অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ২৯

0
5888

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ২৯ ❤📯❤

শান্ত গালে হাত দিয়ে ড্যাবড্যাব করে সামনের ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবার সে আর কান্না করল না। ইনফেক্ট বারবার তার সাথে এটা কি হচ্ছে এই নিয়ে সে এখন চমকিত, বিচলিত। সে কেবল বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শান্তর নীরবতার রেশ কাটিয়ে অর্ণব-ই রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ তোমার সাহস হয় কি করে সবকিছু না জেনে-শুনে ওকে এমন করে কথা শুনানোর? ‘

অর্ণবের ধমকে শান্তর হুঁশ ফিরে। কিন্তু তার চোখে-মুখে আবারও কাঠিন্যতা ফুটে উঠল। তার চোখে কেবলমাত্র এখন তানবীরের কষ্টটায় পড়ছে। আর তাকে দেওয়া প্রিয়তীর ধোকা। বাদবাকি জিনিসে আপাতত তার নজর নেই। তাই সে দমে না গিয়ে উল্টো রাগীস্বরেই বলল,

— ‘ ভাইয়া, আপনি সব জেনেও এমনটা বলতে পাড়ছেন? ‘
— ‘ সব জানি বিধায়-ই এমনটা বলতে বাধ্য হচ্ছি। ‘
— ‘ কিভাবে ভাইয়া! উনাকে না আপনি নিজের ভাই সমতুল্য মনে করেন। তাহলে সবকিছু জেনেও দিদিভাইয়ের সাথে এতটা স্বাভাবিক কিভাবে? নাকি শুধু নামেই উনি আপনার বন্ধু? যার জন্য তার কষ্টে ব্যথিত না হয়ে উল্টো অপরাধীর হয়ে আমাকে কথা শুনাচ্ছেন? ‘

শান্তর অবিশ্বাস্য চাহনি আর তানবীরের কষ্টে তার চোখে-মুখে রাগের আভাস দেখে অর্ণব কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
সে যা বুঝার বুঝে গিয়েছে। এতদিন তানবীরের ক্ষেত্রে ক্লিয়ার থাকলেও আজ শান্তর দিক দিয়েও সে ক্লিয়ার। তার এতক্ষণের সব রাগ মুছে গিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। সে যেটা অনুমান করেছে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে তার থেকে বেশি খুশি আর কে হবে?
সে হাসি মুখে শান্তর দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ যে গালে থাপ্পড় দিয়েছিল সেই গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,

— ‘ খুব বেশি লেগেছে? ‘

শান্তর বোধহয় আজ অবাক হবার-ই দিন। নতুবা এতক্ষণ অর্ণব রাগী স্বরে কথা বলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তার আবার কি হলো?
শান্তকে নিশ্চুপ দেখে অর্ণব-ই আবার বলল,

— ‘ আমাকে তো ভাইয়া বলে ডাক। বড় ভাইয়ের ছোট্ট একটা শাসনে রাগ করে থাকবে? ‘

উপস্থিত সবাই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ব্যক্তি বলতে প্রিয়তী আর শান্ত। তারউপর নতুন করে যুক্ত হয়েছে সাদিদ আর নীলা। তারা অর্ণবের রাগী কন্ঠস্বর শুনে এদিকে এসেছে। কিন্তু এসে তো তারাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হচ্ছেটা কি এখানে?

— ‘ কিরে অর্ণব? তোর আবার কি হয়েছে? ‘
— ‘ ছোট একটা ভুলের জন্য এই ছোট্ট বোনটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ‘

কথাটুকু বলেই অর্ণব স্নেহভরা চাহনি নিয়ে শান্তকে একপাশ থেকে হালকা করে জড়িয়ে ধরল। গালে হাত রেখেই আদুরে গলায় বলল,

— ‘ ভাইয়ার ভুল হয়ে গিয়েছে। তোমার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা না করে পূর্বেই আঘাত করেছি। ভাইয়াকে মাফ করা যায় না? ‘

