অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৫৬

0
4651

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৬

নীলা মোজাইক পাথরের মেঝেতে নিচু হয়ে বসে স্যান্ডেলের ভিতরে চলে আসা ছোট নুড়ি পাথরটা বের করে নিলো। অসমান ধারালো তীক্ষ্ণ ছিলো বলে পায়ের তালুতে একটুখানি লেগেছে। সে এতক্ষণ এটা পরখ করতেই ব্যস্ত ছিলো। এরিমধ্যে আচমকা কেউ একজন ঝড়ের গতিতে এসে তাকে নিজের বলিষ্ঠ বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়ে বুক পাঁজরে আঁকড়ে ধরলো। তাকে আঁকড়ে ধরা মানুষটার হৃদ স্পন্দন অস্বাভাবিক হারে চলছে। নীলাকে এতটাই শক্ত করে ধরেছে যে সে মাথা উপরে তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছে না। কিন্তু ব্যক্তির মুখশ্রী নজরে না এলেও নীলার বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হচ্ছে না মানুষটি কে?
কেননা তার স্পর্শ যে নীলার রক্তকণিকাগুলোর পর্যন্ত মুখস্থ। তার আদরমাথা ভালোবাসাগুলো নীলার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে রয়েছে। প্রেমিক পুরুষের এই মাতালকরা গায়ের গন্ধে নীলা চোখ বন্ধ করেই দূর থেকে বহুদূর পাড়ি দিতে পারবে।

— ‘ কলিজা, পেইন হচ্ছে তোমার? খুব বেশি ব্যাথা হচ্ছে? ‘

সাদিদের কন্ঠস্বর ক্রমশ কেঁপে কেঁপে উঠছে। সাথে যুক্ত হয়েছে চোখে-মুখে মারাত্মক ভয়। কিন্তু নীলা এসবের কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছে না। কি পেইন? কিসের ব্যাথা?
নীলা দ্বিধাজড়িত কন্ঠেই জিজ্ঞেস করলো,

— ‘ কিসের পেইন? আমি আবার কখন ব্যাথা পেলাম? ‘

সাদিদের কাঁপুনিভাব এখনও যায়নি। সে তার গালে নিজের কাঁপা ডান হাতটা রেখে ভয়ার্ত কন্ঠেই আবার বললো,

— ‘ তোমাকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ তুমি নিচে বসে পড়লে৷ আমি মিররে স্পষ্ট তোমার ব্যাথাজনিত মুখশ্রী দেখেছি। প্রিন্সেসের আগমনের তো আরও সময় বাকি আছে। এতো তাড়াতাড়ি পেইন উঠে গেল! আসো কোলে নেই। আমরা এখনই হসপিটাল চলে যাব। ‘

নীলা এই মুহূর্তে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। সে হাসবে না কাঁদবে এটাই এখন বুঝে উঠতে পারছে না। মূলত এককথায় সে নিজের অনুভূতিই বুঝতে এইমুহূর্তে অক্ষম। তাই সে কেবল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে সাদিদের অস্বস্তিভরা মুখশ্রীতে তাকিয়ে রয়েছে। এরিমধ্যে শাহেদরা গাড়ি থেকে নেমে চলে এসেছে। এদের দুইজনকে এই অবস্থায় দেখে তারাও চিন্তায় পরে গেল। শাহেদ দুশ্চিন্তাগ্রস্তে বলে উঠল,

— ‘ কি হয়েছে ভাই? তুই এভাবে দৌড়ে আসলি! নীলা ঠিক আছে তো? তুই ওকে এভাবে ধরে আছিস কেন? কি হয়েছে নীলা? তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে? ‘
— ‘ হ্যাঁ রে মা। তুই ঠিক আছিস? শাহেদের মা, এই শাহেদের মা তাড়াতাড়ি বের হও। দেখো মেয়েটার শরীর খারাপ করেছে। ‘

