গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৪
লিভিংরুমে ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণজনিত অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দু’জন ব্যক্তি ব্যতিত উপস্থিত সবাই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ছোট্ট শাদমানও মাথা ঘুরিয়ে এপাশ-ওপাশে তাকাচ্ছে। সবাইকে এমন চোখ বড় বড় করে রাখতে দেখে, অনুকরণ প্রিয় শাদমান নিজেও চোখ বড় করতে চাইল। কিন্তু সে ঠিকঠাকভাবে করতে পাড়ছে না। তাই সে দুইহাতের আঙ্গুল চোখের নিচে চেপে ধরে বড় চোখ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
নীলা পাশ থেকে ভীতিগ্রস্ত চেহারা নিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। তার চোখের কার্ণিশে ইতিমধ্যে অশ্রুকণার সমাগম ঘটে গিয়েছে। সাদিদ এগিয়ে আসলো তার দিকে। হালকাভাবে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল। সাদিদের ছোঁয়া পেতেই তার কান্নারা এবার বাঁধ ভাঙল। সে মুখ চেপে কান্না আটকানোর দূঢ় প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। সাদিদ এখন কাকে রেখে কাকে সামলাবে? এই নিয়ে দ্বিধাদন্ডে পড়ল। অবশেষে সবকিছুকে ছাপিয়ে সে নীলাকেই বেছে নিলো। কেননা এই মেয়েটার চোখের পানি সাদিদের শরীরে সুচের ন্যায় ফুটছে।
সাদিদ নীলাকে পাশের সোফায় বসিয়ে নিজে হাঁটু ভাজ করে তার সামনে মেঝেতে বসল। পানিভর্তি গ্লাসটা নীলার নিকট এগিয়ে দিলো। নীলা কাঁপা হাতে কয়েক চুমুক পানি খেল। তাকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখে সাদিদ এবার উঠে নীলার পাশে বসল। সবার দিকে তাকাতেই আবারও তাদের চমকিত দৃষ্টি দেখতে পেল। সাদিদ দুইহাতে কপালের চুলগুলো পিছনে ঠেলে বলে উঠল,
— ‘ বিয়েটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। তোমাদের এমন রিয়েক্ট করা স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ওর চোখে পানি সহ্য করতে পাড়ছি না। তাই প্লিজ কিছুতো একটা বলো। ‘
সবাই আবারও একে অপরের দিকে তাকালো। তারা বাকরুদ্ধ হবে না তো কারা হবে?
ছেলের বিয়ে ঠিক করে এসে শুনে মেয়ে-ছেলে নাকি পূর্বেই বিবাহিত দম্পতি। তাদের ভাষার ভান্ডারে শব্দ হারিয়ে যাওয়া তো স্বাভাবিক বিষয়। শাহেদ-ই প্রথমে গলা খানিক কেশে বলে উঠল,
— ‘ আমাদের আর কি বলার আছে? এখানে কিছু বলা যায়? ‘
— ‘ প্লিজ ভাইয়া এমন করে বলো না। তোমাদের তো সবকিছুই খোলে বললাম। ‘
— ‘ হ্যাঁ বলেছিস। কিন্তু বহুত পরে। তোর উপর আমি রাগ করেছি সাদি। এইবার পায়ে ধরলেও মাফ পাবি না। ‘
— ‘ মা তুমিও…
— ‘ চুপ একটা কথাও বলবি না। এখন মুখে খই ফুটছে তাই না? এতদিন এই কথাটা বললে কি এমন ক্ষতি হতো? আমার মেয়েটাকে আরও আগেই নিজের কাছে নিয়ে যেতে পাড়তাম। শুধুমাত্র তোর জন্যই আমি এই খুশি থেকে বঞ্চিত হয়েছি। খুব রাগ করেছি। ‘
