অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৫৩

0
4918

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৩ ❤

ঘড়িতে সময় এখন সকাল ছয়টা বেজে দশ মিনিট। মাত্রই কিছুসময় পূর্বে সকালের রক্তিম সূর্য তার নিজস্ব সৌন্দর্য নিয়ে পূর্ব আকাশে অবতরণ করেছে। নীলা আরেকবার জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকিঝুঁকি মেরে বলে উঠল,

— ‘ এবার তাহলে যাই? অনেক সকাল হয়ে গিয়েছে তো। দেখেন সূর্য পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। ‘

সাদিদ তার কথায় বালিশে মুখ গোঁজেই নিঃশব্দে হাসলো। তারউপর আড়মোড়া ভেঙে শীতের সকালে আরামের নরম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। নীলা ততক্ষণে একেবারে শীতের জামাকাপড় পরে বাহিরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। তখন সাদিদই এগুলো ক্লোজেট থেকে বের করে রেখেছিলো৷ তাড়াহুড়ায় নীলা সাদিদের উঠার আর অপেক্ষা করেনি৷ নিজে নিজেই রেডি হয়ে গিয়েছে। হাঁটু পর্যন্ত শীতের লেডিস জ্যাকেটের সাথে লুজ প্লাজো। গলায় একটা স্কার্ফ পেচানো। এতো ভারি কাপড়ের নিচে তার পুঁচকোটাকে দেখায় যাচ্ছে না।
নীলা এখন ছয়মাসে পা দিয়েছে। ছোট্ট পিচ্চিটা মায়ের গর্ভে একটু একটু করে নিজের আধিপত্য স্থাপন করে চলেছে। অবশ্য অন্য সবার মতো প্রেগন্যান্সিতে নীলা খুব বেশি মোটা হয়নি৷ সমস্ত শরীরে চোখ বুলালে আলাদাভাবে কেবলমাত্র পেটটাই চোখে পড়বে। নতুবা শারীরিকভাবে তার খুব বেশি ওজন বাড়েনি৷ কিন্তু তারপরও চেহারায় কেমন যেন একটা নাদুসনুদুস ভাব এসেছে। দেখলেই মনে হয়ে কোমল তুলতুলে। সাদিদেরতো সারাদিনই বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজের প্রাণপাখিটা আর কলিজার টুকরোটার কথা ভেবে নিজেকে বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে রাখে।
সাদিদ স্মিত হেসে এগিয়ে এসে নীলার কানটুপিটা আরেকটু টেনে ঠিকঠাক করে দিলো। সে নিজেও জামাকাপড় পরে তৈরি ছিলো। কেবলমাত্র সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় নামাজ শেষে বিছানায় হালকা গা এলিয়েছে। কিন্তু এতো চেষ্টা করেও পাখিটাকে বিছানার ধারেকাছেও আনা যায়নি। তার এককথা, সে বিছানায় আসলেই সাদিদ তাকে বুলিয়ে বালিয়ে ঘুম পারিয়ে দিবে৷ তাই সে বিছানায় আসার মতো রিক্স নিবে না। আজকে তার কথা সাদিদকে রাখতেই হবে। সে আজ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। পৃথিবী প্রয়োজনে উল্টিয়ে যাক। কিন্তু নীলা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসবে না। না মানে না।
সাদিদ একপলক নীলার উপর নিচ ভালোভাবে পরখ করলো। সব ঠিক আছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাঁটু ভাজ করে ফ্লোরে বসলো। অতঃপর নীলার কোমড় পেঁচিয়ে তাকে কাছে টানলো। নীলার গায়ের জামার উপর দিয়েই তার পেটে নিজের ঠোঁট বুলিয়ে অনাগত স্নেহের টুকরোটাকে আদর দিলো। নিচুস্বরে নিজের অংশের সাথে ফিসফিসিয়ে কথাও বলে নিলো৷ নীলা ততক্ষণ কিছুই বললো না। শুধু সাদিদের মিষ্টি পাগলামিগুলো ঠোঁট চেপে হাসি আটকিয়ে দেখলো। সাদিদ নিজের সন্তানের সাথে আদর-টাদরের পাঠ চুকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শুধু কি একজনকে করলে হবে? তাহলে আরেকজন যে বাদ যাবে। সেটা কি হয়? তাই নীলার গালে হাত রেখে সাদিদ তার নরম তুলতুলে গালে-কপালে গুটিকয়েক উষ্ণ আদর দিলো। প্রিয়তমার কোমল ঠোঁটযুগল যে তাকে নেশালো দ্রব্যের ন্যায় সর্বদা টানতে থাকে৷ লোভ সামলিয়ে রাখতে সাদিদকে বরাবরই হিমশিম খেতে হয়। সময় আর সুযোগ যেহেতু সুপ্রসন্ন তাই সেখানেও নিজের অধরযুগলের বিচরণ চালালো। নীলার চোখজোড়া ততক্ষণে বন্ধ হয়ে এসেছে। এমন ভালোবাসা নিয়ে আদর দিলে কি নিজেকে সামলিয়ে রাখা যায়? মন উত্তর দেয় পারে না। তাই নীলাও যে নিজেকে সামলাতে পারে না। সাদিদের মতোই ছন্নছাড়া হতে হয়। নীলা হালকাভাবে সদিদের কাঁধ চেপে ধরলো। মিষ্টি সকালটা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে সাদিদ সরে আসলো। অতঃপর ভিজে ঠোঁটজোড়া হালকা নাড়িয়ে মিষ্টিস্বরে বলল,

