অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ ০৭

0
8467

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ০৭

ভাওয়াল রিসোর্টের উদ্দেশ্য পদ্মালয়ার সামনের বড় রাস্তাটায় এসে সবাই উপস্থিত হয়েছে। রিসোর্টটা গাজীপুরে অবস্থিত বিধায় তারা বেশি লেইট করেনি। সকাল সকালই সবাই রউনা দেবার প্ল্যান করেছে। নতুবা জ্যামে আটকে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তাই হালকা নাস্তা খেয়েই সকাল সাতটার মধ্যে সবাই এখানে উপস্থিত।
আঠারো সিটের এসিযুক্ত মিনিবাসে সকলের যাত্রা নিশ্চিত করা হয়েছে। নিজস্ব গাড়ি হলে সবাই ভাগাভাগি হয়ে আলাদা হয়ে যাবে। আর সেই জন্য হয়তো পিকনিক টাইপ ফিলিংসটাও পুরোপুরি আসবে না। তাই এই ভিন্ন উদ্যোগ।

নীলা এদিক-ওদিক দৃষ্টি রেখে মায়ের পিছনে ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের সম্পূর্ণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে গাজিপুর যেতে হচ্ছে। শুধু মাকে একবার বলেছিল সে যাবে না, তৎক্ষনাৎ মায়ের বকা শুনতে হয়েছে। নীলাকে ইচ্ছা মতো ঝেড়ে তিনি শান্ত হয়েছেন। নীলার বিরক্তি আকাশছোঁয়া।
সে বুঝে উঠতে পারছে না সাদিদসহ তার বন্ধুরা রিসোর্টের শেয়ার কিনুক বা রিসোর্ট ভেঙে ফেলুক তাতে নীলার কি? তাকে কেন টইটই করে সেখানে যেতে হবে?
কিন্তু নীলার মনের এই দুঃখটা কেউ বুঝল না। বাবাকে বলেও লাভ বিশেষ করতে পারেনি। সাদিদ তাদের কি জাদু-টুনা করেছে আল্লাহ মালুম। এই ছেলের কথা শুনলেই তারা গলে পুরোপুরি বরফ। তাই জোরপূর্বক ইচ্ছার বিরুদ্ধে টেনে হিঁচড়ে নীলাকে গাজিপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
মূলত কথা হচ্ছে নীলার রিসোর্টে যেতে কিন্তু কোনো প্রবলেম নেই। বরং সে ঘুরাঘুরি বেশ পছন্দ করে। তার একমাত্র প্রবলেম হচ্ছে সাদিদকে নিয়ে।

সেদিনের পর থেকে আজ প্রায় ছয়দিন যাবত সে সাদিদকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছে। রাগ কিংবা ভয়ে নয়, লজ্জায়। নিজের অনুভূতির নাম জানার পর থেকে নীলা এখন সাদিদের মুখোমুখি হতে পারছে না। একঝাঁক লজ্জা এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। কেবল লজ্জায়ও সীমাবদ্ধ নয়, আরও সাথে আছে চাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস। ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা না হতে পারার দীর্ঘশ্বাস।
সবমিলিয়ে নীলা সাদিদের সম্মুখীন হতে চায় না। বিগত কয়েকদিন সাদিদ তাদের বাসায় বেশ কয়েকবার আসলেও নীলা নানা অযুহাতে তার সামনে একবারও আসেনি।
কিন্তু আজ তাকে সাদিদের মুখোমুখি হতেই হবে। আর নীলা সেটা চায় না। সাদিদের থেকে যত বেশি দুরত্ব বজায় রেখে চলা সম্ভব নীলা এখন সেটাই করতে চায়।
কিন্তু আজকে সাদিদের সামনে সে কিভাবে নিজেকে লুকাবে সেটা ভাবতেই নীলার ঘাম ছুটে যাচ্ছে।
এমন অবস্থায় আচমকা পিছন থেকে কেউ ঝাপটে ধরতেই নীলা চমকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরল।

—- ” তুই এখানে? ”