শায়লা রহমানের কথা শেষ হতেই হাসিবুর রহমান-শাহেদ আওয়াজ করে হাসতে লাগল। বাবার দেখাদেখি ছোট্ট শাদমানও সামনের ছোট্ট দাঁত দেখিয়ে হাসা শুরু করল। শায়লা রহমানও মুখ ঘুরিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। তাদের এমনভাব দেখে আরিফ মাহমুদের বুক থেকে যেন পাথর নামল। এরিমধ্য উনার মনে নানারকম কু-চিন্তাভাবনা হানা দিচ্ছিল। যায় হয়ে যাক উনি তো হচ্ছেন মেয়ের বাবা। নীলা-সাদিদের এমন একটা ঘটনায় যদি উনারা কষ্ট পেতেন তাহলে তিনি বাবা হয়ে বড্ড অসহায়বোধ করতেন। তাদের এখন হাসিমুখটা দেখে উনার ঠোঁটের কোণায়ও হাসির রেখা ফোটে উঠল। তাকে দেখে নার্গিস খাতুনও চোখের কোণের পানিটা মুছে নিলেন।
মুহূর্তেই যেন এতক্ষণের গুমোট ভাবটা কেটে গেল।
শায়লা রহমান উঠে গিয়ে নীলাকে তার কাছে আনলেন। মুখটা উঁচু করে ধরে ভিজে যাওয়া গালগুলো মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,
— ‘ তোরা তো আমাদের কাজ অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছিস। এখনতো ডাইরেক্ট ছেলের বউ বরণের প্রস্তুতি নিতে হবে। ‘
বলেই তিনি নিজের হাতের পরিহিত স্বর্ণের চুড়িগুলো খোলে নীলার হাতে পরিয়ে দিলো। কপালে চুমু দিয়ে বলল,
— ‘ খুব সুখি-হো। ‘
নীলা আবেগে শায়লা রহমানের বুকে মুখ গোঁজল। সত্যিই সে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেমনটা চিন্তা করেছে তেমন কিছুই হয়নি। তারা যে এতটা সহজভাবে সবকিছু মেনে নিবে সেটা নীলার কল্পনার বাহিরে ছিল।
শাহেদ এসে শক্ত করে সাদিদকে জড়িয়ে ধরল। পিঠ চাপড়ে বলল,
— ‘ আমিতো তোকে ফাস্ট ভাবতাম। কিন্তু তুইতো সেটার ডেফিনেশন চেইঞ্জ করে দিলি। ফাস্টের ফাস্টকে কি বলে? অভার ফাস্ট? ‘
কথাটা বলে শাহেদ নিজেই হাসল। সাদিদ মাথা চুলকে ভাইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে। নার্গিস খাতুন দ্রুত কিচেনে গেলেন। সবার জন্য প্লেটভর্তি মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন। আর কি মনে করে যেন সাথে নীলার বানানো গোলাপজামুন আর চকলেটও নিলেন।
— ‘ এই মুহূর্তে মিষ্টিমুখ না করলে হয়? ‘
— ‘ আপনি আমার মনের কথাটা বললেন বিয়াইন। দেন, আমি আজকে ডাবল খাব। এত বড় খুশির খবর বলে কথা৷ ‘
— ‘ একদম না বাবা৷ তোমার ডায়াবেটিস হাই। ‘
— ‘ তুই চুপ থাক। নিজে বিয়ে করে বসে রয়েছিস, এখন আবার আমার খাবারে ভাগ বসাতে চাইছিস? তুই একটা কথাও বলবি না। ‘
সাদিদ বাবার বাচ্চামো তে মৃদু হাসল। সে বরাবরই বিশ্বাস করে তার পরিবারের মতো পরিবার আর হয় না৷ কিন্তু আজ যেন সবাই সেই বিশ্বাসের ঢাল আরও মজবুত করে দিলো। সে একপলক সবার দিকে তাকালো। এই রকম একটা ঘটনাকে এতটা হাসিখুশি নেবার সাধ্য কয়টা পরিবারের রয়েছে?
সে নীলার দিকেও দৃষ্টি দিলো।
ইশশ সাদিদের বুকটা শীতল হয়ে যাচ্ছে। ছেলেদের ধারণা মেয়েদের অশ্রুমাখা চেহারাতে সবচেয়ে বেশি মায়াবি লাগে। তারসাথে স্নিগ্ধতা এবং সৌন্দর্যতায় পরিপূর্ণ থাকে। বেশিরভাগ প্রেমিক পুরুষকেই এই কথাটি বলতে শোনা যায়। কিন্তু সাদিদের কেন এমনটা অনুভব হয় না? নীলার অশ্রুমাখা চেহারা কেন তার বুকে সুচ ফোটায়? কেন সাদিদ নীলার তখনকার কান্নামিশ্রিত সৌন্দর্যটা উপলব্ধি করতে পারে না?