— ‘ চলেন মহারাণী, আপনার সেবায় এই অধম হাজির। ‘

নীলা তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে মাথা নিচু করে নিজের লাজুকভাব প্রকাশ করলো। সাথে আড়চোখে সাদিদের দিকে তাকিয়ে নিচুস্বরে খিলখিলিয়ে হাসলো। সাদিদ নিষ্পলক তার হাসিমুখটাতে চেয়ে রইল। হাসছে নীলা কিন্তু বুকে যেন সাদিদের শীতলতা অনুভব হচ্ছে। সময়ের কাটা সেকেন্ড অতিক্রম করে মিনিট পার করতেই নীলা তাকে মৃদুভাবে ধাক্কা দিলো,

— ‘ কি হলো? কোথায় হারিয়েছেন? ‘
— ‘ হ্যাঁ? না কিছু না পাখি। চলো তাহলে, যাওয়া যাক এবার। ‘

সাদিদ খুবই সাবধানে নীলাকে বাহিরে নিয়ে আসলো৷ খুব সকাল বিধায় মা-বাবা কাউকে লিভিংরুমে পাওয়া যায়নি। হয়তো বা নামাজ পরে তারাও এখন বিশ্রাম করছে৷
বাহিরে আসতেই সাদিদের শীতল চোখের দৃষ্টি এবার তীক্ষ্ণ চাহনিতে রূপ নিলো। সে কিছুটা অসন্তুষ্ট গলায় বলল,

— ‘ এখন না গেলে হয় না জান? দেখো, আবহাওয়াতে পুরোপুরি শীতের প্রকোপ না থাকলেও আংশিক রয়েছে। তোমার যদি তাতে ঠান্ডা লেগে যায়? ‘
— ‘ ইশশ আপনি আবার শুরু করেছেন? আমি আজকে যাবোই। আপনার এই প্যানপ্যান আমি আর শুনবো না। ‘
— ‘ লক্ষ্মি পাখি আমার। আমার টিয়া, ময়না, বুলবুলি..
— ‘ বাংলাদেশ এমনকি পৃথিবীর সমস্ত পাখির নাম নিয়ে তবজি পড়লেও আজকে আমি যাবো। এন্ড ইটস ফাইনাল। ‘

