গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৫৮
সাদিদের চোখে-মুখে প্রচন্ড বিরক্তির ছাপ৷ সাথে যুক্ত রয়েছে হালকা রাগের আভা। কিন্তু নীলা এই মুহূর্তে শাশুড়ি বোনকে পেয়ে নিজের মধ্যকার ভয়টাকে সাদিদের সম্মুখে আসতে দিতে চায়ছে না।
— ‘ আমি কিন্তু এবার লাস্ট বার বলছি। এরপর কথা নয় ডিরেক্ট একশনে যাব। ‘
— ‘ মা দেখছেন, আপনার বজ্জাত ছেলে কি বলছে? আপনাদের সামনেই আমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছে। ‘
— ‘ হে রে সাদি, সত্যিই তো। তুই আমার মেয়েটার পিছনে এমন হাত ধুয়ে লেগেছিস কেন? ‘
— ‘ তাহলে আর কি করবো? তোমাদের আদরের দুলালী আমার একটা কথা শুনতে চায়? ‘
— ‘ এমন কথা বলেন কি জন্য? সেগুলো মানা যায় না? ‘
সাদিদ পুনরায় একবার নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নীলার উপর ফেলে তাকে নিঃশব্দে শাসালো। কিন্তু নীলা সেসবের তোয়াক্কাই করলো না। সে যাবে মানে যাবেই। তার বেস্টুর বিয়ে বলে কথা। নীলার না গেলে কি হয়!
— ‘ দেখ সাদি, তুই কিন্তু এবার বেশি বেশি করছিস। সবাই গেলে নীলার কেন বারণ? ‘
— ‘ কেননা গতরাতেও তার শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল না। এখন শান্তাদের বাসায় না যাওয়ার হলে এখনই ডক্টরের কাছে চেকাপের জন্য নিয়ে যেতাম। যেহেতু এখন যাচ্ছি না তাই ফিরে এসেই প্রথমে তাকে চেকআপের জন্য নিয়ে যাব। আর আমি চাই না অসুস্থ শরীর নিয়ে সে বারবার এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি করুক। ‘
— ‘ সে যেতে ইচ্ছুক। এমন করছিস কেন? ‘
— ‘ সে বহুত কিছু করতেই ইচ্ছুক। সেসবে আমার কান দিলে হবে না। ‘
নীলার সাদিদের এমন কথার পরিবর্তে সাদিদের অগোচরে ভেঙচি কাটলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশত নীলার কার্যকলাপ সাদিদের নজরে পড়ে গেল। তাই তো আরও একদফা নীলা তার ভষ্মকারী দৃষ্টির সম্মুখীন হলো।
অবশেষে এতো আকুুতি মিনুতি করেও সাদিদের মন পাওয়া গেল না। সে নীলাকে নিয়ে গেল না যে নিয়ে গেলোই না৷ তার সেখানে উপস্থিত হওয়াটা প্রয়োজন বিধায় তাকে যেতে হয়েছে। নতুবা নীলার মন যেহেতু খারাপ ছিলো তাই আর যেত না৷
কিন্তু আফসোস। কি আর করার? থাক পরে ডাবল আনন্দ দিয়ে পুষিয়ে নিবে।
.
শান্তদের বসার ঘরে সাদিদ, তানবীর অর্ণবসহ হাসিবুর রহমান, শায়লা রহমান এবং শাহেদ বসা রয়েছে। সবার মুখ থমথমে। কেননা এই ছেলেটার হাসিমাখা মুখের পিছনে যে এতটা কষ্ট লোকায়িত ছিলো তারা কেউ সেটা বুঝে উঠতে পারেনি৷
আচ্ছা এই ছেলেটা না হয় তাদের আপন মনে করে বলেনি। কিন্তু পেটের ছেলেটা!
