অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৪৮

0
5234

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৮

প্রায় দুইমাস পর..

মানুষ তার বর্তমান সময় নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুক আর নাই বা থাকুক, প্রবাহমান সময় কারো জন্য নিজের গতির বিরতি দেয়না। সে আদি থেকে অন্ত বিরতিহীনভাবে চলার চুক্তি নিয়েছে। তেমনিভাবে সাদিদও নিজের প্রিয়তমার জন্য হৃদয়হীন সময়টাকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি৷ দিনশেষে প্রিয়তমার কপালে উষ্ণ চুম্বন এঁকে দেওয়ার সার্মথ্য তার হয়নি৷ সৃষ্টিকর্তা নাকি তার পছন্দের বান্দাদের বেশি বেশি পরীক্ষা নেন। কিন্তু সাদিদ যে এই পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুক নয়। সে এই দমবন্ধকর পরীক্ষার ছাত্র হতে চায় না।
বাংলাদেশের একেবারের উত্তরাঞ্চল হিসেবে পঞ্চগড়ের শীতের তাপমাত্রা বরাবরই ভয়াবহ আকারের। এই শীতের সকালেও গায়ে চাদর আর পিঠে ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে কাউকে ছুটে চলতে দেখা যাচ্ছে। এতো সকালে রাস্তায় কাউকে তেমন একটা দেখা যাচ্ছে বা৷ হুটহাট মাঠে যাওয়া কৃষকদের সাথে দেখা হলেই সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করছে৷ তেমনিভাবে পিঠে খেজুরের রস চাপিয়ে যাওয়া এক রসের লোককে দেখে সে এগিয়ে গেল। শীতে থরথর করে কাঁপা হাতটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ চাচা, এই মেয়েটাকে কখনও দেখেছেন? আজ বা তারও আগে? ‘

অপরিচিত লোকটা নিজের কান টুপিটা একটু নিচে নামিয়ে সাদিদের বাড়িয়ে দেওয়া মোবাইলের দিকে তাকালো। কয়েক সেকেন্ড ভালোভাবে দেখে নিয়ে কাঁপা স্বরে বলল,

— ‘ না ভাজান, দেহি নাই। কেডা ইলা? ‘

সাদিদ মাথা নিচু করে হতাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। আর কতো? একটুখানি আশার আলো কি খোঁজে পাওয়া যাবে না?
লোকটি এখনও যায়নি, সাদিদের সামনে দাঁড়িয়েই তার আগাগোড়া ভালোভাবে পরিলক্ষিত করছে। তাদের এলাকার মনে হচ্ছে না। সে কিছু বলবে তার আগেই ঘন কোয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে কাউকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। সে সাদিদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সেদিকে মনোযোগ দিলো। কয়েক সেকেন্ড পরই তারা ঘন কোয়াশার চাদর বেঁধ করে সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। একজন নয়, দুইটা ছেলে। সে কিছু বুঝবে তার আগেই ছেলেদুটো ধিরিম-ধারিম সাদিদের পিঠে লাগালো৷

— ‘ হারামি, তোর লাইগ্গা দুইডা দন্ড ঘুমাইয়াও শান্তি পাই না৷ হেই পোলা, আমার প্রাণের সখি ঘুমের লগে তোর কি শত্রুতা? এমন হহোনের মতো পিছে পইরা থাহস ক্যান? ‘

বলেই তানবীর আরও দুইটা লাগালো। অপরদিকে সাদিদ নিঃশব্দে মার খাচ্ছে। অর্ণব তার চুপসে যাওয়া মুখ দেখে বলল,

— ‘ আরও জোরে দে। সম্ভব হইলে আমার পক্ষ থেকেও চারটা দে। এই পাথরটার গায়ে হাত লাগাইয়া ইতিমধ্যে আমার হাত ব্যাথা করতাসে। ‘

তারা দুইজন নিজেদের মধ্যেই কতক্ষণ বকবক করলো। কিন্তু সাদিদের মুখ থেকে এখন পর্যন্ত একটা শব্দ বের করতে পারলো না৷ দুইজনই একে-অপরের দিকে তাকালো। এটা নতুন নয়। এই দুইমাসের মোট দিনের সংখ্যা অনুযায়ী সাদিদের মুখ থেকে ষাটটি কথা শুনেছে কি-না এতে সন্দেহ। সারাদিন পাগলের মতো এখানে সেখানে নীলাকে খোঁজে বেড়াবে। অতঃপর নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে নির্ঘুম রাত কাটাবে তার স্মৃতি বুকে আগলে ধরে। এতো কষ্টে বুকে চেপে রেখেও ছেলেটা কান্না করে না। অশ্রুকণাগুলোকে আটকে রেখে আঁখিদ্বয়গুলোকে সবসময় লাল বানিয়ে রাখবে৷ সাদিদ নিঃশব্দে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই অর্ণব এসে কাঁধে ধরে তাকে বাঁধা দিলো,

— ‘ কাল রাতেও কিছু খাসনি৷ না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারবি? চুপচাপ এখানে দাঁড়া। ‘

অর্ণব সাদিদকে ধরে রেখেই রসওয়ালাকে বলে উঠল,

— ‘ চাচা, আমাদের তিন গ্লাস রস দেন। ‘

তাদের সবাইকে তিনি পাত্র থেকে রস দিলেন। সাদিদের হাতে গ্লাস দিতেই সে একপলক অর্ণবের মুখপানে তাকালো। কিছু বলার আগেই অর্ণব বলল,

