অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৩২

0
5689

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩২

শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফিরবার জন্য তারা বাস জার্নিকেই বেছে নিয়েছে। এবারের সবকিছুই সবার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। আর নতুন তো সবকিছুকেই আরও মধুর করে তোলে। তাহলে সেখানে নতুন সম্পর্কের শুভলগ্নে হোক না সবকিছু নতুনভাবে। ক্ষতি কি তাতে?
সবার সুবিধার জন্য একটা বড় দুটো এসি বাস রিজার্ভ করা হয়েছে। দুইপরিবারের সবাই একএক করে বাসের সিটে গিয়ে বসতে লাগল। প্রিয়তী অর্ণবও পিছনের সারির একটা সিটে বসেছে। স্বাভাবিকভাবেই নতুন বিবাহিত দম্পতির প্রাইভেসির জন্য একটু আলাদা জায়গা চায়। তাই আগেভাগেই নিজেদের সুবিধামতো তারা বসে পড়ল। নীলা সাদিদও প্রিয়তী অর্ণবদের সাথে একি বাসে উঠল। তারাও বাসের একেবারে শেষ সিটের একটিতে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করেছে। গুটিকয়েক সদস্য তাদেরকে আড়চোখে দেখলেও পরমুহূর্তেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হলো। কেননা দুইজনের আংটিবদলের কথাটা ইতিমধ্যে সবার কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছে।
শান্তও সবার পিছু পিছু হেলতে দুলতে এগিয়ে আসলো। নীলাদের সামনের সিটটিতে সে খুব আয়েশ করে দখল করল। গতরাতের সবকিছুকে ভুলে প্রিয়বন্ধুর সাথে লম্বা জার্নিটা এনজয় করতে রিয়াদও হাসিমুখে তার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই বাধঁল বিপত্তি। আসার দিনকার মতো এবার আর তানবীর নিজেকে গুটিয়ে রাখল না। বরং পিছন থেকে হুড়মুড়িয়ে এসে মৃদু ধাক্কায় রিয়াদকে পাশের সিটে ফেলে দিয়ে সে শান্তর পাশের সিটটি দখল করল। আচমকা তার এমন আক্রমণে রিয়াদসহ সবাই মোটামোটি ভরকে যায়। কিন্তু তানবীর একেবারে স্বাভাবিক। যেন একটু আগে কিছুই হয়নি৷ রিয়াদ নিজেকে ধাতস্থ করে খানিকটা রাগ দেখিয়ে বলল,

— ‘ এসব কি অভদ্রতা? এমন করে ধাক্কা দেবার কি মানে? ‘
— ‘ ধাক্কা কবে দিলাম৷ আমি আসছিলাম তোমার সাথে কাঁধ লাগল। আর নিজেকে সামলাতে না পেরে তুমি পড়ে গিয়েছ। এখানে আমার কি করার আছে? ‘
— ‘ একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনি আমাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছেন। ‘
— ‘ ওহ্ তাই বুঝি? এমনটা তোমার মনে হচ্ছে? আমিতো এমনটা ভাবছি না। তুমি এমনটা মনে করলে আমার সেখানে কিছুই করার নেই৷ ‘

শেষ৷ তার বাক্যটুকু সমাপ্ত করে সে আবারও সিটে গা এলিয়ে দিলো৷ শান্তশিষ্ট পরিবেশটাকে মুহূর্তেই গুমোট করে দিয়ে সে আয়েশ করে আড়মোড়া ভাঙল। শান্ত পাশ থেকে ভয়াতুর চোখে শুকনো ঢুক গিলছে৷ তার একটাই ভয় আবার যেন কোনো ঝামেলা না হয়। বড়দের নজর এখনও তাদের উপর পরেনি। তাই সবকিছু যেন স্বাভাবিকভাবে শেষ হয় সে শুধু মনে প্রাণে এই কামনাই করে যাচ্ছে।
তানবীর পূর্বেকার ন্যায় ভীষণ শান্তভাবে চোখ বন্ধ করতেই এবার পাশ থেকে রিয়াদ আবারও ক্ষেপা স্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমি ওর পাশে বসব। আপনি দয়া করে আরেকটা সিটে গিয়ে বসুন। ‘