সে কিভাবে এত বড় সত্য তাদের থেকে গোপন করে গিয়েছে! কিন্তু তারা অবাক হলেও শান্তর বাবা কামাল শেখ এসবে বড্ড বিরক্ত। প্রথম দিকে ছেলের আর্থিক অবস্থা এবং প্রশংসা শুনে মনে মনে বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন। কিন্তু এখন বেশ বিরক্তির রেশ তার চোখে-মুখে।
— ‘ তাহলে এখন আপনারা কি চাচ্ছেন? আমি আমার মেয়ের এতো ভালো সমন্ধ ভেঙে দিয়ে এই রকম একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিব? আগেই বলে দিলাম আমার থেকে ভুলক্রমেও এমনটা আশা করবেন না। কেননা এটা কখনও হবার নয়। ‘
এমনিতে এই প্রসঙ্গটা উঠলে তানবীরের মুখটা মলিন হয়ে যায়। কিন্তু কামাল শেখের এমনভাবে বলাতে তার চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। সে হাতের মুঠি শক্ত করে রাগের বশে কিছু বলে উঠতে গেলেই সাদিদ তার ডানহাত চেপে ধরলো। তাকে কথা বলতে আটকে দিয়ে চোখের পলকে ইশারা করে নিজেই বলল,
— ‘ আঙ্কেল, আমরা আপনাকে আপন ভেবে সবটা সত্য জানিয়েছি। আপনাদের আগে কিন্তু আমার ফ্যামিলির লোকজনও সেটা জানতে পারেনি। আজকে এটা বলার খুব প্রয়োজন অনুভব করায় আমরাই আপনাদেরকে বলে দিয়েছি৷ যদি আমরা সেটা গোপন রাখতে চাইতাম হলফ করে বলতে পারি আপনাদের কখনও জানা সম্ভব হতো না। কিন্তু আমরা সেটা করিনি৷ কেননা নতুন একটা সম্পর্ক কখনও মিথ্যার আশ্রয়ে তৈরি করা উচিত নয়। সেটা ভেবেই আমরা আপনাদেরকে তানবীরের কৈশোরের বিয়ের কথাটা জানিয়েছি৷ শুধু আপনারা নন। শান্তাও এটা অনেক আগে থেকেই জানে৷ আর সে সবটা সত্য জেনেই তানবীরকে আপন করে নিতে চায়। এখন আপনিই বলুন মেয়ের খুশি বেশি না-কি আপনার অহংকার?
দেখুন আমাদের জীবনের এক সেকেন্ডের ভরসা নেই। আগামিকাল কি হবে সেটা আমরা কেউ জানি না৷ আল্লাহ না করুন আজকে আপনি শান্তার খুশির পরোয়া না করে আপনার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দিলেন৷ আর আমি এটাও জানি শান্তার মতো মেয়ে কখনও বাবার সিদ্ধান্তের বাহিরে যাবে না। সবই হলো। কিন্তু আজ বাদে কাল গিয়ে ঐ ছেলেটাই অপর নারীতে আসক্ত হয়ে যাক৷ বিয়ে করে ঘরে তোলে আনুক তার অপর বউকে। তখন কি মেয়ের মুখে হাসি দেখতে পাবেন? নাকি যেই সুখের জন্য মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দিলেন সেই সুখ দেখতে পারবেন?
আমি বলছি না এমনটাই হবে। কিন্তু ভবিষ্যৎ আমরা কে বলতে পারি? তাই আঙ্কেল, প্লিজ একটাবার অহংকার, রাগ, জেদ, তানবীরের অতীতের কালো স্মৃতি এগুলো সাইডে রেখে মেয়ের সুখের কথা ভাবুন। মনে শান্তি না থাকলে পৃথিবীর অন্য কোনো কিছুতে শান্তি পাওয়া যায় না৷ তাই প্লিজ একটাবার সবকিছুর উর্ধ্বে গিয়ে তাদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসাটা দেখুন। আমার বন্ধুটা জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করেছে। অবশেষে আপনার মেয়েটাকে আঁকড়ে ধরে একটু সুখে বাঁচতে চায়। প্লিজ তার থেকে এই সুখটা কেঁড়ে নিয়েন না। আমি হলফ করে বলতে পারবো আমার ভাইয়ের থেকে বেশি ভালো আপনার মেয়েকে আর কেউ বাসতে পারবে না। প্লিজ আঙ্কেল একটাবার গভীরভাবে ভেবে দেখুন। ‘
পরিস্থিতিটা যেন ক্রমশ ঘোলাটে থেকে ঘোলাটেতে পরিণত হচ্ছে। শান্তর মা-বাবা একে-অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। অপরদিকে শায়লা রহমান হাসিবুর রহমানও তাদের থেকে প্রত্যাশিত উত্তর পেতে মুখিয়ে আছেন। তাদের ছোট ছেলেটা মা-বাবার হয়ে যেন সবটাই খুব বিচক্ষণতার সহিত তোলে ধরেছে৷ তাদের জন্য একটা শব্দও যেন বাকি নেই। তারপরও গুরুজন হিসেবে দায়িত্ব পালনে শায়লা রহমান বিনয়ের সাথে বললেন,