—- ” তা নয়তো কি? তুই আমাকে ভুলে গেলে কি হবে! আমার দুলাভাই ঠিক-ই মনে রেখেছে। ”

—- ” দুলাভাই! ”

—- ” বারে, বান্ধবীর জামাইতো দুলাভাই-ই হবে। ”

—- ” কি আজগুবি কথা বলছিস? কোন বান্ধবী, কার জামাই? ”

—- ” ধ্যাত! তুই কিছু বুঝিস না। আরে আমি সাদিদ জিজুর কথা বলছি। ”

—- ” থাপড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দিব ফাজিল মেয়ে। উনি তোর জিজু কিভাবে হয়? ”

—- ” তারমানে বলছিস হয় না? তাহলে তো আমি আরও বেশি খুশি। অবশেষে আমার ক্রাশবয়কে ফিরে ফেলাম। ”

নীলা রাগী চেহারায় শান্তর দিকে তাকাতেই শান্ত আবারও তাকে ঝাপটে ধরল। আর মুহূর্তেই নীলার রাগ গলে পানি। শান্ত তাকে জড়িয়ে রেখেই বলল,

—- ” অনুভূতির থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন? ভাইয়াকে এবার বল। অনেকদিন তো হলো। ”

—- ” না শান্ত। আমি আগেও তোকে বলেছি, আমি উনাকে কিছু বলতে চাই না। তার জন্য আমি অনুভব করলে কি হবে? সে তো আমাকে অনুভব করে না। ”

—- ” তুই জানিস? তোকে সে এই কথা একবারও বলেছে? ”

নীলা এবার চুপ করে গেল। এই নিয়ে আর কথা বলতে চায় না। তাই সে পা বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
সবাই এক এক করে বাসে উঠে বসল। নীলা এবং শান্ত সেকেন্ড লাস্ট সিটে গিয়ে বসেছে। সামনে বসা মানেই ফ্রিতে বড়দের বকা খাওয়া, তাই তাদের এই মিলিত সিদ্ধান্ত। নীলা এতক্ষণ ভয়-টেনশনে থাকলেও শান্তকে পেয়ে এখন বেশ ভালো লাগছে। তাই দুইজনই বেশ হাসিখুশি।
কিন্তু প্রাণের বন্ধু হয়ে যে শান্ত মীরজাফরের কাজ করবে সেটা কে জানত!
সাদিদ তানবীর আর অর্ণবকে নিয়ে বাসে উঠতেই শান্ত বলে উঠল,

—- ” জি.. মানে ভাইয়া আপনার সিটের সাথে আমারটা এক্সচেইঞ্জ করবেন? আসলে আমার ওয়েনডো সিট পছন্দ। অর্ণব ভাইয়াকেই বলতাম, কিন্তু উনার সাথে তো প্রিয়তী আপু রয়েছে। ”

—- ” নো প্রবলেম, তুমি এখানে চলে আস। ”

নীলা তাদের কথোপকথন শুনে আতংকিত কন্ঠে বলে উঠল,

—- ” এই না, না তুই আমাকে আগে বলবি তো। আমি এখনই সিট পাল্টাচ্ছি। ”

বলেই নীলা দ্রুত দাঁড়িয়ে সিট পাল্টাতে গেলেই শান্ত তাকে বাধা দিলো।

—- ” আরে বসতো। আমি এত পিছনে বসতে পারব না। ভাইয়া আপনি আসেন তো৷ ”