তানবীর সাথে সাথেই চোখ খোলল। নির্বাক। কিন্তু চোখগুলো রক্তলাল। এতক্ষণের সব শিষ্টতার পাঠ চুকিয়ে সে এবার নিজস্ব ক্যারেকটারে ফিরে আসলো।

— ‘ শুনিনি কি বললি? আবার বল? ‘

রিয়াদ কিছুটা হকচকিয়ে গেল। তারপরও পূনরায় বাক্যটা রিপিট করতেই তানবীর রাগিস্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ তোর কথাতেই নাকি? আমি উঠব না এই সিট থেকে। তোর যা খুশি কর গিয়া। ‘

রিয়াদ বুঝতে পারল এই ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে কথা বললেই ঝামেলা বাঁধাবে। আর সে এখন ভালো মুডটা তার সাথে ঝগড়ায় খারাপ করতে চায় না৷ তাই শান্তকেই বলল,

— ‘ এই তুই উঠ। এখানে বসতে হবে না৷ আমরা পিছনে গিয়ে বসব। ‘

শান্তর গলায় এবার কাটা বেঁধে যাবার অবস্থা। এই ছেলের কি মাথা খারাপ? কার সামনে কি বলছে?
তাকে উঠতে না দেখে রিয়াদ আবারও বলল,

— ‘ এই, উঠছিস না কেন? জলদি উঠ। ‘

তানবীর রিয়াদকে কিছু না বলে শান্তর দিকে তাকালো। মুখে উপচে পরা হাসি ফুটিয়ে বলল,

— ‘ যাবে? যাও৷ ‘

শান্ত ঢুক গিলল। সে নিশ্চিত এটা ঝড়ের পূর্বাবাস। সে শুধু ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে না জানাল। তানবীরের ঠোঁটের কোণের হাসি বিস্তৃত হলেও পাশের জনের তীক্ষ্ণ স্বরে সেটা মিলিয়ে গেল।

— ‘ মানে কি? এই লোকের সাথে তুই কেন বসবি? আমার রাগ তুলবি না শান্ত৷ উঠে আয়৷ ‘

বাক্যটুকু সমাপ্ত করেই সে এবার কিছুটা এগিয়ে এসে তানবীরের উপর দিয়েই শান্তর হাতটা চেপে ধরল। বিষয়টা দ্রুতটায় ঘটেছে বিধায় শান্ত – তানবীর সেটা আঁচ করতে পারেনি৷ কিন্তু এই মুহূর্তে রিয়াদের দ্বিতীয় বাক্য শুরু করার পূর্বেই সে সজোরে আবারও এক ধাক্কা খেল। রাগী তানবীর বেশ জোরেই ধাক্কাটা দিয়েছে। তাই সিটের হাতলে লেগে রিয়াদ মোটামোটি ব্যাথা পেয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে সে সেটা সহ্য করে সোজা হতেই তানবীর ফোঁসে উঠে তেড়ে যেতে নিলো। শান্ত আর চুপ থাকতে পারল না। খামচে ধরল তানবীরের হাতের কব্জি।

— ‘ প্লিজ না৷ বড়রা সবাই এখানে রয়েছে। প্লিজ আবারও ঝামেলা করবেন না৷ আমি রিয়াদকে বলে দিচ্ছি।
এই শুন, আমি এখনেই উনার পাশে বসব। তুই প্লিজ আরেকটা সিটে বসে যা। ‘

তানবীর তীক্ষ্ণ চোখে শান্তর ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকল। কপালের রাগে দপদপ করা রগটা যেন ক্ষণে ক্ষণে মিলিয়ে যেতে লাগল। একসময় সম্পূর্ণ মিলিয়ে যেতেই সে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসল। অতঃপর বিনাবাক্য খুবই ভদ্র ছেলের ন্যায় সিটে বসল। রিয়াদের দিকে একপলক তাকিয়ে শান্তর ডানহাতটা নিজের মুঠিতে নিলো। এতটা জোরে না বললেও হতো। কিন্তু সে যেহেতু শুনানোর উদ্দেশ্যই রয়েছে তাই শুনিয়েই বলল,

