গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬১ ❤💛❤
[ প্রাপ্তবয়ষ্কদের বিষয়বস্তু উপস্থিত। মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা এবং বয়সভেদে পড়ার অনুরোধ। ]
আপাতদৃষ্টিতে বিয়ে বাড়ির সুন্দর মহলকে এখন ঝগড়াটে বাড়ির চিত্রমহল মনে হচ্ছে। আর পায়ে পা দিয়ে ঝগড়াঝাটিতে মত্ত রয়েছে বিয়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তিত্ব তথা স্বয়ং বর এবং কনে।
— ‘ না। সম্ভব না। মাথায় জলদি পানি দেও। এই ছেমরি মাথা চূড়ান্ত হট করে দিছে। ‘
— ‘ পাগলদের মাথা বরাবরই হট থাকে। ‘
— ‘ তোকে..
— ‘ চুপ। আর একটাও কথা নয়। কখন থেকে দুইজন ইঁদুর বেড়ালের মতন ঝগড়াঝাটি করছিস! লোকে কি বলবে? ‘
— ‘ বাপ, আমি আবার কি করলাম! এসব এই দুর্দান্ত বদমহিলার কামাল। ‘
— ‘ আমি! এতো বড় মিথ্যাবাদীর জ্বিব আল্লাহ নির্ঘাত কেটে দিবে। ‘
— ‘ তোর টা না কাটলেই হয়। তোর জিহ্বাতো কাটার ও যোগ্য না। ‘
শান্ত বেচারি এবার বোধহয় কেঁদেই ফেলবে। আর কতো অপমান সহ্য করা যায়? সে সকলের নিকট লোকায়িত ছলছলে চোখ নিয়েই স্টেজ থেকে নেমে পড়ল। বাদবাকি সবাই মিথ্যা স্বান্তনার বাণী শুনালেও সাদিদ নির্বাক। আচমকা তানবীরের চোখ তার দিকে পরতেই সে মাথা নিচু করে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ভাবখানা এমন যে তানবীর ভিষণ লজ্জা পেয়েছে।
নীলা এতক্ষণ প্রাণের বান্ধবীকে সামলাতে ব্যস্ত থাকলেও এবার অবাক হলো। বলা যায় অনেকটাই। কেননা সাদিদের ঠোঁটের কোণে চাপি হাসিটা তার নজর এড়াতে পারলো না। আর সেটার কারণই তার মাথায় আসছে না। সবাই যেখানে বিয়ে হবে কি হবে না এই চিন্তায় দিশেহারা সেদিকে দুই বন্ধুর এমন নীরব চক্ষু বার্তালাপ তার ঠিক হজম হচ্ছে না। আর ঐদিকে শান্ত গিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সেন্টারের রুমে সজোরে দরজা আটকে দিয়েছে। এতো ডাকাডাকির পরও দরজা খোলার নাম নিচ্ছে না।
নীলাও এতো হট্টগোলে এবার ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। সাদিদের চোখে সেটা পরা মাত্রই সে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসলো৷ একহাতে নীলার বাহুতে চেপে ধরে তাকে নিজের বুকে আলতো করে জড়িয়ে নিলো। ক্লান্ততার দরুন নীলাও আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু আস্তে করে সাদিদের বুকে নিজের মাথাটা মাথাটা হেলিয়ে দিলো।
— ‘ ম্যাডামের জন্য একটা লেমন-মিন্ট জুস। কুইক। ‘
সাদিদ ওয়েটারকে অর্ডার দিয়ে আর দেরি করলো না। ততক্ষণে নীলাকে নিয়ে জনসমাগম থেকে একটু দূরে সরে সোফায় এসে বসিছে। ওয়েটার জুস নিয়ে হাজির হতেই সাদিদ নিজের হাতেই নীলাকে খাইয়ে দিলো।
