গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৩৯ 💛💚💛
গায়ে হলুদের সাজে আয়নায় নীলা নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তাদের এটা দ্বিতীয়বারের মতো বিয়ে হলেও সাদিদ যেন কোনো কিছুতে কমতি রাখতে চায় না। না আয়োজন আর না আমেজ। সবটুকুতেই যেন এক আকাশ ভালোবাসা নিয়ে সাদিদ নিজ দায়িত্বে সবটুকু করছে৷ এককথায় নিজের বিয়ের ঢোল নিজেই পিটাচ্ছে। শুধু সাদিদ-ই নয়। দুইপরিবারের সবার মধ্যেই যেন একি আমেজ। এখন যেসব হচ্ছে আগেরবার তাদের বিয়েতে এসব কিছুই ছিল না৷ তাই নিজেকে প্রথমবার এমন রূপে দেখে নীলাও বড্ড অবাক হচ্ছে। সত্যিই নিজেকে এতদিন পর তার হঠাৎ বউ বউ মনে হচ্ছে।
— ‘ ধুর, কি ভাবছি আমি? আমিতো বউ-ই। উনার বউ।’
— ‘ কিরে নীল, কি আপনমনে ভাবছিস? ‘
— ‘ না কিছু না৷ ‘
— ‘ আহারে বেস্টু আমার লজ্জা পাচ্ছে। আমার কাছে আবার কি লজ্জা? তোর সবটাই তো আমার জানা। পুরো বিশুদ্ধ জলের ন্যায় ফকফকা – ছকছকা পরিস্কার। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ ন্যাকা। মনে হয় কিছু বুঝো না? জিজুকে যে মনে মনে ভাবছিস এটা লোকানোর কি আছে? ‘
— ‘ কে বলল আমি তোর জিজুর কথা ভাবছি? ‘
— ‘ কে আর বলবে? তোমার ঐ লাল লাল গালগুলো আমাকে এসে বলে গিয়েছে। ইশশ পুরো টমেটো হয়ে গিয়েছিস। জিজু দেখলে নির্ঘাত হার্টফেইল করবে। ‘
নীলা আর কথা বাড়াতে চাইল না৷ মুখ দিয়ে অস্বীকার করলে কি হবে তার ভাবভঙ্গিতে যে স্পষ্ট সাদিদের অনুপস্থিতি বিরাজমান। তাদের কথোপকথনের মধ্যেই দরজায় আওয়াজ পড়ল। নীলা-শান্ত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নিধিকে দেখতে পেল। নিধির চোখজোড়া ছলছল করছে। ছোট্ট বোনটা তার এত বড় কবে হলো? গায়ে হলুদের সাজে মেয়েটাকে নিধি চিনতেই পারছে না৷ সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নীলাকে বাহু ধরে দাঁড় করালো। অপলক দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে কপালে স্নেহের চুম্বন আঁকল।
— ‘ আল্লাহ, কারো যেন নজর না লাগে। আমার পিচ্চুটাকে পুরো পুতুলের মতো লাগছে। ‘
নীলা খানিকটা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। অপরপাশ থেকে শান্ত অভিযোগের স্বরে বলল,
— ‘ এখন আসছে ভালোবাসা দেখাতে। এই তোমার আসার৷ সময় হলো? আমরা কতক্ষণ যাবত ওয়েট করছি। ‘
— ‘ সরি বোন। কি করব বল? ঐদিকে সাদিদের হলুদ ছোঁয়া শেষ না হলে কিভাবে আসি? তুই আমার দিকটাও একটু দেখ। এদিকে বোন ঐদিনে ভাইয়ের মতো দেবর৷ আমি কোনটা ছেড়ে কোনটা যাব? ‘
— ‘ হয়েছে হয়েছে। আর শশুরবাড়ির গীত গাইতে হবে না৷ এখানে এসেও শশুর বাড়ি করা হচ্ছে। ‘
— ‘ তবে রে পাঁজি মেয়ে। কিন্তু আমি যেন শুনাকথায় কি শুনলাম? ঝাঁঝ লংকাকে নাকি ইদানিং উত্তরার পাশে বেশি দেখা যাচ্ছে! কি ব্যাপার? মোহাম্মদপুরের বাস আজকাল উত্তরা হয়ে যায় না-কি? ‘