শান্ত নিজেই এবার অর্ণবকে জড়িয়ে ধরল। তার নিজের মায়ের পেটের কোনো ভাই নেই। দুইবোনের মধ্যে সে ছোট্ট। কিন্তু একটা ভাইয়ের অভাব সে বরাবরই অনুভব করে গিয়েছে। আজ অর্ণবকে এতটা মায়া নিয়ে কাছে টানতে দেখে সে নিজেকে সামলাতে পাড়ল না৷ কিছুক্ষণ আগের সবকিছু ভুলে গিয়ে সে এখন ভাইয়ের স্নেহ নিতে ব্যস্ত। চোখগুলো তার অশ্রুসিক্ত। কিন্তু তাতে রয়েছে ঢের মায়ার ও খুশির ছাপ।
তাদেরকে ঘিরে আশেপাশের কেউ কিছু না বুঝলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তার বেশ আনন্দিত। অর্ণবের খুশির দেখে প্রিয়তীর ঠোঁটের কেণেও এবার হাসির রেখা দেখা গেল।
ভাই-বোনের স্নেহ-মমতার অবসান ঘটছে না দেখে সাদিদ এবার অধৈর্য্য গলায় বলে উঠল,

— ‘ এবার কিছু বলবি? সবতো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ‘

অর্ণব শান্তকে একহাতে স্নেহের সাথে জড়িয়ে নিয়েই সাদিদের প্রশ্নের এক-এক করে উত্তর দিতে লাগল।
শান্ত বেচারির লজ্জায় গাল টমেটো হয়ে উঠেছে। নিজের বোকামির জন্য এখনই মাটির নিচে চলে যেতে প্রবল ইচ্ছা জাগছে তার। অর্ণবের কথার প্রথমদিকে সবার চমকিত দৃষ্টি থাকলেও এবার তারা ঠোঁট টিপে হাসছে। প্রিয়তীও তাদের মধ্যে সামিল হয়েছে। ছোটরা ভুল করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বড় হয়ে যদি ভুলগুলো ক্ষমা না করতে পারে তাহলে কি করে হয়?
প্রিয়তী হাসিমুখেই তাদের দিকে এগিয়ে এলো। নিজেও শান্তকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে দুষ্টুমিস্বরে বলল,

— ‘ তাহলে তলে তলে এতদূর? আশিকের জন্য কিছু না জেনেই যুদ্ধে লেগে গিয়েছ! বাহ্বা প্রেম তো দেখি উতলে পড়ছে। ‘

শান্ত এবার লজ্জার সাথে অবাকও হলো। আশিক! উভয় অনুভূতির সংমিশ্রণে সে নতজানু হয়ে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ কিসব বলছ দিদিভাই? এমন কিছুই নয়। আমিতো এমনিতেই..
— ‘ হয়েছে, হয়েছে। আর লুকাতে হবে না। আমরাও প্রেমের বিয়ে করছি। এক্সপেরিয়েন্স নিয়ে আমাকে বলতে হবে না৷ এসবের গন্ধ শুকলেই পুরো ব্যাপার বুঝতে পারি। ‘

শান্ত আপাতত নীরবতাকেই ঠিকঠাক মনে করল। নতুবা কথা বললেই উল্টো লজ্জা দিবে তারা। নীলা এতক্ষণ চুপচাপ সবকিছু শুনলেও এবার এগিয়ে আসলো। কিছুটা অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,

— ‘ খুব তো নিজেকে আইনস্টাইন দাবী করিস। এই তোর আইন্সটাইনগিরি? দিদিভাই যে তোকে থাপ্পড় দেয়নি এটাই তো অনেক। কপাল ভালো তাই শুধু একটা খেয়েছিস। ‘
— ‘ একটা নয় দুই দুইটা। ‘

শান্তর ফিসফিসিয়ে বলা কথাটা নিজের মনেই রয়ে গেল৷ কিন্তু পাশ থেকে অর্ণব দুঃখভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ প্লিজ নীলা, এই নিয়ে আর বলো না৷ এমনিতেই আমার বড্ড খারাপ লাগছে। তখন যে কি হয়ে গিয়েছিল! শান্তকে প্রিয়তীর সাথে বিনা কারণে এমন ব্যবহার করতে দেখে..
— ‘ ভাইয়া থাক না এসব। আমি কিছু মনে করিনি। নিজেই তো বললেন বড় ভাইয়া হন। তাই ছোটদের উপর সব অধিকার রয়েছে। আবারও দিলে খারাপ লাগবে না৷ ‘