সাদিদ ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। মেয়েটা আজকাল তার একটা কথাও শুনতে চায় না। সাদিদও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারে না। ক্ষণে ক্ষণে মুড সুয়িং জিনিসটা মেয়েটার বড্ড বেশি হচ্ছে। এইমাত্র ভালো তো একটু পরেই অকারণে রেগে যায়। আবার হুট করেই কেঁদে গাল ভাসায়। এখন এটা চাই মানে চাই-ই। না শব্দটা শুনলেই চোখের কোণে জলধারা এসে ভিড় জমায়।
সাদিদ প্রবল ভালোবাসাময় দৃষ্টি নিয়ে নির্নিমেষ তার পাখিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর এগিয়ে এসে নীলার কানটুপি বেধ করে আসা ছোট চুলগুলোকে সন্তপর্ণে কানের পিছে ঠেলে দিলো। প্রিয়তমার মুখটা আঁজলাভরে ধরে কপালে আলতো করে উষ্ণ ঠোঁটযুগল চেপে ধরলো। শীতের আমেজে উষ্ণ কোমল স্পর্শটা যেন নীলার দেহে আলোড়ন তুলছে৷ তার চোখজোড়া আবেশে পিটপিট করছে। প্রিয়তমাকে শীতের সকালের নরম উষ্ণ আদর শেষে সাদিদ একহাতে তাকে আগলে নিলো। ছোট ছোট পা ফেলে খুবই সাবধানে নীলাকে নিয়ে মেইট গেইট পেরিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামলো।
নীলার খুশি আর দেখে কে! মুখে হাত চেপে ধরে সে ঘন কালো আঁখিপল্লবের নিচে লোকায়িত ডাগর ডাগর মায়াবী চোখজোড়া দিয়ে সবকিছু পরখ করছে। যেন সাদিদ তাকে বাড়ির সামনে নয় বরং শীতের সকালে কোনো সমুদ্র সৈকতে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া এটা সমুদ্র সৈকত থেকে কম কোথায়? এই মুহূর্তটা লাভ করার জন্য নীলাকে এইপুরো সপ্তাহটা সাদিদের পিছনে হাত ধোয়ে পরে থাকতে হয়েছে। কতো কথা এমনকি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল পর্যন্ত করেছে। কিন্তু সাদিদ কিছুতেই তাকে সকালে নিয়ে বের হতে রাজি হচ্ছিলো না। তার এককথা সকালের ঠান্ডা কোয়াশায় নীলার শরীর খারাপ করবে। আর এই রিক্স সাদিদ নিতে পারবে না। কিন্তু গতকাল রাতে হুট করেই সাদিদ বলল আজকে তাকে নিয়ে বরে হবে৷ নীলার তখন থেকেই উপচে পরা আনন্দ। এতো উত্তেজনায় রাতটাই যেন কাটতে চাইছিলো না৷ নীলা চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস টানছে। চোখে-মুখে তার প্রবল খুশির ছাপ।
প্রাখপাখিটাকে এমন আনন্দে আত্মহারা হতে দেখে সাদিদের মনের খচখচানিটা এবার ক্রমশ মিলিয়ে যেতে লাগলো। সে নিজেও যে চায় সবসময় তার ছোট্ট পাখিটার মুখে এই হাসি-আনন্দটুকু লেগে থাকুক। সেই অনুযায়ী চেষ্টাও থাকে সর্বোচ্চ। কিন্তু মাঝেমধ্যে তার কলিজাটা এমন সব আবদার করে বসে যে সাদিদের তাতে বড্ড ভয় হয়। এককথায় তার এখনও প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। যদি সকালের এই ঠান্ডা বাতাশে মেয়েটার শরীর খারাপ করে? তখন? তখন সাদিদ কিভাবে তাকে সামলাবে? আর.. আর কিভাবে নিজেকেই বা সামলাবে?