বলেই নিধি দুষ্টু হেসে ভ্রুজোড়া নাচালো। শান্তর এতক্ষণের পকপকানি ছুটে গেল। কেননা নিধি যে দুর্বল জায়গাতে আঘাত করে বসেছে। তার আর তানবীরের সম্পর্কটার কথা ঘটা করে কাউকে না জানালেও ইতিমধ্যে এক কান-দুইকান করে কথাটা অনেকেই জেনে নিয়েটা।
একটা কথা আছে না, প্রেমের বায়ু স্বাভাবিক বাতাশের চেয়ে দ্রুত বয়। ঠিক তাই। অন্য সবকিছু গোপন করা গেলেও এই ব্যাপার লুকিয়ে রাখা ভীষণ টাফ। আর যারা সেটা পারে তারা নেহাৎই দুর্লভ ব্যক্তি৷ সবার তাদের থেকে অবশ্যই এই সাবজেক্টে জ্ঞান আহরণ করা উচিত।
নীলার বড় ফুফু এসে তাদের তাড়া দিতেই নীলাকে নিয়ে শান্তসহ তার কাজিন সিস্টারগুলো বেড়িয়ে যেতে লাগল। কিন্তু নিধি আচমকা নীলার হাত টেনে বলে উঠল,
— ‘ তোরা একটু বাহিরে গিয়ে বস। আমি পিচ্চুর সাথে পাঁচ মিনিট কথা বলে নিয়ে আসছি। ‘
নিধির কথাতে কেউ আর আপত্তি করলো না। দুইবোনকে কিছুটা একান্ত মুহূর্ত দিয়ে তারা সবাই বাহিরে বের হয়ে গেল। সবাই যেতেই নীলা কিছুটা ভয়ার্ত চোখে প্রশ্ন করে উঠল,
— ‘ কি হয়েছে আপুনি? হঠাৎ এমন করে আটকালে, কোনো সমস্যা? ‘
নিধি তার কথায় মৃদু হাসল। যত্নে গালে হাত বুলিয়ে বলল,
— ‘ সমস্যা আবার সমস্যা নাও বলতে পারিস। আমার কি আর এক দায়িত্ব? ডাবল দায়িত্বে ডাবল কাজ। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ মানে টা না হয় তার থেকেই জেনে নিস। আমি ভাই গেলাম। এই বয়সে থার্ড পার্সন হওয়া বড্ড লজ্জাজনক। ‘
নীলা কেবল ড্যাব ড্যাব করে নিধির মুখপানে তাকিয়ে রইল। তার মুখশ্রী দেখে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে যে আপাতত এতক্ষণের সব কথা নীলার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। নিধি আর ঘাটতে চাইল না৷ নিচু স্বরে বেস্ট অফ লাক বলে দরজা ভেতর থেকে লক চলে গেল।
নীলার হতবিহ্বল দৃষ্টির পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না যতক্ষণ পর্যন্ত খুব পরিচিত কন্ঠটা কানে এলো। নীলা এবার চমকিত দৃষ্টিতে পিছনে ফিরল।
নীলার সাথে মিলিয়ে বাসন্তী কালারের পাঞ্জাবির উপরে সবুজ ফ্লুরাল কটি আর সাদা পায়জামা পড়া সাদিদকে দেখে তার ঠোঁটজোড়া আপন শক্তিতে আলগা হয়ে গেল। সাদিদ প্রিয়তমার এমন অবস্থা দেখে নিচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। নীলার একেবারে সন্নিকটে এসে তার দিকে একটু ঝুঁকে চোখে-মুখে ফুঁ দিতেই যেন সে হুঁশ ফিরে পেল। সাদিদকে কিছু বলবে তার আগেই সাদিদ নীলার দুইগালে চেপে ধরে মাথাটা উঁচু করল। কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধতায় তাকিয়ে থেকে কপালে গাঢ় চুমু খেয়ে বলল,
— ‘ মাশাল্লাহ। আমার ভাবনার থেকেও বেশি সুন্দর। ‘