এতক্ষণ বোধহয় এতটুকুরই অভাব ছিলো৷ যা এই পাগলাটে প্রেমিকের কৃপায় ষোলোআনায় পরিপূর্ণ হয়েছে। নীলাকে আরও একদফা অবাক করে দিয়ে বাড়ির ভিতর থেকে হুড়মুড়িয়ে শায়লা রহমান, নিধি এবং কাজের মেয়েগুলো পর্যন্ত বেরিয়ে আসলো। মাকে দেখে যেমন সব সন্তানেরা নরম হয়ে যায় সাদিদেরও তেমনটাই হলো। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে না পরলেও চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে আসলো। সে ধরা গলায় শায়লা রহমানের উদ্দেশ্য বলে উঠল,

— ‘ মা.. মা আমার পাখির কষ্ট হচ্ছে। ‘

ছেলের এমন অসহায় মুখশ্রী দেখে মায়ের মনটা নিঃশব্দে যেন ডুকরে কেঁদে উঠলো। তিনি আলতো হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে স্বান্তনার স্বরুপ প্রবল আত্মবিশ্বাসের কন্ঠে বললেন,

— ‘ শান্ত হো বাবা। ওর কিছু হবে না। আমরা সবাই আছিতো। এখনই হসপিটাল চলে যাবো। কই গো শুনছো? জলদি এমারজেন্সিতে কল দিয়ে হসপিটালে সিট বুক করো। আমরা আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট করবো না। ‘

নীলার চোখজোড়া এখনও গোলগোল হয়ে আছে। কি হচ্ছে এসব? দয়া করে কেউ কি তাকে কষ্ট করে একটু বলবে?
সাদিদ নীলাকে এতক্ষণ নিজের বুকেই চেপে ধরে রেখেছিল। এখন তাকে কোলে তুলে নিতে গেলেই নীলার ভাবনায় ছেদ পরলো। সে এই ছেলের কর্মকান্ডে এখন মারাত্মকভাবে বিরক্ত। তাই সাদিদকে থামিয়ে বিরক্তিমাথা কন্ঠে বলল,

— ‘ ছাড়ুন বলছি। একদম কাছে আসবেন না? ‘
— ‘ এমন করে বলে না পাখি৷ তোমার কষ্ট হচ্ছে তো। আসো এখনই হসপিটালে নিয়ে যাব। ‘
— ‘ চুপ থাকুন তো। আমি কি একবারও আপনাকে বলেছি যে, আমার কোনো জায়গায় ব্যাথা হচ্ছে?
আমি উত্তর দিচ্ছি। বলিনি। তাহলে এসব পাগলামির মানে কি? ‘
— ‘ পাগলামি কোথায় করলাম? আমি স্পষ্ট তোমার চোখে-মুখে ব্যাথার ছাপ দেখেছি। ‘

নীলা ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেললো। না এই পাগলকে বুঝানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে একপলক বাকি সবার দিকে তাকালো। সাদিদের পাগলামিতে তারাও চিন্তায় পরে গিয়েছে। তাই সকলের চিন্তার অবসান ঘটাতে সে পাশে পরে থাকা ছোট্ট নুড়ি পাথরটা হাতে নিলো। হাত বাড়িয়ে সেটা সবার দৃষ্টির সামনে এনে সকলের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ এই যে পাথরটা দেখছেন? এটা পায়ে লেগে একটু ব্যাথা পেয়েছিলাম৷ আর সেটা দেখেই পুরো ঘটনা বিস্তারিত না শুনেই এই পাগল মানুষ নিজেও চিন্তায় পরেছে এবং সাথেসাথে আপনাদের সবাইকেও দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। ‘

সবাই তার কথা শুনে বিস্মিত হলো। অপরদিকে সাদিদ তীক্ষ্ণ চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। নীলা সেটা দেখেও পাত্তা দিলো না। হুহ, সে নিজেই পাগল আবার এখন আসছে নীলার দিকে চোখ বড় করে তাকাতে। তাকাবেই না সে।
সবাই কয়েক মুহূর্ত একে-অপরের মুখপানে তাকিয়ে থেকে এবার সশব্দে হেসে উঠল। শাহেদ হাসতে হাসতেই বলতে থাকলো,

— ‘ লাইক সিরিয়াসলি ভাই? তুই সব না শুনেই এতদূর চিন্তা করে নিলি? সত্যিই আমার হাসি থামছে না৷ ‘

