গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৫ ❤
নীলার মুখের সামনে চলে আসা এলোমেলো চুলগুলোকে সাদিদ আলতো হাতে কানের পিছনে গুঁজে দিলো। আঙুলের উল্টোপাশ দিয়ে প্রিয়তমার গালে লম্বালম্বি দাগ কাটতেই নীলা মৃদুভাবে কেঁপে উঠল। সাদিদ সেটা দেখে নিঃশব্দে হাসলো। অতঃপর খুবই নমনীয়তায় প্রিয়তমার কপালে ভালোবাসার উষ্ণ চিহ্ন একে দিলো।
নীলা নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখলো সেই ঘোর লাগা আঁখিযুগল। বরাবরই শুনে এসেছে বিয়ের পূর্বে প্রেমিক মনে ভালোবাসার ছড়াছড়ি থাকলেও বিয়ের পরে এসব কেবল নিছক কল্পনা। সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসাগুলোও লবন ছাড়া তরকারির ন্যায় পানসে হতে থাকে। কিন্তু সাদিদ! নীলা কেন তার মধ্যে পানসে মনোভাব দেখে না? বরং মনে হয় দিনকে দিন ছেলেটার ভালোবাসা যেন তার প্রতি উপচে পড়ছে।
— ‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? ‘
— ‘ অনুমতি নেওয়ার কি আছে? আমিই তো। ‘
নীলা তার কথায় মুচকি হাসলো। অতঃপর বলে উঠল,
— ‘ আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা এখনও এতো তীব্র কেন? এমনটাতো হওয়ার কথা নয়। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ আপনাকে কি আমার রোগে ধরেছে? ‘
— ‘ এটা কেমন কথা? ‘
— ‘ তাহলে মানে মানে করছেন কেন? ‘
সাদিদ এবার চট করে নীলার কথার অর্থটা বুঝে ফেললো। তাই সে নিচু আওয়াজে হেসে উঠল।
— ‘ বললেন না যে। ‘
— ‘ বলবো কিভাবে ম্যাডাম? আপনার প্রশ্নের অর্থোদ্বারই তো আমি করতে পারেনি। কাইন্ডলি এমন বাঁকা ত্যাড়াভাবে না বলে সোজাভাবে বলা যাবে? ‘
— ‘ না বলবো না। ‘
— ‘ কেন? ‘
— ‘ কারণ আপনি আমার কথাকে বাঁকা-ত্যাড়া বলে অপমান করেছেন। তাই আমি রাগ করেছি। যার ফলে বলা সম্ভব নয়। ‘
সাদিদ কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীলার মুখপানে তাকিয়ে রইলো। ক্ষীণ সময় অতিবাহিত হতেই সে বাঁকা হাসলো। এলোপাতাড়ি সুড়সুড়ি দিতেই নীলার অবস্থা এবার কাহিল।
— ‘ প্লিজ, প্লিজ বন্ধ করেন। আমি আর পারছি না। বলছি আমি। ‘
— ‘ এইতো লাইনে চলে এসেছো। তোমাকে কিভাবে সোজা করতে হয় সেটা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে। ‘
— ‘ আপনি খুব খারাপ। ‘
— ‘ হলেও কিছু করার নেই৷ তোমারই বর। এখন ভালো মেয়ের মতো চুপচাপ বলে দাওতো। ‘
নীলা ঘাড় বাঁকিয়ে একবার সাদিদের মুখশ্রীতে নজর বুলালো। কাত হয়ে এসে সাবধানে সাদিদের বুকে মাথা রাখলো। সাদিদের পরিহিত শার্টের উপরের দুইটা বোতাম খোলা। যার দরুন তার বক্ষরোমগুলো নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশে উঁকি দিচ্ছে। নীলা আপনমনে সেগুলোতে আঙুল চালিয়ে খেলতে খেলতে বলে উঠল,