— ‘ আমার মাথা ব্যাথা করছে। কিছুক্ষণ বিরক্ত করবে না। আর অন্যজনও যেন না করে। নতুবা তোলে আছাড় দিতে দ্বিতীয়বার ভাবব না কিন্তু। ‘

শান্ত গলায় রাগী ওয়ার্নে পরিবেশ শান্ত হলো। রিয়াদ এখন চোখ প্রায় কোটর থেকে বের করে তাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে। তানবীরের শান্তর প্রতি এতো অধিকারবোধ দেখে এতটুকুতো সে ইতিমধ্যে বুঝেই নিয়েছে। আর সেখানেই তার যত রাগ। সে এতদিন কোন দুনিয়ায় ছিল? তার পিছন পিছন আর কি হলো? এতটা নির্বোধতো সে ছিল না। তাহলে!

______________

বাস ছেড়েছে অনেকক্ষণ। কয়েকদিনের ব্যবধানে আজ সম্পর্কগুলো নিজেদের পূর্ব পরিচিত নাম পাল্টিয়ে নতুন নামে সেজেছে। প্রেয়সী হয়েছে প্রিয়তমা। প্রেমিক হয়েছে প্রিয়তম। ইশশ বর্তমান নামগুলো এতটা মিষ্টি কেন? পবিত্র বন্ধন বলে? হয়তো হবে।
রিয়াদ এখনও পাশের সিটে বসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। কিন্তু সেই রাগের অবিশিষ্ট ফলাফল হিসেবে কোনো ধ্বংসলীলা লিখা নেই। সে তার মিষ্টি রাগ নিয়ে খেঁকিয়ে আবারও বলল,

— ‘ হারামিরদল, তোদেরকে আবারও একদফা থাপড়ানো দরকার। তোদের মতো শাঁকচুন্নির জন্য আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলেটা কি মাইরটাই না খেল। শক্ত হাতের মাইর। ‘

নীলা পিছন সিট থেকে একটু জোরেই হাসল। সাদিদ চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সে ঠোঁটে আঙ্গুল চাপল। শান্তর দৃষ্টি এলোমলো। সে বারবার শুকনো ঢুক গিলে এপাশ ওপাশ দেখছে। রিয়াদ তাকে চুপ থাকতে দেখে আবারও তেতে উঠল,

— ‘ তুই আমার সাথে জীবনেও কথা কইবি না। তোরে আমার বিয়েতেও দাওয়াত দিমু না৷ বন্ধুর বিয়ে না খাওয়ার শোকে শোকে তুই কাতর হইয়া মইরা যাবি৷ আর আমি তোর খাটিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণখোলে হাসব। বেয়াদব মহিলা। ‘

— ‘ অবিবাহিত মেয়েদেরকে মহিলা ডাকতে নেই। ‘

শান্তর বিড়বিড়িয়ে কথাটুকু রিয়াদের কানে পৌঁছাতেই সে আবারও একদফা ঝাড়ল। শুধু ঝাঁটা তুলতে বাকি ছিল। তানবীর পাশের সিটে বসে চোখ বন্ধ করে রয়েছে। তার বন্ধ চোখেও দুষ্টু হাসির রেখা। শান্ত অনেকক্ষণ যাবত তীক্ষ্ণ চোখে তাকে পরখ করছে। অবশেষে রাগ চেপে না রাখতে পেরে বলল,

— ‘ আমাকে ঝামেলায় ফেলে রেখে আপনি নিশ্চিতে বসে রয়েছেন? ‘

তানবীর চোখ খোলল। নিষ্পলক কিছু মুহূর্ত পার করে দিয়ে বিস্ফোরণজনক বাক্য উচ্চারণ করল।