পাশে দাঁড়িয়ে নিধিও নিঃশব্দে মুখ টিপে টিপে হাসছে৷ সে শাহেদের কাঁধে হাসি থামাতে মৃদুভাবে ধাক্কা দিলো। নিধির ইশারা বুঝতে পেরে সে প্রাণপণে হাসি থামাবার চেষ্টায় রয়েছে। কিন্তু হাসি যেন থামার নামই নিচ্ছে না। রহমান দম্পতিও ছেলেকে বউয়ের প্রতি এমন পাগল দেখে মুখ টিপে হেসে যাচ্ছে। সাদিদ এবার নীলার ন্যায় সকলের দিকে একপলক বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর নীলার দিকে তাকিয়ে ভ্রযুগল কুঁচকে গম্ভীর থমথমে স্বরে বলে উঠল,

— ‘ তুমি তাহলে বাহিরে কেন এলে? আর তোমার মধ্যে এতো তাড়াহুড়োই বা কেন ছিলো? ‘

নীলার এতক্ষণের পূর্ববর্তী বিরক্তির আভাস সম্পূর্ণ মিলিয়ে গিয়ে মুখটা চুপসে গেল। সাদিদ এতক্ষণ দুশ্চিন্তায় পাগল থাকলেও এখন নীলাকে ঠাটিয়ে দুইটা লাগাতে পিছুপা হবে না। তাই সে আমতা আমতা করে নিচুস্বরে বলল,

— ‘ আপনার ফোনটা ভুলে রেখে এসেছিলেন। ‘
— ‘ সিরিয়াসলি! তুমি সামান্য একটা ফোন দেওয়ার জন্য এমনভাবে বেরিয়ে আসবে? তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো? এতটুকু বুঝ শক্তি কি তোমার মধ্যে এখনও হয়নি? তোমাকে ব্যাথায় কাতর হয়ে নিচে বসতে দেখে আমার অনুভূতি কেমন হয়েছিল সেটা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে? কেন এসেছো বাহিরে? ‘

শেষোক্ত কথাটা সাদিদ উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বললো৷ নীলা আচমকা এমন ধমকে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠল। সাদিদ তারপরও থামলো না। সকলের সামনেই নীলার কাঁধ চেপে তার শরীর মৃদুভাবে ঝাঁকিয়ে আবারও ঝাঁঝালো স্বরে বলল,

— ‘ মেরে ফেলবি আমাকে? কতটুকু কষ্ট হয় বুঝিস না তুই? এতটা পাষাণ কিভাবে হতে পারিস? একটুও দয়ামায়া কি তোর মধ্যে নেই? ‘

সাদিদ মৃদু ধাক্কা দিয়ে নীলার কাঁধ ছেড়ে দিলো। নীলার চোখজোড়াতে ভালোবাসার মানুষ থেকে এমন তিক্ত বাক্য শুনে ইতিমধ্যে অবাধ্য অশ্রুকণারা এসে ভিড় জমিয়েছে। সে অশ্রুসিক্ত আঁখিযুগলে আড়চোখে একবার উপস্থিত সবার দিকে তাকালো।
সাদিদ কখনোই নিজেদের ভেতরকার রাগ-ক্ষোভ অন্যকারো সামনে প্রকাশ করে না। কিন্তু আজ হঠাৎ সকলের সামনে এমন করাতে কষ্টের সাথে সাথে নীলার ভীষণ লজ্জাও লাগছে৷ সে বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব বেশি বিব্রতবোধ করছে। সাদিদ এখন নিজের মধ্যে না থাকলেও নীলার অবস্থাটা বাকি সবাই বেশ ভালোই বুঝতে পারছে। তাই শাহেদই গম্ভীরস্বরে বলল,

— ‘ সাদি, বিহেভ ইউরসেলফ। ওর সাথে তুইতোকারি করছিস কেন? নীলার এখানে কি দোষ! তুই নিজেইতো উল্টো পাল্টা ভেবে নিয়ে এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি করেছিস। ‘
— ‘ কি বললে তুমি? দোষ নেই? ‘

সাদিদ এতটাই রেগে গিয়েছে যে পাশের একটা ডালিয়া ফুলের টবে সজোরে লাথি দিলো৷ টব ভাঙার বিকট আওয়াজে নীলার এবার নিঃশব্দের কান্না ফুঁপানিতে রূপ নিলো। নিধি তাকে সামলানোর জন্য দ্রুত বাহুজড়িয়ে আগলে ধরলো৷