— ‘ এই জীবনে আমাকে ভুলে যাবার এমনকি ভুল বুঝারও অনেক বিষয় আপনার সামনে এসেছে। যখন সম্পর্কের কোনোরকম নাম ছিলো না তখনও আপনি আমাতে মত্ত ছিলেন। প্রবাসের এতো দীর্ঘ রজনী পার করেও এই আমিটাকেই একমাত্র মনে ধরে রেখেছিলেন। তারপর.. তারপর সম্পর্কের নাম আসার পরও আমাদের মাঝে দূরত্ব এসেছিল। এসেছিল ভুল-ভ্রান্তির অগণিত কারণ। নিজের খুব কাছের মানুষগুলোও আমাকে ভুল বুঝতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু তখনও আপনি কেন এমনটা করলেন? কেন এতো ভালোবাসলেন? কেন সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে এই আমিটাকেই বিশ্বাস করলেন? আমার যে আপনার এই প্রচন্ড ভালোবাসার সামনে ভয় হয়। খুব ভয় হয়। ‘
নীলার কথাগুলো ক্রমশ জড়িয়ে যাচ্ছে। সাদিদ নীলার মুখ না দেখেও স্পষ্ট বুঝতে পারছে তার প্রাণপাখির মায়াবী আঁখিজোড়াতে নোনাজল এসে ভিড় জমিয়েছে। নীলা সাদিদের বুকের শার্ট শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। সাদিদ সযত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুলের ভাঁজে চুমু দিলো। নরম শরীরের প্রাণপাখিটাকে সাবধানে বুক পাঁজরে আঁকড়ে নিয়ে মায়াভরা কন্ঠে বলল,
— ‘ ভালোবাসিতো। আর ভালোবাসায় বিশ্বাস না থাকলে হয়? ‘
— ‘ লোকে বলে সময়ের সাথে সাথে সম্পর্কের মতো বিশ্বাসেও ফাটল ধরে। ‘
— ‘ হ্যাঁ সেটা হয়তো দেখা যায়। কিন্তু বউ, তাই বলে কি সবাই এক? সবাই কি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায়? ব্যতিক্রমতো অবশ্যই থাকবে৷ তাই বলে সবাইকে এক পাল্লায় মাপা কোন দিক দিয়ে ঠিক? ‘
নীলা ঘাড় উঁচিয়ে সাদিদের দিকে তাকাতেই সে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। নীলার মনে যে এখনও অগণিত প্রশ্নের আনাগোনারা এসে ভিড় জমাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে তার মুখটা আঁজলাভরে ধরলো। অতঃপর একটু নিচু হয়ে সাদিদ তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে পূণরায় বলল,
— ‘ পৃথিবীটা এখন ক্রমশ আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে। দিনকে দিন অবিশ্বাস, ছলনা, মিথ্যার আড়ালে ভালোবাসার সজীবতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। এই ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা বড্ড যন্ত্রণার। কিন্তু তাই বলে এখনও যে ভালোবাসার সায়য়ের অক্লান্ত প্রেমিক পুরুষের দেখা মিলবে না তেমনটা ভাবা অনুচিত। জানি না আমি কেমন বা কতটুকু তোমার প্রেমে মাতোয়ারা। শুধু এতটুকু জানি তোমার জন্য অনুভূতিগুলো অন্তরাল থেকে উপলব্ধি করি। আর শেষাংশে এসে অনুরাগটা অন্তরালের সর্বোচ্চ গহীনে এসে আপনমনে তৈরি হয়। তাই ভুল বুঝা সম্ভব না বউ। একবারেই সম্ভব নয়। ‘
নীলার বন্ধ চোখ বেয়ে পড়া নোনাজলগুলো তার শুকনো গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। এত সুখ সে কিভাবে সহ্য করবে? পারবে তো দীর্ঘ বর্ষ রজনী পেরিয়ে এই ভালোবাসার মানুষটাকে সযত্নে আগলে রাখতে?