— ‘ ফিলিং বেটার? ‘
— ‘ হুম। ‘
সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হেসে তার মাথায় হাত রাখলো। চুলের ভাঁজে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে অতঃপর সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। যেন ছোট একটা বাচ্চাকে আদর করে কেউ শান্ত করছে। নীলাও প্রিয় মানুষটার বুকের ওম পেয়ে চুপটি করে বসে রইল। নো নড়নচড়ন।
নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত হতেই নীলা আস্তে করে এবার তখনকার প্রসঙ্গ টেনে বলে উঠল,
— ‘ সবাই এতো টেনশনে রয়েছে। কিন্তু আপনি তখন এমনকরে হাসলেন কেন? ‘
— ‘ কই হাসলাম? ‘
— ‘ মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না। আপনার মুখের চাপা হাসিটা আমি দেখেছি। ‘
— ‘ তাই? ‘
ঘন গলার প্রশ্নটার পরে নীলা আর কিছু বলতে পারলো না। কেননা চোখ যে কথা বলে। আর সাদিদের সেই জ্বলজ্বলে চোখজোড়ায় নীলা যে নিজের মরণ দেখে। তাই লজ্জা পেয়ে তার বুকে আরেকটু মুখ লুকিয়ে বসলো। অপরদিকে সাদিদও আর কিছু বললো না। কেবলমাত্র তার ঠোঁটের কোণে ঈষৎ চাপা নিঃশব্দের হাসিটা নীলার বুকে যেন ঘূর্ণিঝড় তুলছে। ভয় হচ্ছে এই ধিরিম-দারিম আওয়াজটা না সাদিদের কর্ণকুহর অবধি পৌঁছে যায়? তাহলে যে নীলার লজ্জার পরিমাণটা আরও কয়েকদাপ বৃদ্ধির খাতায় নাম লেখাবে।
.
— ‘ করবো না বিয়ে। ঐ অভদ্র শয়তান ছেলেকে কোনোভাবেই বিয়ে করা সম্ভব নয়। মরে গেলেও না। এটা কোনো মানুষের কাতারে পরে? ‘
শান্ত নিজের মনে বকবক করে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। আর রাগের তোপে অনবরত বিছানার চাদর এলেমেলো করছে। ইতিমধ্যে সুন্দর পরিপাটি রুমটার সে একদম বেহাল দশা করে ছেড়েছে। নিজের মনে সে এতটাই বিভোর ছিল যে, কখন তার পিছনে এসে বলিষ্ঠ শরীরের পুরুষটির আগমন ঘটেছে সেদিকে তার লক্ষ্য নেই। রাগে-দুঃখে সে রীতিমতো সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে যাচ্ছে।
— ‘ বাইদ্দারা কি নদীর কূল ছাইরা ঢাকার জ্যামবহুল লোকালয়ে সাপের খোঁজে আইয়া পরছে না-কি তা? নাইলে কালনাগিনী এমন ফণা তুইল্লা আছে ক্যান? ‘
অবাকচাহনিতে শান্ত পিছনে ফিরে তাকালেও পরমুহূর্তেই সে রাগে অগ্নীশর্মা। তার বোধহয় ইচ্ছে হচ্ছে তেঁতুল-বরই চাটনির পরিবর্তে এই তানবীর নামক ছেলেটাকেই চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে।