অর্ণব সত্যি সত্যিই হাত উঠাল। কিন্তু শান্তকে আঘাত না করে বরং তার গালটা জোরে টেনে দিলো। শান্ত গাল ঘষে হাসছে। পাশ থেকে প্রিয়তী আপসোসভরা কন্ঠে বলল,

— ‘ আজকে তাহলে বুঝতে পাড়লাম এই বাঁদরটার আমাকে নিয়ে এতো প্রবলেম কেন ছিল। এতদিনতো রাগ হতো। কিন্তু আজ সবকিছু জানার পর খারাপ লাগছে৷ আমি আরও কতটা রাগারাগি করতাম। ‘
— ‘ সরি প্রিয়ু। বিষয়টা তানবীরের ব্যক্তিগত ছিল৷ আর তার পছন্দ ছিল না এটা নিয়ে অন্য কাউকে জানানো। তাই আমি আর সাদি কখনও আমাদের বাহিরে বিষয়টাকে যেতে দেয়নি। তাই তোমাকেও বলা হয়নি। কিন্তু আজ এতসব ঘটে গেল যে সবার সামনেই চলে এসেছে৷ ‘
— ‘ আচ্ছা মন খারাপ করো না। আমরাই তো। তানবীর যেহেতু চায় না তাই এই গুটিকয়েক সদস্য ব্যতিত আর কারো কানে কথাটা যাবে না। ‘
— ‘ হ্যাঁ ভাইয়া। আপনারা চিন্তা মুক্ত থাকুন। আমরা কখনও এটা নিয়ে তানবীর ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলব না৷ ‘

নীলার কথায় অর্ণব মৃদু হাসল। সে নিজেও জানে তারা সকলে অপরের ব্যক্তিগত লাইফ নিয়ে কতটা কেয়ারফুল। কিন্তু তারপরও খারাপ লাগার কারণ হচ্ছে তানবীর। সে চায়নি কখনও বিষয়টা তাদের তিনজন ব্যতিত অপর কেউ জানুক। কিন্তু আজ?
অর্ণবের মন মানসিকতা বুঝতে পেরে সাদিদ তার দিকে এগিয়ে আসলো। কাঁধে হাত রেখে বলল,

— ‘ ইট’স ওকে অর্ণব। ডোন্ট থিংক এভাউট দিস। লেট ভায়গন্স বি ভায়গন্স। ‘
— ‘ এতটা ইজি? তানবীর…
— ‘ কিছু মনে করবে না। আর সব থেকে বড় কথা তুই এটা জানিয়ে বরং উপকার-ই করেছিস৷ তাকিয়ে দেখ শান্তকে? কিছু বুঝতে পাড়ছিস? ‘

অর্ণব শান্তর দিকে একপলক তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসল। তারপর সাদিদের দিকে দৃষ্টি রেখে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠল,

— ‘ হুম বেশ বুঝতে পাড়ছি। আর বিশ্বাসও করছি যে আমার ভাইয়ের এলোমেলো জীবনটাকে গুছিয়ে দিতে কেউ নিজ দায়িত্বে এসেছে। এবং আমার বিশ্বাস সে পারবে। ‘
— ‘ আমারও বিশ্বাস। তাকে যে পাড়তেই হবে। ‘

সাদিদ কথাটুকু বলে আবারও শান্তর দিকে একপলক তাকালো। এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ কিছু প্রয়োজন হলে অবশ্যই জিজুকে জানাবে। তোমার বান্ধবী সঙ্গে থাকুক আর নাই থাকুক জিজু কিন্তু অবশ্যই আছি এবং থাকব। ‘

নীলার কর্ণকোহরে সাদিদের খোঁচা দেওয়া কথাটা পৌঁছাতেই সে তেড়ে আসলো। শান্তকে একপ্রকার টেনে নিজের কাছে সরিয়ে এনে ক্ষেপাস্বরে বলল,