নীলা চঞ্চল হরিণীর ন্যায় নিজেও সাদিদের গালে হাত রাখলো। সাদিদ তার কাজকর্ম ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারলো না। তাকে চরম মাত্রায় অবাক করে দিয়ে নীলা নিজের ভেজা অধরযুগল তার শুষ্ক ঠোঁটজোড়াতে মিলিয়ে দিলো৷ কয়েক মুহূর্ত সাদিদ চমকিত ভাবের মধ্যেই থমকে রইলো।
নীলা আগ বাড়িয়ে ভুলেও কখনও আদর দিতে আসে না। তার তো সাদিদের এগিয়ে আসাতেই লজ্জায় মরিমরি অবস্থা হয়। সেই নীলা নাকি আজ তাকে এভাবে অস্থির হয়ে চুমু দিচ্ছে!
সাদিদ আর কালবিলম্ব করলো না। নীলাকে বুকে আগলে নিয়ে সাবধানে বালিশে শুইয়ে দিলো। কিন্তু দুটো মনের তৃষ্ণা নিবারণ তখনও থেমে রইলো না। নীলার এমন আগ্রাসী রূপ সাদিদের নিকট একেবারে নতুন৷ তাই মুহূর্তটাকে সে নিজেও চরম উপভোগ করছে৷ নীলার অস্থিরতা সাদিদের পুরুষ শরীরে তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি করছে। তাই নীলার বাম হাতের আঙ্গুলের ভাঁজে নিজের ডান হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। অপরহাতে নীলার চিবুক চেপে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট বিচরণের যেন প্রতিযোগীতা চালালো। কত সময় অতিবাহিত হলো সেটা দুইজনের কারোই খবরে নেই৷ কিন্তু মুখে যখন উষ্ণকোমল তরল পদার্থের উপস্থিতি টের পাওয়া গেল তখনই সাদিদের হুঁশ ফিরলো। কি হচ্ছে দেখার জন্য সে নীলার ঠোঁট ছেড়ে সরে আসলো। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নীলার মুখপানে তাকালো। মেয়েটা ইতিমধ্যে নিঃশব্দে কেঁদে-কেটে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে। সাদিদ এবার এতক্ষণের ভালোবাসা মিশ্রিত আদর ছেড়ে মৃদুস্বরে ধমকে উঠল,
— ‘ এটা কি হচ্ছে? আদর দিলে কেউ কান্না করে! নাকি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি এভাবে কাঁদবার জন্য? ‘
নীলা দ্রুত গাল-চোখ মুছে সাদিদের সামনে ভালো মেয়ে সাজতে চাইলো৷ সেটা বুঝতে পেরে সাদিদ তার অগোচরে নিঃশব্দে মৃদু হাসলো৷
দরজায় নক হতেই সাদিদ নীলার থেকে সরে এসে বিছানা থেকে নামলো। এগিয়ে যেতে যেতে শার্টের উপরের দুটো বোতাম লাগিয়ে নিলো। নিধি হাতে একটা মিডিয়াম সাইজের ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— ‘ ভাবীমণি তুমি আসলে কেন? কাউকে দিয়ে পাঠিয়ে দিতে। ‘
— ‘ অবসরই ছিলাম৷ তাই ভাবলাম আমিই নিয়ে যাই। নতুবা তুমি থাকলে তো পিচ্চুর ত্রিসীমাতে কাউকে থাকার প্রয়োজন হয় না। ‘
সাদিদ তার কথায় হালকা হাসলো। অতঃপর দরজা ছেড়ে বলে উঠল,
— ‘ তাহলে তোমাদের আদরের দুলালীকে কষ্ট করে নিজেই খাইয়ে দাও। খাওয়া নিয়ে এই মেয়ে মহা ড্রামাবাজ। ‘
শেষের কথাটা সাদিদ কিছুটা ফিসফিসিয়ে নীলার অগোচরে বললো। নতুবা তার প্রাণপাখির কানে গেলে মুখটা হুতুমপেঁচার মতো করে রাখবে। নিধি ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। তাকে ট্রে নিয়ে বিছানায় বসতে দেখে সাদিদ তোয়ালে কাঁধে নিয়ে আবারও বলল,
— ‘ তাহলে তুমি এই মহারাণীকে খাওয়াতে থাকো। আমি এরমধ্যে গোসলটা সেরে ফেলি। ‘
— ‘ আরে যাও যাও। বউয়ের চিন্তায় বেচারা গোসল করতে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না। ‘