— ‘ তাকিয়ে লাভ নেই। এটা খা, নতুবা আমাদের হাতের শক্ত মাইর খা৷ ‘

সাদিদ চুপচাপ গ্লাসে চুমুক দিলো। একচুমুক দিয়ে আর খেতে পারলো না। কান্নারা এসে তার গলায় আটকে গেছে। সে ঢুল গিলে তাদের সামনে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটা ধরল। ঘন কোয়াশায় খুব অল্প সময়ে সে তাদের চোখের আড়াল হয়ে গেল৷ অর্ণব সেদিকে তাকিয়ে হতাশাজনক নিঃশ্বাস ফেলল। আর কতো? এভাবে যে চলতে পারে না৷ নীলা ছাড়া যে সাদিদ বেঁচে থাকতে পারবে না এই দুইমাসে কারো সেটা বুঝার বাকি নেই৷ সবাই যত যায় বলুক না কেন সাদিদ নীলাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। মেয়েটাকে ছাড়া হয়তো বাঁচতে পারবে। কিন্তু সেটাকে বাঁচা বলে না৷ যেমনটা এই মুহূর্তে সে বেঁচে আছে। প্রাণহীন এক জীবন। যেখানে জীবন নামক প্রাণ থাকলেও প্রাণোজ্জ্বল জীবনের বড্ড সংকট। অর্ণব টাকা দিয়ে তানবীরকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে সাদিদ কয়েকজন শীতের সবজি বিক্রেতাদের ধরে ফোন দেখাচ্ছে। তারা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। সাদিদের মলিন মুখটা দেখেই তারা অনুমান করে নিয়েছে৷ এবার কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে তার পিছনে হাঁটা ধরল। শূন্য রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার হেঁটে তার ক্লান্ত লাগছে। পূর্বে হয়তো এমন কয়েক কিলো সে এমনিতেই জগিংটাইমে পার করে ফেলতো৷ কিন্তু এখন আর পারে না। কেননা আজকাল মনের সাথে সাথে শরীরটাতে যে অসুখের বীজ বুনছে৷ এতো অবহেলা, অনিয়ম, অনাহার এসব যাবে কোথায়? শরীরের উপর দিয়েই তো যাবার কথা।
ক্লান্ত সাদিদ পিছনে ফিরে তাকাতেই অর্ণব আর তানবীরকে দেখল। কথা বলতে ইচ্ছে করে না। তারপরও দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,

— ‘ আমার পিছনে কি? ‘
— ‘ কথা যেহেতু বলেছিস-ই তোর ঐ ধন্য মুখে অন্য কিছু বল। ‘
— ‘ চলে যা। আমার পাখিকে আমি একাই খোঁজে বের করব। ‘
— ‘ সরি ব্রাদার, এটা সম্ভব নয়। বউসুদ্ধ পারমিশন দিয়ে দিয়েছে৷ আর মা-বাবা বলেছে ভাইকে ছাড়া বাড়ি ফিরলে তোকেও বাড়ি ছাড়া করবো৷ তাই বাড়ি ছাড়ার রিক্স নিতে পারব না৷ ‘

অর্ণবের কথা শুনে যে সাদিদ রেগে যাচ্ছে সেটা তার মুখে পরিলক্ষিত। তাই তাকে আরেকটু জ্বালাতে সে তানবীরের কাঁধ জড়িয়ে বলল,

— ‘ কিরে দোস্ত, তোর কোনো সমস্যা? ‘
— ‘ কি কস! আমার আবার কি সমস্যা? বউ নাই তারউপর পরিবারও নাই। আমারতো যেহানে রাইত ওহানেই কাইত। ও.. সরি। একটা পিচ্চি উডবি আছে। সেও তোগো বউদের মতো মহান। কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই৷ ‘

তানবীর কথাটুকু বলে দাঁত কেলালো। সাদিদ দু’জনের উপর একপলক বিরক্তিকর দৃষ্টি ফেলে কোনো কথা না বলে সামনে এগিয়ে গেল। তারাও নিজেদের মতো বকবক করতে করতে তার পিছনে চলল। সাদিদ আর কিছু বলতে গেল না। হাজার বার বললেও এরা যে তার পিছু ছাড়বে না এটা সে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। মনটা ভালো থাকলে হয়তো বন্ধুগুলোকে বুকে আগলে ধরত। এতো ভালো কেন তারা? কিন্তু ইচ্ছে করে না৷ জীবনটা কেমন যেন নির্জীব হয়ে গিয়েছে। সেখানে তার কিছুই আর ইচ্ছে করে না। সে কোয়াশা আচ্ছন্ন রাস্তায় আবারও বিরামহীন হাঁটতে লাগল।