— ‘ এহ্ আসছে আমার জিজুওয়ালা। যাকে দিয়ে সম্পর্কের ভিত্তি তাকেই বাদ দেওয়া হচ্ছে। যান, যান নিজের রাস্তা মাপেন৷ আমার বোনের সঙ্গে আমি সর্বদা ছিলাম আর ভবিষ্যতেও থাকব। ‘
— ‘ এমন ভাবসাব দেখাচ্ছ যেন বোনটা তোমার একার? সে আমারও বোন। ‘
— ‘ আপনার হবে পরে। সে আমার বেস্টু। ‘
— ‘ তাহলে সে আমার বউয়ের বেস্টু। ‘

সাদিদের কথায় নীলা কিছুটা থতমত খেল। আর শান্ত বেচারি লজ্জায় শেষ। তাদের বলা কথাগুলোর অর্থ বুঝতে তার একটুও সমস্যা হয়নি। সবাই এখনই কিসব ভাবছে? ইশশ শান্ত লজ্জায় দৌড়ে জায়গা প্রস্থান করল। নীলা এতক্ষণ বুঝে উঠতে না পাড়লেও এবার সম্পূর্ণ কথা বুঝতে পেরে মেকি রাগ দেখিয়ে সাদিদের বাহুতে কিল বসাল। অপরদিকে মারের বদলে নীলার নরম হাতের আদর খেয়ে সাদিদ হাসছে।
প্রিয়তী অর্ণবের মুখেও হাসির রেখা। যাক অবশেষে ভালো ভাবেই ঝামেলাটা মিটে গেল। আর তানবীরকে নিয়েও আপাতত ভাবতে হচ্ছে না তাদের। কেননা তারা সকলেই অবগত যে তাকে নিয়ে ভাবার মানুষ চলে এসেছে। আর তাকে সামলে নেবারও। যদি তার রাগ থাকে তাহলে সেটার পরিবর্তে অপরজনের অপ্রকাশিত ভালোবাসাও বিদ্যামান রয়েছে। আর ধরণীর বুকে এমন কি আছে, যার জোর ভালোবাসার চেয়েও বেশি?

________________________

এখনও বাহিরে বেশ অন্ধকার। কিন্তু রিসোর্টের পরিবেশ ভীষণ জমজমাট। মনে হচ্ছে মাত্রই সন্ধ্যা নেমেছে৷ কিন্তু ঘড়িতে সময় এখন তিনটে বেজে একুশ মিনিট। প্রিয়তীর সাজসজ্জা অলমোস্ট কমপ্লিট। লগ্নের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তাই বড়রা এবার জলদি তাড়া দিচ্ছেন। পার্লারের মেয়েগুলোও নিজেদের পারদর্শীতা দেখিয়ে ক্রমাগত হাত চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়তীর শরীরে লাল রঙের টুকটুকে ভারি বেনারসি শাড়ি। তার সঙ্গে দেহবর্তী স্বর্ণের অলংকার আর বিয়ের কনের সাজে তার থেকে চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়েছে। এটা নিয়েও ভাবীগণ, সমবয়সীরা তাকে বারবার লজ্জায় ফেলছে। অর্ণব আর তাকে জড়িয়ে কতশত হাবিজাবি কথা! ইশশ কি লজ্জা।
তার সাথে সাথে বাকি মেয়েরাও নিজেদের গোছগাছ করে নিয়েছে।
নীলা আজকেও চুড়িদার পরেছিল। কিন্তু প্রিয়তীর ভাবী জোর করে তাকে এবং শান্তকে শাড়ি পরতে বাধ্য করেছে। তাই আপাতত এই দুইজনই রেডি হবার জন্য বাকি। কিন্তু তারাও দ্রুত তৈরি হচ্ছে।

অপরদিকে অর্ণবকেও তার ভাই এবং বন্ধুগণ মিলে অনবরত টিজ করে যাচ্ছে। আর সে মুখটিপে নিঃশব্দে হাসছে। কিন্তু অন্যদিনের ন্যায় জবাব কিংবা মারামারিতে নেই।
তানবীরও এখানে রয়েছে। কিন্তু সে আসতে রাজি হচ্ছিল না। অর্ণব আর সাদিদ গিয়ে তাকে একপ্রকার টেনে হিঁচড়ে বিছানা ছাড়িয়েছে। অবশেষে ঠেলেঠুলে রেডি পর্যন্ত করে নিয়েছে। তাই সে এখন রাগ মিশ্রিত চোখে তাদের কান্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে। সাদিদ-অর্ণব তাকে খেয়াল করেছে। কিন্তু তারা একপ্রকার দেখেও অদেখা করছে। সবসময় তার কথামতো এতো চলা যাবে না৷ কিছুক্ষেত্রে সম্পর্কের অধিকার খাটানো একান্ত বাধ্যগত হয়ে পড়ে। এখানেও তাই হচ্ছে।