নিধির সামনাসামনি হঠাৎ এমন কথায় নীলা-সাদিদ দুইজনই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সাদিদ বারকয়েক শুকনো কেশে বিনাবাক্য ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়ালো।
সাদিদ চলে যেতেই নিধি ট্রেয়ের উপর থেকে ঢাকনা সরালো। সকাল সকাল নিধি তার জন্য হুমমেইড স্যান্ডউইচ, দুটো সেদ্ধ ডিম আর অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসেছে। নীলার নজরে সেগুলো পরতেই তার চোখ-মুখ কুঁচকে এলো।
— ‘ আপুনি এসব কি এনেছো? আমি এসব খাবো না। ‘
— ‘ চুপ। প্রতিদিন এক বাহানা করিস। এসব খাবি না তো কি খাবি? ‘
— ‘ আচার নতুবা টক-ঝাল-মিষ্টি টাইপ কিছু নিয়ে আসো। ‘
— ‘ হুম সাদিদ বের হোক। তার কয়েকটা ধমক খেলেই টক-ঝালের স্বাদ একেবারে মিটে যাবে। ‘
নিধির এই কথার পর নীলার মুখটা আরও চুপসে গেল। কেননা সাদিদ এমনটাই করে। প্রতিদিন ধমকিয়ে-টমকিয়ে জোর করে হলেও এসব খাইয়ে ছাড়বে। তাদের হ্যাঁ না এর বাকবিতন্ডায় ইতিমধ্যে সাদিদ গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছে। নিধি রুমে আছে বিধায় সে খালি গায়ে বের হয়নি। ট্রিশার্ট আর টাওজার পরে তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসলো। নীলা দরজার খোলার আওয়াজে সেদিকে ফিরে তাকালো। গোসলের পর বরাবরের মতোই সাদিদকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। কিন্তু এই স্নিগ্ধ চেহারার ছেলেটা এখন তার কি অবস্থা করবে এটা ভেবেই নীলার আগাম বিরক্তি লাগছে। সে আবারও তীব্র বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে প্লেটের উপর রাখা খাবারগুলোর দিকে তাকালো। নিধি তার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসলো।
— ‘ কি হয়েছে ভাবীমণি? এতো তাড়াতাড়ি খাওয়ার পর্ব শেষ হয়ে গেল? নাকি আমিই গোসল দেরীতে শেষ করলাম? ‘
— ‘ শেষ কোথায়? এখনওতো শুরুই হয়নি। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ মানে হচ্ছে তোমার ধমক আজকাল কিছু মানুষের জন্য হজমির ন্যায় কাজ করে। হজমি এতক্ষণ ছিলো না তাই খাওয়াটা অসমাপ্তই রয়ে গেল। ‘
সাদিদ চোখ বাঁকিয়ে নীলার দিকে তাকাতেই সে মাথা নিচু করে বিছানার চাদর মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো। আড়চোখে সাহস করে একবার সাদিদের দিকে তাকাতেই আবারও সেই হালকা রাগের আভাযুক্ত চোখজোড়ার সম্মুখীন হলো। সে দ্রুত নজর সরালো।
— ‘ ভালো কাজ না? তাহলে এটা হবে কিভাবে? তোমার পিচ্চি বোনটা দিনদিন আদর খেয়ে বাঁদর হচ্ছে। ভালো জিনিস এখন তার মুখেই যায় না। তুমি জানো? আজকে এই মেয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করা ফ্লাস্কে বানিয়ে রাখা রং চা খেয়েছে। তাও আবার চেটেপুটে। অথচ তার শরীরের জন্য ভালো এমন কিছু একটা আমি জোর করেও তাকে খাওয়াতে পারি না। ‘
— ‘ ঠিকই তো পিচ্চু। আমার বেচারা ভাইটাকে এতো জ্বালাস কেন? ‘
— ‘ আমি কোথায় জ্বালালাম? ‘
নীলা মিনমিনিয়ে কথাটা বলেই আবারও আড়চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। সে এখনও একদৃষ্টিতে নীলাকেই পরখ করে যাচ্ছে। ইশশ এমন করে তাকায় কেন? নীলার ভয় লাগে না বুঝি?