_____________________

— ‘ নীলা, খাবারটা খেয়ে নাও। ‘

তমার কথায় নীলা চোখ পিটপিট করে তার দিকে তাকালো। তমা তার মলিন মুখে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। নীলার শরীরটা আজকাল খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। গতকাল রাতেও জ্বর এসেছিল৷ এমনিতেই শুকনো তারউপর এই অবস্থায় খাবারের রুচি একেবারে চলে গিয়েছে। যতটুকু খায় তার সবটুকু আবার বমি করে বের করে। এখন অবশ্য আগের থেকে বমির পরিমাণ একটু কমেছে। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। তমা ভেবে পায় না এমনটা চলতে থাকলে সামনে কি হবে? নীলাকে বাঁচানো সম্ভব হবে তো? তারউপর এই বাচ্চা!
তার নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হয়। বড্ড ইচ্ছে করে এই অসহায় মেয়েটার একটু সাহায্য করতে৷ কিন্তু তাকে দমে যেতে হয়। কেননা দিনশেষে সেও ভীষণ অসহায়। পরিবার, পেটের দায়ে এসব খারাপ কাজে জড়িয়ে পরেছে। এখান থেকে পিছিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই।
নীলাকে উঠতে না দেখে তমা নিজেই তাকে বাহু আগলে বিছানা থেকে উঠালো। শীতের সিজন শুরু হয়ে গিয়েছিল। তাই তমা তানহাকে নীলার থাকবার বিছানা নিয়ে কথা বলে৷ তানহা আপত্তি জানায়নি। নীলার জন্য একটা সিঙ্গেল বেডের ব্যবস্থা করতে পেরে তমা ভীষণ খুশি হয়েছিল। কিন্তু সেটা সবার নিকট অপ্রকাশিত-ই রয়ে গেল। নীলা নিস্তেজ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপু, আজ কত তারিখ? ‘
— ‘ ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ। কেন, কি হয়েছে? ‘

নীলা কিছু বলল না। চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। মনে পরছে পুরোনো অনেক সুখস্মৃতি। সব ঠিক তাহলে আজকের দিনটা কতই না সুন্দর হতো৷ সে, সাদিদ এবং তাদের সন্তান। ইশশ ভাবতেই নীলার মন পুলকিত হয়। আবার বর্তমান ভেবে বুকটা চাপা কষ্টে ভরে উঠে। নীলাকে পেটের উপর হাত রাখতে দেখে তমাও সেদিকে তাকালো। যদিও চারমাসে বাচ্চার অস্তিত্ব খুব ভালো একটা বুঝা যায় না। কিন্তু নীলা এতো পরিমাণ শুকিয়েছে যে এখন এই কাঠ শরীরে কেবল হালকা উঁচু পেটটাই উঁকি দিয়ে থাকে। নীলা আলতো করে নিজের পেটে কয়েকবার হাত বুলিয়ে দিলো। অতঃপর পেটে হাত রেখেই চোখজোড়া বন্ধ করে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপনি কোথায়? আমি যে আশায় রয়েছি। আমাদেরকে নিয়ে যাবেন না? খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘

নীলা আর কান্না চেপে রাখতে পারলো না। শুকনো গালগুলো মুহূর্তেই ভিজে গেল। তমা তার সামনেই বসা ছিলো। সে আর নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। নীলা বহুবার তার হাতে-পায়ে ধরে অনুরোধ জানিয়েছে৷ শুধু তাকে নয়, তানহা এমনকি ইমরানের কাছেও। যদিও সে নীলার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যতদিন ছিলো নিজের জন্য নয় তার সন্তানের ভালোর কথা চিন্তা করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করেছে। কিন্তু ঐ পাষাণগুলোর মন গলাতে পারেনি৷ নীলার প্রেগন্যান্সির কথা জেনেই ইমরান তার নিজের রাস্তা ধরেছে। সে তানহাকে সোজা বলেছে তার আর নীলার প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তাই তানহা যদি এখন নিজের স্বার্থে নীলার খুনও করে ফেলে সেটাতে তার কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু মুখ বন্ধ রাখার জন্য নগদ অর্থের প্রস্তাব অবশ্যই রেখেছে। এবং তানহা সেটাতে আপত্তি করেনি। তাদের এসব কথাবার্তা সব নীলার সম্মুখেই হয়েছিল। তাই তমা অথবা কারো জানার আর বাকি নেই। তমা এটা বুঝতে পারে না আপন রক্তের মানুষগুলোও এইরকম পশুর ন্যায় কিভাবে আচরণ করতে পারে। আর না বুঝতে পারে তানহার নীলাকে বাঁচিয়ে রাখার আসল উদ্দেশ্য। সে চাইলেই পারতো এতোদিনে নীলাসহ তার বাচ্চাকে মাটির নিচে জিন্দা পুঁতে ফেলতে। কিন্তু সে সেটা করেনি। এমনকি নীলাকে মুক্তিও দেয়নি। এভাবেই এতদিন যাবত মেয়েটাকে বন্দি রেখে দিয়েছে।
তমা আবারও নিঃশব্দে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নীলার উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ খাবারটা খাও। নতুবা নিজের সাথে সাথে বাচ্চাটাকেও কষ্ট দিবে। ‘

নীলা আচমকা তমার পা দুটো আঁকড়ে ধরল। আকষ্মিক এমন কান্ডে তমা হতবাক। বুঝে আসতেই সে নীলার থেকে নিজের পা সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু নীলা কিছুতেই ছাড়ছে না।