তানবীর তার জ্বলন্ত চোখের বুঝলো কি-না সেটা বুঝা দায়, কিন্তু সে এগিয়ে আসলো। শান্তর একেবারে শরীর ঘেঁষে বিছানায় বসলো। শান্তর শরীরে বোধহয় নিয়ন্ত্রণহীন বিষের জ্বলন। তাই সে দ্রুত নিজের স্থান পরিবর্তন করে উঠতে গেল। কিন্তু আচমকাই একটা রক্তপোক্ত রুক্ষ হাত তার কব্জি টেনে ধরলো। শান্ত নিজের চমকিতভাব প্রকাশ করার আগেই নিজেকে তানবীরের একান্ত কাছে অনুভব করলো। গরম নিঃশ্বাসগুলো নিঃসন্দেহে তার দম আটকে ফেলার জন্য যথেষ্ট। এতক্ষণের রাগ-ক্ষোভ সব জানালা দিয়ে বোধহয় পালিয়ে গেল। নিজেকে একজন বছরজুড়ে রুগ্ন ব্যক্তির ন্যায় কাঁপা অবস্থায় দেখে শান্ত নিজেই হতবাক। কিন্তু তারপরও নিজেকে সামলাতে পারলো না। তার চোখ-ঠোঁট লাগামহীনভাবে কেঁপে চলেছে। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলার সাধ্যি নেই।
মুহূর্ত অতিবাহিত হয়ে তানবীরের ডানহাতটা শান্তর শাড়ির ফাঁক দিয়ে উন্মুক্ত কোমড়ে পরতেই মেয়েটার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। আর নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে শান্ত শরীরের জোর প্রয়োগ করে আবারও উঠতে গেল। কিন্তু বরাবরের মতোই বিফল।
— ‘ এতো তাড়াহুড়ো কেন? ‘
ঘন স্বরটা যেন শরীরটাকে আরও কাঁপিয়ে তুলছে। অস্ফুটস্বরে কেবল মুখফুটে একটাই বাক্য বের হলো,
— ‘ প্লি…জ যে..তে দি..ন। ‘
তানবীরের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ চাপা হাসি। অবশেষে বাঘিনী তাহলে বিড়ালে পরিণিত হলোই। দুষ্টুর মাথায় আরও দুষ্টুমি চাপলো। হাত তো সরালোই না। উল্টো রুক্ষ হাতটা দিয়ে নরম কোমড়টা আরও চেপে ধরলো। তাতে শান্তর মুখফুটে অস্ফুট একটা উত্তেজক শব্দ বেড়িয়ে আসলো।
যা শুনে তানবীরের দুষ্টুমি মুহূর্তেই হিংস্রতায় পরিণত হলো। একটানে শান্তকে নিয়ে বিছানায় পরলো। নরম শরীরের উপর বলিষ্ঠ পুরুষালী শরীরটা আধশোয়া হতেই মেয়েটার বুকে ঝড় উঠার উপক্রম।
তানবীরের নিকট বোধহয় নিজেদের মধ্যের এই সামান্য দুরত্বটুকু আর সহ্য হচ্ছে না। তাই ক্ষেপা বাঘের মতোই শান্তর একেবারে মুখোমুখি হলো। দুইজনের গরম নিঃশ্বাসগুলো তখন একে-অপরের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়ার উপক্রম। শান্ত আর চোখ খুলে রাখতে পারলো না। কিন্তু বন্ধ চোখের পাতাগুলোও অনবরত তিরতির করে কেঁপেই চলেছে।
হঠাৎ বাহির থেকে দরজায় আবারও বিরামহীন করাঘাতে তানবীরের টনক নড়লো। শান্তর থেকে থেকে কেঁপে চলা মুখশ্রীতে নজর পরতেই তানবীরের হাতের শক্ত বাঁধন আলগা হয়ে গেল। এতক্ষণ হুঁশ না থাকলেও এখন যেন পরবর্তী পদক্ষেপটা ভাবতেই নিজের শরীরেই কাটা দিচ্ছে।
সে আস্তে করে শান্তর কোমড় থেকে হাত সরিয়ে আনলো। নিজে উঠে শান্তর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো।
— ‘ উঠো। ‘