— ‘ আমাকে দিয়ে হবে না সাদিদ। এই মেয়েকে তুমিই খাইয়ে দাও। ‘
নিধি আর দাঁড়ালো না। যেখানে সাদিদ রয়েছে সেখানে শুধুশুধু থেকে কি লাভ?
সাদিদ এগিয়ে গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে আসলো। অতঃপর বিনাবাক্য নীলার পাশে বসে ট্রে থেকে স্যান্ডউইচ হাতে নিলো। নিঃশব্দে সেটা নীলার মুখের সামনে ধরতেই নীলা দৃষ্টি এদিক-সেদিক ঘুরাতে শুরু করলো। সাদিদ কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ চোখে তার ফাঁকিবাজ বউয়ের কর্মকান্ড দেখলো। অতঃপর গম্ভীরস্বরে বলল,
— ‘ চুপচাপ হা করো। ‘
— ‘ না মানে.. খিদে নেই। ‘
নীলার কন্ঠে অসহায়ত্বের ছাপ। কথাগুলো তীব্র আকুতিভরা। কিন্তু সাদিদ সেসবে বিন্দুমাত্র গললো না। থমথমে গলায় আবারও বলল,
— ‘ খেলেই খিদে লাগবে৷ ‘
— ‘ এটা কেমন লজিক? এসব আজাইরা লজিক মানি না। ‘
— ‘ কানের পিছনে দুই তিনটা পরলে অনায়াসে মানতে বাধ্য হবে৷ এবার চুপচাপ খাবারটা শেষ করো। ‘
— ‘ আমি…
— ‘ পাখি। ‘
নীলা এবার ভদ্র বাঁচার মতো হ্যাঁ করলো। কে বলবে এই ছেলেটা মিনিট বিশেক আগেও তাকে আদরে আদরে ক্লান্ত করেছে! এই ছেলে মুহূর্তে মুহূর্তে গিরগিটির মতো রং পাল্টায়। এই নরম তো এই দাবানলের ন্যায় গরম।
সবকিছু খাইয়ে সাদিদ নীলার মুখটা সন্তপর্ণে মুছিয়ে দিলো। এতক্ষণ গম্ভীরমুখে থাকলেও এখন তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ঝুলছে। সাদিদ নীলার গোলুমোলু গালগুলো হালকা করে টেনে দিয়ে কপালে আদরভরা চুমু খেলো। নীলার ঠোঁটের কোণেও কিঞ্চিৎ হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কিন্তু সেটা বেশ একটা দীর্ঘায়িত হলো না।
— ‘ লক্ষ্মি বউ আমার। একটু পর আবারও আবার সাথে নাস্তা করে ফেলবে। একেবারে ফাস্ট ফাস্ট৷ ‘
এমন ভয়াবহ কথা শুনিয়েও সাদিদের মধ্যে কোনোরকম হেলদোল নেই। সে নিজেই ক্লোজেট থেকে অফিসিয়াল ড্রেস বের করে গায়ে জড়াচ্ছে। অপরদিকে নীলার মুখটা একেবারে দেখার মতো হয়েছে। যাকে এককথায় বলে বাংলার পাঁচ।
_____________
শাহেদ আর হাসিবুর রহমান ইতিমধ্যে গাড়িতে বসে ওয়েট করছে। সাদিদ বের হলেই একসঙ্গে যাবে। শাহেদ বারবার ঘড়ির কাটা দেখে যাচ্ছে কিন্তু সাদিদের খবর নেই।
— ‘ আর কতক্ষণ বাবা? লিভিংরুম থেকে এখানে আসতে সর্বোচ্চ দুইমিনিট লাগার কথা। সেখানে পনেরো মিনিট ওভার। ‘
— ‘ আরে অধৈর্য্য হচ্ছিস কেন? এটা নতুন কি? সে আমাদের এগিয়ে যেতে বলে প্রতিদিন নিজের মহৎ কাজ উদ্ধার করে। ‘