— ‘ সাদিদ, তোমরা কিন্তু কাজটা ঠিক করলে না। আমরা সবাই পাঞ্জাবি-ধুতি পরেছি। কিন্তু তুমি আর তানবীর মাঝ দিয়ে ভিন্ন। ‘
— ‘ দাদা, প্লিজ এটা নিয়ে আর জোর করো না। নতুবা বিয়ে বাড়িতে মানসম্মান নিয়ে টানাটানি লাগবে। আমাদের এসবে অভ্যাস নেই। তার চেয়ে বরং জিন্স-ই ঠিক আছে। ‘

কথাটুকু হাসি মুখে বলেই সাদিদ গুমরামুখো তানবীরের দিকে দৃষ্টি দিলো। সে অনেকক্ষণ যাবত তানবীরের দুষ্টুৃমিগুলো মিস করছে। তাই এবার তাকে একটু খেপানো যাক।

— ‘ আমি নিজেরটা বললাম৷ তানবীরকে বলে দেখতে পারো। সে বোধহয় ধুতি পরতে ইচ্ছুক। ‘
— ‘ শালা, বাতাসের যন্ত্রণায় আমি লুঙ্গি পরি না। আর তুই আমাকে ধুতি পরতে কস? সর সামনে থাইক্কা৷ ‘
— ‘ একি তানবীর, তুমি দেখি উল্টো। সবাইতো আরামসে বায়ু প্রবাহের জন্য লুঙ্গিকেই ফাস্ট প্রায়োরোটি দেয়। আর তুমি কি-না পরো-ই না? ‘
— ‘ জ্বি, পরি না। আর না পরার ইচ্ছে আছে৷ নতুবা বেশি বায়ু প্রবাহের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পরে আবার সম্পূর্ণ বায়ু প্রবাহের রাস্তা তৈরি হয়ে যাবে৷ ‘

তানবীরের কথায় বিপ্লব দাদা সহ মোটামোটি সবাই হাসিতে ফেটে পড়েছে। বাঙালি পুরুষ জাতির ঐতিহ্য লুঙ্গিকে নিয়ে তানবীরের এমন মতবাদ সত্যিই তাদের জন্য হাস্যকর।
সাদিদও হাসছে। যাক অবশেষে তাকে কথা তো বলানো গিয়েছে। নতুবা রাত থেকে পুরোপুরি মুখ আটকে বসে ছিল। যেন কথা বললেই কেউ তার গর্দান নিবে

_________________

বর বরণের প্রস্তুতি চলছে। যদিও বর-কনে একই স্থানে রয়েছে তারপরও পরিবারের সবাই বিয়ের সব নিয়ম-নীতি মেনে চলছে৷ তাই অর্ণবকে এখন প্রিয়তীর মা বরণ ডালা সাজিয়ে বরণ করছেন। নিজের একমাত্র জামাতাকে থালায় প্রদীপ, ধান দুর্বা, ফুল এবং অন্যান্য বরণ সামগ্রী নিয়ে তিনি বরণে ব্যস্ত। পাশ থেকে অনেকের কন্ঠে শঙ্খের আওয়াজ এবং ওলুর ধ্বনি ভেসে আসছে৷ একপাশে সানাই, ঢুল আর তবলাও বেজে চলেছে। বরণের সব কার্যক্রম শেষে অর্ণবকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো।
এরপর প্রিয়তীর বাবা পঙ্কজ সেন অর্ণবকে পট্টবস্ত্রসম্পাদন করল। অর্ণব সেটা পরে নিয়ে ছাঁদনাতলাতে বসল। পুরোহিত মহাশয় একধ্যানে বিয়ের মন্ত্র পাঠ করছেন।