সাদিদের কাছে এর উত্তর জানা নেই। কেবল জানা সব প্রশ্নের একটাই উত্তর হচ্ছে, অনুরাগ। নীলার জন্য তার অন্তরালের অনুরাগের ফলাফল-ই তার এই ভিন্নতা।
সাদিদের এতক্ষণের ভাবনায় ছেদ ঘটে নার্গিস খাতুনের কথায়,
— ‘ গোলাপজামুনটা তোর বোন আজকে নিজে তৈরি করেছে। ‘
— ‘ তাই নাকি? পিচ্চু আর রান্না! আম্মু আমাকে একটু চিমটি দাওতো। ‘
নীলা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সকলের সামনে মায়ের এমন করে বলাতে তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। সাদিদ লাজলজ্জা ভুলে নিধিকে বলে উঠল,
— ‘ ভাবীমণি চিমটি পরে হবে। আগে আমাকে মিষ্টি দাও। আজ বড্ড মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। ‘
সাদিদের কথায় আবারও লিভিংরুমে একটা হাসির ধুম পড়ল। নীলা একেবারে চুপসে গিয়েছে। এই ছেলেটা এত নির্লজ্জ কেন? সবার সামনে এমন করে কেউ বলে?
নিধি একটু দুষ্টু মনোভাব পোষণ করল। সে গোলাপ জামুনটা না দিয়ে পাশের থেকে স্পঞ্জের মিষ্টিটা সাদিদকে এগিয়ে দিলো।
— ‘ নাও সাদিদ। ইচ্ছে অপূর্ণ থাকতে নেই। ‘
— ‘ এটা না। গোলাপজামুনটা দাও। ‘
— ‘ কেন? এটা কি মিষ্টি না? ‘
— ‘ হয়তো বা মিষ্টি। কিন্তু আমার যে এই মিষ্টিতে হবে না৷ তাই জলদি দাওতো। ‘
— ‘ এই, তুই এমন বেশরম কবে থেকে হলি? ‘
— ‘ তোমার বোধহয় খুব শরম? সবার সামনে কিছু বলব? ‘
শাহেদ হেসে দিয়ে সাদিদের পিঠে জোরে চাপড় দিলো।
— ‘ ফাজিল। ‘
সাদিদও হাসছে। আর তাদের কান্ডে বড়রা ঠোঁট টিপে হাসছে। আর সাথে নিজেরা অন্যদিকে ব্যস্ত হবার ভান করছে। তারা যে এখানে বসে রয়েছে সেদিকে ছেলেগুলোর বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। এতটা ঠোঁটকাটা এগুলো কিভাবে হলো?
নিধি আর সাদিদকে অপেক্ষা করালো না। গোলাপজামুনের প্লেটটা সাদিদের দিকে এগিয়ে দিলো।
সাদিদ মিষ্টি হাতে নিয়েই নীলার মুখের দিকে তাকালো।
সে মাথা নিচু করে বসে থেকে সমানে নিজের দুইহাতের আঙ্গুল মোচড়ামুচড়ি করে যাচ্ছে। জীবনে প্রথম করেছে। তাই টেস্ট কেমন হবে? বা সাদিদের ভালো লাগবে কি-না? নীলা এটা নিয়েই টেনশনে রয়েছে।
অপরদিকে সাদিদ একেবারে পুরো মিষ্টিটাই মুখে পুরে নিয়েছে। তার চোখগুলো অটোমেটিকলি বন্ধ হয়ে গেল।
শাহেদ পাশ থেকে ফোড়ন কাটল,
— ‘ কিরে ঘুমিয়ে গেলি না-কি? ‘
সাদিদ মুখের মিষ্টিটা শেষ করে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আরেকটা মিষ্টি মুখে দিতে দিতে নিধির উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ সরি টু ছে ভাবীমণি, বাট এই সবগুলো গোলাপজামুন আমার লাগবে। তোমরা সবাই বাকি মিষ্টিগুলো খেতে পার। ‘
ইশশ কি নির্লিপ্ত উত্তর। নীলার পক্ষে আর এই লজ্জাহীন ছেলের সামনে বসে থাকা সম্ভব নয়। সে সোফা থেকে উঠে প্রায় দৌড়ে বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো। ইশশ সবাই কি ভাবছে? এসব মনে হতেই লজ্জায় নীলার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে।
অপরদিকে বসার ঘরের সবাই সাদিদের লোকসম্মুখে এমন নির্লজ্জতা দেখে ঠোঁট টিপে সমানে হাসছে৷ আরিফ মাহমুদও নিঃশব্দে হাসছে। কিন্তু তাতে রয়েছে ঢের তৃপ্তি।
সাদিদ যে নীলাকে সীমাহীন ভালোবাসে এটা বুঝার তার আর বাকি নেই। আদরের মেয়ে স্বামীর সাথে সুখে থাকলে মা-বাবা হিসেবে আর কি চাওয়ার থাকে?
