অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৫১

0
5099

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫১

নীলার মন রক্ষার্থে আর সাদিদের অনুরোধে আরিফ মাহমুদ এবং নার্গিস খাতুন রাতটা পদ্মলয়ায় অতিবাহিত করার জন্য রাজি হয়। রাতের খাবারটা সবাই একসাথেই খেতে বসেছে। বলাবাহুল্য সেখানে নীলার আধিপত্যই বেশি। সবাই পারলে নিজের ভাগেরটা পর্যন্ত নীলার প্লেটে তুলে দেয়। আর অপরদিকে নীলার অবস্থা খারাপ। এমনিতেই সে খেতে পারে না আবার তারা সবাই এতো এতো খাবার নিয়ে পরেছে! নীলা অসহায় চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। সকলের এতো আদর-ভালোবাসা আর সাদিদ-শাদমানের দুষ্টুমিতে ডিনারটা সবাই শেষ করলো। নীলা এখনও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এতদিন এটা মাথায় না আসলেও আজকে শাদমানের সাথে তার খুনসুটি দেখে নীলার অদ্ভুত ধরণের অনুভূতি হচ্ছে। কিছুদিন পরতো তাদের ঘরও আলো করে ছোট্ট হাতপায়ের একজন ব্যক্তি আসবে। তখন সাদিদ কি করবে? কেমন হবে তার প্রতি সাদিদের আচরণ? নীলার জানতে বড্ড ইচ্ছে করে।
রাত অনেকটা হয়ে গিয়েছে বিধায় সাদিদ শাদমানকে নিধির কাছে দিয়ে নীলাকে নিয়ে উপরে আসলো। রুমে ডুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে চিরুনিটা হাতে নিয়ে নীলার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতে লাগল।।নীলা কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ স্বামীর যত্নে মাখা ভালোবাসাটা উপভোগ করলো। সাদিদ সুন্দর মতো চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিয়ে রাবার দিয়ে ঝুঁটি করতে করতে বলল,

— ‘ মেয়েরা যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বিনুনি করে সেটা আমি পারি না। তাই আপাতত এটা করে দিয়েছি। শীঘ্রই শিখে নিবো। ‘

নীলা সাদিদের কথায় হাসল। সাদিদ উঠে গিয়ে রুমের লাইটগুলো অফ করে দিয়ে আসলো। নীলাকে কম্বল দিয়ে ভালোভাবে জড়িয়ে নিয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পগুলো অফ করে দিয়ে বলল,

— ‘ তখন এমন করে কি দেখছিলে? ‘

নীলা সাদিদের বুক থেকে মাথা উঁচিয়ে তার মুখপানে তাকালো। সাদিদ তখনকার চাহনি খেয়াল করেছিল? প্রশ্ন চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

— ‘ আপনি খেয়াল করেছেন? ‘
— ‘ না খেয়াল করে উপায় আছে? বউ যে চোখ দিয়ে পুরোপুরি গিলে খাচ্ছিল। ‘

নীলা আস্তে করে সাদিদের বুকে চিমটি কাটলো। সাদিদ মৃদু হেসে উঠলো। নীলাকে বুকের সাথে আরও জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো,

— ‘ এখন বলো। কি দেখছিলে এমন করে? ‘
— ‘ আপনি বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করেন, তাইনা? ‘
— ‘ সেটাতো সবাই-ই করে। আর আমিও তো সবার মধ্যেই একজন। ‘
— ‘ আমাদের বাবুকেও খুব আদর করবেন, তাই না? ‘