নীলা বেশ লজ্জা পেল। মুখোমুখি এভাবে প্রশংসা করলে নীলার বরাবরই ভীষণ লজ্জা লাগে। সাদিদ হাসল। অতঃপর গালে হাত রেখেই নীলার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— ‘ ভাগ্যিস ভাবীমণিকে রাজি করিয়ে একটু একা পেলাম৷ নতুবা যে আমার এই নিরীহ চোখজোড়ার সাথে বড্ড অন্যায় করে ফেলা হতো৷ এই আনিন্দ্যসুন্দর দেখা হতে আমার চোখজোড়াকে বঞ্চিত না করাতে ভাবীমণিকে পুরস্কিত করা হবে। কিন্তু ভাবছি কিভাবে পুরস্কার দেওয়া যায়। যেহেতু তার বোনকেই ঘরে তুলছি তাহলে এককাজ করব, তার বোনকেই পুরস্কারটা দিয়ে দিব। সে তাহলে বোধহয় বেশি খুশি হবে৷ আদরের বোন বলে কথা। আর আমারও ঠিকঠাক পুষিয়ে নেওয়া হবে। ‘
নীলা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। আজকে সবাই এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলছে কেন? সবকিছুই নীলার মাথা হতে বিশহাত উপর দিয়ে চলাচল করছে।
নীলার কুঁচকানো কপাল দেখে যেন সাদিদের বেশ মজা লাগল। সে নীলাকে আরও অস্থিরতায় ফেলতে হেঁচকা টান দিলো। এতএত ফুলের গহনা আর তারউপর বাঙালিয়ানা স্টাইলে শাড়ি পরার ধরুন নীলা তালসামলাতে পারল না। হুমড়ি খেয়ে গেয়ে সাদিদের উপর পড়ল। নীলা কয়েক মুহূর্ত থতমত খেয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই খানিকটা রাগীস্বরে বলল,
— ‘ এটা কি হলো? এমনটা কেউ করে? এখন-ই শাড়িতে পা বেঁধে পড়ে যেতাম। আর সবথেকে বড় কথা আপনি এখানে কেন? আর কিভাবেই বা আসলেন? আপনি জানেন না, দাদি যে বাসায় আছে? আপনাকে এইসময় আমার রুমে দেখলে তুলকালাম বাধিয়ে ছাড়বে। ‘
সাদিদ একটা কথাও বলল না। চুপচাপ নীলার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলালো। দেখেও যেন তৃপ্তি মিটছে না।
গায়ে হলুদের বাসন্তী কালারের শাড়ির উপর সবুজ-সাদা-লাল সুতোয় ফ্লুরাল কারুকাজ। সাথে লাল টকটকে গোলাপের সাথে রজনীগন্ধার ফুলের গহনা। একেবারে হালকা কৃত্রিম সাজ। ইশশ কি অপরুপ মনধাঁধানো সৌন্দর্য।
সাদিদের কোনো হেলদোল না দেখে নীলা এবার তাকে ছাড়াতে চাইল৷ তাই নড়েচড়ে মোচড়ামুচড়ি করতে নিলেই সাদিদের রাগ হলো। তাই সে শাড়ি গলিয়ে নীলার পেটে হাত রাখল। একটু জোরেই চেপে ধরল৷ নীলা সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নিচু করল। আর অস্ফুটস্বরে মুখ থেকে ব্যাথাজনক শব্দ বেড়িয়ে এলো৷ সাদিদ তার মুখটা নীলার গলায় নিয়ে ঠেকালো। কিছু মুহূর্ত প্রিয়তমার শরীরের চন্দন-হলুদের ঘ্রাণ নিলো। সাদিদের ঘন নিঃশ্বাস শরীরের লাগতেই নীলা শাড়ি খাঁমচে নিজেকে সংযত করতে চাইল৷ বুকে যেন উথালপাতাল ঢেউ বয়ছে। এই নিঃশ্বাসের মালিক কি কোনোদিন নীলার পরিচিত হবে না? সে যে নীলার অতি পরিচিত হয়েও অজ্ঞাত। এখনও যেন তার গভীর স্পর্শগুলো নীলাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়৷ পরিচিত স্পর্শ বলে অভ্যাসে পরিণত হয় না। ঠিক যেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ ছড়িয়ে পরে।
নীলার কাঁপাকাপির মাত্রা দেখে সাদিদ বারকয়েক টেনে টেনে শ্বাস নিলো। লোভ সামলাতে না পেরে গলায় ফুলের গহনাটা একটু সরিয়ে ঠোঁটজোড়া চেপে ধরল। গাঢ় দীর্ঘ এক চুমু খেল। এতটুকু স্পর্শ যে সে নিজের জন্য চায়। নতুবা তার নিজের দমটাই গলাতে এসে আটকে যাবে।