— ‘ চুপ। একদম কাঁদবি না। একটা টু শব্দ যেন না হয়৷ তোর কান্নার আওয়াজ আমার কাছে বিষের ন্যায় মনে হচ্ছে। ‘
— ‘ চুপ কর সাদি। কখন থেকে মেয়েটার সাথে রাগারাগি করে যাচ্ছিস। ভুলে যাস না তোর মা-বাবা, ভাই-ভাবীসহ অনেকেই এই মুহূর্তে তোদের সাথে উপস্থিত। তাই নিজেদের রুমের বিষয় বাইরে এনে মেয়েটাকে আর বিব্রতবোধ করাস না। ‘

সাদিদ কোনোভাবেই নিজের রাগটাকে যেন কমিয়ে আনতে পারছে না। সে রক্তিম চোখজোড়া নিয়ে আবারও একপলক নীলার অশ্রুসিক্ত মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে হনহনিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। এলেমেলোভাবে গেইট পেরিয়ে তার গাড়িটি বের হতেই শায়লা রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলার দিকে এগিয়ে গেলেন। মেয়েটার চোখ-মুখ ইতিমধ্যে ফুলে গিয়েছে। তিনি সযত্নে গাল মুছিয়ে দিয়ে তাকে স্বান্তনা দিতে বলে উঠলেন,

— ‘ কাঁদিস না মা। জানিস তো ছেলেটা আমার তুই বলতে পাগল। চোখে হারায় তোকে। তাইতো তোর এমন ছেলেমানুষী সহ্য করতে পারে না। ছেলেটা প্রচন্ড ভয় পায় তোকে নিয়ে। ওর এমন আচরণে কষ্ট পাবি না৷ দেখ গিয়ে, হয়তো বা তোকে ধমকিয়ে সে নিজেও এখন শান্তি পাচ্ছে না৷ ‘
— ‘ আমি জানি মা। আমি উনার সবটুকুই জানি৷ কিন্তু আমিও যে সহ্য করতে পারছি না। আমার কষ্ট হচ্ছে মা। খুব কষ্ট হচ্ছে। ‘

নীলা শায়লা রহমানের বুকে মুখ চেপে নিজের ভেতরকার কষ্টের সাগরটা কমাতে চাচ্ছে। কিন্তু না৷
অতিরিক্ত ভালোবাসা দিয়ে দিয়ে সাদিদ তাকে আজ পুরোপুরি ভালোবাসার কাঙাল বানিয়ে ছেড়েছে৷ তাই এখন আর একবিন্দু কষ্ট তার দ্বারা সহ্য হয় না। মন যে কেবল সুখ চায়। বড্ড বেশি ভালোবাসার সুখ।

______________________

ধানমন্ডির একটা আভিজাত্যপূর্ণ রেস্টুরেন্টের কর্ণারের টেবিলে শান্ত মাথানিচু করে বসে রয়েছে। প্রাইভেসির জন্যই মূলত এখানে বসা। অতিথির সুবিধার জন্য এখানে কেবিন সিস্টেম করা আছে। আর শান্ত আপাতত তেমনই একটা কেবিনে রয়েছে। সে একা নয়। তার সামনের চেয়ারেই তানবীর একধ্যানে ফোন স্ক্রলিংয়ে ব্যস্ত। যেন এমন একটা ভাব, এই মুহূর্তে ফোনের নিউজফিডের উর্ধ্বে তার কাছে আর কিছু নেই৷ শান্ত আবারও আড়চোখে একবার তার দিকে তাকিয়ে মিনিমিনিয়ে বলল,

— ‘ আমি আগে থেকে কিছু জানতাম না। আর না এই সম্পর্কে কোনো আইডিয়া ছিলো। হঠাৎ করেই এতসব..
— ‘ ইট’স ওকে ডিয়ার। তুমি এমন ভয়ার্ত স্বরে এক্সপ্লেইন করছো কেন? এখানে ভয় পাওয়ার মতো কি আছে? এনগেজমেন্ট হয়েছে, সো কংগ্রাচুলেশনস। ‘