নীলা অসহায় চোখে শান্তর দিকে তাকালো। আর শান্ত প্রতিউত্তরে তাকে একটা কুটিল হাসি ফিরিয়ে দিলো। নীলার আর বুঝতে বাকি রইল না সবটাই শান্তর জেনে-বুঝে করা।
শান্ত সাদিদের সিটে গিয়ে বসতেই সাদিদ এসে নীলার পাশে বসল।
নীলার বাহুতে সাদিদের হালকা স্পর্শ লাগতেই নীলা শিউরে উঠে জানালার পাশে আরও লেগে বসল।
সাদিদ একপলক তাকিয়ে নীলার ইতস্ততবোধ খেয়াল করল। কিন্তু সে দূরে সরে না গিয়ে বরঞ্চ বেশ আয়েশ করে বসল।
নীলা পারলে এবার জানালা দিয়ে বাসের বাহিরে চলে যায়। সাদিদের শরীরের ঘ্রাণ নীলার নাকে স্পষ্ট লাগছে। আর মাঝেমধ্যে শরীরের স্পর্শগুলোতে নীলার শরীর প্রায় জমে যাচ্ছে। গায়ে বারবার কাটা দিচ্ছে।
সাদিদ সবটাই আড়চোখে খেয়াল করছে। তাই সে ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু হাসল।

.

নীলাদের দুই সিট সামনেই শান্ত বসেছে। শান্ত জানালা দিয়ে রাস্তায় গাড়িদের চলাচল দেখছিল, তার মধ্যেই হুট করে পাশে কেউ বসতেই সে ফিরে তাকালো।
উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের সেই ছেলেটা।
দেখেই শান্তর ভ্রুজোড়া অটোমেটিকলি কুঁচকে গেল।
আজ সকালে রিক্সা থেকে নেমে সাদিদদের বাসার দিকে আসতেই, এই আপদটটার সাথে তার দেখা হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবে তানবীরের পায়ে শান্তর হিল জুতার খোঁচা লাগে।
তারপর শান্তকে সরি বলার সুযোগটুকু না দিয়েই, সে একচুট ঝগড়া শুরু করেছিল।
কেবল ঝগড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে মাফ করা যেত কিন্তু সে শান্তর আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। গেঁয়ো হয়ে স্টাইলিশ হবার ট্রাই করছে এসব হাবিজাবি বলে অপমান করছে।
আর শান্তও কি চুপ থাকবে নাকি? এরপর জায়গায় দাঁড়িয়েই তানবীরের সাথে কোমরবেঁধে ঝগড়া করেছে। তানবীরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে তবে সে ক্ষান্ত হয়েছে।
পরবর্তীতে যখন দুইজনের সামনাসামনি পরিচয় হয়েছিল, তখনও দুইজনের মধ্যে খুব একটা আত্মীয়সূচক ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়নি। মানে হচ্ছে তারা এখনও ঝগড়াতেই সীমাবদ্ধ।
কিছুক্ষণ আগের কথা মনে হতেই শান্তর আবারও বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো। তাই বেশ রাগীস্বরে বলে উঠল,

—- ” আপনি এখানে বসেছেন কি জন্য?
উঠুন বলছি। ”

—- ” মানে! আমি কি তোমার কথায় উঠ-বস করব নাকি? ”

—- ” দরকার হলে তাই করবেন। আমি আপনার সাথে যেতে পারব না। সরুন বলছি। ”

—- ” এহ্, আমি মনে হয় তোমার সাথে যাবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি? তোমার পাশে বসা তো দূর দাঁড়ানোরও আমার ইচ্ছা নেই। কিন্তু চোখগুলো একটু কাজে লাগাও বাসের সব সিট ইতিমধ্যে ফিলাপ। যেগুলো খালি আছে সেগুলোতে সবার ব্যাগপত্র রাখা। ”

—- ” আমার চোখ জায়গাতেই আছে। বরং আপনি নিজেরগুলো কাজে লাগান। ব্যাগের উপর গিয়ে বসার মতো যথেষ্ট জায়গা ফাঁকা আছে? ”

—- ” কি? আমি ব্যাগের উপর গিয়ে বসব? ”

—- ” দরকার হলে ব্যাগের নিচে গিয়েও বসতে পারেন। ”

—- ” আর যদি না যাই? ”

—- ” যাবেন না কেন? আপনার সাথে এক সিটে বসে গাজীপুর পর্যন্ত যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

—- ” তাহলে তো আমি অবশ্যই যাব না। পৃথিবী উল্টিয়ে গেলেও আজ আমি এই সিট ছাড়ছি না। ”