— ‘ তাহলে কি করব? কোলে নিব? আসো নেই৷ ‘

বলেই ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি ঝুলিয়ে নিজের হাতদুটো তার দিকে বাড়িয়ে দিলো। শান্ত রেগে গিয়ে ধুম করে তার হাতে চড় বসাল। শুকনো হাতের থাপ্পড় খেয়ে তানবীর মেকি রাগ দেখাল,

— ‘ তোমার সাহস তো কম নয়। নিজের থেকে এত বড় মানুষের গায়ে হাত তুলো। থাপ্পড় মেরে একেবারে গাল লাল করে ফেলব। ‘

শান্ত কিছুক্ষণ নির্বাক চাহনিতে তানবীরের মুখশ্রীতে স্থির দৃষ্টি নিবন্ধ করল। অতঃপর চোখদুটো হালকা জ্বলে উঠতেই দ্রুত নজর সরিয়ে নিলো৷ কেটে গেল ক্ষীণ অভিমান মিশ্রিত প্রহর। তানবীর এখনও ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। আর এতক্ষণ মুগ্ধ দৃষ্টিতে স্মৃতির পাতায় জমা করেছে প্রেয়সীর অভিমান এবং হালকা রাগের আভাসে ফুটে উঠা পূর্ণ মুখশ্রী। কিন্তু সময়টা হিসাবের বাহিরে চলে যাচ্ছে বিধায় তানবীর নিজেকে মনে মনে ধমকে উঠল। আপনমনে বার কয়েকটা বিশ্রি গালি দিয়ে পাশের সিটের দিকে এগিয়ে আসলো। নিজের খুব কাছে কারও উপস্থিতি টের পেয়ে শান্ত জানালার পাশে আরও চেপে বসল। তানবীর আবারও নিঃশব্দে হাসল। হাতের উপর হাত রাখতেই শান্ত সেটা ঝটকা মেরে দূরে সরাল। সে আবারও কার্য পূর্ণরায় করল। অভিমানী শান্তও নিজের জায়গায় বহাল থাকল। তানবীর মনে মনে বিড়বিড় করল,

— ‘ একটু বেশি হয়ে গেল না-কি? ‘

শান্ত শুনেও সেটা না শুনার বান করে নাকটা আরও ফুলিয়ে নিলো। তা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে। তানবীর এবার চারপাশটা একবার পরখ করে নিয়ে একেবারে শান্তর শরীর ঘেঁষে বসল। শান্তর রাগ-অভিমানের পর্ব ভুলে শ্বাস বন্ধ হবার জোগাড়। শিহরিত হয়ে কেঁপে উঠা শান্তর শরীরের প্রবহমান কম্পন তানবীরও টের পেল। ফলে দুষ্টু মস্তিষ্কে আরও দুষ্টুমি খেলে বসল। সে নিজের বলিষ্ঠ হাতটা শান্তর জামার উপর দিয়েই চিকন কোমড়ের একপাশে রাখল। শান্তর কম্পন আরও বাড়ল। চোখ খোলে রাখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। থেকে থেকে সেগুলো কেঁপে উঠে বন্ধ হতে চায়ছে। আর শান্ত নিজের জোরের বলে সেগুলো আঁটকে রেখেছে। তানবীর কিছু মুহূর্ত পর দুষ্টুর লেবেল আরেকটু বাড়িয়ে শান্তর কোমড়ে আস্তে করে নিজের হাতটা বুলালো। কোমড়ের একপাশ থেকে হাতটা ক্রমশ সামনের দিকে নিয়ে আসতে গেলেই শান্ত নিজের কাঁপা হাতটা দিয়ে তানবীরের হাতটা নিজের পেটে চেপে ধরল। চোখগুলো এতক্ষণে নিজেদের যুদ্ধে বিজয় লাভ করে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সে একেবারে নিচুস্বরে কাঁপা কন্ঠে বলল,