বলেই তিনি হেসে ফেললেন। অপরদিকে শাহেদও সিটে শরীর এলিয়ে মৃদুস্বরে হাসলো।
— ‘ মা, আমি না আসা পর্যন্ত প্লিজ ওকে একা থাকতে দিও না। তুমি না হয় ভাবীমণি নতুবা যে কোনো একজন সর্বদা যেন ওর পাশেপাশে থাকে। ‘
শায়লা রহমানের বিরক্তির মাত্রা যেন এবার অতিক্রম করবে। ছেলেটা প্রতিদিন এই এক কথা বলে বলে তার কান রীতিমতো পচিয়ে দিচ্ছে।
— ‘ সাদি, তুই কিন্তু এই বয়সে এসেও অনায়াসে আমার হাতের কয়েকটা থাপ্পড়-টাপ্পড় খেয়ে ফেলতে পারিস। প্রতিদিন এসব বলার কোনো মানে হয়? ‘
তার কন্ঠে প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ। সাদিদ সেটা দেখে মুখটা লটকিয়ে ফেললো। মায়ের হাতটা দুইহাতে চেপে ধরে উল্টোপাশে ঠোঁট ছুঁইয়ে নরম গলায় বলে উঠল,
— ‘ কি করবো মা? শান্তি পাই না তো। তাই নিজের একটু প্রশান্তির জন্য বারবার এমনকরে বলে যাই। ‘
শায়লা রহমানের মুখে তৎক্ষনাৎ বিরক্তি কাটিয়ে মায়া এসে ভর করলো। তার ছেলেটা যে কাউকে এমন করে ভালোবাসতে পারে এটা তার নিকট স্বপ্নের মতো। ছেলেটাকে কোনোসময় এইসব প্রেম-ভালোবাসায় জড়াতে দেখেনি৷ সবসময় পড়াশোনা, পরিবারের সদস্য আর বাকি সময়টুকু বন্ধুদের সাথেই কাটিয়েছে। আর আজ কি-না এই ছেলেটাই একটা মেয়েকে চোখে হারায়! প্রতিদিন মায়ের নিকট তাকে নিয়ে কতো আকুতি-মিনুতি করে! তিনি ছেলের কপালে স্নেহের চুম্বন করে সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— ‘ একদম চিন্তা করবি না। এরা দুইবোন আমার কাছে ছেলের বউ নয়। বরং দুইটা মেয়ে। তাই নিজের মেয়েকে দেখা নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না৷ ‘
সাদিদ একগাল প্রশান্তির শ্বাস টেনে হাসলো। অতঃপর মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে অদূরে সোফায় বসা নীলার দিকে এগিয়ে আসলো। তার পাগলী বউটা ভাগিনার সাথে বসে সিএন চ্যানেলে ওগি কার্টুন দেখছে। আর একটু পর পরই দুইজনের হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। সাদিদ সেটা দেখে নিজেও ঠোঁট চেপে খানিকটা হাসলো। তারপর এগিয়ে গিয়ে নীলার পাশে বসে শাদকে টেনে নিজের কোলে আনলো। গালে ঠেসে চুমু দিতেই শাদ বিরক্তির সুর তুলে গাল ঘষতে ঘষতে নীলার নিকট অভিযোগ তুললো,
— ‘ খালামণি, পাপু পঁপা। গাল খেয়ে ফেলে। ‘
নীলা হেসে ফেললো তার অভিযোগ মাখা কথা শুনে। সাদিদ তাকে হাসতে দেখে দুষ্টু হেসে নীলার হাসি বন্ধ করার টেকনিক অবলম্বন করে বলল,
— ‘ খালামণি আর কি বলবে? খালামণিরই তো আরও অনেককিছু খেয়ে ফেলি। গাল, নাক, ঠোঁ..