শান্তর রাগে মাথা ফেটে যাবার অবস্থা। ইচ্ছে করছে তানবীরকে তুলে সজোরে একটা আছাড় দিতে। সে দাঁতে দাঁত কেটে বলল,

—- ” গাড়কাটা লোক। ”

—- ” তোমার থেকে কম। ম্যানার্স ভুলে গিয়ে ফাজিল হয়েছ। ”

—- ” খবরদার বাজে কথা বলবেন না। ”

—- ” তুমি পুরোপুরি বাজে। আমি এতটাও গুছিয়ে বলতে পারছি না। ”

—- ” কি! আমি বাজে? তাহলে আপনি আমার বড়টা। ”

—- ” অবশ্যই বড়। তোমার গুরুজন, তাই পা ধুয়ে ধুয়ে পানি খাও। ”

—- ” ছিঃ ”

—- ” ছিঃ বলার কিছু নেই। হটি মেয়েরা আরও অনেক কিছুর জন্য ওয়েট করে বসে থাকে। ”

শান্ত ভ্রু কুঁচকাল। আশেপাশে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে নিচু স্বরে বলল,

—- ” যে যেমন তার জন্য তেমন মানুষ-ই বসে থাকে। ”

শান্তর ফিসফিসানি তানবীরের কর্ণকোহরে ঠিকই স্পষ্টভাবে পৌঁছে গেছে। তাই সে শান্তর দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে কন্ঠ তার থেকেও খাদে নামিয়ে বলল,

—- ” ঠিক ধরেছ, যে যেমন। আমিও ফাস্ট ক্লাস তারাও ফাস্ট ক্লাস। মধ্যে থেকে তোমার মতো মিডেল ক্লাসের জায়গা নেই। ”

—- ” ফাস্ট ক্লাস বলেই জামা-কাপড়ের এত অভাব? ”

—- ” সেটা তোমার বুঝার বাহিরে। ফ্যাশনের ‘ফ’ বুঝ না আস আবার ড্রেস নিয়ে কথা বলতে। ”

শান্ত আর কথা বাড়ালো না। এই বাচাল ছেলের সাথে কথা বললেই কথাকে টেনে-টুনে চুইংগামের মতো লম্বা করে। তাই প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে জানালার পাশ ঘেঁষে বাহিরের দিকে তাকালো।

__________________

বাস ইতিমধ্যে উত্তরা পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণ সবাই শান্তভাবে বসে থেকেই বাস জার্নিটা এনজয় করছিল। কিন্তু এবার তানবীর প্রায় চেঁচিয়ে বলে উঠল,

—- ” ভাই, আমরা পিকনিকে যাচ্ছি না শোকসভায় যাচ্ছি? এত নীরবতা কেন? ”

—- ” তুই রাজি থাকলে তোর শোকসভার আয়োজন করতে পারি। কি রে তানবীর, হয়ে যাবি নাকি শোকসভার পাত্র? ”

—- ” শালা তুই কথা মারাইস না। প্রিয়ুকে পাইয়াতো বাসের মধ্যেই অন্দরমহলে ডুইককা যাইতাসছ। ফ্যামেলি পিকনিকে যাইতাসি না তোদের রঙ্গলীলা দেখতে? ”

বাসে উপস্থিত বড়দের সামনে তানবীরের এমন লাগামছাড়া কথায় নীলা-শান্ত কেশে উঠল। বড়দের অনেক কেই ইতস্ততবোধ করতে দেখে সাদিদ এগিয়ে এসে তানবীরের পিঠে জোরে চাপড় বসাল।

—- ” হারামি মুখ সামলাইতে পারস না? ”

—- ” দোস্ত আরেকটু জোরে লাগা। পারলে হেতের মুখটাত লাগা। ”

—- ” শালা তুই মাঝখান থাক্কাইকা কথা কইলেই ধাক্কা দিয়া ফালাই দিমু। ”

—- ” বাবু এসব কি বলে তানবীর? ”

—- ” প্রিয়ু বেবি সে অনেক কিছু বলে। এতসবে কান দিয়ে তোমার লাভ নেই। ”