নীলার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে শায়লা রহমান বলে উঠলেন,
— ‘ মেয়েটাকে সবার সামনে লজ্জা দিয়ে কি লাভ হলো? দেখলি তো কেমন দৌড়ে চলে গিয়েছে। ‘
সাদিদ মায়ের দিকে তাকিয়ে কেবল হাসল। তারপর আবারও মিষ্টি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কোনো প্রতি উত্তর জানালো না। হাসিবুর রহমান-ই বললেন,
— ‘ তাহলে এখন পরবর্তী কাজ কি? আমরা তো বিয়ে ঠিক করতে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে যে মামলা উল্টো। ‘
— ‘ শাহেদের বাবা, যে যাই বলুক। আমি কিন্তু ছেলের বউকে ঢাকঢোল না বাজিয়ে বরণ করব না। ‘
— ‘ আমরাও তো এমনটাই চাই মা। দুই পরিবার থেকেই এটা শেষ বিয়ে। তাই আয়োজনে কোনো কমতি রাখতে চাই না। ‘
— ‘ আমিও একমত। ‘
— ‘ তাহলে বাড়ির বউকে আমরা ধুমধামে বরণ করে তুলব। কি বলেন মেয়ের মা-বাবা? ‘
— ‘ আমরা আর কি বলব? আপনারা যেমনটা ঠিক মনে করেন। ‘
দুই পরিবারের সম্মিলিত মতামতে সাদিদ এবং নীলার এনগেজমেন্ট সামনের শুক্রবারে ঠিক করা হয়েছে। যেহেতু কেউ তাদের অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিয়েটা জানে না, তাই আপাতত যেচে গিয়ে বলার ইচ্ছেটা পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও দেখা গেল না। তারা পুরনো নিয়মনীতি অনুসারেই তাদের বিয়ের কার্যক্রমটা আবারও সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ করবে। এবং সেটা খুব শীঘ্রই।
__________________
তানহা ঢুলতে ঢুলতে উপর থেকে নিচে নামল৷ ঘুমের ঔষধের এফেক্টটা এখনও যায়নি। তাই সে উঁচু গলায় হাঁক ছাড়ল,
— ‘ ভাবী, একটু কড়া করে ব্ল্যাক কফি দাও। ‘
তানহা মাথা চেপে ধরে রেখেছে। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকালেই ঔষধগুলো খেয়ে নিয়েছিল। এতসময় অতিবাহিত হবার পরও নিধির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তানহা এবার রাগীস্বরে চিল্লিয়ে উঠল,
— ‘ ভাবী, কখন কফির কথা বলেছি। আমার মাথা ব্যাথা করছে। ‘
তানহার রাগী কন্ঠস্বর শুনে মিনু দ্রুত টিভি বন্ধ করে দৌড়ে আসলো। সে স্টার জলসায় ভারতীয় ধারাবাহিক নিয়ে মগ্ন ছিল। দৌড়ে আসাতে সে ক্রমাগত হাঁপাচ্ছে।
— ‘ আফামণি, কিছু কইছিলেন? ‘
— ‘ তোকে না। ভাবীকে বলেছিলাম। কিন্তু তাকে তো দেখতেই পাড়ছি না। তাছাড়া বাড়ি এত নীরব কেন? ‘
— ‘ নিধি ভাবী বাড়িতে না। হে গেছে তার বাপের বাড়ি। সাথে বড় ভাইজান-ছোট ভাইজানসহ খালাম্মা-খালুও গেছে। ‘
— ‘ তা হঠাৎ এমন দলবেঁধে যাওয়ার অর্থ? ‘
— ‘ আফা আপনেরে তো খালাম্মা কতবার কইরা ডাকল। আফনি তো উঠলেন না৷ আফনে ঘুমাইয়া রইছেন বলে খালাম্মা আমারে কইয়া গেছে। ‘
— ‘ কি বলে গিয়েছে। ‘
— ‘ আপনের খাওন গরম কইরা দিতে। ‘
— ‘ সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর কই? বাড়িসুদ্ধ সবাই হঠাৎ একসাথে? ‘
— ‘ আসলে আফামণি…
— ‘ কি আসলে-নকলে? ‘
মিনু ঠোঁট চেপে লাজুক হাসছে। সে লজ্জামাখা কন্ঠে হেলেদুলে বলল,
— ‘ খালাম্মারা ছোট ভাইজানের লগে নীলা আফামণির বিয়ার কথা ঠিক করবার লাইগ্গা গেছে। ‘
— ‘ কি? ‘
তানহা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। সাদিদ আর বিয়ে? তাও আবার নীলার সঙ্গে!
সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পাড়ছে না। অপরদিকে মিনু এতক্ষণ লাজুক হাসলেও এখন চমকিত চোখে তানহার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তানহা তাকে এই পরিস্থিতি থেকে বাহির না করে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। রুমে এসেই সে ধপ করে বিছানায় পড়ল। চোখ-মুখ তার ইতিমধ্যে ফোলে উঠেছে। কান্না করতে করতে তার হেঁচকি উঠে গিয়েছে।
— ‘ কেন সাদি? কেন? আমার ভালোবাসায় কি এমন কমতি ছিল, যার জন্য তোকে নীলাকে বাছাই করতে হয়েছে? কি কমতি ছিল আমার মধ্যে? ‘
একা এই রুমটাতে তার কথার বিপরীতে কোনো উত্তর আসছে না। তানহা বিছানার চাদর খামচে ধরে অনবরত ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কোনো হৃদয়হীন ব্যক্তিও বোধহয় এই কান্না দেখে ঠিক থাকতে পারবে না। ভেতর থেকে ভেঙে ঘুড়িয়ে যাবে। তানহা নিজের ফোনটা হাতে তোলে নিলো। ফোনের ডিসপ্লেতে সাদিদের হাসোজ্জল একটা ছবি। তানহা সেটাতে অগণিত চুমু দিলো। আদরমাখা কন্ঠে বলল,
— ‘ আমার এতো ভালোবাসাও তোর পাথর মনটাকে নাড়াতে পাড়ল না? এতটা নির্দয় তুই? মরে যাচ্ছি সাদি। দেখ, দমটা কেমন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি বাঁচব না সাদি। তোকে ছাড়া বেঁচে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নই। ‘
বলেই তানহা আবারও ফোনের স্ক্রিন দীর্ঘ চুমু দিলো। সাদিদের হাসোজ্জল ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তানহার অশ্রুসিক্ত চোখগুলো ধীরে ধীরে লাল হতে লাগল। এতক্ষণের কান্নারত মায়াবী মুখটা এখন আর নেই৷ সেখানে এসে যেন ভিড় জমিয়েছে ধ্বংসাত্মক চাহনি। যে অগ্নি চাহনির বলে সুন্দর-হাসিখুশি পৃথিবীটা মুহূর্তেই কান্নারজলে স্নান করানো সম্ভব। যেখানে সম্ভব এক আকাশ আনন্দকে পিছু ফেলে, এক সমুদ্র কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার চূড়ান্ত লড়াইয়ে হামাগুড়ি দেওয়া।
___________________
সাদিদরা সবাই নীলাদের বাসা থেকে ডিনার করে বাড়িতে ফিরেছে। ছোট্ট শাদমানের হাতে এখনও নীলার তৈরি চকলেট। সেগুলো সে চেটেপুটে খাচ্ছে। খাবারটা যে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সবার মুখেই হাসি লেগে রয়েছে।
আর সাদিদের অবস্থা তো ভাষায় প্রকাশ করবার মতো নয়। শাদমানকে ঘুষ-টুস দিয়ে সে একটা চকলেট নিয়ে নিয়েছে। বেচারা কেঁদে-কেটে একশেষ। সে নিজের খালামণির বানানো তৈরি চকলেট কাউকে দিবে না। কিন্তু সাদিদের যে এই চকলেট থেকে যেকোনো মূল্যে ভাগ চায়। তাই সে যতসব হাবিজাবি কথা শুনিয়ে চকলেট নিয়ে নিলো৷ আপাতত দু’জনই চকলেট খেতে ব্যস্ত। একজন বাচ্চা হয়ে চকলেট খাচ্ছে। অপরজন যেন বড় হয়েও কাজে বাচ্চা। সাদিদরা হাসিমুখে ভিতরে প্রবেশ করতেই তানহাকে লিভিং এড়িয়াতে পেল। সে তাদেরকে আসতে দেখেই হাতে তালির সাথে এগিয়ে আসছে।
— ‘ বাহ্ বাহ্ বাহ্। খুব চমৎকার দৃশ্য। ‘
সাদিদ ভ্রুজোড়া বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। তানহাকে দেখে তার হাসিমুখটা নিমিষেই গম্ভীরে পরিণত হলো। বাকি সবাইও কিছুটা চমকিতভাব নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। চোখগুলো তার লাল-লাল। সাথে ফোলেও গিয়েছে। শায়লা রহমান দ্রুত এগিয়ে আসলেন। গালে হাত দিয়ে জানতে চাইলেন,