— ‘ আল্লাহরওয়াস্তে চুপ করেন। অসভ্য লোক একটা। ‘
শেষোক্ত কথাটা নীলা বেশ বিড়বিড়িয়ে সাদিদের অগোচরে নিচুস্বরে বলে উঠল। সাদিদ বুঝতে পেরেও এখনকার মতো ছেড়ে দিলো। অলরেডি অফিসের জন্য অনেক লেইট হয়ে গিয়েছে। তাই ঝটপট শাদের চোখের উপর হাত ধরে নীলার মাথায় গাঢ় চুমু খেলো।
— ‘ ইশশ সরাও সরাও। অন্ধকার লাগে। ‘
— ‘ বিচ্ছু একটা। চাচি মণির সাথে একদম দৌড়াদৌড়ি করবে না। তাহলে কিন্তু চাচ্চু খুব রাগ করবো। মনে থাকবে? ‘
শাদ একেবারে সব বুঝে গিয়েছে এমন একটা ভাব টেনে দ্রুত মাথা উপর নিচ করলো। কিন্তু তার ছোট্ট মস্তিষ্ক বরাবরই সাদিদের চাচি মণি আর নীলার খালা মণি ডাক নিয়ে মারাত্মক ঝামেলা পাকিয়ে বসে থাকে। কিন্তু সে প্রতিবারই নির্বাক শ্রোতা। সাদিদ নিজের অনাগত স্নেহের টুকরোটাকেসহ খালামণি এবং ভাগিনাকে আদর দিয়ে অফিসের জন্য বের হয়ে গেল।
গাড়ির সামনে আসতেই শাহেদ রসিকতা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠল,
— ‘ ভাগ্যিস এসেছিস। নতুবা আমি আর বাবা ভেবেছিলাম একটা ঘুম দিয়ে দিবো। ‘
সাদিদ তার কথার সারমর্ম বুঝতে পেরে ঠোঁট কামড়ে হাসলো৷ অতঃপর বিনাবাক্য দরজা খোলে ফ্রন্ট সিটে বসে পড়ল। শাহেদ আর দেরি না করে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দিলো। কিছুদূর যাওয়ার পরই গাড়ির মিররে চোখ পরতেই সাদিদের বুক বোধহয় কেঁপে উঠল। সে উত্তেজিত কন্ঠে শুধু বলল,
— ‘ ভাইয়া প্লিজ গাড়ি থামাও। ‘
শাহেদ এককথাতেই গাড়ির ব্রেক চাপলো। কিন্তু কি জন্য সাদিদ ব্রেক করতে বলেছে সেটা আর জিজ্ঞেস করতে পারলো না। কেননা সাদিদ ইতিমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছে।
#চলবে…
[ প্রিয়পাঠক, দীর্ঘদিনের অনুপস্থিতির জন্য পেইজে রিচ প্রবলেম হচ্ছে। তাই অনুরোধ থাকবে যাদের নিকট গল্পটা পৌঁছাবে প্লিজ রেসপন্স করবেন। কমেন্ট না করতে পারেন অন্ততপক্ষে রিয়েক্ট করার চেষ্টা করবেন। ]