— ‘ শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি বোধহয় মরে যাব। ‘
— ‘ এতদিন জীবিত থাকার সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা কারও ভালো লাগেনি। আমার জীবন অতিষ্ঠ করে এখন নিজের প্রাণ নিয়ে সংশয়বোধ করা হচ্ছে? সেটাতো হতে দেওয়া যায় না। আমি তাকে মেরেই ফেলব। একেবারে মেরে ফেলব এই অশান্ত নামের মেয়েটাকে। ‘

তানবীরের ঘোর লাগা কন্ঠে এতক্ষণ হুঁশ না থাকলেও রাগটা আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সে হাতের কনুই দিয়ে তানবীরের পেটে খোঁচা মারল। নরম জায়গায় লাঠির ন্যায় আঘাত লাগায় মৃদু ব্যাথায় তানবীরের চোখ খানিকটা কুঁচকে এলো। রাগ মিশ্রিত ধমকের স্বরে বলল,

— ‘ এই মাইয়া সমস্যা কি? খোঁচা মারছ কেনো? বাস থেকে এক ধাক্কা দিয়া ফালাই দিমু। ‘
— ‘ আমি কি তাকিয়ে তাকিয়ে আপনার মুখ দর্শন করব না। আমিও ধাক্কা দিব। ধাক্কা দিতে না পাড়লে লাথি দিব। ‘
— ‘ কি? এত বড় দুঃসাহস? তোলে আছাড় মারব। ‘
— ‘ এহ্ আসছে আমার বীরওয়ালা? ‘
— ‘ বীর নয়তো কি? কোনদিক দিয়ে আমাকে বীরের চেয়ে কম মনে হয়? ‘

শান্ত বিরক্তিমাখা চোখে একবার তানবীরকে তীক্ষ্ণ চোখে উপর নিচ পরখ করল। তার চেহারায় তানবীরের বীরত্ব নিয়ে বেজায় সন্দেহ। তানবীর টিপটিপ চোখে শান্তর সন্দেহভরা দৃষ্টি অবলোকন করল। সময়ের দীর্ঘতা বাড়তেই আবারও খেঁকিয়ে উঠল,

— ‘ এই মেয়ে, এই। এমন ড্যাবড্যাব চোখে কি দেখস? মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলবি। আ’ম তানবীর হাসান। কি শুনলি? তানবীর। অর্থাৎ বীর। ‘
— ‘ কচুর বীর। ‘

শান্তর ব্যাঙ্গাত্বক স্বর তানবীরের কর্ণকোহরে পৌঁছে গেল। এবং সে রাগে তেতে উঠে মারার জন্য হুড়মুড়িয়ে আসলো।

— ‘ তবে রে অশান্ত মাইয়া। দাঁড়া আজ তোরে খাইছি। ‘

তানবীর শান্তকে চেপে ধরে অনবরত সুড়সুড়ি দিচ্ছে। বাসে যে আরও অর্ধশতাধিক লোক রয়েছে সেদিকে তাদের দৃষ্টি নেই৷ খুনসুটিময় মিষ্টি ভালোবাসায় তারা এখন সুখের ভেলায় বহমান।
নীলা সাদিদ তাদের পিছনের সিটেই বসেছে। এতক্ষণ তাদের মিষ্টি ঝগড়াঝাঁটিগুলো তারাও শুনে গিয়েছে। দুইজনের চোখেই প্রশান্তিময় তৃপ্তি। নীলাকে হাসতে দেখে সাদিদ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। নীলা হাসিমুখেই তার চোখে চোখ পরতেই ভ্রুজোড়া বাঁকা নাচালো। সাদিদ মৃদু হেসে খানিকটা এগিয়ে আসলো। নীলা তাতে কিছুটা ভরকে গেল। কেননা এই ব্যক্তিকে মোটেও ভরসা-বিশ্বাস করা যায় না৷ নির্লজ্জের একশেষ। আর বাসেও দুইপরিবারের অনেকজন বিদ্যামান। এই মুহূর্তে লজ্জাজনক কিছু ঘটিয়ে বসলে মানসম্মান কিছু আর থাকবে না। তাই সে বড় বড় চোখ করে জানালার সাথে মিশে একেবারে চেপে বসল। নীলাকে এমন করে পিছিয়ে যেতে দেখে সাদিদের কপাল কুঁচকে এলো। পরমুহূর্তেই তার হাবভাব বুঝে উঠতে পেরে কুঞ্চিত ভ্রুযুগল আরও খানিকটা কুঁচকে নিলো। অতঃপর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুলে আচমকা তার দিকে ঝুঁকে পড়ল। নীলা হকচকিয়ে যেতেই সাদিদ রসিকতা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