— ‘ দেখেন ভাই সাহেব, হয়তো বা ছেলেটা আমার পেট থেকে জন্ম নেয়নি। কিন্তু আমি কখনও আমার দুই ছেলের থেকে এই দুইজনকে কম দেখেনি৷ তানবীরটা তো আরও কাছের। সব সময় নিজের দুষ্টুমিতে ঘরটা ভরিয়ে রাখতো। কিন্তু কেবলমাত্র থাকার ঘরটাই আলাদা ছিল। নতুবা সর্বদা ঘরের ছেলের মতোই থাকতো। আর আমি যদি ঘুনাক্ষরে এই ঘটনার টের পেতাম তাহলে কিছুতেই তাকে নিজের থেকে আলাদা রাখতাম না। কিন্তু কি করবো বলেন? এই পাঁজিদুটো এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও আমাদের কিছু জানতে দেয়নি। আজকে এখানে উপস্থিত না থাকলে তো আমরা কখনও এটা জানতেই পারতাম না। তাই ভাইসাহেব, আপনি যেটাই সিদ্ধান্ত নেন না কেন এই ছেলেটার অতীত বিবেচনা করে নিয়েন না। ছেলেটা আমার লাখে এক। আপনার মেয়েটাকে সবসময় খুশিতে রাখবে৷ ‘
— ‘ হ্যাঁ আঙ্কেল। আপনার মেয়ের হাতটা খুশিমনে আমার ভাইটার হাতে তোলে দিন। ইনশাআল্লাহ কখনও আফসোস করার সুযোগ পাবেন না। ‘
তাদের সবার এতো আবদার অনুরোধের পর কামাল শেখের মনটাও ক্রমশ নরম হয়ে আসতে চায়ল। তিনি একপলক নিজের মেয়ের দিকে তাকালেন৷ সব সময় দুষ্টুমিতে মেতে থাকা মেয়েটা আজ কেমন ভয়ে চুপসে গিয়েছে। তিনি আদুরেস্বরে মেয়েকে কাছে ডাকলেন,
— ‘ মা, কাছে আয়। ‘
শান্ত গুটিগুটি পায়ে বাবার পাশে এসে দাড়ালো। কামাল শেখ তাকে বসতে বলতেই সে মাথা নিচু করে সোফায় বসে পড়ল।
— ‘ তোর সাথে জুলহাজের বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে। সামনেই বিয়ের ডেইট। আমারই ভুল হয়েছে মেয়ের থেকে কোনোরকম ইচ্ছা অনিচ্ছা জানতে চাইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বড্ড ভুল করে ফেলেছি রে মা৷ তোর মুখে যে হাসি দেখতে জুলহাজের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করেছিলাম, সেই হাসিটার লেশমাত্র তোর মুখে নেই। তোর বাবাতো এতটা খারাপ নয়। কেন তখন তানবীরের কথা আমাদের জানাসনি? বল কেন? ‘
শান্ত এবার ভয় ভুলে বাবার বুকে মাথা দিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠল। কান্না মিশ্রিত ভাঙা গলায় বলে উঠল,
— ‘ আমি ভয় পেয়েছিলাম বাবা। সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলাম৷ তোমরা হঠাৎ করে এতসব করে ফেলেছিলে যে আমি কিছু বুঝার সুযোগ অব্দি পাইনি। ‘
কামাল শেখ মেয়ের মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন। অতঃপর মায়া নিয়ে বললেন,
— ‘ এখন তুই কি চাস বল? তোর সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। তুই যদি তানবীরের অতীত মেনে নিয়ে সুখী হতে চাস আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা যে কেবল তোর সুখটাই চায়। সেইজন্যই সবথেকে ভালো ছেলেটার হাতেই আদরের মেয়েটাকে তুলে দিতে চাই। বল মা, তুই কি চাস বল। ‘
__________________
নীলা বারবার দেয়াল ঘড়িটা দেখে যাচ্ছে। সাদিদের সাথে অভিমান করে তাকে কল দেয়নি। কিন্তু বাদবাকি কাউকে কল দিতে সে বাকি রাখেনি৷ কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কেউ তার কল রিসিভ করছে না। সেইজন্য নীলা তাদের সকলের প্রতি খানিকটা বিরক্ত। আর সাদিদের উপরতো বিরক্তির কোনো মাত্রা-সীমানা নেই। একমাত্র এই মানুষটার জন্যই নীলাকে এই অস্থিরতায় ডুবে থাকতে হচ্ছে। নতুবা নিজেই সেখানে উপস্থিত থাকতে পারতো।