— ‘ এই যে শুনছেন? আরে এই মশায় শুনুন না। ‘
— ‘ হ্যাঁ.. হ্যাঁ জান। কি হয়েছে? ‘
— ‘ বারবার কোথায় হারিয়ে যান বলুন তো? ‘
— ‘ আমার আর জায়গা কোথায় পাখি? সব জায়গাতে তো নিজের নামের সিল লাগিয়ে বসে রয়েছো। ‘

নীলা ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই সাদিদ মৃদ হাসলো। নীলার নাকটা হালকা করে টেনে দিয়ে তাকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে আবারও বলে উঠল,

— ‘ দিনদিন বড্ড আদুরে হয়ে যাচ্ছো পাখি। বারবার শুধু আদর করতে ইচ্ছে করে। কি করবো বলো তো? ‘
— ‘ ধেৎ। ‘

নীলা লাজুক হেসে মাথা নিচু করে সাদিদ থেকে খানিকটা দূরে সরে আসলো। আড়চোখে চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে দেখে নিলো তাদেরকে কেউ দেখেছে কি-না। কিন্তু না। এতো সকালে এদিকটা বেশ জনমানবশূন্য। তাই নীলা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর সাদিদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছুটা ক্ষেপাস্বরে বলল,

— ‘ এমন হুটহাট চিপকে যান কেন? কেউ দেখলে কি ভাববে? ‘
— ‘ কি আর ভাববে? ভাববে এই সুদর্শন ছেলেটা তার মিষ্টি বউটাকে বড্ড আদর করে। আদর করে করে একেবারে তুলতুলে করে ফেলে..
— ‘ চুপ চুপ। আল্লাহরওয়াস্তে আপনার বিখ্যাত মুখটাকে কিছুসময়ের জন্য অফ রাখুন৷ ‘
— ‘ বারে! তুমিই তো জানতে চাইলে। আমার এখানে কি দোষ? ‘
— ‘ আমার ভুল হইছে ভাই। মাফ করেন আমাকে। ‘

সাদিদের মুখের দুষ্টু হাসিটা নিমিষেই মিলিয়ে গিয়ে এবার চোয়াল শক্ত হলো। তার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে সামনে দাঁড়ানো এই নাদুসনুদুস মেয়েটার নরম গালদুটো এখন মেরে লাল বানিয়ে দিতে। অপরদিকে নীলা নির্বাক। ভুল করে যে কি একটা মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে সেদিকে তার বিন্দু মাত্র ভ্রক্ষেপ নেই। সাদিদ রক্তিম চোখজোড়া বন্ধ করে নিজের রাগটা দমন করতে চাইলো৷ কিন্তু না পারা যাচ্ছে না। তাই আঁখিদ্বয় বন্ধ রেখেই সে থমথমে গলায় বলে উঠল,

— ‘ আমি তোমার ভাই লাগি? ‘

ইশশ যা। নীলার আত্মা এবার শুকিয়ে কাঠ। কি বলতে কি বলেছে এতক্ষণে তার খেয়াল আসছে৷ সাদিদের থমথমে গম্ভীর কন্ঠ শুনে তার আর এখানে থাকার বিন্দুমাত্র সাহসে কুলাচ্ছে না। তাই ধীরপায়ে সাদিদের দৃষ্টির বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাদিদ তার ডানহাতটা খপ করে ধরে ফেললো। নীলার প্রাণপাখি এবার ফুড়ুৎ হবার আশংকায়। সে বারকয়েক শুকনো ঢুক গিলে মিনমিনিয়ে বলতে চাইল,

— ‘ আ.. আসলে
— ‘ ইচ্ছেতো করছে গালদুটোতে সজোরে কয়েকটা থাপ্পড় বসাতে। কিন্তু আ’ম হেল্পলেস। তোমাকে মারা আমার পক্ষে সম্ভব নই। কিন্তু তোমার কৃতকর্মে রাগটা কিছুতেই নিবারণযোগ্য নয়। তাহলে এখন কি করে রাগ কমাবো? ‘
— ‘ রা..গ না..
— ‘ এ্যান্সার মি ড্যাম। ‘