অর্ণবের আর তার বেবির আদিখ্যেতা দেখে তানবীরের গায়ে যেন ফোসকা পরল। তানবীর দাঁত চেপে বলে উঠল,

—- ” যতসব বাল ছাল। ”

সাদিদ হাসল। তারপর বন্ধুর মন ভালো করতে পিছন থেকে গিটারটা তুলে এনে সুর তুলল। তানবীরের রাগ এবার থেমে গেল। দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে সেও হাতে আরেকটা গিটার তুলে নিলো।

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে মনের গহিন ঘরে
চিত্রপটে তোরই ছবি, তোরে মনে পড়ে
(তোরে মনে পড়ে)
তোরে মনে পড়ে

রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে মনের গহিন ঘরে
চিত্রপটে তোরই ছবি, তোরে মনে পড়ে
(তোরে মনে পড়ে)
তোরে মনে পড়ে

সবাই এতক্ষণ পাশ থেকে তাদের উৎসাহ দিচ্ছিল। কিন্তু এবার সাদিদের সাথে সবাই জোরে একসঙ্গে গেয়ে উঠল।

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

সবার মুখে হাসি। করতালি দিয়ে বাসের সবাই ইতিমধ্যে পরিবেশ গরম করে ফেলেছে। ছোট্ট শাদমানও সিটে দাঁড়িয়ে ছোট্ট হাতগুলো দিয়ে সবার দেখাদেখি হাততালি দিচ্ছে। আর খিলখিলিয়ে হাসছে। আর চলন্ত বাসে পড়ে যেন না যায় শাহেদ তাকে শক্ত করে আগলে ধরেছে। তার মুখে হাসি, পাশে বসে নিধিও হাসছে।
সাদিদ পাশে বসা নীলার দিকে তাকিয়ে আবারও সুর তুলল।

মনের ভেতর দ্বিধা, পা বাড়াতে বাঁধা
শেকল পড়া পায়
ক’দিন বাঁচা যায়, বেঁচে থাকা যে দায়
(বেঁচে থাকা যে দায়)
বেঁচে থাকা যে দায়

মনের ভেতর দ্বিধা, পা বাড়াতে বাঁধা
শেকল পড়া পায়
ক’দিন বাঁচা যায়, বেঁচে থাকা যে দায়
(বেঁচে থাকা যে দায়)
বেঁচে থাকা যে দায়

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল (২)

কৃষ্ণচূড়ার লাল, পদ্মপাতার জল
অঙ্গে মেখে আজকে সখি
সূর্যস্নানে চল
(সূর্যস্নানে চল)

দ্বিধা-দ্বন্দ ভোল, মনের আগল খোল
রক্ত-আবির অঙ্গে মেখে
সূর্যস্নানে চল
সূর্যস্নানে চল
(সূর্যস্নানে চল)
(সূর্যস্নানে চল)

সবাই হাসছে। কেননা এতক্ষণ সবাই বয়স-সম্পর্ক ভুলে গিয়ে গলা ফাটিয়ে সাদিদের সাথে গান গেয়েছে। সুর কেমন হয়েছে সেটা বড় কথা নয়, সবাই যে আনন্দ করেছে এইটাই মোক্ষম।
সাদিদ নীলার দিকে তাকালো। তার মুখে এখনও হাসি লেগে আছে। এতক্ষণের সব জড়তা কেটে গিয়ে সবার সাথে সাথে সেও আনন্দে সামিল ছিল। সাদিদের মুখেও হাসি ফুটল। কেননা সাদিদতো এমনটাই চেয়েছিল। আর তারজন্যই এতকিছুর আয়োজন। প্রাণপাখির রাগ-ক্ষোভ, মধ্যকার সকল দুরত্ব কমাতে সাদিদ কোনো কমতি রাখতে চায় না। শীঘ্রই পাখিকে নিজের খাঁচায় আটকানোর পুরো ব্যবস্থা করে ফেলেছে সাদিদ।