— ‘ হুহ। আমার বেস্টুর বিয়ের কথা হচ্ছে অথচ আমিই না-কি থাকতে পারবো না৷ এই জন্যই বলা হয় মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। যতসব আধিখ্যেতা ‘
— ‘ আর তোমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়া-পড়শির ঘুম নাই। ‘
নীলা আগত শব্দের উৎসের দিকে ফিরে তাকালো। সাদিদসহ সদরদরজায় সবাই দাড়িয়ে রয়েছে। নিধি একটু আগেই বাড়ির পিছনের সবজি বাগান থেকে গ্রিন ক্যাপসিকাম আনতে গিয়েছে। তাই দরজাটা খোলাই ছিলো। তাই ভেতরে প্রবেশ করতে তাদের আর বেল বাজাতে হয়নি। এবং এখন নীলাকে উদ্দেশ্য করে এই অপমানসূচক বাক্যটা সাদিদের মুখ থেকেই বের হয়েছে। সে সবাইকে দেখে উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করলেও সাদিদের সামনে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। বড্ড অভিমান যে জন্মেছে৷
হাসিবুর রহমান আর শাহেদ শান্তদের বাসা থেকে ডিরেক্ট অফিসে চলে গিয়েছে। নীলার ডক্টরের কাছে এপয়েন্টমেন্ট আছে বিধায় সাদিদ আর যায়নি। তাই এখন তার সাথে শায়লা রহমানসহ কেবল তানবীর আর অর্ণবই রয়েছে।
নীলার ক্রমশ অস্থিরতাপূর্ণ মুখশ্রী কারো নজরে এড়ালো না। তাই তাদের মধ্যে থেকে অর্ণবই রসিকতার স্বরে বলে উঠল,
— ‘ সব সম্পর্ক একত্রিত হয়ে যে বিশাল প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। প্রথম ছিলে বোন। এখন ভাবি। আবার এখন হিসেব করলে দেখা যায় বিয়াইন। কোনটা ডাকবো? ‘
— মানে? ‘
নীলা গোল গোল চোখ করে অর্ণবের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। বিষয়টা তার মাথাতে ঢুকেনি। নীলার এমন মুখখানা দেখলে সাদিদের বরাবরই হাসি পায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। সে হাসিমুখেই সোফায় এসে নীলার পাশে বসলো। অর্ণব তার জন্য সহজ করতে আবার বলল,
— ‘ মানে হচ্ছে ভাইয়ের বউয়ের বান্ধবীরদের তো বেয়াইন সাহেবাই ডাকতে হয়। কিরে জামাই মিয়া, ঠিক বললাম তো? ‘
— ‘ আবার জিগায়। তা শালিকা সাহেবা জিজুর সেবাযত্ন না করে তাকাইয়া আছো ক্যান? যাও যাও৷ ঠান্ডা-টান্ডার ব্যবস্থা করো। মাথা এমনিতেই আমার ভীষণ গরম। শশুরমশাই হেব্বি ডেঞ্জেরাস৷ গরম গরম কথা কইয়া আমার ঠান্ডা মাথা রীতিমতো গরম কইয়া দিছে। ফিলিং সো হট শালিকা। ‘
বলেই সে দুষ্টুমি করে নীলাকে চোখ টিপলো। এতক্ষণে সবকিছু বুঝে উঠতে পেরে নীলার খুশি আর দেখে কে। সে যে ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা এটা ভুলে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। আর তাতেই সাদিদের ফ্রিতে ধমক।
— ‘ এই মেয়ে, জ্ঞান বুদ্ধি কি দিনদিন লোপ পাচ্ছে? এমন অবস্থায় কেউ লাফ দেয়? বিয়ে কি তোমার নাকি? ‘
— ‘ ইশশ সাদি মেয়েটাকে শুধুশুধু ধমকাস কেন? আদর করে বললেই তো বুঝে যায়। ‘
— ‘ শুধুশুধু মানে কি? এই মেয়েকে তো দিনরাত মাইরের উপরে রাখা উচিত। আর আদর! এমনিতেই বাঁদর হয়ে অনবরত আমার ঘাড়ে চেপে নাচছে। ‘
এমন অপমান বাক্য শুনে নীলার অভিমানের পাহাড়ের চূড়া যেন আরও দীর্ঘায়িত হলো। তাই সে মুখটা লটকিয়ে নিঃশব্দে রুমের দিকে পা বাড়ালো। তার খুশি এই ব্যক্তির কোনো কালেই হজম হয় না। নীলার সুখের সাথে এই ছেলের অদৃশ্য এক শত্রুতা রয়েছে।
অপরদিকে নীলার যাওয়ার পাণে তাকিয়ে থেকে সবাই মুখ টিপে হাসছে। দুইজনের ভালোবাসার গভীরতাটুকু কারও কাছে আর অজানা নয়। তারপরও সবসময় কেমন খুনসুটিতে মেতে থাকে!