অর্ণবের ভীষণ অস্থির লাগছে। প্রেম চলাকালে প্রিয়তীর জন্য সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে গিয়েছে। কিন্তু কখনও নিজেকে এতটা অস্থির লাগেনি৷ কিন্তু আজ লাগছে৷ মারাত্মক অস্থির। আর হবে নাই বা কেন? এতদিনতো প্রেমিকা ছিল। কিন্তু আজ থেকে যে সম্পর্কের নাম বাড়ছে, সাথে পাল্লাও। আর নিজের বউয়ের জন্য অস্থির হওয়া যে এককথায় বাধ্যতামূলক।
অবশেষে অস্থিরতার ক্লান্ত অপেক্ষার প্রহর কাটিয়ে কনেকে ছাঁদনাতলায় আনা হচ্ছে। প্রিয়তীর মুখ পান পাতা দিয়ে ঢাকা। বড় দাদারা তার পিঁড়ি ধরে রেখেছে। তাকে অর্ণবের চারপাশে সাতপাক দিয়ে শুভদৃষ্টির জন্য মুখোমুখি করা হয়েছে।

সাদিদও রীতিমতো অস্থির হয়ে পড়েছে। মেয়েটা গেল কোথায়? সবাই এসে পড়েছে অথচ তার দেখা নেই৷ নিজের অস্থিরতা চেপে না রাখতে পেরে সে সামনে যাবার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু যেতে আর পাড়ল না। তার পা-গুলো জায়গাতেই স্থির হলো।
সাদিদ নিজের বুকের বামপাশে হাত রাখল। বুকটা এতো জোরে জোরে ধকধক করছে যেন এখন-ই বেড়িয়ে আসতে চায়। সাদিদ বারকয়েক শুকনো ঢুক গিলল।
সিঁদুর লাল কাঞ্জীভরম শাড়ির পুরো আঁচল আর বর্ডারটা যেন এক ফুটন্ত রক্তজবা। তারসাথে পুরোটা জোরে সাদা আর গোল্ডেনের কারুকার্যের বাহার। গলায় আর কানে শাড়ির সাথে মিলিয়ে হালকা গহনা। দুইহাতে লাল-গ্লোডেনের কাচের চুড়ি। দূর থেকে নীলার হাত নাড়ানো দেখে বুঝা যাচ্ছে যে হাতগুলোও তার আজ আলতায় রাঙানো রয়েছে। টকটকে লালরঙা ঠোঁটে খোলা চুলগুলো বাতাশে মৃদু উড়িয়ে সাদিদের দিকেই সে ক্রমশ এগিয়ে আসছে। নীলাকে সাদিদের কাছে আজ পুরোপুরি প্রাণনাশিনী মনে হচ্ছে। যে ক্রমশ তার প্রাণটা শুষে নিচ্ছে।
কিন্তু কারো যে ঘোরলাগা দৃষ্টি নীলার পুরোটা শরীরজুড়ে বিচরণ করছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। সে শাড়ি সামলিয়ে শান্তর সাথে কথা বলতে বলতে আসছে।
ইতিমধ্যে প্রিয়তী মুখ থেকে পানপাতাটা সরিয়ে নিয়েছে। অর্ণব মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার এই কনে রূপ দেখে যাচ্ছে। প্রিয়তীও অর্ণবের এই বরবেশের রূপ দেখে মৃদু হাসল। ইশশ তাদের কত সাধনার ফল আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে।
শুভদৃষ্টির পর মালাবদল হলো। তারপর প্রিয়তীকে এনে অর্ণবের পাশে পিঁড়িতে বসতে দেওয়া হলো। পুরোহিত মহাশয় এবার বিয়ের পরবর্তী কাজে অগ্রসর হলেন।
নীলার এতক্ষণ সাদিদের দিকে নজর না গেলেও এবার হঠাৎ করেই পড়ল। বিয়ের আমেজে তার মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলছিল। কিন্তু এখন সেটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল।
এবার সেও একটা শুকনো ঢুক গিলল। সাদিদ একদৃষ্টিতে তার দিকেই ঘোরলাগা চোখে তাকিয়ে রয়েছে। চোখে যেন তার উপচে পড়া নেশা৷ নীলা সেই নেশার ঔষধ সম্পর্কে অবগত তাই তার এতোটা ভয়।
সে জলদি সাদিদের থেকে দৃষ্টি নত করল। এখন তার প্রিয়তীর ভাবীর উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। তার জন্যই নীলা এই ভয়ংকর বিপদে এসে পড়ল। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তাকে জোর করে শাড়ি পড়তে বাধ্য করেছে। তার উপর আবার এই সাজ। নীলা ভয়ার্ত চোখে আবারও সাদিদের দিকে আড়চোখে তাকালো। সে এখনও নীলার দিকেই একধ্যানে তাকিয়ে রয়েছে।
দৃষ্টির কোনো নড়চড় নেই।