— ‘ একি, কি করছো এসব? আবারও পাগলামি শুরু করেছো! পা ছাড়ো নীলা। ‘
— ‘ আপ.. আপু প্লিজ আমাকে সাহায্য করো। তুমি আমার বড় বোনের মতো। ছোট বোনকে এই বিপদের সময়ে একটু সাহায্য করো৷ ‘
— ‘ নীলা কি হচ্ছে কি এসব? ছাড়ো বলছি। তুমি যেটা বলছো সেটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ছাড়ো পা। ‘
— ‘ আপু, দোহায় লাগি একটু সাহায্য করো৷ আমি নিজের জন্য চিন্তা করছি না। আমার বাচ্চাটা এভাবে থাকলে বাঁচবে না। ও আমার কাছে আমানত আপু। আমি মা হয়ে কিছু করতে পারছি না৷ প্লিজ আমাকে একটু সাহায্য করো। ‘

নীলার কান্নামাখা কন্ঠের আবদারগুলো তমার আর সহ্য হচ্ছে না। না তাকে দুর্বল হলে চলবে না। সে জোরপূর্বক নীলার হাত থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।
নীলার কান্নাগুলো বাঁধ মানছে না৷ সে হাঁটুতে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। এতগুলো অমানুষের মাঝে শুধু এই তমা মেয়েটাকেই তার আপন মনে হতো। এতগুলো দিন কেবলমাত্র এই মেয়েটাই সবসময় নীলার পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। এতগুলো চোখকে ফাঁকি দিয়ে নীলার খেয়াল রাখার চেষ্টা করেছে। তাকে এই বন্দি জীবন থেকে বের করতে না পারলেও সবসময় পাশে থাকার চেষ্টা করেছে৷ শেষ আশাটুকু বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকায় নীলার কান্নাগুলো থামছে না। কি করবে সে? কিভাবে সাদিদকে তার এই অবস্থার কথা জানাবে? কেউ কি সাহায্য করবে না? সবাই তো বলে সৃষ্টিকর্তা তার বান্দাদের জন্য আশার সব দরজা একসাথে বন্ধ করে দেয় না। কিন্তু নীলা যে এখানে পুরোপুরি আশাহীন হয়ে বসে রয়েছে।
হঠাৎ করেই মাথায় কারো হাতের স্পর্শে নীলা মাথা তুলে তাকালো। তার সামনে তমা বসে রয়েছে। সে এখনও যায়নি। সে নীলার কাছে ফিরে এসেছে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলসে। নীলা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। সে কেবল নিষ্পলক তমার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। নীলার এমন চাহনি দেখে তমা নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। তারপর নিজের জিন্সের প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে নীলার সামনে ধরল। নীলা একবার তার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার ফোনের দিকে৷ সে আবারও মুচকি হাসলো। অতঃপর বেশ স্বাভাবিক স্বরেই বলে উঠল,

— ‘ কি? এতক্ষণ তো অনেক পাগলামি করছিলে। এখন কি হয়েছে? নাও ধরো৷ জানাও তাকে। নিয়ে যেতে বলো এই বন্দিজীবন থেকে৷ ‘

নীলা কয়েক মুহূর্ত নির্বাক তমার মুখপানে তাকিয়ে রইল। সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝে আসতেই তার চোখজোড়া আবারও ঝাপসা হতে লাগল। এতো খুশি সে প্রকাশ করতে পারছে না। সে কান্না থামাতে ঠোঁট কামড়ে ধরল। তমার হাত থেকে ফোন নিয়ে কল লাগাতে গেলেই সে হঠাৎ থেমে গেল। সে তো অমানুষ নয়। তার মানবিকতা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। সে কান্না মিশ্রিত অসহায় কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ আপু, তোমার মা এবং ভাই? আর তুমি? তারা যদি জানতে পারে তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে রাখলেও তোমাকে ছাড়বে না৷ আমি কি করবো আপু? ‘

তমা নীলার নিষ্পাপ মুখটাতে তাকালো। তার মতো মেয়ের থেকে এমনটাই আশা করা যায়। এই কয়েকটা মাসে তাকে বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে সে৷ তাই তমা আর অবাক হলো না৷ বরং নীলার অশ্রুসিক্ত ভেজা গালগুলো মুছিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘ আমার কথা বাদ দাও৷ তুমিতো বলেছিলে তোমার স্বামী অনেক বড়লোক৷ টাকা-পয়সার অভাব তাদের কোনো কালেই ছিলো না৷ যদি বেঁচে ফিরতে পারো তাহলে তাকে বলো আমার মা আর ভাইটাকে যেন দেখে রাখে৷ আমার পরিবারে আমি ছাড়া উপার্জনের আর কেউ নেই৷ তারা সুখে থাকলে আমি মরে গেলেও শান্তি পাবো। ‘

তমা নিজের কথাটা শেষ করে মলিন হাসলো। নীলার চোখজোড়া ভেজা৷ কে বলেছে আপন আপনই হয়৷ কখনও কখনও আপন মানুষগুলো বুকে ছুঁড়ি বিঁধতে পারলেও দূরের লোকগুলো ক্ষতস্থানে মলম লাগাতে এগিয়ে আসে।
নীলাকে সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগতে দেখে তমা নিজেই তার হাতে ফোন তুলে দিয়ে বলল,

— ‘ সময় নষ্ট করো না নীলা। এই সময়টুকুর বড্ড দাম। কেউ চলে আসলে আমি তখন কিছুই করতে পারব না। প্লিজ তাড়াতাড়ি করো৷ আমার কথা ভেবো না৷ জানাও তাকে। ‘