শান্ত এখনও কেঁপে যাচ্ছে। তানবীর আগেও তার কাছাকাছি এসেছে। কিন্তু আজকে যেন তার চোখের ভাষা ভিন্ন ছিলো। জ্বলজ্বলে চোখজোড়াতে শান্তকে একান্তভাবে কাছে পাওয়ার, শরীরে শরীরে মিশে যাওয়ার পরিপূর্ণ মনোভাব।
শান্তকে তারপরও ভাবলেশহীন দেখে তানবীর আবারও তাকে ডাক দিলো,
— ‘ কি হলো? উঠো। ‘
শান্ত এবার ধীরেসুস্থে উঠে বসলো। শরীরটা এখনও মৃদুভাবে কেঁপে যাচ্ছে। সে অহেতুকই এই অপ্রস্তুত পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য শাড়ির আঁচল, কানের দুল, মাথার টিকলি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দৌড়ে যে পালাবে এই শক্তিটুকু যেন হ্রাস পেয়েছে। শরীরের অবিচ্ছেদ অঙ্গ পা একেবারে অসার।
তানবীর তীক্ষ্ণ চোখে তার সবটা পরখ করলো। অতঃপর তার অগোচরে ছোট একটা শ্বাস ফেলল। সে নিজেও যে কম অপ্রস্তুত নয়। কিন্তু এখন সেসব ভেবে সময় নষ্ট করার টাইম নেই। বাহিরে বোধহয় দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম। তাই সহসাই তানবীর একটানে আবারও শান্তকে নিজের কাছে আনলো। সর্বদা ঝগড়াঝাটিতে ব্যস্ত থাকা মেয়েটাও আজ ভিতু মেয়ের মতো দুর্বলভাবে চোখ পিটপিট করে যাচ্ছে। তানবীর নিচুস্বরে হেসে ফেলল। তারপর নিজের গুরুত্বপূর্ণ কাজটাতে হাত দিলো।
উন্মুক্ত কোমড়ে ঠান্ডা হলুদের ছোঁয়া পরতেই শান্ত আবারও কেঁপে উঠে নিজের শাড়ি খামচে ধরলো। তানবীর নিজেও সেটা অনুভব করতে পারলো। কিন্তু কিছু করার নেই। এগুলো যে মেয়েটাকে এবার সহ্য করতেই হবে। নতুবা এতো ভালোবাসা নিজের বুকে তানবীর আর কতদিন আগলে রাখবে? বুক না-হয় যেকোনো দিন ফেটে যাবে!
— ‘ এতো সৌন্দর্য দিয়ে আমার চোখ ঝলসে দেওয়ার সামান্য পুরস্কার। দিনকাল বিবেচনায় শাস্তি মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টায় শাস্তির পরিমাণ দিগুণের পরিবর্তে চারগুণ করার দলিল ছাপানো হলো। আর আমি কিন্তু হিসেবে একেবারে পাকাপোক্ত। এক চুল শাস্তির ভাগ কিন্তু বাকিতে রাখবো না। ‘
অতঃপর লজ্জারাঙা মুখটাতে আলতো করে ধরে তানবীর ছোট্ট কপালটাতে চুমু খেলো। তারপর যেদিক দিয়ে এসেছিলে সেদিক দিয়েই পগারপার।
শান্ত সেদিকে তাকিয়ে এবার মাথা নুইয়ে লাজুক হেসে ফেলল। আর সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত হয়ে আসা প্রত্যেকটা ঘটনা বুঝতে পেরে সে নিজের মুখেই হাত চেপে ধরলো। কিন্তু লজ্জাটা পুরোপুরি নিবারণ করার আর সময় পাওয়া গেল না। দরজা বোধহয় এবার ভেঙেই ফেলবে।
— ‘ আরে আস্তে। আসছি রে বাবা। ‘
নিজের এমন লেগে যাওয়া কথা শুনে শান্ত আবারও নিচুস্বরে হেসে ফেলল। তার এতো সুখ সুখ লাগছে কেন? দমবন্ধকর এক সুখানুভূতি!
