এক ঘৃণিত অবস্থানে গিয়ে পৌঁছাল।
কত কত রাশেদ এভাবেই নিরবে নিভৃতে অত্যাচার করেছে পৃথিবীর নানান প্রান্তের ইলেরাদের। এখনও করে যাচ্ছে। তবে ভবিষ্যতে রাশেদদের অত্যাচারি কতৃত্বের বদল হবে আমি ইলোরা নিশ্চিত। সারা পৃথিবীর। বিশেষ করে বাঙালি প্রতিটি নারী এখন থেকে এভাবে আর নিগৃহীত হবে না।মাইর খাবে না আর। খাওয়া উচিত হবে না।ইটের জবাব পাত্থর মেরে দেবে নারীরা। রাশেদের মতো নিগৃহীতও করবে এমনই নিরবে নিভৃতে নিয়ত। তাহলেই জাতীয় ভাবে শান্তি আসবে পরিবারে।
এখনও নারীরা যেমন সমাজের ভয়ে, সম্মানের ভয়ে, নিরাপত্তার ভয়ে, সন্তানদের ভবিষ্যতের ভয়ে আতঙ্কিত থাকে এমন সব অত্যাচারি পুরুষদের মোকাবিলায়!এবং মুখবুজে সব সহ্য করে নেয়। এখন থেকে রাশেদদের মতো পুরুষরা এরকম অন্যায় করার পূর্বে তেমন নিগৃহীত হবার আতঙ্কে ভুগবে ইনশাআল্লাহ।
এর জন্য দায়িত্বটা৷ নিতে হবে প্রথমে সকল নারীদেরকে এবং সত্যিকারের মানুষ হওয়া পুরুষদেরকেও।
ফজরের আজান পড়তেই আমার ভাবনায় ছেদ পড়ল। আমরা সবাই অজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। আমি আমার তিন সন্তানকে নিয়ে আমার বেডরুমে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকেও তাদের রুমে গিয়ে ঘুমাতে বললাম।
রাশেদ আমাদের রুম থেকে নিজেই বেরিয়ে গেল।
বেলা এগারোটার পরে সবাই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করলাম। ইফতি ও আমার শ্বশুর খুব করে বলল আমাকে রাষ্ট্রপতি পদক নিতে অনুষ্ঠানে যেতে। কিন্তু আমি গেলাম না।কারণ আমি নিজেকে আরও তৈরি করতে চাই। আমি আমার ছেলে ইফতি, ইনতি, মেয়ে মুনিয়া ও আমার শ্বশুর শ্বাশুড়িকে পদক আনতে পাঠালাম আমার পক্ষে।
আমি ইলোরা মনে করি আমার সৃষ্টিকে আরও সমৃদ্ধ ও ঋদ্ধ করতে হবে। আমি আসলেই এখনও খুবই সাধারণ। আমি আরও তৈরি হই। ইনশাআল্লাহ তারপর যাব। মনে মনে এই ব্রত নিলাম আমি।
আমি বিশ্বাস করি একজন মানুষ নামের মানুষের এবং একজন শিল্পী ও সাংষ্কৃতিক জগতের মানুষের কথা ও কাজের সবসময় মিল থাকা জরুরি। এটা না থাকলে মানুষ জন্মটাই তো অসম্পূর্ণ!
আমার পরিবারের সকলে সম্মানের সাথে আমার পক্ষ হয়ে রাষ্ট্রপতি পদক গ্রহণ করে বাসায় ফিরল। সকলেই ভীষণ আনন্দিত। আমার কারণে আজ আমার পরিবার অনেক সম্মানিত হয়েছে। আমিও ভীষণ খুশি। সৃষ্টিকর্তার রহমতে আমার জীবনে অনেক অনেক দুঃখের গ্লানি ধুয়ে আনন্দ এলো। আরও আরও আরও আনন্দ আসবে আমার বিশ্বাস। পৃথিবীর সকল নারী একদিন সত্যি সত্যি পরিপূর্ণ সম্মানের মুকুট পরবে। আমার মতো এভাবেই অধিকাংশ ঘাসেদের জীবনে ফাগুন আসবে।আসবে বটবৃক্ষ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার কার্যকর পরিবেশ।
আমার ছেলের কাছে শুনলাম রাশেদও নাকি অনুষ্ঠানের ওখানে গিয়েছিল। আমি শুনলাম আর ভাবলাম পৃথিবীর সবচেয়ে আজীব প্রণী আসলেই মানুষ প্রজাতি! রাশেদ কী কয়েক ঘন্টায় পুরোপুরি বদলে গেল! রাশেদ কী ওর সন্তান আর বাবা-মায়ের চোখে ভালো সাজার অভিনয় করতে ওখানে গেল! রাশেদ কী সত্যি সত্যি নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরে নিজেকে পদলে নেয়ার চেষ্টা করছে! রাশেদরা কী বারংবার একটা ভালো মানুষের মুখোশ পরে মুখোশ মানুষ হয়ে মিশে থাকবে প্রতিটি নারীর জীবনে! কী জানি! রাশেদরা কী আসলেই বদলায়!
মূলত আমরা যে কখন কোন বোধে আমাদেরকে পরিচালিত করি। তার বিচিত্রিতার বোধ আমাদের নিজেদেরই কী ঠিকঠাক বোধগম্য হয়! হয় না। তাহলে আমরা কী করে ঠিকঠাক অন্য সকল মানুষকে বুঝব! আমি ঠিক জানি না! আমরা ঠিক জানি না!
সমাপ্ত।
বিঃদ্রঃ
আমার সুপ্রিয় পাঠক, সুহৃদ, বন্ধু ও প্রিয়জন। আপনাদের আন্তরিক ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, অসাধারণ অর্থবহ সব মন্তব্য, নিয়মিত সাপোর্ট ও আগ্রহের কারণে আমি মাত্র একমাস আট দিনে এই উপন্যাসটি কমপ্লিট করতে পারলাম। এটা আমার জীবনের একটা অন্যতম পাওয়া হয়ে থাকবে। বিনম্র কৃতজ্ঞতা আর শুকরিয়া আর ভালোবাসা আপনাদের সকলকে। আপনারা সকলে আমার প্রেম হয়ে গেছেন।হয়ে গেছেন ভীষণ সুখের একটি অভ্যাস। আমি নিয়মিত কবিতা লিখি, আবৃত্তি পোস্ট দেই, গল্প উপন্যাস তো থাকবেই ইনশাআল্লাহ। আপনাদেরকে এভাবেই আমার প্রতিটি সৃষ্টির সাথে চাই। ভালো থাকবেন সকলে। অনেক অনেক ভালোবাসা।
পৃথিবী হোক বিশুদ্ধ বোধের সন্তরণ।
পৃথিবী হোক সুখেন্দু আলয় সকলের।