তানবীরের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। শান্তর বুকের বাম পাশটা আচমকা তীক্ষ্ণ ব্যাথায় যেন জর্জরিত হয়ে গেল। তানবীর তাকে তুমি বলে সম্বোধন করছে? এই ছেলেটা তো সবসময় তাকে বলতো আপন মানুষদের সে তুমি করে বলতে পারে না। কেমন পরপর লাগে। শান্ত এই নিয়ে কতসময় রাগ দেখিয়েছে অথচ তানবীরের ভাষা শুধরাতে পারেনি। সে হাসিমুখে তখন আরও বেশি করে তুইতোকারি করতো। পূর্বে এটাতে বিরক্তবোধ করলেও আজকে যেন এটা না করাতেই তানবীরের শব্দগুলো তার নিকট অসহ্যনীয় তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার ন্যায় অনুভব হচ্ছে।
তার এমন এলেমেলো অবস্থা দেখে তানবীর যেন আরও বেশি মজা পেল। তাই টেবিলের উপর থেকে শান্তর বামহাতটা আচমকা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। অতঃপর অনামিকাতে চকচক করা সাদা পাথরের ছোট্ট ডায়মন্ডের আংটিটা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো।

— ‘ বাহ্। খুব সুন্দরতো। বর তাহলে পয়সাওয়ালা? এনগেজমেন্টেই এতো দামি ডায়মন্ডের আংটি দিলে বিয়ের সময়তো শরীর ভরে গহনা পরিয়ে দিবে৷ আঙ্কেল-আন্টি নিশ্চয়ই খুব খুশি? ‘
— ‘ আপনি এমন করছেন কেন? ‘
— ‘ আরে আমার কথা ছাড়ো। তোমাদের কথা বলো৷ পরিবারের সবাইতো নিশ্চয়ই অনেক বেশিই খুশি? শতহলেও কানাডার মাটিতে সেটেল হওয়া ছেলে। ভালো পরিবার, টাকা-পয়সা অঢেল। তারউপর ছেলে দেখতে শুনতেও হিরোর থেকে কম না৷ মেয়ে জামাই হিসেবে আর কি চায়? এমনটাই তো? ‘
— ‘ প্লিজ আমার কথাটা বুঝার চেষ্টা করুন৷ আপনাকে আমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ‘
— ‘ ইশশ সুইটহার্ট। আ’ম টোটালি ফাইন। তাছাড়া সামনে বড়সড় একটা বিয়ের দাওয়াত পাবো৷ ঠিক না থেকে কি পারা যায়? ‘

তানবীর হাসিমুখেই সবটা কথা শেষ করলো। শান্ত মনে কষ্ট নিয়ে তানবীরের মুখপানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। তানবীরের হাসিমুখটা ধীরে ধীরে থমথমে রূপে পরিণত হতে লাগলো। যেমনটা গ্রহণের সময়ে চন্দ্র-সূর্যের হয়ে থাকে। হাসিমাখা মুখটাতে মুহূর্তেই নিকষ কালে অন্ধকার যেন ছেয়ে গেল। আর এই সবটাই একেবারে সামনে বসে শান্ত স্বচোখে দেখে গেল। আচমকা শান্তর বামহাতটা তানবীর শক্ত হাতে চেপে ধরলো।
শান্ত মৃদুভাবে ব্যাথা পাচ্ছে। অপরদিকে তানবীর সেটা দেখেও পুরোপুরি ভাবলেশহীন। শান্ত এবার সহ্য করতে না পেরে দুর্বলস্বরে বলে উঠল,

— ‘ আমি খুব ব্যাথা পাচ্ছি। ‘
— ‘ ওহ্ রিয়েলি? আমারতো মনে হচ্ছে না। বিয়ের সুখের সামনে তো এসব নিছক ধরাছোঁয়ার বাহিরে। তাই না হটি? ‘
— ‘ প্লিজ এসব বলবেন না। আপনি নিজের মধ্যে নেই। ‘
— ‘ তাই নাকি? ‘

তানবীরের শান্ত স্বর নিমিষেই পাল্টে গেল। সে একটানে শান্তর অনামিকা আঙুল থেকে বাগদানের রিংটা টেনে খোলে নিলো। দিকবিদিকশুন্য হয়ে সেটা কোথাও পরতেই শান্ত চমকিত দৃষ্টিতে তানবীরের মুখপানে তাকালো। নিজের মধ্যেকার উত্তেজনা চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল,