তমা নীলার কাছে আর বসলো না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ তাদেরকে খেয়াল করেছে কি-না সেটা দেখলো। তাকে বেড়িয়ে আসতে দেখে একজন ছেলে বলে উঠল,

— ‘ এতক্ষণ কি করস? ‘
— ‘ মেয়েটা অসুস্থ। আবার বমি করেছে। তাই পরিস্কার করতে সময় লাগলো। ‘

ছেলেটা আর কিছু বললো না। নীলার এই অবস্থা সবাই-ই জানে। তাই নিজেদের মধ্যে আবার কথা বলতে শুরু করলো৷ তমা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। অপরদিকে নীলা এখনও ফোন হাতে নিয়ে বসে রয়েছে। তার শরীর মারাত্মকভাবে কাঁপছে। কিন্তু সে আর এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সময় নষ্ট করতে পারবে না। তাই কাঁপা হাতে ফোন লাগালো।

.

কোয়াশার চাদর সরিয়ে পঞ্চগড়ের এই ছোট্ট গ্রামে হালকা রৌদ্রের আলো ফুটছে। যদিও সূর্যাদয় আরও অনেক আগেই হয়েছে, তারপরও প্রচন্ড কোয়াশায় সূর্যের আলোর দেখা পাওয়া কঠিন। তানবীর আর অর্ণব স্থানীয় একটা রাস্তার পাশের ছোট্ট হোটেলে সকালের নাস্তা করতে বসেছে। সাদিদ বসতে চায়নি। কিন্তু তারপরও তাকে জোর করে বসিয়ে খাবার সামনে দিয়েছে। অর্ণব তানবীর খাওয়া শুরু করলেও তার খাবারের প্লেট এখনও একি জায়গায়৷ তা দেখে তানবীর বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,

— ‘ তুই কি রোবট? না খাইয়া এভাবে চলবো? দুই কদম হাঁটার আগেই তো উষ্ঠা খাইয়া পরবি। ফাইজলামি না করে খা। তুইতো অবুঝ না। অবুঝ হলে না হয় বুঝতাম। দ্রুত নাস্তা শেষ কর। তারপর তো আবার তোর অভিযান অব্যহৃত রাখতে হইবো৷ শক্তির দরকার না? খা জলদি৷ ‘

সাদিদকে তারপরও একধ্যানে বসে থাকতে দেখে তানবীর বিড়বিড়িয়ে তার গালমন্দ করলো। সাদিদের তাতে কোনো খেয়াল নেই। সে নিষ্পলক সামনের খোলা মাঠের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে যেন মানুষ হয়েও আজ রোবট হয়ে গিয়েছে। ফোনের আওয়াজে তার ধ্যান কাটলো৷ সে পকেট হাতড়ে ফোন বের করলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। সাদিদ চোখজোড়া কুঁচকে নিয়ে ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকালো। আজকাল শায়লা রহমান বিভিন্ন জনের ফোন থেকে কল করে তাকে বাড়ি ফিরে যাবার কথা বলে। এবারও হয়তো তিনি কল করছেন বিধায় প্রথমবারে সাদিদ ফোন রিসিভ করলো না। বারবার মায়ের কথার অবাধ্য হতে ভালো লাগে না৷ আবার তিনি যা বলেন সেটাও সাদিদের পক্ষে শোনা সম্ভব নয়। নীলাকে খোঁজে পাক আর না পাক কিন্তু হাত গুটিয়ে সে বাসায় বসে থাকতে পারবে না। সবাই এটাকে তার পাগলামি বললেও সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। বাড়ি থেকে যেহেতু বের হয়েছেই নীলাকে সাথে না নিয়ে সে ফিরবে না৷ যদি আজীবন চলে যায় তাতেও সাদিদ নিজের প্রাণপাখিকে ব্যতিত গৃহে প্রবেশ করবে না। আবারও কল আসাতে সাদিদ এবার রিসিভ করলো। কানে ফোন লাগিয়ে হ্যালো বলতেই অপরপাশ থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার ভেসে আসতে লাগল। সাদিদ আচমকা এমন ঘটনায় কপাল কুঁচকে নিলো। কিন্তু সেকেন্ড সময় অতিবাহিত হয়ে মস্তিষ্কে তার অপরপাশের শব্দের উৎস পৌঁছাতেই সাদিদের চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে উঠল। সে ধরা গলায় মায়াভরা কন্ঠে ডেকে উঠল,

— ‘ পাখি। ‘

কতদিন আহ কতগুলো দিন পর এই ডাকটা নীলার কর্ণকোহরে এসে পৌঁছিয়েছে। সে নিজেকে সামলাতে পারছে না। বারবার কিছু বলতে চায়ছে কিন্তু কান্নারা এসে গলায় আটকে গিয়েছে। অপরপাশ থেকে এবার সাদিদের অস্থির কন্ঠ ভেসে আসলো,

— ‘ এই পাখি, লক্ষ্মি বউ আমার। একদম কান্না করে না। আমি আছিতো। কান্না থামাও। ‘
— ‘ আ.. আমি…
— ‘ কি? কি হয়েছে বলো আমাকে? এই প্রাণপাখি এমন করে কাঁদে না। কষ্ট পাচ্ছি তো। ‘