শান্তও সেই কখন থেকে একদৃষ্টিতে তানবীরকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে৷ অথচ তানবীরকে একবারও এদিকে তাকাতে দেখেনি৷ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে রাগ এখনও তার মাথায় চেপে আছে।
রিয়াদ এসে শান্তর পাশে দাঁড়াতেই সে একটু দূরে সরে গেল। আর দ্রুত আড়চোখে তানবীরের দিকে তাকালো। এবার তানবীরও তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে।
সে প্রথম থেকেই শান্তকে দেখে চলেছে। রাগ থাকলেও মুগ্ধতা যে তাকে হার মানতে বাধ্য করেছে। শান্তও আজ শাড়ি পরেছে। নীলার মতো সেও কাঞ্জীভরম শাড়ি পরেছে। কিন্তু কালারটা ভিন্ন। সবুজের মধ্যে গোল্ডেন আর সাদার কারুকাজ। তানবীরের বড্ড ইচ্ছা জাগছে সব রাগ-ক্ষোভ দূরে সরিয়ে শান্তকে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু সে পাড়ছে না৷ মাঝদিয়ে কিসের যেন এক দায়বদ্ধতা।
কিন্তু এখন রিয়াদকে আবারও তার পাশে ঘেষতে দেখে তার কপাল বিরক্তি এবং রাগ উভয় সংমিশ্রণে কুঁচকে এলো। সন্ধ্যায় না এই ছেলে এতো মার খেল। এরিমধ্য সব ভুলে গিয়েছে!
তানবীরকে আবারও রেগে যেতে দেখে শান্ত এবার অপরপাশে গিয়ে নীলার সাথে একেবারে চেপে দাঁড়াল। রিয়াদ বেচারা থতমত খেয়ে গেল। হঠাৎ করে শান্তর আবার কি হলো? এমন পালিয়ে গেল কেন?
অপরদিকে তানবীর প্রকাশ করতে চায়ছে না। কিন্তু তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফোটে উঠল।

একে একে কন্যাদান সম্প্রদান, সাতপাক, অঞ্জলিসম্পাদনা হয়ে গেল। এবার হচ্ছে সিঁদুর দানের পালা। অর্ণবের হাতে সিঁদুর কৌটা দেখতেই প্রিয়তীর চোখে জলের আভাস দেখা গেল। এটা কি সুখের না দুঃখের এই মুহূর্তে বুঝা দায়। কিন্তু সিঁথিতে অর্ণবের হাতের সিঁদুর লেপন হতেই প্রিয়তী নিজের আঁখিদ্বয় বন্ধ করে নিলো। আর গাল বেয়ে মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়ল জীবনের অতিব প্রত্যাশিত কিছু লাভের সুখের অশ্রুকণা।
সিঁদুর দানের পরপরই প্রিয়তীর মাথা অর্ণবদের পরিবারের দেওয়া নতুন শাড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। এটিকে ঘোমটা বা লজ্জা বস্ত্র বলা হয়।
অবশেষে আজ থেকে নিজেদের নামের সাথে সারা জীবনের জন্য আরেকটি নাম জড়িয়ে গেল। দুইজনে বাঁধা পড়ল শক্ত এক বন্ধনে। প্রেমের জীবন থেকে দাম্পত্যময় জীবনের শুভসূচনা যেন আজকে এই ছাঁদনাতলা থেকেই শুরু।

#চলবে…

[ পাঠকগণ আপনাদের পাঠপ্রতিক্রিয়াগুলো আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের ভালোলাগা-মন্দলাগাগুলো জানতে আগ্রহী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here