সাদিদ এবার উত্তর না দিয়ে নীলার মুখপানে তাকালো। সাদিদ তখন রুমের লাইট নিবিয়ে ডিম লাইট জ্বলিয়ে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নীলার সুবিধার কথা চিন্তা করে বারান্দার লাইটগুলো অফ করেনি৷ তাই বারান্দা থেকে আলো এসে নীলার মুখটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। সাদিদ তাকে বুক থেকে নামিয়ে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিলো। এখন নীলাকে ধরার আগেও যেন সে দশবার চিন্তা করে। কোথাও কোনো ব্যাথা পাবে কি-না এই নিয়ে সাদিদের ভীষণ চিন্তা।
নীলার উপর কোনোরকম ভর না দিয়ে সাদিদ নিজের হাতের উপর ভর দিয়ে নীলার উপর আধশোয়া হলো৷ সামান্য ঝুঁকে আসতেই নীলা চোখ কুঁচকে নিলো। সেটা দেখে সাদিদ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে হেসে ফেলল। নীলা ফ্যালফ্যাল করে সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। এতদিন ধরে এই পুরুষের সান্নিধ্যে থেকেও নীলা পুরোপুরি তাকে বুঝে উঠতে পারেনি। তার কর্মকান্ডে কেমন যেন রহস্য ঘেরা থাকে৷ সাদিদ কম্বল না সরিয়েই নিচু হয়ে নীলার পেটে মুখ রাখল৷ নীলা সকচিত হয়ে মৃদু চিৎকার করে নিজেই মুখ চেপে ধরল। সাদিদ জামা সরিয়ে নিজের সন্তানকে অনুভব করে দীর্ঘ উষ্ণ চুম্বন দিয়ে আদর করলো৷ নীলা এতক্ষণ অবাকের শীর্ষ পর্যায়ে থাকলেও এখন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। সে নড়াচড়া করতেই সাদিদ মাথার উপর থেকে কম্বল সরিয়ে নীলার উপর বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো,

— ‘ এই তোমার সমস্যা কি? এমন ব্যাঙের মতো লাফাও কেন? ‘
— ‘ আপনি বের হয়ে আসুন। আমার সুড়সুড়ি লাগছে। ‘
— ‘ পারবো না৷ ‘

বলেই ঘাড়ত্যাড়া দুষ্টু সাদিদ আবারও নীলার পেটে চুমু খেল। আর নীলাতো বরাবরের মতোই তিড়িংবিরিং শুরু করে দিয়েছে। সাদিদ একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে কম্বলের নিচ থেকে বেড়িয়ে আসলো। বিরক্তিতে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ না প্রিন্সেস, হবে না৷ তোমার মাকে নিয়ে আর পারা যাবে না৷ সে আমাদের আদরের মধ্যে বাধা দিতে আসবেই৷ ‘

সাদিদের গোমড়ামুখটা দেখে নীলার বড্ড হাসি পেলেও এই মুহূর্তে আর হাসলো না। নতুবা তার ভাগ্য শনি আছে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরও সাদিদের মুডের পরিবর্তন না দেখে নীলা মিনমিনিয়ে বলে উঠল,

— ‘ আচ্ছা, আর নড়াচড়া করবো না। করেন যা করার। ‘

এতক্ষণের সাদিদের গোমড়ামুখো ভাব যেন মুহূর্তেই কেটে গেল। সাদিদ উৎফুল্ল হয়ে আবারও নিজের কাজে মগ্ন হয়ে গেল। নীলা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে নিজেকে স্থির রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। অপরদিকে সাদিদ আর তার প্রিন্সেসের আদরের পর্ব শেষ হবার নাম-ই নিচ্ছে না। বহু চেষ্টা করেও নীলা আর পারলো না৷ নড়েচড়ে হাসতে হাসতেই বলে উঠল,

— ‘ আর কতো আদরের পর্ব চলবে? ‘

সাদিদ নীলার উন্মুক্ত পেটের আশেপাশে আরও কয়েকটা চুমু খেয়ে নীলার মুখোমুখি হলো। সাদিদের এমনিতেই গরম বেশি এবং ঠান্ডা কম। তাই এতক্ষণ কম্বলের নিচে থাকায় মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। দুষ্টু সাদিদ নিজের ঘর্মাক্ত মুখটা নীলার গলায় ডুবিয়ে দিয়ে ফিচেল কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ কেন? হিংসে হয়? ‘
— ‘ আমার বয়েই গিয়েছে হিংসে হবার। দূর হোন, কাতুকুতু লাগছে। ‘