সাদিদ নিজেকে শান্ত রাখতে পারছে না। এতদিন পর নীলার কন্ঠ শুনতে পাওয়া, তারউপর আবার এখন এমনকরে কান্না করছে। সে আশেপাশের সবকিছু ভুলে ক্রমাগত পাগলের মতো চেঁচিয়ে যাচ্ছে,

— ‘ প্রাণপাখি, কথা বল৷ এমন করে থাকে না। বল না আমাকে। প্লিজ কিছু তো বল। ‘

অর্ণব তানবীরও সাদিদের অস্থিরতায় উঠে দাঁড়িয়েছে। সাদিদের কথা শুনে তাদের আর বুঝতে বাকি নেই ফোনের অপরপাশের ব্যক্তিটি কে। কিন্তু এভাবে সাদিদের পাগলামিতে কিছু সমাধান হবে না৷ তাই অর্ণব এগিয়ে গিয়ে জোরপূর্বক সাদিদের হাত থেকে ফোন নিয়ে সেটা লাউডস্পিকারে দিলো। তারাও স্পষ্ট নীলার ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ শুনতে পারছে।

— ‘ নীলা কি হয়েছে, কথা বলো? এভাবে কাঁদলে বুঝবো কিভাবে? ‘
— ‘ আমি নীলা নই তমা বলছি। আর ফোনে কথা বলা সম্ভব নয়। আপনি কোথায় আছেন? ‘
— ‘ আপনি কে? আমার পাখি কোথায়? আমার পাখিকে দিন৷ আমার পাখি কাঁদে কেন? আপনি কাঁদিয়েছেন ওকে? ছাড়বো না কিন্তু, একেবারে মেরে ফেলব। ‘
— ‘ চুপ কর সাদি৷ সবসময় মারামারিতে থাকিস। ‘

অপরদিকে তমা কানে ফোন লাগিয়ে নিঃশব্দে হাসছে। ফোনের অপরপাশ থেকে সাদিদের এমন ধমকি শুনে তার বড্ড হাসি পাচ্ছে। কিন্তু এখন হাসার সময় নয়। আবারও একপলক দরজার দিকে খেয়াল করে সে নিচুস্বরে বলে উঠল,

— ‘ আপনার পাখি রাঙামাটিতে রয়েছে। দ্রুত এসে পাখিকে নিয়ে যান। আমি এড্রেস এই নাম্বারে সেন্ড করে দিচ্ছি। কিন্তু একা আসার ভুল করবেন না। তাহলে কেউ জীবিত ফিরে যেতে পারবেন না। সম্ভব হলে পুলিশফোর্স নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন। আর কল দিবেন না আমাকে। নতুবা বিপদে পরতে হবে। ‘
— ‘ আমার পাখি ও.. ওকে দিন। ওর..
— ‘ প্লিজ বুঝার চেষ্টা করুন। নতুবা বিপদ আরও বাড়বে। ‘

তমা তাদেরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো। নীলা মুখ চেপে কান্না করছে। তমা এখনও নিঃশব্দে হেসে যাচ্ছে।

— ‘ পাগল মেয়ে। এতো কান্না করলে চলবে? ‘

নীলা তমাকে ঝাপটে ধরল। এতো খুশি সে কিভাবে প্রকাশ করবে? কতোদিন পর আজকে সেই প্রিয় কন্ঠটা শুনতে পেল। সে তমার কাঁধে মুখ চেপে কান্না মিশ্রিত গলায় বলতে লাগল,

— ‘ আমি তোমার কাছে ঋণী আপু। সারাজীবনেও তোমার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। ‘

অপরদিকে সাদিদের ফোনে তমা লোকেশন সেন্ড করেছে। এবং তার সাথে ছোট একটা ইনফরমেশনও দিয়েছে। যেটা দেখে তাদের আর বুঝার বাকি নেই যে নীলা কোনো বিপদে রয়েছে। সাদিদতো এখন পাগলপ্রায়। এতদিন সন্ধান ছিলো না। আর এখন সন্ধান পেয়েছে তাও এমনভাবে। সাদিদকে আর পায় কে। সে জায়গা থেকেই পাগলের মতো দৌড় শুরু করেছে। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা কতক্ষণে তার প্রাণপাখিটার কাছে পৌঁছাতে পারবে। তাকে বুক পাঁজরে আঁকড়ে ধরতে পারবে। অস্থির সাদিদের পিছনে অর্ণব তানবীরও দৌড়িয়ে আসছে। এইজন্যই তারা এতটাদিন সাদিদকে একা ছাড়েনি। সাদিদ বিরক্ত হয়ে যেতে বললেও তারা সবসময় সুপারগ্লোর মতো তার পিছনে লেগে ছিলো। কখনও তো কেবলমাত্র বন্ধু বলে মনে করেনি। ভাই ভেবে এসেছে আর এখনও ভাবে। তাইতো পিছু ছাড়তে পারেনি। তারা এগিয়ে এসে একটা অটোরিকশা পেল। তিনজনই তাতে উঠল। সাদিদ অস্থির কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ ভাই জলদি বাস স্টেশন যান। ‘

চালক জলদিই চালিয়ে যাচ্ছে তারপরও সাদিদের যেন তাতে পোষাচ্ছে না। সে অস্থিরতা মিশ্রিত রাগী স্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ ভাই আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন না কেন? জলদি চলুন। নতুবা জায়গা দেন আমি চালাই। ‘