তাদের গানের শেষেই আকস্মিকভাবে বাহিরে সূর্যের তাপে ভাটা পরল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে মুহূর্তের মাঝেই বাসের ছাদে আওয়াজ হতে লাগল ঝুম বৃষ্টির রিনিঝিনি।
তাই তানবীর ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলে উঠল,

—- ” কিরে সাদি তুইতো মারাত্মক কুফা!ভালা-টালা দিনটারে বৃষ্টিতে চুবাইয়া দিলি। ”

সাদিদ মাথা চুলকে হাসল। একপলক পাশে বসে থাকা নীলার দিকে তাকাতেই নীলার হাসিমুখটা নজরে আসলো। সাদিদকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নীলার পূর্বের ন্যায় আবারও দৃষ্টি এড়ালো।
সবাই বৃষ্টিস্নাতরত প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত।
বাহিরে দেখতে গিয়ে শান্তর শরীরের সাথে তানবীরের আচমকা স্পর্শ লাগতেই শান্ত তাকে ধাক্কা দিয়ে সরাল।

—- ” গায়ে পড়া লোক, দূরে সরুন। ”

—- ” ইশশ আসছে আমার প্রিন্সেস ডায়না! কি আমার শরীর, আবার এটা নিয়েই রংচং। ”

—- ” খারাপ কি দেখলেন? ”

—- ” ভালোর কি আছে? ”

—- ” আপনার মাথা আছে। ”

—- ” সেটা তুমি না বললেও জায়গায় আছে। ”

শান্ত বিরক্ত হয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠল,

—- ” ড্রাইভার ভাই জোরে একটা গান চালান তো। পাশে বসা পাগলটা আমার মাথা খেয়ে নিচ্ছে। ”

—- ” কাকে পাগল বললে? ”

—- ” আপনাকেই বললাম। এনি ডাউট? ”

তানবীর উত্তর না দিয়ে কি মনে করে বাঁকা হাসল। শান্ত তার হাবভাব না বুঝে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল। আপাতত এই আপদের মুখ দর্শন করার তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই।

শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে। (২)

নীলা চমকিত দৃষ্টিতে পাশ ফিরল। বুকটা তার ধুক করে উঠল, কেননা সাদিদ অপলক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নীলা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো। তার চিন্তা হচ্ছে সাদিদ কি চলন্ত বসে তার কাঁপুনি বুঝে যাবে নাকি? নতুবা বাসের সিট যে হারে নড়ছে, সাদিদ বুঝতে পারলে লজ্জায় পরতে হবে। ভাবতেই নীলার এখন ভয় করছে।

আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে,
আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে।

কবিতার বই সবে খুলেছি
হিমেল হাওয়ায় মন ভিজেছে,
জানালার পাশে চাঁপা মাধবী
বাগান বিলাসী হেনা দুলেছে। (২)

আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে,
আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে।

এত অস্থিরতায় বুঝি থাকা যায়? নীলার ইচ্ছা করছে এইমুহূর্তে শান্তর মাথায় জোরে একটা ইট ফাটাতে। তার জন্যই নীলার এখন এই অবস্থা। এমনিতে এসব গানে সমস্যা না হলেও সাদিদ পাশে থাকায় নীলা কোনোভাবেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।
তাই কিছু না পেয়ে সে পানির বোতলটা হাতে তুলে নিলো। কিন্তু এখানেও বিপত্তি ঘটল। তার হাত এত বেশি পরিমাণ কাঁপছিল যে মুখে-গলায় পানি পরে জামা কিছুটা ভিজে গেছে।
সাদিদ এবার এগিয়ে আসলো। নীলাকে বুঝতে না দিয়ে, টিস্যু হাতে নিয়ে নীলার মুখের আর গলার পানিটুকু মুছিয়ে দিতে লাগল।
নীলার অস্বস্তি যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। পানি মুছিয়ে দিয়ে সাদিদ বোতলটাতে হাত দিতেই নীলা তার দিকে চোখ উঠিয়ে তাকালো।
কিন্তু সাদিদের চোখে চোখ পরতেই নীলা আবারও মাথা নিচু করল। এই চোখে যে নীলা তাকাতেই পারে না। নেশার মায়াজাল যেন এই চোখজোড়া আর এই চোখের মালিক। সাদিদ নীলার অবস্থা দেখে নিঃশব্দে হাসল।