সাদিদ শুনলো না। বরং দুষ্টুমি করে নীলার গলায় অনবরত মুখ ঘষতে শুরু করলো। নীলার কন্ঠ এবার ভারি হয়ে আসছে। সে লেগে যাওয়া কন্ঠে বলল,

— ‘ প্লিজ সরুন। ‘

সাদিদ এবার মুখ তুলে নীলার দিকে তাকালো। তার চোখেও ঘোর লেগে এসেছে। কতদিন পর আজ নিজের প্রিয়তমাকে সাদিদ এতটা কাছ থেকে একান্তভাবে পেয়েছে। তার কি আর হুঁশ থাকে?
সাদিদ নিজের হাতের উপর ভর দিয়ে নীলার মুখোমুখি হলো। প্রাণপাখির মুখের উপর চলে আসা এলোমেলো চুলগুলোকে খুবই সন্তপর্ণে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। নীলার চোখজোড়া মিটমিট করছে। কেননা সে ইতিমধ্যে সাদিদের ঐ ঘোর লাগা চোখের সম্মুখীন হয়েছে। কতদিন পর সাদিদের ঐ চোখজোড়ার সম্মুখীন হলো সে। এখনও সেই প্রথমবারের মতোই বুকে হাতুড়িপেটা হচ্ছে। সাদিদ খুবই যতনে নীলার গালে হাত রাখলো। আলতো করে হাতটা বুলিয়ে দিতেই নীলা আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে নিলো৷ সাদিদ সেটা দেখে নিঃশব্দে মৃদু হাসল। অতঃপর নীলার কানের কাছে ঠোঁট লাগিয়ে মোহাচ্ছন্ন কন্ঠে বলল,

— ‘ বাবুকে যে কতটুকু আদর করবো সেটার প্রমাণ নিশ্চয়ই পেয়েছ? কিন্তু বউ, আমি যে বড্ড লোভি। কেবলমাত্র বাবুকে আদর করেই আমার পোষাবে না। আমার যে বাবুর আম্মুকেও চাই। ‘

সাদিদের এমন কথায় নীলার শরীরে অনবরত কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। তার পাতলা ঠোঁটযুগলও মৃদুভাবে কাঁপছে। সাদিদ তার তর্জনী আঙুল নীলার কাঁপা ঠোঁটের উপর রাখল। সাদিদ আলতো করে স্লাইড করতেই নীলা কাঁপা কাঁপা চোখে তার মুখপানে তাকালো। আর মুহূর্তেই দুই চোখজোড়া মিলিত হলো। সাদিদ পূর্বেকার ন্যায় কন্ঠেই বলে উঠল,