নীলার কাঁপা হাতজোড়া ততক্ষণে সাদিদের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরেছে। সাদিদ গলা থেকে মুখ সরিয়ে নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। বারকয়েক কানের লতিতে ঠোঁট ঘষে লেগে যাওয়া স্বরে বলল,
— ‘ আমার গায়ে ছুঁয়ানো হলুদ তোমাকে লাগাতে বাহিরে সবাই তোড়জোর করছে। অথচ আমি-ই নাকি আমার পাখিকে হলুদ ছুঁয়ে দিতে পারব না৷ এমনটা কি মানা যায়? এই নিয়ম কি প্রেমিক মন বিরুদ্ধ নয়? তাই নিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাতে স্বশরীরে হাজির হলাম। ‘
সাদিদ থামল। নীলা এবার চোখ তুলে সাদিদের মুখপানে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকালো। সাদিদের মুখেও হলুদের আভা। বুঝাই যাচ্ছে কোনোমতে মুখের হলুদ মুছেই এখানে চলে এসেছে। নীলা অপলক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সাদিদদের ফর্সা বর্ণে হলুদের ছোঁয়া দেখছে। কিন্তু চোখে তার চঞ্চলতা। অর্থাৎ সাদিদের কথাটার মানে সে এখনও বুঝতে পারেনি।
সাদিদও নীলার মুখপানে তাকালো। কিন্তু মুখে আর কিছু না বলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছোট একটা বক্স বাহির করলো। নীলা শুধু তাকিয়েই রয়েছে। কি হচ্ছে এসব?
সাদিদ ছোট বক্সটা থেকে সাথে করে নিয়ে আসা হলুদ নিজের দুই আঙ্গুলে ছুঁয়ালো। নীলার গালে আলতো করে হলুদটুকু লাগালো। আবেশে শিহরিত হয়ে নীলার চোখজোড়া বন্ধ হলো। সাদিদ একপলক নীলার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে মাথায় দুষ্টুমির ফন্দি আটলো। এই মেয়েটাকে প্রেমময় জ্বলনে জ্বালিয়ে সে যেন এক পৈশাচিক আনন্দ পায়। সাদিদ এবার নিজের গালেই হলুদ লাগালো। নীলাকে নিজের সাথে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গলায় মুখ রাখল। ঘষে ঘষে গলায়-ঘাড়ে শীতল হলুদ ছুঁয়ে দিতে লাগল।
আর নীলা পারে না এই ভয়ংকর পরিস্থিতি থেকে জান বাঁচিয়ে পালাতে। এই ছেলেটা সবসময় নীলার নিরীহ জানটার পিছনে পরে থাকে। নীলার অস্থিরতা বুঝতে পেরেও সাদিদ থামল না। সে নিজেও তো অস্থির। তার অস্থিরতা কে দূর করবে? সে নীলাকে আরও গভীরভাবে ছুঁয়ে দিতে লাগল। শাড়ির সবটুকু উন্মুক্ত অংশে হলুদ লাগিয়ে সাদিদ এবার হাঁটু ভাজ করে নিচে বসল। পেট অনাবৃত করে গাল ঘষা দিতেই ধারালো খোঁচা দাঁড়ির আঘাত নীলার নরম পেটে বেশ লাগল। সে সাদিদের চুলগুলো খামচে ধরল।
সাদিদ বুঝতে পেরে তৎক্ষনাৎই আঘাতপ্রাপ্ত জায়গায় ছোট্ট ছোট্ট চুমু খেল। রুক্ষ ঠোঁট যুগলের উষ্ণ পরশে নীলার অবস্থা আরও কাটিল। সাদিদ যেন উপকার করতে গিয়ে অজান্তেই অপকার করে বসছে৷ কেননা নীলার বুকে যে ঝড় বয়ছে। আর ভিতরের প্রবাহমান এই ঝড়কে এই মুহূর্তে কিভাবে সে নিয়ন্ত্রণ করবে?