তারপর নীলার থুতনিতে হাত দিয়ে তার মুখটা একটু উঁচু করে নিজেই পানি খাইয়ে দিতে লাগল।
নীলার অবস্থা যে কেমন হবে সেটা বলাবাহুল্য।
সাদিদ তাকে পানি খাইয়ে আবারও মুখ মুছিয়ে দিলো।
নীলা সবটুকু সময় শুধু মাথা নিচু করে রাখল। সাদিদের দিকে তাকালোর মত সাহস সে খোঁজে পাচ্ছে না। কিন্তু বারবার মনে এসে ভিড় জমাচ্ছে কতগুলো প্রশ্ন। যে প্রশ্নের উত্তর সাদিদ ব্যতিত আর কারও পক্ষে হয়তো দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সাদিদ কি দিবে সেই প্রশ্নের উত্তর? নীলার অবুঝ মন বলে দিলে ক্ষতি কি?
কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন মস্তিষ্ক বলে এমনটা চিন্তা করাও পাপ। নীলার আবারও বু্ক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। ভালোবাসা শব্দটাই কষ্টের। কষ্ট ব্যতিত আর কিছুই তাতে আশা করা যায় না।

মেঘেদের যুদ্ধ শুনেছি
সিক্ত আকাশ কেঁদে চলেছে,
জমেছে হাঁসের জলকেলী
পথিকের পায়ে হাঁটা থেমেছে। (২)

আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে,
শ্রাবনের মেঘ গুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে।

শ্রাবনের মেঘগুলো জড়ো হলো আকাশে
অঝরে নামবে বুঝি শ্রাবনেই ঝরায়ে,
আজ কেন মন উদাসী হয়ে
দূর অজানায় চায় হারাতে ..

গানটা শেষ হতেই নীলার আড়চোখে একবার সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ বোতলের শেষ পানিটুকু মুখ লাগিয়ে শেষ করছে।
এই দৃশ্য দেখে নীলার চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সাদিদ তার মুখ লাগানো যায়গায় মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছে বিষয়টা মাথায় যেতেই অজান্তেই নীলার হাত তার ঠোঁটে চলে গেল।
আর এমন সময়ই সাদিদ আবারও নীলার দিকে
তাকালো। নীলাকে ঠোঁটে হাত দিতে দেখেই সে এগিয়ে আসলো।
মাথা নুইয়ে খানিকটা ঝুঁকে ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে নিচুস্বরে বলল,

—- ” ইট’স টেস্ট লাইক সুইট। কিন্তু পানির স্বাদতো এমন হবার কথা নয়। কিছু মিশিয়েছ? নাকি ঠোঁটের মিষ্টি পানিতে দিয়ে দিয়েছ? ”

নীলা সাদিদের এমন কথায় লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। কিসব বলছে সাদিদ? কিন্তু তার এমন কথার অর্থ কি? সাদিদকে বড্ড অদ্ভুত লাগছে নীলার।
ক্রমশ যেন নিজের চারপাশে নতুন বেড়াজাল তৈরি করছে সে। নীলা তাকে একমুহূর্ত বুঝে উঠলেই পরমুহূর্তেই সম্পূর্ণ নতুনরূপে সে ধরা দিচ্ছে। এত অদ্ভুত কেন ছেলেটা?

#চলবে…

[ প্রিয়পাঠক আজকের পর্বের জন্য ব্যবহৃত গানগুলো হচ্ছে,

গানের নামঃ সূর্যস্নানে চল
কন্ঠশিল্পীঃ বাপ্পা মজুমদার

Song Name: Sraboner Meghgulo
Original Song by Different Touch. Different Touch is a Bangladeshi band in the early 1990s
But today I used (New Version) song by Saif Zohan. ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here