— ‘ বাবাইয়ের আম্মিকে একটু আদর করা যাবে? ‘

নীলা অপরদিকে মুখ ফেরালো। সাদিদের এমন কথায় তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। আর সাদিদ মুগ্ধ দৃষ্টিতে অবলোকন করছে প্রিয়তমার রক্তিম বর্ণের মুখশ্রী। সাদিদ নীলার গালে হাত রেখেই মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে আনলো। কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক প্রাণপাখির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে নীলার দিকে ঝুঁকে আসলো।
অধরে অধরে মিলন হতেই নীলা সাদিদের ঘাড়ে হাত রাখল। শিহরণ অনুভব করে ঘাড়ের পিছনের চুলগুলোও মৃদুভাবে টেনে ধরল। আর সাদিদ সবকিছু ভুলে গিয়ে প্রিয়তমার ঠোঁটের নেশায় মত্ত হয়ে পড়ল। একটা দুটো করে অসংখ্য ছোট বড় চুমু খেল।
নীলা আর সইতে পারছে না৷ শরীরটা কেমন যেন ছেড়ে দিয়েছে। সাদিদ উম্মাদের মতো প্রিয়তমাতে মত্ত হলেও নিজের ব্যালেন্স ঠিকই বজায় রেখেছে। এতক্ষণে নীলার শরীরের উপর তার নামেমাত্র ভার সে পড়তে দেয়নি। দীর্ঘ সময়ের ঠোঁট আদরে নীলা বেহাল হয়ে পড়ল। আর নিতে পারছে না। সাদিদকে আগ বাড়িয়ে সেটা বলতে হলো না। সে বুঝতে পেরে নিজেই নীলার ঠোঁট ছেড়ে দিলো৷ এতক্ষণের আদরে টকটকে লালচে বর্ণের পাতলা ঠোঁটযুগল দেখে সাদিদ ঠোঁট কামড়ে হাসল। অতঃপর আবারও ঠোঁটযুগল নিজের মধ্যে পুরে নিয়ে বারকয়েক আদরে আদরে প্রিয়তমাকে পূর্ণ করলো। অবশেষে শীতের রাতে দীর্ঘ উষ্ণতার ভালোবাসাময় আদর শেষে সাদিদ থামলো। ছাড়তে তো ইচ্ছে করে না। তবুও সাদিদকে ছাড়তে হলো৷ কেননা সাদিদের যে আর ঘোরে যাওয়া ঠিক হবে না। তার প্রাণপাখিটার মধ্যে যে তার আরেকটা প্রাণের সৃষ্টি হচ্ছে। তাই নিজের উন্মাদনাকে জোর করে হলেও সামলিয়ে রাখতে হবে।
সাদিদ নীলার গলায় মুখ রেখে লম্বা শ্বাস টানলো। নীলাও ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে৷ যা এই বন্ধ রুমে ভীষণ স্পষ্টভাবে শুনা যাচ্ছে। সাদিদ তার গলার ভাঁজে ঠোঁট ছুয়ালো। নীলা কেঁপে উঠে আবারও তার বাহুতে খামচে ধরল। সাদিদ আর দুষ্টুমি করতে চাইলো না। নতুবা পরবর্তীতে নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতে হবে। আর সে নীলাকেও আর অস্থির করতে ইচ্ছুক নয়। তাই গলা থেকে মুখ সরিয়ে প্রাণপাখির কানের কাছে মুখ নিলো। কানের লতিতে ছোট্ট একটা কামড় বসিয়ে পূর্বেকার ন্যায় ঘোর লাগানো স্বরেই বলল,

— ‘ আজকের জন্য এতটুকুই। বাকিটা পরের জন্য রেখে দিলাম। বাবাইয়ের জন্য তার মায়ের আদর একটু কমিয়ে করেছি। কিন্তু তাই বলে কিন্তু ছাড় দেওয়া হয়নি৷ একবার বাবাই তার মা-বাবার কাছে চলে এলেই সুদসমেত সবগুলো ফেরত যাবে। বুঝেছেন বাবাইয়ের আম্মি? ‘

নীলা এমন লাগামছাড়া কথায় লজ্জায় জড়সড় সাদিদের বুকেই মুখ লুকালো। সাদিদ এবার শব্দ করেই হেসে ফেলল৷ অতঃপর বালিশে ঠিক হয়ে শুয়ে নীলাকে সাবধানে বুকে জড়িয়ে নিলো। আর ক্ষণেক্ষণে নীলার মাথায় আলতো করে আঙুল চালাতে লাগলো। নীলা আরাম পেয়ে আরও গুটিশুটি মেরে সাদিদের সাথে মিশে রইল। অনেকক্ষণ যাবত মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সাদিদ বলে উঠল,

— ‘ কলিজা, ঘুমিয়ে পরেছো? ‘

নীলা মাথা উঁচিয়ে তাকালো। তার যদিও আরাম পেয়ে চোখ লেগে আসছিলো কিন্তু সাদিদের সামনে মাথা নাড়িয়ে না করলো। সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হেসে তার মাথায় চুমু খেল। অতঃপর বুকে জড়িয়ে আবারও মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— ‘ অনেকক্ষণ যাবত, এমনকি বলতে পারো আরও অনেক আগে থেকেই একটা কথা মাথায় ঘুরঘুর করছে। বলার বা জানার ঐরকম সময়-সুযোগ পায়নি। আর পেলেও তখন বলাটা অনুচিত মনে হয়েছে। ‘
— ‘ এতো জড়তা কেন? বলেন না কি বলবেন। ‘