— ‘ কিরে, শরীর খারাপ তোর? মুখটা এমন লাগছে কেন? ‘
— ‘ মামি আ’ম টোটালি ফাইন। ইনফেক্ট এত ভালো যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কিরে সাদি বল, তুইতো ভালো জানিস আমি কতটা ভালো আছি। ‘
সাদিদ এখনও তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে আজকে তানহাকে বাধা দিবে না। আর কতদিন পরিবারকে এর থেকে বাহিরে রাখবে? সত্যটা তো একদিন না একদিন সামনে আসবেই। তাই তানহা যদি এখন নিজেই সেটা প্রকাশ করতে চায় তাহলে সাদিদ আর তাকে বাধা দিবে না। সাদিদ সেই রকম একটা মনোভাব নিয়েই তাকিয়ে রয়েছে।
অপরদিকে সাদিদকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে তানহা হাসতে লাগল। ভাবটা এমন যে খুশিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
সাদিদের কুঁচকে রাখা ভ্রুজোড়া আরও খানিকটা বাঁকা হলো। কি চাচ্ছে এই মেয়ে?
তানহা দৌড়ে এসে সবার সামনেই সাদিদকে জড়িয়ে ধরল। সাদিদ ছাড়ানোর আগেই সে এবার ছেড়ে দিলো। তারপর হাসিমুখেই বলল,
— ‘ কনগ্রচুলেশনস ইয়ার। আ’ম ভেরি হেপি ফর ইউ। ‘
— ‘ হুয়াট ডু ইউ মিন তানহা? ‘
— ‘ এখনও গোপন রাখবি? তুই এতবড় মিথ্যাবাদি কবে থেকে হয়েছিস? নীলাকে পছন্দ করিস আর সেটা আমরা কেউ জানলাম না? ‘
এতক্ষণে বিষয়টা সবার মাথায় এসেছে। আর মুহূর্তেই সাদিদ ব্যতিত সবার মুখে হাসির রেখাটা ফোটে উঠেছে। তানহা আবারও বলল,
— ‘ কিন্তু যাই বল। দিনশেষে হলেও আমি ভীষণ খুশি। আরে বন্ধুর বিয়ে বলে কথা। চুটিয়ে আনন্দ করব। পেট ভরে তোর বিয়ের খাবার খাব। ‘
— ‘ শুধু বন্ধুরটা খেলে হবে? নিজেরটা আমাদের খাওয়াতে হবে না? ফুপি কিন্তু আমাদের কাছে সব বলেছে। রায়ানকে আর কত অপেক্ষা করাবে? ‘
— ‘ আরে ভাবী তুমিও না কিসের মধ্যে কি? এত আনন্দের মতো সেই পানসোটে ছেলেকে কেন আনছ? এখন শুধু মিষ্টি কথাবার্তা হবে। অনলি মিষ্টি। ‘
তানহার কথায় সবাই আরেকদফা হাসলেও সাদিদ পাড়ছে না। বিষয়টা তার কাছে মোটেই ঠিক লাগছে না৷ এ যেন সবার জন্য তৈরি করা সুন্দর এক ছবি। কিন্তু ভেতরটা তার একেবারে নড়বড়ে।
তানহাকে সাদিদের বিয়ে নিয়ে এতটা এক্সাইটেড দেখে না চাইতেও সে খানিকটা চমকিত। তার কেন যেন বিষয়টা তানহা যতটা নরমাল দেখাচ্ছে, ততটা মনে হচ্ছে না। কোথায় যেন একটু কিন্তু রয়েছে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই সাদিদ মাথা ঝাঁকাল। হয়তো তানহার এতদিনের পাগলামির জন্য হঠাৎ করে এমনটা সাদিদকে খানিকটা অবাক করছে। সাদিদ সব নেগেটিভ চিন্তা ছেড়ে পজিটিভটাই বেছে নিলো। এগিয়ে গিয়ে তানহার সামনে দাঁড়াল। মাথায় হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,
— ‘ আ’ম অলসো হেপি ফর ইউ। ‘
সাদিদের কথাটার অর্ন্তনিহিত অর্থ আর কেউ বুঝতে পারুক আর না পারুক, তানহার জন্য সমস্যা হলো না। সেও মিষ্টি হেসে বিপরীত প্রতিক্রিয়া জানাল। সাদিদ হাসিমুখেই সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। তানহা সেদিকে তাকিয়ে হাসছে। আজ যে তার খুশির দিন। বড্ড খুশি। সে না হাসলে হাসবেটা কে?