সাদিদের পাগলামি মার্কা কথাবার্তা শুনে চালক হতবাক। কি বলে এই লোক? অর্ণব পাশ থেকে তাকে শান্ত করতে বলল,

— ‘ পাগলামি করিস না সাদি। উনি জোরেই চালিয়ে যাচ্ছে। ‘

তানবীর অর্ণব পাশ থেকে আরও অনেককিছুই বলে যাচ্ছে কিন্তু কোনো কিছুতেই সাদিদ শান্ত হতে পারছে না। একেকটা সেকেন্ড যেন বিষ কাটার মতো শরীরে বিঁধছে।
সাদিদরা রাঙামাটি এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সেইদিন পার হয়ে নতুন দিনের সূচনা হয়েছে। ভয়ে বোধহয় সাদিদের আত্মায় একফোটা পানি অবশিষ্ট নেই। এত ভয় সে আজকের আগে কখনও পায়নি। এখনপ ভয় দূর হচ্ছে না। যতক্ষণ বা পর্যন্ত নীলাকে তার সামনে সুস্থ অবস্থায় পাচ্ছে এই ভয়-অস্থিরতা দূর হবার নয়। সাদিদ বাহিরের দিকে তাকালো। চারপাশে গাছগাছালিতে ঘেরা ঘন জঙ্গল। এখনও ভোরের আলো পৃথিবীর বুকে ফুটেনি। অন্ধকার রাস্তায় পুলিশ ব্যানে তারা ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় পুলিশের একদল টিম তাদের সাথে রয়েছে। সাদিদদের পুলিশ স্টেশনে যেতে হয়নি৷ ঢাকা মহানগরীর পুলিশ অফিসারই তাদেরকে ইনফর্ম করেছে। পঞ্চগড় থেকে ফেরার রাস্তায়-ই তারা ঢাকা মহানগরীর পুলিশ কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করেছিল। সাদিদ সেদিন রাগারাগি করলেও পরে অর্ণব গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে তখনকার সবটুকু পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলে। ফলাফলে তারাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। এতদিন নীলার খোঁজ জানার জন্য তাদের টিমও কাজ করেছে। আর সেইজন্যই তানহা নীলার নিরাপত্তা আরও জোরদার করে। কিন্তু নীলার ভাগ্যে হয়তো সেটা ছিল না। তাই তাদের এতো অভিযানও কাজে আসেনি। এতদিন পর আশার একটু আলো দেখেছে সবাই। তাই সবার মনোবলই ভীষণ দৃঢ়। পূর্বেই সর্তক থাকাতে তারা কোনো ভুল করার সুযোগ রাখেনি। সাদিদও ভিতরে ভিতরেই নিজের অস্থিরতাটা লোকায়িত করেছে। এটা তার প্রাণপাখির সাথে জড়িত। তাই নিজের পাগলামির জন্য সে কখনই নীলার ক্ষতি হতে দিবে না। যেহেতু রাতের শেষ প্রহর চলছে তাই পাহারা দেয় এমন অনেকগুলো গার্ড বিশ্রাম নিচ্ছিলো। এরমধ্যেই সাদিদরা তমার দেওয়া ঠিকনাতে এসে পৌঁছালো৷ এতগুলো গার্ড দেখে সাদিদরাও অবাক হয়েছে। নীলার সাথে এমন শত্রুতা কার থাকতে পারে? যার ধরুন এভাবে তাকে আটকে রেখেছিল!
তারা বেশ বুদ্ধিমত্তার সাথে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ভিতরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের উপস্থিতি তারা বুঝে যায়। আর শুরু হয় একে-অপরের বিপক্ষে অস্ত্রধারী আক্রমণ। আচমকা এতো গুলির শব্দে নীলার ঘুম ছুটে যায়। বেশিক্ষণ হয়নি তার চোখ লেগেছে। সাদিদকে জানানোর পর থেকে একদণ্ডও স্থির থাকতে পারেনি৷ শুধু অস্থিরতায় সময় অতিবাহিত করেছে। এখন এতো গুলাগুলির আওয়াজে নীলা ভয়ে চুপসে গিয়েছে। ভয়ে সে কানে হাত দিয়ে চেপে ধরেছে। অপরদিকে সাদিদের জন্য চিন্তায় শ্বাস আটকে যাওয়ার অবস্থা। হঠাৎ করে এমন গুলিবর্ষণ কেন? তাহলে কি সাদিদ তাকে নিয়ে যেতে এসেছে? আর তারা সাদিদের উপর হামলা করেছে?
নীলার দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমন চিন্তায় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আর নিজেকে মনে মনে দোষারূপ করে যাচ্ছে। তার জন্যই সাদিদ আজ এই বিপদে এসে পরেছে। এখন তার যদি কিছু হয়ে যায় নীলা কখনও নিজেকে এর জন্য ক্ষমা করতে পারবে না।
আচমকা দরজা খোলে যাওয়াতে নীলা নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়ে ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকালো।
সাদিদ যতটাই না দ্রুত ঘরে প্রবেশ করেছিল নীলাকে সামনে দেখে ততটাই থমকে গেল। কতগুলো মিনিট, কতগুলো ঘণ্টা, এমনকি কতগুলো দিন পেরিয়ে প্রিয় মুখখানি তাদের দুজনেরই চোখের সামনে। নীলার চোখজোড়া মুহূর্তেই ঝাপসা হয়ে গেল। অশ্রুকণা ভিড় জমিয়ে সাদিদকে ঝাপসামান দেখাচ্ছে। তাই নীলা দ্রুত চোখ মুছে আবারও সাদিদকে দুচোখ ভরে দেখতে লাগল।
সাদিদ কিভাবে দৌড়ে এসেছে সেটা সে নিজেও বোধহয় জানে না। প্রচন্ড শক্ত করে সে নিজের সাথে প্রিয়তমা স্ত্রীকে জড়িয়ে নিলো। নীলার হাড়গোড় বোধহয় ভেঙে যাবার উপক্রম। কিন্তু এতে তার বিন্দুমাত্র ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না। এ যে সুখের ব্যাথা। আর সুখময় ব্যাথা কখনও কষ্টের অনুভুতি দেয় না।