সাদিদ কম্বলের নিচ দিয়ে হাত নিয়ে নীলার হালকা উঁচু পেটটাতে একটা হাত রাখল। অতঃপর তার মুখপানে তাকিয়েই বলল,

— ‘ বাবাইয়ের আগমনের হিসাবটা ঠিক মিলাতে পারছি না জান। আমিতো এখনই এসব আশা করিনি। নিম্নে আরও কয়েক বছর পর এসবের প্ল্যান করতাম। আর আমার জানা মতে এখনই এইরকম কোনো কিছু হওয়ার কথাও ছিলো না৷ আমি সবসময় সেটা খেয়াল রেখেছি। তারপরও কিভাবে…

নীলা বুঝতে পারলো সাদিদ কোন প্রসঙ্গে কথাটা বলছে। তার এইমুহূর্তে রাগ বা লজ্জা হলো না। অভিমানে সেগুলো চাপা পড়ল। নীলার চোখজোড়াতে মুহূর্তেই অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমালো। তাই সাদিদকে কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়েই অভিমানভরা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ওর আগমনে আপনি খুশি হননি? আপনি তাকে চান না? ‘

সাদিদ থতমত খেয়ে গেল। এই মেয়েটা নাকি দুইদিন পর বাচ্চার মা হবে৷ যে নিজেই এতো অবুঝ সে কিভাবে বাচ্চাকে বুঝ শেখাবে! সাদিদ নীলার অভিমানভরা মুখটাতে তাকিয়ে হেসে ফেলল। অতঃপর রসিকতার স্বরে বলে উঠল,

— ‘ তুমিতো দেখছি ‘ক’ বললে কক্সবাজার বুঝে ফেলো। ক দিয়ে যে কলা হয় সেটা জানো না? ‘

নীলা প্রতিউত্তর জানালো না। তার ভীষণ অভিমান হয়েছে। সাদিদ কিভাবে তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে এমনটা বলতে পারে। কোমল মনের নীলা আর ভাবতে পারলো না। ভীষণ কষ্ট পেয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না আটকাতে চাইলো।
সাদিদ এতক্ষণ দুষ্টুমির মুডে থাকলেও এবার নীলার ফুঁপানির আওয়াজ শুনে বেশ গম্ভীর হয়ে উঠল। হাত বাড়িয়ে একটা টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে নীলাকে সাবধানে উঠে বসালো। এই মেয়েটা এই রাতের বেলাও কান্না করে হেঁচকি তুলে ফেলেছে৷ সাদিদ পাশের টেবিল থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে নীলার মুখের সামনে সেটা ধরল। নীলা খেতে না চাইলে সাদিদ মৃদু স্বরে ধমক দিলো। শেষে নীলা বাধ্য হয়ে কয়েক চুমুক পানি খেল। সাদিদ তাকে একটু স্বাভাবিক দেখে নিজে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে তাকে বুকে টেনে আনতে চাইল। কিন্তু নীলা জোর খাটিয়ে শক্ত হয়ে বসে রয়েছে। সাদিদ একটু জোর প্রয়োগ করেই তাকে বুকে টেনে আনলো। অতঃপর বলে উঠল,

— ‘ পাখি চুপ করো। আর কাঁদে না। এতো বোকা মানুষ হয়? এমন করে কাঁদছো কেন? কান্নার কি হয়েছে? ‘

নীলা উত্তর দিলো না। তাকে কান্না থামাতে না দেখে সাদিদ এবার গম্ভীর স্বরে ধমকে উঠল,

— ‘ পাখি, চুপ করতে বলেছি না? একবারে চুপ। আর একফোটা পানি যেন চোখে না আসে। ‘

সাদিদের রাগী আওয়াজ শুনে নীলা ঠোঁট চেপে কান্না আটকাতে চাইল। সাদিদ বুঝতে পারছে। সেও নীলাকে ধমক দিতে চায় না। কিন্তু মেয়েটা কি বুঝে না, সাদিদ যে তার চোখে পানি দেখতে পারে না?
সাদিদ নীলার মাথায় দীর্ঘ চুমু খেয়ে আদুরে কন্ঠে ডাকলো,