নির্জন কোলাহলমুক্ত রাস্তায় সাদিদের থমথমে গলায় ধমকির শব্দটা বেশ প্রখরভাবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো।
নীলার চোখজোড়াতে মুহূর্তেই অশ্রু কণারা এসে আন্দোলন শুরু করেছে। সে নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল। কান্না আটকানোর সর্বোচ্চ প্রয়াস। অভিমানে সিক্ত হয়ে মুখফুটে বলতে পারছে না যে সে এটা ভুল করে বলেছে৷ সাদিদ আবারও ফোঁস করে শ্বাস টনলো। নীলার অশ্রুসিক্ত মুখশ্রীটাতে নজর পড়তেই তার বুকের বামপাশে চিনচিন ব্যাথা শুরু হতে লাগলো। ইশশ কি ভয়ানক তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা!
সে এগিয়ে গেল৷ নিজেদের মধ্যকার সবটুকু দুরত্ব মিটিয়ে নীলাকে খুব সাবধানে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। নীলা এবার অভিমান ভুলে হকচকিয়ে উঠলো। তার শরীরটা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই ভারি। তাছাড়া এই অবস্থায় তাকে সাদিদ কোলেই বা কেন নিলো? তাও আবার এই মাঝরাস্তায়?
সে নিজের মধ্যে প্রশ্ন চেপে না রাখতে পেরে বলেই ফেলল,

— ‘ কোলে নিয়েছেন কেন? ‘
— ‘ সরি কলিজা। ‘

নীলার চোখজোড়া আবারও নোনাজলে ম্লান হলো। সাদিদ তাকে এতো ভালোবাসে অথচ তার থেকে একটু ধমকও তার সহ্য হয় না। বোধহয় বেশি ভালোবাসা পেয়ে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে বলে এখন সামান্য একটু মান-অভিমানের দুরত্বও সহ্য হয় না। সাদিদ হাঁটা অবস্থাতেই ঝুঁকে এসে নীলার মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ালো। নীলা সাদিদের গলা জড়িয়ে ধরে একদৃষ্টিতে সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। এমন এমন কাজ করলে রাগ বা অভিমান কি ধরে রাখা যায়? ইশশ একদমই যায় না।
অদূরেই তারা যেই পার্কটার উদ্দেশ্য বের হয়েছে তার সীমানা প্রাচীর দেখা যাচ্ছে। তাই সাদিদ একেবারে নীলাকে পার্কের বেঞ্চে নিয়ে বসালো। এই শীতের সকালেও সাদিদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের মুক্তোর ন্যায় কণা দেখা যাচ্ছে। নীলা নিজের গলার স্কার্ফটা দিয়ে সাদিদের কপালটা আলতো করে মুছিয়ে দিতে লাগলো। সাদিদ তাতে মিষ্টি করে হাসলো। পাখিটাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে সামনে নজর দিলো। পার্কের অপর গেইট দিয়ে অনেকের সমাগম চোখে পড়ছে৷ ধীরে ধীরে হয়তো এখনকার এই নীরবতাটুকু সবটাই কোলাহলে পরিপূর্ণ হবে৷ তার আগেই সাদিদ চায়ছে নীলাকে বাসায় নিয়ে চলে যেতে৷ তাই সাদিদ এবার মিহিস্বরে ডাকলো,

— ‘ পাখি। ‘
— ‘ হুম? ‘
— ‘ চলো বাসায় চলে যাই। ‘
— ‘ না, না। মাত্রই এসেছি৷ আরও থাকবো। ‘
— ‘ দেখো কতো লোক এসে জড়ো হচ্ছে। একটুপরেই এখানে মানুষজন গিজগিজ শুরু করবে। তোমার কষ্ট হবে তো জান। তাই আসো চলে যাই। ‘
— ‘ আমার কিছু হবে না। একটু থাকি। আপনিতো নিয়ে আসতেই চান না। তাই আজকে যেহেতু এসেছি এতো তাড়াতাড়ি যাব না। ‘