— ‘ কি করেছেন এটা আপনি? কোথায় ফেলেছেন রিংটা? এটা খুঁজে না পেলে বাবা আমাকে জীবিত কবর দিয়ে দিবে। ‘

তানবীর যেন আর সহ্য করতে পারলো না। চোখের পলকে শান্তর হাতে টান দিয়ে চেয়ার থেকে তুলে নিলো। শান্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই টেবিল ঘুরিয়ে তাকে নিজের পাশে টেনে জোর প্রয়োগ করে নিজের উরুর উপর বসিয়ে দিলো। শান্ত হয়তো অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তানবীর সেটা হতে দিলো না। ক্ষিপ্তভাবে তার ঠোঁট কামড়ে ধরলো।
শান্তর কয়েক মুহূর্ত লাগলো পুরোপুরি বিষয়টা বুঝে উঠতে। আর যখন বুঝতে পারলো কি হচ্ছে এটা, তখন মেয়েলি লজ্জায় সে কুঁকড়ে গেল। কিন্তু সেটা দীর্ঘায়িত হলো না। কেননা ধারালো দাঁতের হিংস্র কামড়ে ঠোঁটজোড়া বোধহয় কেটে যাচ্ছে। তানবীরের এমন আক্রমণে শান্ত কোনোরকম বাক্য উচ্চারণ করার পরিস্থিতিতে নেই। আর সে চায় ও না। যেহেতু অন্যায় সে করেছে তাই এখন শাস্তি ভোগ করতেই হবে৷ নিজের সহ্যশক্তি ক্রমশ নিচে নেমে আসছে৷ ব্যাথায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে সমস্ত মুখমণ্ডল। কিন্তু শান্ত নির্বাক। তানবীরের পিঠের শার্ট আঁকড়ে ধরে সে নিজেকে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে৷ আর অপরদিকে নিঃশব্দের নোনাজলে তার শুষ্ক গাল ভিজে সিক্ত হচ্ছে।
কতক্ষণ এই হিংস্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু ভালোবাসার ভিন্ন রূপের দীর্ঘ যন্ত্রণার পাঠ চুকিয়ে ব্যাথাযুক্ত ঠোঁটযুগলের ব্যাথা নিরাময়ে এবার প্রেমিক পুরুষ কোমল আদরে প্রেয়সিতে মত্ত হলো। গাঢ় থেকে তীব্র গাঢ় হতে থাকলো অধরযুগলের বিচরণ। শান্তর কোমড় পেঁচিয়ে তাকে নিজের সাথে তানবীর আরেকটু ঘনিষ্ঠ করে তুললো৷ শান্ত বাধা দেওয়ার শক্তি খুঁজে পেল না। শুধু অনুভব করতে পারলো ভীষণ লজ্জা এবং ব্যাখাহীন ভালোলাগার এক তীব্র শিহরণ। নিজের রাগ, ক্ষোভ, ভালোবাসা সবকিছু মিটিয়ে নিয়ে প্রেমিক এবার ধীরে ধীরে প্রেয়সির ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁটযুগল আলাদা করলো। কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি নয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে তানবীর ঘন ঘন শ্বাস টেনে বলে উঠল,

— ‘ তুই কি ভাবিস, তোর এমন অর্থহীন এনগেজমেন্টের কথা শুনে এই তানবীর তোকে ছেড়ে দিবে? হতে দিবে অন্যকারো ঘরনি? এমনটা ভেবে থাকলে তুই ভুলের দুনিয়ায় বসবাস করছিস৷
ভেবেছিলাম তোর অনার্স শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবো৷ তাই তোর বাপের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাইনি। কিন্তু শশুরমশাইয়ের দেখি আমার বউকে অন্যকারো ঘরে তুলে দেবার বহুত তাড়া। তাই এবার আমারও তাড়া লাগছে। এখনই বিয়া হইবো। অপেক্ষার পাঠ চুকিয়ে এখন সময় বিয়ের পাঠ পূর্ণ করার। ‘

শান্তর গলার স্বর আটকে গিয়েছে। কি থেকে কি হচ্ছে সবকিছুই যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না। কিন্তু সেটা হলেও পারা যেত। ভুল যায়গায় ভুল কথা বলার থেকে নীরব থাকা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু শান্ত যেন এখন এই অবুঝের কাজটাই করে বসলো।