তাদের এমন মধুরঘন মুহূর্তটা বেশ বাজেভাবে নষ্ট করলো বেসুরো ভাবে শব্দের করাঘাত। অপরপাশে যেন দরজা ভেঙে ফেলার প্রক্রিয়া চলছে।
সাদিদ বিরক্ত হলো। প্রচুর বিরক্ত হলো এইসব নিয়ম-নীতির উপর। বিয়ের তারিখ ঠিক হওয়ার পর থেকে সে নীলাকে কাছে পাচ্ছে না। এইসেই নিয়মনীতি লেগেই রয়েছে। আজ একটু কাছে পেয়ে আদরের ফাঁকা স্থানটুকু পূরণ করতে চায়লে তাতেও যেন সবার ঘোর আপত্তি। সে বিরক্তমাখা চোখে উপরে তাকালো। সমস্ত শরীরসহ ঠোঁটগুলো নীলার তরতর করে কাঁপছে। নীলাকে এই অবস্থায় দেখে যেন অকারণেই সাদিদের রাগটা ফিকে পরল। দরজায় এখনও করাঘাত হচ্ছে। শব্দের সাথে বড় ফুপির বেসুরো গলা শুনা যাচ্ছে। পাশ থেকে অনবরত নিধির বানানো মিথ্যা কথাও কানে আসছে। কিন্তু বড় ফুফি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বিরামহীনভাবে দরজা ধাক্কিয়ে যাচ্ছে। সাদিদ দ্রুত উঠে দাঁড়াল। চট করে পটাপট নীলার পুরো মুখে এলোপাতাড়ি আদর খেয়ে নিলো। অতঃপর কয়েককদম সামনে গিয়েও আবার কি মনে করে যেন পিছনে ফিরল। নীলাকে এখনও ঠাঁই মুর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে কাঁধে ধরে ধাক্কা দিলো। এবার নীলার হুঁশ ফিরেছে। চোখ খুলে হকচকিয়ে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদ আপাতত সেদিকে না খেয়াল করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— ‘ যাও। নিয়মনীতির গোডাউন চলে এসেছে। দরজা খুলো, নতুবা ভেঙে ফেলবে। ‘
কথাটা যতটা গম্ভীরতা নিয়ে বলেছে শেষোক্ত কাজটা ততটাই বাচ্চামিতে ভরা। নীলা গালে হাত দিয়েই দ্রুত দরজা খোলে দিলো। দাগ পরেনি। কিন্তু কামড়ের জন্য মৃদু জ্বলছে। বড় ফুফু রুমে প্রবেশ করেই একদফা জেরে নিলো।
— ‘ এই মেয়ে, এইসব কোনো কাজ? ঐদিকে গায়ে হলুদের জন্য সবাই বসে রয়েছে আর তুই কি-না দরজা লাগিয়ে বসে রয়েছিস? শহরে থেকে থেকে বড্ড বেয়াদব হচ্ছিস। ‘
— ‘ আহা বড় ফুপি চুপ করো। পিচ্চু ওয়াসরুমে ছিলো হয়ত। তাই না পিচ্চু? ‘
নীলা যেন এমন একটা কথারই অপেক্ষাতে ছিলো। সে দ্রুত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ করলো। বড় ফুপি তেমন একটা সন্তুষ্ট হলেন না৷ সেটা তার চোখে-মুখেই স্পষ্ট। হঠাৎ তার চোখ নীলার চোখে-মুখে ভালোভাবে পড়তেই তিনি আতংকে উঠলেন,
— ‘ একি! তুইতো হলুদ আগেই লাগিয়ে বসে রয়েছিস! সব নষ্ট করে দিলি। এখন কি হবে? ‘
নিধিসহ মোটামোটি সবাই নীলার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। সে বেশ অপ্রস্তুুত হয়ে পড়ল সবার এমন তাকানো দেখে।
নিধির সবটাই মাথাতে চলো আসল। সে নিঃশব্দে একটু হেসে নিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর জন্য বলল,
— ‘ আসলে কি বলোতো ফুফি, পিচ্চুকে তখন দেখে আবেগ সামলাতে পারিনি। তাই হাতের কাছের হলুদ নিয়ে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ‘
— ‘ তাই বলে এতো! ‘
— ‘ আসলে ভালোবাসা বেশি তো৷ তাই বেশি-ই লাগিয়েছি। তাই নারে পিচ্চু? ‘
নীলা এবার আর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলাতে পারল না৷ বরং নিধির সবটা বুঝে যাওয়াতে বেশ লজ্জা পাচ্ছে। বড়ফুপি এবার তাড়া দিতেই সবাই ধীরে ধীরে বেড়িয়ে পরতে লাগল। উদ্দেশ্য বাসার ছাদ। কেননা ছাদেই হলুদের সকল আয়োজন করা হয়েছে। নীলা হাঁটতে হাঁটতেই পিছন ফিরে তাকালো। চোখ-মুখে তার চিন্তা ভাব। নিধি তার দৃষ্টি খেয়াল করে ঠোঁট বাকিয়ে হাসল। কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
— ‘ যে আসতে পারে সে যেতেও পারে। ভয় নেই। ‘
ইশশ নীলা আবারও লজ্জা পেল। আজ কি তার হলুদের দিন না-কি লজ্জা পাবার দিন? নতুবা সবাই বারবার এতএত লজ্জা দিচ্ছে কেন?