_______________
এতরাতে ফোনের শব্দে শান্তর কাঁচা ঘুমে ব্যাঘাত ঘটল। সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ রেখেই এলেমেলো হাতড়ে ফোনটা নিলো৷ কোনোভাবে রিসিভ করে বলল,
— ‘ হ্যালো। ‘
— ‘ ______________’
কিন্তু না অপরপাশ থেকে কোনোরকম আওয়াজ আসছে না৷ শান্ত আবারও হ্যালো হ্যালো করে এবার চোখ খোলল৷ অপরিচিত নাম্বার থেকে কল। কিন্তু এতরাতে এমন ফাইজলামি ভালো লাগে?
— ‘ ধুর ছাই। এতরাতে এগুলোর কোনো মানে হয়? ‘
শান্ত রাগ নিয়েই ফোন কেটে দিলো। তারপর আবারও চোখ বন্ধ করল। অপরদিকে ফোনের অপরপাশের ব্যক্তির চোখে ঘুম নেই। তার রাত নির্ঘুম কাটছে।
শান্তর রাগী আওয়াজ শুনে নিজের অজান্তেই তানবীরের মুখে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজের এমন অদ্ভুত ব্যবহারের জন্য সে বিরক্ত হলো। এতরাতে এমনটা করার কোনো মানে হয়? আর সব থেকে বড় কথা সে শান্তকে কল দিলো-ই বা কি জন্য?
মন বলতে চাইলেও তানবীর সেটা শুনতে নারাজ। সে রাগ দেখিয়ে ফোনটা একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলল। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারও নিজের হাতে নিলো। ফোনে খুব বেশি ছবি নেই। কিন্তু তাদের দার্জিলিং ট্রুরের কয়েকটা ছবি রয়েছে। তানবীর গ্যালারী ঘেটে সেইগুলো-ই দেখছে। আর আপনমনে একজনকেই তাতে খোঁজে চলেছে।
অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তির মুখটা ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠতেই তানবীরের মুখে প্রকাশ না করতে চাওয়া টুকরো হাসির রেখা ফোটে উঠল।
সে শান্তর মায়াভরা মুখটার উপর নিজের হাত স্পর্শ করল। ভাবটা এমন যে সে বাস্তবেই শান্তকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত পার হতেই তানবীর সজোরে ফোনটা দেয়ালে আছাড় দিলো। মুহূর্তেই ফোনটা ভেঙে কয়েক টুকরো হলো। আর তার সাথে টুকরো হলো জমানো স্মতিগুলো।
তানবীরের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখটা নিমিষেই লালচে বর্ণে পরিণত হলো। তার শরীরের রগগুলো যেন সব টগবগিয়ে ফোটে উঠল। সে রাগে রীতিমতো ফুঁসছে। হঠাৎ তার এমন অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ কি?
তানবীর রাগ মিশ্রিত গলায় বলে উঠল,
— ‘ সব একরকম, সব। ‘
বলেই বিছানার বালিসগুলো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। চাদর টেনে নিমিষেই পরিপাটি বিছানার বেহাল দশা করল।
নিজের সাথে লড়াই করে ক্লান্ত তানবীর অবশেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। চোখের কার্নিশ তার চিকচিক করছে। সেটা কি অশ্রুকণা? কিন্তু কেন? তানবীরের চোখে জল কেন?
তানবীর আবারও আটকে যাওয়া গলায় বলল,
— ‘ আই জাস্ট হেইট ইউ। ‘
#চলবে…