— ‘ সবসময় বুঝি এই ধান্দায় থাকো? নটি গার্ল। বাসেও রোমান্স চাও? ‘

বলেই সে ঠোঁট এলিয়ে হাসল। আর ভ্রু বাঁকিয়ে নাচাতে লাগল। নীলা হতবিহ্বল। পুরোপুরি বাকরুদ্ধ! কি বলে এই লোক? সে কখন এমনটা চেয়েছে?
নীলার অবস্থা বুঝে সাদিদ তার কানে মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে আবারও বলল,

— ‘ এতো আদর করেও মন ভরেনি? কিন্তু এখন যদি বাসে আদর করি, তাহলে সবাই কি মনে করবে? ‘

বাক্যটা সমাপ্ত হতেই কপট রাগে নীলা তাকে মৃদু ধাক্কা দিলো। অভিযোগের স্বরে বলল,

— ‘ সবসময় আজেবাজে কথা। অসভ্য-নির্লজ্জ লোক কোথাকার। ‘

সাদিদ আবারও নীলার অগোচরে নিঃশব্দে হাসল। বরাবরের মতোই দিনদুনিরার সবকিছুকে পরোয়া না করে নীলাকে কাছে টেনে আনলো। নীলা এই ছেলের এমন সব উদ্ভট কান্ডে দিশেহারা। এমন অবুঝ মানুষ হয়? তাও আবার এই বয়সে?
সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলেই সাদিদ বাঁধা দিলো৷ ঠোঁটের হাসি মুছে খানিকটা রাগি স্বরে আওড়াল,

— ‘ আরেকবার নড়াচড়া করলে মার দিব। চুপচাপ বসো। ‘

গম্ভীর কিন্তু শান্ত স্বরের শীতল কথায় নীলা নড়াচড়া বন্ধ করল। সাদিদের রাগকে সে বরাবরই বড্ড ভয় পায়। যদিও জানে তাকে সে কখনও আঘাত করবে না। কিন্তু অনেকে বলে না, কথায় না হলে কাজে কি হবে? নীলার ক্ষেত্রেও একিইরকম। সাদিদের কার্য সম্পাদন করতে হয় না। মুখ নিঃসৃত বাক্যই নীলাকে পুরোপুরি দমিয়ে দিতে যথেষ্ট।
নীলাকে এমন মুষড়ে যেতে দেখে সাদিদের বড্ড মায়া লাগল। তার ছোট্ট একটা ধমকেই কেমন বাচ্চাদের মতো চুপসে গিয়েছে। সাদিদ খুব মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়তমার মুখশ্রীতে হাত রাখল। আলতো করে গালে হাত বুলিয়ে মোহনীয় স্বরে বলল,

— ‘ বউপাখি? ‘

নীলা তাকালো না। অভিমান জমেছে। এই ব্যক্তিটা তাকে সবসময় ধমকের উপর রাখে। কথা বলবে না সে। সাদিদ গালে আরেকটু গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতেই নীলা কেঁপে উঠল। সাদিদ হাত না সরিয়েই মাথা খানিকটা নিচু করে নীলার প্রায় সমানে সমানে মুখ রেখে বলে উঠল,

— ‘ তুমি জানো না? আমার কলিজা এটা। ‘

বাক্যটুকু সমাপ্ত করে সাদিদ থামল। গাল বুলিয়ে কানের পিছনে হাত রেখে নীলার মুখটা উঁচু করল। ইতিমধ্যে জলে চিকচিক করা আখিঁদ্বয়ের মুক্ত কণাগুলো বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্য সযত্নে মুছে নিয়ে আবারও বলল,