.
হলুদের সম্পূর্ণ পার্ট চুকিয়ে মেয়েরা এবার মেহেদী নিয়ে বসেছে৷ রাত অনেক হয়েছে। তাই ছোটরা বাদে বড়দের সংখ্যা এবার কমে গেল। বেশিরভাগই নিচে চলে গিয়েছে। পার্লারের মেয়েগুলো নীলার দুইহাতে ব্রাইডাল ডিজাইনে কাভেরী মেহেদী পরাচ্ছে। নীলার মোটামোটি কোমড় ব্যাথা হয়ে যাবার জোগাড়। কিন্তু মেহেদী শেষ হবার কোনোরকম নামগন্ধ নেই। নীলার সাথে সাথে বাদবাকিরাও মেহেদী লাগাচ্ছে। নীলার এমনিতে সমস্যা না থাকলেও সমস্যা হচ্ছে সাদিদকে নিয়ে৷ কেননা ইতিমধ্যে সে অনেকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। স্পষ্টভাবে কিছু বলছেও না। শুধু বলছে সব শেষ হয়েছে কি-না? আর কতক্ষণ লাগবে শেষ হতে?
নীলা বেশ কয়েকবার বলেছে মেহেদী দেওয়া শেষ হলে জানাবে। কিন্তু এই অধৈর্য্য ছেলে নীলাকেসহ অধৈর্য্য করে তুলছে। সে আবারও ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠা সাদিদের নামটার দিকো তাকিয়ে মেয়েগুলোর উদ্দেশ্য বলল,
— ‘ আপু আর কতক্ষণ লাগবে? ‘
— ‘ আর বেশি লাগবে না। ত্রিশ-চল্লিশ মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে। ‘
— ‘ আরও এতক্ষণ? ‘
— ‘ হা হা। আপু এগুলোতে একটু সময় লাগেই৷ বউ বলে কথা। ‘
নীলা আর কথা বাড়ালো না। সাদিদ এতবার করে বলছে তাই না চাইতেও অস্থিরতা কাজ করছে। নীলার কাজিনগুলো এটা-সেটা নিয়ে মজা করছে। সাইডে মৃদু আওয়াজে সাউন্ড বক্সে গান ভেজে চলেছে। কিন্তু নীলার কেন জানি সেদিকে খেয়াল নেই৷ মনোযোগ দিতে চেয়েও দিতে পারছে না৷ মানুষটা এখানে উপস্থিত থাকলেও মনটা যেন সাদিদের কাছে পরে রয়েছে। প্রচন্ড অস্থিরতায় সময়গুলো কাটাচ্ছে।
অবশেষে দীর্ঘ একটা মুহূর্তের পর নীলার মেহেদীর পর্ব শেষ হলো। নীলা যেন হাফ ছেড়েছে। দ্রুত উঠে ফোনটা হাতে নিতে গিয়েই মুখটা চুপসে গেল। সে অসহায় চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কোনদিক দিয়ে ফোনটা ধরবে এটা ভেবেই পাচ্ছে না। সে আশপাশ দেখে নিচুস্বরে শান্তকে ডাক দিলো। সে কাছে আসতেই বলল,
— ‘ একটু সাহায্য কর। ফোনটা নিতে পারছি না৷ ‘
শান্ত চট করে ফোনটা তুলে নিলো৷ কিন্তু এখানেও বাঁধল বিপত্তি। কল করবে কিভাবে? তাই অসহায় কন্ঠে আবারও বলল,
— ‘ ফোনটা একটু লাগিয়ে দে না। ‘
— ‘ কানে? ‘
— ‘ না মানে উনাকে৷ ‘
শান্ত দাঁত দেখিয়ে হাসল। নীলা খানিকটা চোখ গরম করে তাকাতেই ভালো মেয়ে সেজে নাম্বারটা লাগিয়ে কানে ধরল। প্রথম কল যেতেই সাদিদ ধরল। অস্থিরতা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
— ‘ এতক্ষণ! আমিতো অপেক্ষা করতে করতে শহীদ হয়ে যাচ্ছিলাম পাখি৷ ঘটা করে বিয়ের কাজে যে এতো ঝামেলা আগে জানলে কাকপক্ষীকেও জানাতাম না৷ কখন থেকে একটু কাছে চাইছি কিন্তু তোমার দেখা পাওয়াই তো মুসকিল। ‘