সাদিদ নীলার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিজেও রুমের দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু যাওয়ার আগে তানবীরের দিকে তাকিয়ে শাসানোর স্বরে বলে গেল,
— ‘ ভাবী। বুঝেছিস? অনলি ভাবী। আরও ভালো হয় ভাবী মা ডাকলে। নো শালিকা-টালিকা। এসব সম্বোধন তার স্বামী একদম টলারেট করবে না। ‘
বলেই সে হনহনিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ালো। অপরদিকে তানবীর ভয়াতুর ভঙ্গিতে বুকে থুথু ছিটিয়ে নিচুস্বরে মিনমিনিয়ে বলল,
— ‘ শালা হারামি, বউ প্রেগন্যান্ট তারপরও হেতের ভাবভঙ্গি এমন যেন হের গার্লফ্রেন্ডের লগে লাইন মারতে আইছি। ‘
অর্ণব নিধি তার নাটকীয়তা দেখে সশব্দেই হেসে উঠল। শায়লা রহমান আর এসব ঠোঁটকাটা ছেলেপুলের সামনে থাকতে চান না৷ তাই নিজ সম্মান বাঁচিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।
সাদিদ রুমে এসে দেখলো নীলা মুখ ফুলিয়ে ডেসিং টেবিলের সামনে বসে চুলে চিরুনি করছে৷ সে সেইদিকে না গিয়ে গম্ভীরস্বরেই বলল,
— ‘ ডক্টরের কাছে যেতে হবে৷ দ্রুত রেডি হয়ে নাও। ‘
— ‘ যাব না আমি। ‘
— ‘ কি বললে আবার বলো। ‘
নিচুস্বরের এমন গম্ভীর ধমকিতে নীলা এতক্ষণের নিজের জমানো জেদ ছাড়তে বাধ্য হলো। এই ছেলেটা খারাপ। খুব বেশিই খারাপ। নীলা তার সামনে রাগ-ক্ষোভ কিছু দেখাতে পারে না। তাই সে মিনমিনিয়েই বলল,
— ‘ না মানে বললাম রেডি হচ্ছি৷ ‘
— ‘ এমনটাই বলেছিলে? ‘
— ‘ জ্বি। ‘
বলেই নীলা মাথা নিচু করলো। সাদিদ ঠোঁট চেপে নিজের হাসি আটকিয়ে এগিয়ে গেল। নীলার একেবারে মুখোমুখি দাড়িয়ে নীলার কোমড়ে দুইহাত রেখে তাকে কাছে টেনে নিলো। মুখে মৃদু ফুঁ দিতেই নীলার চোখের পাতা বার কয়েক কেঁপে উঠল। সাদিদ মুখ এগিয়ে তার সেই কাঁপা চোখের পাতায় চুমু খেতেই নীলা তার কাঁধ চেপে ধরলো। সাদিদ ঘাড় বাঁকিয়ে একবার নিজের কাঁধের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে বিধায় এখন দুষ্টুমির মনোভাব বর্জন করলো। নীলার হাত টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেই বাকি চুলগুলো চিরুনি করে দিলো৷ তারপর খুব যত্নে বিনুনি করে দিলো। নীলার এই অবস্থায় সাদিদ এটা খুব ভালোভাবেই রপ্ত করেছে। নীলা আয়নাতে নিজেদের প্রতিববিম্বের উপরে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। সাদিদ তাকে আপনমনে হাসতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
— ‘ হাসো কেন? ‘