— ‘ কলিজা, আই মিসড ইউ। আই মিসড ইউ সো মাচ বেবি, আই মিসড ইউ। ‘

সাদিদের ধরা গলা শুনে নীলা এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। শীতের কাপড়ের উপর দিয়ে সাদিদের পিঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। নীলার কান্নার আওয়াজ শুনে সাদিদ তার কাঁধ থেকে মুখ উঠিয়ে প্রাণপাখির মুখটা আঁজলাভরে ধরল। কপালে দীর্ঘ চুমু খেল।

— ‘ আমার লক্ষ্মী পাখি, কাঁদে না৷ আমি এসেছি তো৷ ‘

কে শুনে কার কথা নীলার কান্না কি আর থামে? প্রিয়তমার অশ্রুসিক্ত মুখটার কানায় কানায় সাদিদ তার ঠোঁটের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিতে লাগল। ভেজা চোখ, ভেজা গাল, কপাল, নাক কোনো কিছু বাদ রাখলো না৷ আদরে আদরে প্রিয়তমাকে পূর্ণ করতে লাগল। তারা নিজেদের মধ্যে এতটাই বিভোর যে পিছনে যে অর্ণব তানবীরসহ পুরো পুলিশফোর্স দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। নিজেরা লজ্জিত হয়ে তারা নিজেদের পথ দেখলো। রুম থেকে বেড়িয়ে যাবার মুহূর্তে সবার মুখেই ছিল চাপা হাসি।
সাদিদ নীলাকে আবারও বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় গভীর চুমু খেয়ে চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ আর কাঁদে না পাখি৷ কষ্ট হচ্ছে তো। আমাকে আবারও কষ্ট দিবে? আর কষ্ট দিলে মরে যাবো তো। ‘

নীলার হেঁচকি উঠছে। সে সাদিদের এমন কথা শুনে বুক থেকে মাথা তুলে তার মুখের উপর নিজের ডানহাত রেখে মাথা ডানে-বামে নাড়িয়ে না করতে লাগল। সাদিদের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা দেখা গেল। সে নীলার হাতটা নিজের দুইহাতের মুঠিতে নিয়ে উষ্ণ চুম্বন একে দিলো৷ তার চোখজোড়াও আবার ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। সে নীলার মুখপানে তাকিয়ে ভীষণ আবেগ-অভিমান জড়ানো গলায় বলে উঠল,

— ‘ খুব কষ্ট দিয়েছিস পাখি। খুব কষ্ট। ‘
— ‘ আ’ম সরি। খুব সরি আমি৷ ক্ষমা করে দিন৷ ‘

সাদিদ নীলার কোমল অধরযুগল ছুঁয়ে দিয়ে অন্য উপায়ে মুখ বন্ধ করে দিলো। নীলার শরীরে ক্রমশ শিহরণ বয়ছে৷ সাদিদ ঠোঁটে আলতো ছুঁয়ে দিয়ে সরে আসলো। কিন্তু আবারও কাছে গিয়ে ছোট করে একটা চুমু খেল। অতঃপর নীলার গালে নিজের দুইহাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

— ‘ ওহ্ আর কখনও এটা বলবে না। আমার পাখি কোনো অপরাধ করেনি, আর না কখনও করতে পারে। সরি বলার জন্য তাকে কিন্তু শাস্তি দেওয়া হবে৷ সাদিদের ভয়ংকর সব শাস্তি তার জন্য বরাদ্দ করবো। ‘

নীলা এবার ফিক করে হেসে উঠল। সাদিদ তার হাসির আওয়াজ পেয়ে নিজেও নিঃশব্দে মৃদু হাসল। মাথা নিচু করে ঠোঁটের কোণে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,

— ‘ আপাতত সরি বলার জন্য এতটুকু দিলাম৷ বাকিটুকু দেনা রইল। সবার ক্ষেত্রে বাকির নিয়ম নেই। স্পেশাল পার্সন বিধায় তৈরি করেছি। কিন্তু শাস্তি মওকফ করা হবে না। সময়মতো সুদসমেত পুষিয়ে দিবো৷ ‘

নীলা আবারও হাসল। সাদিদও প্রিয়তমার মিষ্টি হাসিতে হেসে দিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক ঘষে দিলো।

#চলবে…

[ প্রিয়পাঠকগণ, চকলেট নিজ দায়িত্বে পৌঁছিয়ে দিবেন৷ আশার বালতির সাথে চকলেটের বালতি নিয়ে অপেক্ষামান।😊]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here