নীলা চোখ উঠিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। ফাজিল মেয়েটা ভ্রুজোড়া নাচিয়ে হেসে যাচ্ছে। নীলা এবার না পেরে নিচুস্বরে বলল,
— ‘ কি বলবেন, বলুন। ‘
— ‘ এত স্বাভাবিক! আমাকে পুড়িয়ে নিজে তো দিব্যি রয়েছ। আমারও দিন আসবে বউ। তখন সবগুলো ফিরিয়ে দিব। ‘
— ‘ ইশ চুপ করুন। আমার হাতে মেহেদী। শান্ত ফোন কানে ধরে রয়েছে। ‘
শান্ত এবার জোরেই হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল,
— ‘ সরি জিজু শুনে ফেললাম। বাহ্ বেশ টক-ঝাল-মিষ্টি ভালোবাসা দেখছি। এই ভালোবাসা তো এই ধমকাদমকি। ‘
— ‘ আহা শালিকা মজা কইরো না। তোমার উনিও কিন্তু বেশ ঝাঁঝালো। ‘
শান্ত এবার মিইয়ে গেল। অন্যের লেগপুল করতে গিয়ে নিজেই ফেসে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই রাগও হলো। কি-না কি বলেছে তাই নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসেছে। কতগুলো ঘণ্টা পার হয়েছে অথছ তার খবর নেই। পরে ভাব জমাতে আসলে শান্তও পাত্তা দিবে না।
— ‘ এহ্ আসছে ভাবওয়ালা। সে ভাবের গোডাউন হলে শান্তও হচ্ছে ভাবের পাকিস্তান। একেবারে কড়ায় গন্ডায় ভাব পুষিয়ে দিব। ‘
শান্তকে নিজের মনে বিড়বিড় করতে দেখে নীলা বলে উঠল,
— ‘ আরে বোন ফোনটা একটু উপরে ধর। তোর ভাবনাতে আমি কিছুই শুনতে পারছি না। ‘
— ‘ ওহ্। হ্যাঁ হ্যাঁ। ‘
— ‘ জ্বি এবার বলুন। এতক্ষণ শুনতে পরিনি। ‘
— ‘ নিচে এসো। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ আমি বললাম নিচে নামো। যেমন আছো সেই অবস্থাতেই৷ ‘
— ‘ আপনি কি পাগল হলেন? বাসা ভর্তি মেহমান। এমন অবস্থায় এতো রাতে আমি নিচে কিভাবে নামব? আর সবাই কি ভাববে বুঝতে পারছেন? ‘
— ‘ এতকিছু বুঝার সময় নেই৷ আমি বলছি নিচে নামতে তাই নিচে নামবে৷ ‘
— ‘ আরে আমার কথাটা…
— ‘ কিছু শুনতে পারব না। আমি অনেকক্ষণ যাবত অপেক্ষা করছি। আর মশার কামড় না খাওয়াতে চাইলে জলদি এসো। নতুবা বলা তো যায় না। ঢাকাতে এখন প্রচুর ডেঙ্গুর প্রভাব। কাল হয়তো বাসর ঘরে না থেকে হসপিটালের ঘরে থাকতে হবে। ‘
— ‘ ইশচ যত বাজে কথার কারখানা। ‘
— ‘ যাই বলো৷ কিন্তু অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলে শাস্তিটুকুও সুদ-আসলে নিতে প্রস্তুত থেকো। ‘
এইটুকু বলেই সাদিদ ফোন কাটল। আর নীলার জন্য রেখে গেল অস্থিরতায় ভরপুর অক্সিজেন। কেননা সাদিদের এই কথার পরবর্তীতে নীলার সবটুকু মুহূর্তই অস্থিরতায় ছেয়ে রয়েছে। না নাকচ করার সামর্থ্য রয়েছে আর না গ্রহণ করার রাস্তা। কি করবে এখন?
#চলবে..