সাদিদ মাথা নিচু করে নীলার দিকে তাকালো। নীলা অনবরত হালকা গোলাপি কোমল ঠোঁটযুগল নাড়িয়ে চলছে। তার অন্যদিকে খেয়াল নেই। সে এখন একধ্যানে সামনে তাকিয়ে সাদিদের নামের অভিযোগের ঝুড়ি খুলে বসেছে। সাদিদ নিজের ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করলো। কিন্তু নীলাকে বাধা দিয়ে আর টু শব্দটি করলো না। সাদিদ তাকে কিভাবে বুঝাবে তার মনে কি ঝড় চলে? উপর দিয়ে নিজেকে শক্ত বানিয়ে রাখলেও ভিতর দিয়ে যে সে একেবারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আর দিনকে দিন যেন সেটার মাত্রা আরো তীব্র হচ্ছে। শ্বাসটা যেন সবসময় গলায় এসে আটকে থাকে। না পারে স্বস্তিতে নিতে আর না পারে উগলে ফেলতে। সাদিদ আচমকা নীলাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। বাহুবন্ধনী জোরালো হতেই নীলা মৃদু ব্যাথা অনুভব করলো। আজকাল শরীরটা কেমন যেন নাজুক হয়ে যাচ্ছে। অল্প একটু জোর প্রয়োগেই শরীরটা কেমন যেন ভেঙে আসতে চায়। আর সাদিদ সেটা নীলার থেকেও বেশি বুঝতে পারে৷ কিন্তু হঠাৎ তার কি হলো? এমন করছেই বা কেন?
সাদিদকে না ছাড়তে দেখে নীলা জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকলো। নরম শরীরে বেশ ব্যাথা লাগছে৷ তাই নিচুস্বরে বলল,

— ‘ আমি ব্যাথা পাচ্ছি। ‘

সাদিদের এবার হুঁশ ফিরলো। নিজের কৃতকর্মের জন্য সে ভীষণ লজ্জিত। তার পাখিটা ব্যাথা পেয়েছে অথচ সে কি-না খেয়াল রাখতে পারেনি!
সাদিদ আপনমনে নিজেকেই শাসালো। অতঃপর নীলার গালে আলতো করে আঙুল চালিয়ে বলল,

— ‘ বাসায় গিয়ে ঔষধ দিয়ে দিবো। ‘
— ‘ আরে না, না ঔষধ লাগবে না। হালকা একটু…
— ‘ হালকা না ভারি সেটা জানতে চাই না। আমার পাখি ব্যাথা পেয়েছে তাহলে অবশ্যই ব্যাথানাশক দিতে হবে। উষ্ণ উষ্ণ স্পর্শকাতর আদর দিলে ব্যাথা যাবে না জান? নাকি আদরের গভীরতা বৃদ্ধি করতে হবে? ‘

সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসিরা ঝিলিক দিচ্ছে। নীলা সেদিকে সরু চোখে তাকিয়ে রয়েছে। সাদিদ ঠোঁট এলিয়ে হাসতেই নীলা এবার লজ্জা পেয়ে অপরদিকে মুখ ফিরালো। সম্পর্কের নাম বৃদ্ধির সাথে সাথে যেন এই ছেলের অসভ্যতার মাত্রাও চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলছে।

#চলবে…

[ প্রিয়পাঠক, দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির জন্য পেইজের রিচ প্রবলেম হতে পারে। তাই অনুরোধ থাকবে যাদের নিকট গল্পটা পৌঁছাবে প্লিজ রেসপন্স করবেন। কমেন্ট না করতে পারেন অন্ততপক্ষে রিয়েক্ট করার চেষ্টা করবেন। ]

পাঠকমহলের সুবিধার্থে আগের পর্বের লিংক-
https://www.facebook.com/108201258209128/posts/153581760337744/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here