— ‘ প্রাণপাখি। ‘

নীলা মুহূর্তেই সাদিদের বুকে মুখ চেপে তার পিঠ আঁকড়ে ধরল। নিঃশব্দে সাদিদের বুক ভাসাতে লাগল। সাদিদ হাসবে নাকি কাঁদবে সেটা বুঝে উঠতে পারছে না৷ তার পাখিটা এখনও অবুঝই রয়ে গেল। সাদিদ মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই আদুরে গলায় বলল,

— ‘ এইজন্যই আমি তখন এতটা জড়তা প্রকাশ করছিলাম৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার ভয়টাই ঠিক হলো। এতো অবুঝ হলে হয় জান? আমি কি একবারও বলেছি বাবাইয়ের আগমনে আমি খুশি হইনি? নাকি এটা বলেছি যে তাকে আমি চাই না? কোনটা? ‘

নীলা এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলো না। আসলেই সাদিদ এমনটা কখন বলেছে? সাদিদ নিজেই আবার বলল,

— ‘ একজন পুরুষ মানুষের জন্য বাবা হবার অনুভূতিটা ঠিক কি রকম সেটা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না পাখি৷ এটা কেবলমাত্র একজন পুরুষ মানুষই উপলব্ধি করতে পারবে। মেয়েরা যেমন মাতৃত্বে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে তেমনিভাবে একজন পুরুষের জন্যও বাবা হবার সক্ষমতা বিশাল কিছু। অনেকে কত বছর সাধনা করেও এই বিশাল প্রাপ্তিটা অর্জন করতে পারে না। আর আল্লাহ আমাকে না চাইতেই এতোটা খুশি হবার তৌফিক দান করেছেন৷ আমার এখানে খুশি না হয়ে উপায় আছে?
আমিতো কেবল সময় বিষয়টা তোমার কথা ভেবেই এসব বলছিলাম। আমি চাইনি এখনই তোমার উপর এতো বড় দায়িত্বটা পরুক। আরও চার-পাঁচটা বছর গেলে তুমিও কিছুটা বড় হতে, আর তখন না হয় আমরা এই সিদ্ধান্তটা নিতে পারতাম। তাই আমার এতসব বলা। ‘

নীলা নিজের কাছেই ভীষণ লজ্জিত হলো। সে কি থেকে কি ভেবে নিয়েছে। আজকাল তার খুব বেশিই মুড সুয়িং হয়। অল্পতেই রিয়েক্ট করে ফেলে আবার অনেকসময় একেবারে নীরব। সাদিদ নীলার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে এবার নিজেই অভিমানীস্বরে বলল,

— ‘ আমার দেখছি সবদিক দিয়েই বিপদ। ভালোও বলা যায় না আবার খারাপও বলা যায় না। ‘

নীলা সাদিদের এমন কন্ঠস্বর শুনে ফিক করে হেসে ফেলল। এতক্ষণ পরে নীলার মুখে হাসি দেখে সাদিদও হাসলো।

— ‘ তাহলে এখন? ‘
— ‘ এখন আবার কি? ‘
— ‘ আমার প্রশ্নের উত্তর? ‘
— ‘ কি প্রশ্ন? ‘
— ‘ কি প্রশ্ন? ‘

সাদিদ বাঁকা হেসে নীলাকে সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করলো। নীলার হাসতে হাসতে অবস্থা খারাপ।

— ‘ আর না, আর না। বলছি আমি৷ ‘
— ‘ এইতো লাইনে এসেছো। ‘
— ‘ আসলে.. না মানে আমার মনে হয় শ্রীমঙ্গলের ঐ সময়েই..
— ‘ তুমি কি অর্ণবের বিয়ের দিনকার কথা বলতে চাইছো? ‘

নীলার বেশ ইতস্ততবোধ হতে লাগল। তারপরও সে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। সাদিদকে বেশ চিন্তিত দেখা গেল। সে নিজের মধ্যে প্রশ্নদের ভিড় চেপে রাখতে না পেরে বলেই উঠল,