— ‘ না এমনি। আচ্ছা বিয়ের ডেট কবে? তেমন কিছু কি ফিক্সড করা হয়েছে? ‘
— ‘ হ্যাঁ ফিক্সড তো করা হয়েছে। কিন্তু শান্তাদের পারিবারিক কিছু জটিলতার জন্য একটু পিছিয়ে গিয়েছে। একেবারে তোমার ডেলিভারির ডেটের কাছাকাছি। বউ, আমারতো এখনই চিন্তা হচ্ছে। তখন তোমাকে একা রেখে আমি কিভাবে দায়িত্ব সামলাবো? আমার যে এখন থেকেই ধম আটকে যাবার জোগাড়। ‘
সাদিদের অস্থিরতাটুকু দেখে নীলার এতক্ষণের নিজের মধ্যকার সুপ্ত অস্থিরতাটা বের হয়ে আসতে চায়ছে৷ কিন্তু সে জোরপূর্বক সেটা উপচে ফেলে দিয়ে উঠে দাড়িয়ে সাদিদের বুকে মাথা রাখলো। চোখ বন্ধ করে সাদিদের পিঠে আলতো করে হাত চেপে ধরলো।
সাদিদ তার কাজে নিঃশব্দে মৃদু হেসে নীলার চুলের ভাঁজে চুমু খেল। মাথায় থুতনি ঠেকিয়ে নীলার চুলে যত্নে হাত বুলিয়ে দিলো। আদরমাখা কন্ঠে ডাকলো,
— ‘ পাখি৷ ‘
— ‘ হুম? ‘
— ‘ ডক্টরের কাছে যাবে না। ‘
— ‘ উহু। ‘
— ‘ সেটা কেমন কথা? না গেলে হবে? চুপচাপ আসো। ‘
— ‘ ইশশ না৷ ‘
— ‘ তাহলে কি? ‘
নীলা উত্তর দিলো না। শুধু চুপ করে সাদিদের বুকে মাথা চেপে রাখলো। সাদিদ সেটা দেখে দুষ্টুমির ফন্দি আটলো। নিচু হয়ে নীলাার কানের কাছে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে উঠল,
— ‘ বউটা কি আদর চাচ্ছে? একটু বেশিই আদর? ‘
নীলা চমকিত দৃষ্টিতে মাথা উঁচিয়ে সাদিদের মুখপানে তাকালো। সাদিদের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি। তাই সে আলতো করে সাদিদের বুকে একটা কামড় বসিয়ে দিলো৷ সরে যেতে যেতে নিচুস্বরে বলল,
— ‘ বদের হাড্ডি। ‘
কিন্তু এই বদের হাড্ডি সাদিদ তাকে যেতে দিলে তো? সে পিছন থেকে নীলার পেট জড়িয়ে ধরলো। বারকয়েক উঁচু পেটে আদুরেভাবে হাত বুলাতেই নীলার শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠল। সাদিদ সেটা বেশ ভালোভাবেই অনুভব করতে পারলো৷ অতঃপর মোহনীয় স্বরে বলল,
— ‘ সাথে ভালোবাসার কাঙাল। তোমার প্রেমেতে উন্মাদ। তাইতো প্রিয়তমা তোমাতে মিশে আমি লেখতে চাই ভালোবাসার শত উপন্যাস। গড়তে চাই হাজারো স্বপ্নের দুনিয়া। বুনতে চাই আমাদের ভালোবাসায় রঞ্জিত কারও কোমল মুখশ্রী। ‘
এহেন প্রেমময়ী বাক্যে নীলার শিরদাঁড়া দিয়ে ক্রমশ ঠাণ্ডা স্রোত বেয়ে চলছে। এমন আদরমাখা বুলি শুনলে কি আর স্বাভাবিক থাকা যায়? মন যে বলে যায় না। বুকে যেন কেমন অস্থিরতা বিরাজ করছে। নিজেকে একেবারেই উল্টো পাল্টে দেবার ক্ষমতাধারী অস্থিরতা।
#চলবে…