— ‘ আমার কলিজাটাকে কি কখনও আমি মারতে পারি? বলেছি বিধায় এতো কান্না? ‘
— ‘ সব..সময় এমন করে..ন৷ ‘

নীলার কান্না মিশ্রিত নিচুগলার অভিযোগটা শুনে সাদিদ তার গাল টেনে ধরল। ইশশ শক্ত হাতে গাল ব্যাথা করে দিয়েছে। নীলা চকচক করা চোখে গাল ঘষতে ব্যস্ত। আর নিজেকে সাদিদ থেকে দূরে সরাতে। কিন্তু সে কি এতো ভালো মানুষ? নীলা চাইলেই কি সে হতে দিবে?
তাই নীলার চাওয়াকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে একপাশ থেকে নিজের বুকের হৃদযন্ত্রের উপরে তার মাথাটা চেপে ধরল। নিঃসন্দেহে, নিঃসংকোচে, সবার দৃষ্টির আড়ালে প্রিয়তমার ললাটে ভালোবাসার স্পর্শ আঁকলো। পিঠ বাড়িয়ে ধরে রাখা হাতটা আরেকটু শক্ত করে চোখ বন্ধ করল। অপরহাতটি দিয়ে আলতো হাতে বারকয়েক চুলে হাত বুলিয়ে বলল,

— ‘ ভালোও তো বাসি। সেটা বুঝ না? শুধু শাসনগুলো গুনতে থাকবে? ভালোবাসার পরিমাণটা গুণতে চেষ্টা করা কি উচিত নয়? ‘

নীলা চোখ তুলে তাকালো। সে অভিমান করেছে৷ কিন্তু সাদিদ কি কোনোভাবে তার কথায় কষ্ট পেয়েছে? তার চিন্তা ধারার মধ্যেই সাদিদ আবারও বলে উঠল,

— ‘ থাক বাদ দাও। গুণতে চেষ্টা করার দরকার নেই৷ সেটা তোমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠবে না। আর তাছাড়া বউপাখিটাকে এতকষ্টের কাজ দিয়ে খাটাতে চাই না। এমনি আমার বউটা বড্ড নাজুক। ‘

বলেই দুষ্টুমি করে আবারও গালে টান দিলো। নীলা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে স্বামীর কথা শুনলেও এবার কটমট চাহনি নিয়ে তাকালো। সাদিদ রাগের চেষ্টায়রত অর্ধাঙ্গিনীকে দেখে আবারও হাসল। অবশেষে রাগটুকু নীলা সত্যিই দেখাতে পারল না। ঠোঁট বিস্তৃত করে মিষ্টি হাসলো। মাথা নিচু করে সাদিদের বুকের বামপাশে হাত রাখল। বুকে ঠোঁট চেপে সাদিদের অগোচরে ছোট্ট একটা ভালোবাসা দিতে চাইল। নীলা মনে প্রাণে সেই বিশ্বাসে থাকলেও অপরজনের কাছে হেরে গেল। সাদিদ যে তার পাখির নিঃশ্বাসটুকুর সাথেও পরিচিত। সেখানে জামার উপর হোক বা উন্মুক্ত, প্রিয়তমার কোমল উষ্ঠযুগল কি তাকে ছুঁয়ে যাবে আর সে সেটা বুঝতে অক্ষম থাকবে? এমনটাও কি হওয়ার কথা? এটাও কি সম্ভব?
সাদিদ নিঃশব্দে হাসল। নিজেকে নীলার ন্যায় গোপন করে নয়। বরং খুব নিবিড়ভাবে তাকে বুক পাঁজরের সাথে চেপে ধরে মাথায় চুমু খেল। দীর্ঘ ভালোবাসাময় এক উষ্ণ চুম্বন।

#চলবে…

[ প্রিয়পাঠক, শরীরটা খুব একটা ভালো না। তাই দেরিতে পরবর্তী অংশ দেওয়ার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here