— ‘ কিন্তু পাখি, সেটা কিভাবে সম্ভব? তুমিতো বলেছিলে তোমার তখন সেইফ পিরিয়ড চলছিলো। তাই আমি আর এই নিয়ে কোনোরকম চিন্তা রাখিনি৷ ‘
— ‘ না মানে.. বলে তো ছিলাম। কিন্তু সম্ভবত ভুলবশত হিসাবে ঝামেলা লাগিয়ে দিয়েছি৷ ‘

সাদিদের এবার চিন্তার সাথে সাথে গম্ভীর মুখশ্রীও দূর হয়ে গেল। দেখা গেল দুষ্টু মুখে বাঁকা হাসি। সে নীলার গালে হাত রেখে দুষ্টুমিস্বরে বলে উঠল,

— ‘ হায়রে আমার ভুলাক্কার বউরে! একবারেই ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে রয়েছে। আমারই ভুল ছিলো। তোমার কথা মেনে নেওয়াটা আমার কোনোভাবেই উচিত হয়নি৷ না তখন তোমার উপর দায়িত্ব দিতাম। আর না আজ এই দিন আসতো৷ আমার-ই ভুল। ‘
— ‘ আপনি কি কোনোভাবে এটাকে এক্সিডেন্টলি বলবেন? ‘

নীলা আবারও অভিমানে গাল ফুলিয়ে ফেলল। সাদিদ এবার আর রাগলো না। তার বউটা যে বড্ড অবুঝ। অবুঝ না হলে কেউ এই সামান্য হিসেবে ভুল করে? তাই সাদিদ এবার তার অভিমানে ফুলে উঠা গালগুলো বেশ জোরেই টেনে দিলো,

— ‘ আউ ছিঁড়ে যাচ্ছে..
— ‘ ছিঁড়েই ফেলবো৷ ‘
— ‘ আপনি খুব খারাপ৷ খুব বেশিই খারাপ। আমার গালগুলো এখনও ব্যাথা করছে। ‘
— ‘ ব্যাথা করার জন্যই দিয়েছি। এমন উল্টা-পাল্টা ভাবলে এর থেকেও বেশি জোরে দিবো। ‘
— ‘ আমি কি উল্টা-পাল্টা ভেবেছি? ‘
— ‘ উল্টো পাল্টা নয়তো কি? তুমি এক্সিডেন্ট শব্দটা উচ্চারণ কিভাবে করতে পারো? তাও আবার নিজের সন্তানের বিষয়ে! পাখি আল্লাহর রহমত স্বরূপ আসা এই উপহার কখনও বান্দার জন্য এক্সিডেন্ট হতে পারে। আমরা মানবজাতি যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বাচ্চাকে এক্সিডেন্ট বলে চালিয়ে দেয় না কেন, এই শব্দটা একটা নিষ্পাপ প্রাণের ক্ষেত্রে উচ্চারণ করাও পাপ। নিজেদের ভুলে হোক বা অন্যকিছু কখনও এই উপহারকে এক্সিডেন্ট বলা ঠিক নয় পাখি৷ কখনও নয়। ‘
— ‘ আ’ম সরি৷ এতটা গভীরভাবে বুঝে বলিনি৷ ‘
— ‘ আমি জানিতো। পাখিটা আমার কতোটা অবুঝ সেটা সাদিদ না বুঝলে কে বুঝবে? ‘

নীলা হাসল। খুব মিষ্টি সেই হাসি। সাদিদও মুগ্ধ হয়ে প্রাণপাখির হাসি মুখটা দেখলো। হোক না কিছুটা অবুঝ, কিছুটা চঞ্চল। কিন্তু দিনশেষে মেয়েটার মনটা যে একেবারে নিষ্পাপ। আর সাদিদ এই নিষ্পাপ মনের মেয়েটাকেই ভালোবেসেছে। যেই ভালোবাসার গভীরতার পরিমাণ বোধহয় কোনো মাপযন্ত্র দ্বারাই নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here