— ‘ আংটিটা? ‘

তানবীর মুহূর্তেই কপাল সরিয়ে শান্তর গাল চেপে ধরলো। এমনভাবে ধরেছে যেন এখনই গাল ভেদ করে দাঁতে আঙুল লেগে যাবে।

— ‘ এমন আজাইরা পটপট করবি তো মুখটা একেবারে সেলাই করে দিবো৷ আংটি? তাই না? ভুল করেও আর একটা আংটি বিষয়ক কথা বললে আংটির সাথে সাথে তোকেও ছুঁড়ে ফেলবো৷
কিন্তু ছুঁড়বো বলেছি বলে এটা ভাবিস না যে তোকে ছেড়ে দিব। এই তানবীরের থেকে ছাড়া পাওয়া এতো সোজা না জান। একবার যেহেতু হাত আঁকড়ে ধরেছি সেটা আমৃত্যু পর্যন্ত ছাড়ছি না। তুই ছাড়তে চাইলেও ছাড়বো না। এটা মগজে প্লাস শরীরের সব অঙ্গে ভালোভাবে গেঁথে রাখ৷ ‘

গালটা এতক্ষণ পর ছাড়া পেতেই যেন শান্ত জান হাতে ফিরে পেল। ব্যাথায় সেখানটা টনটন করছে। কিন্তু মুখফোটে কিছু বলার সাহস নেই৷ যেই পরিমাণ রেগে আছে দুই চারটা চর-থাপ্পড় অনায়াসে ফ্রিতে খেয়ে নিতে পারে। তাই চুপ থাকায় শ্রেয়৷ কিন্তু আচমকা তানবীরের ঠোঁটের কোণে চোখ পরতেই শান্ত লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। সে আজকে হালকা পিংক কালারের একটা লিপস্টিপ দিয়ে ছিলো৷ আর তখনকার তানবীরের এরূপ পাগলামির জন্য তার ঠোঁটে এখন শান্তর ঠোঁট হতে সেটা জায়গাবদল করেছে। সেটা দেখেই শান্তর ভিষণ লজ্জা লাগছে।
তাকে এমন লাজুকলতা হয়ে হাসতে দেখে তানবীরের রাগের পরিমাণ যেন আরও দ্বিগুণ হলো। সে বিষয় না বুঝে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে উঠল,

— ‘ হাসছিস কেন? আমি এখানে হাসির মতন কি বললাম? ‘
— ‘ না মানে.. আপনার ঠোঁটে লিপস্টিক। ‘

বলেই শান্ত উল্টো ঘুরে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিলো৷ ইশশ কি লজ্জাজনক ব্যাপার।
তানবীরের কয়েক সেকেন্ড লাগলো বিষয়টা বুঝে উঠতে। বিষয়বস্তু ঠাহর হতেই সে রাগ ভুলে নিঃশব্দে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। কয়েক কদম এগিয়ে এসে শান্তর একেবারে পিঠ ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে দাড়ালো। অতঃপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,

— ‘ ঠিক জায়গায়ই তো রয়েছে। তোর ঠোঁটের এই মিষ্টি তো আমার ঠোঁটেই লেগে থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এটা ভাবিস না বিয়ের আগেই মিষ্টিতে ভাগ বসিয়েছি বলে সরি-টরি কিছু বলবো। তোর বুঝার সুবিধার্থে আবারও বলে দিচ্ছি যে এমনটা আমি ভুল করেও করবো না। হয়তো বা কাজটা তোর ছাগলামিতে আগেই হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জায়গা ঠিকই আছে৷ তাই অযথা লজ্জা না পেয়ে এখন থেকেই অভ্যাসে পরিণত করতে শিখ৷ কেননা পরবর্তীতে হুটহাট এই অংশে আমাকে খুঁজে পাবি৷ খুব একান্ত গরিষ্ঠতার সাথেই পাবি। ‘

শান্তর যেন দম আটকে আসার উপক্রম। জীবনে প্রথমবার এমন অনুভূতিতে পুরো শরীর জমে বরফ শীতল হয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা নিউরন যেন অচল হয়ে শান্তকে পুরোপুরি নিশ্চল বানিয়ে ছেড়েছে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here