_____________________
অতঃপর রাত বাড়ার সাথে সাথে বর-কনের হলুদের সম্পূর্ণ অনুষ্ঠান বিনা বিঘ্নে শেষ হলো। উপস্থিত দর্শকমহল আধো বুঝতে পারলো না হঠাৎ করে কি এমন কেরামতি খেলে গেল যে দিন-ক্ষণ না মেনেই চন্দ্র সূর্য একত্রিত হয়ে গ্রহণ লেগে গেল! বিষয়টা সবার মাথার উপর দিয়ে গেলেও তারা নির্বাক শ্রোতা। অবশেষে অনুষ্ঠানের পর্বটা যে চুকে গিয়েছে এটাতেই বোধহয় গুরুজনেরা শান্তি। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে সাদিদের ঠোঁটের কোণের চাপা হাসিটা নীলার কাছে স্থানান্তরিত হয়েছে। এমনকি শান্তর এমন লজ্জায় নুইয়ে পরা চেহারা দেখে সেটা ক্ষণে ক্ষণে নিচুস্বরের ধ্বনি তুলছে। তারপর শান্তর গরম করে চোখ রাঙানো দেখে কয়েক মুহূর্ত শান্ত বাচ্চা হয়ে থাকলেও পরমুহূর্তেই শান্তশিষ্টতা ভুলে গিয়ে তার আবারও একি অবস্থা।
— ‘ খুব খুশি মনে হচ্ছে? ‘
সাদিদ মিচকি হেসে ভ্রু নাচাতেই নীলা আবারও মাথা নিচু করে হাসলো। রয়েসয়ে বলল,
— ‘ আপনি খুব দুষ্টু। ‘
— ‘ এতোবড় অপবাদ! এমন সহজ-সরল ছেলের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেন? ‘
সাদিদ কথা বলতে বলতেই হালকা করে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরলো। নীলা তার বুকে মুখ চেপে নিচুস্বরে বলল,
— ‘ সব বুঝে বুঝে এমন করেন। ‘
— ‘ আমি আবার কি করি? ‘
সাদিদের রাশভারি কন্ঠটা শুনে নীলা আর প্রতিউত্তর করলো না। শুধু আলতো করে বুকে একটা চিমটি কাটলো। সাদিদের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল অদ্ভুত খুশির এক রেখা। পাখিটাকে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে দিনদুনিয়া ভুলে কপালের একপাশে আর্দ্র স্পর্শ দিলো।
— ‘ ছিঃ ছিঃ ভাই। একটু তো লজ্জা শরম কর। সবাই না থাক আমার মতো ভুলা বালা পুলাডার সামনে ইতা কিতা করস! লজ্জায় তোর বউয়ের না হইয়া আমার কান দিয়া-ই ধোয়া বাহির হইতাসে। ‘
তানবীরের দুষ্টুস্বরের কুটিল বাক্যে নীলা মুহূর্তেই ছিটকে সরে যেতে চাইল। কিন্তু সাদিদ সেসবের বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে তাকে নিজের সাথেই পূর্বেকার ন্যায় মিশিয়ে রাখলো।
— ‘ ওহ্ তাই নাকি? তাহলে সবার সামনে তোর লজ্জার পাঠ্যপাঠ করি? ‘
বলেই সাদিদ ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ টিপলো। তাতেই যা বুঝার তানবীরের বুঝে চলে এসেছে। নিচুস্বরে সে বিড়বিড়িয়ে উঠল,
— ‘ হারামি বন্ধু জুটাইছি যতসব। ‘
তানবীরের বিরক্তিভরা মুখভঙ্গি দেখে উপস্থিত আড্ডামহলের সবাই-ই হেসে উঠল।
— ‘ আচ্ছা অনেক তো হলো। বিয়ের আমেজে একটু গান-টান না হলে কি হয়? ‘
— ‘ ইশশ আমার বউটাকে দেখ। কত বুদ্ধিমতী। বিউটি উইথ ব্রেইন। উম্মা। ‘
— ‘ পাপা আমাকেও উমম্মা দাও। আই নিড বিগ পাইজ উমম্মা। মায়ের থেকেও বড়। ‘
নিধি দ্রুত ছেলের মুখের উপর লাগাম টেনে ধরলো মানে মুখ চেপে ধরলো আর অপরদিকে ছেলের বাপকে কনুই খোঁচা দিলো।
অতঃপর আরেকদফা হাসির রুল পড়লো৷
— ‘ হ্যাঁ সত্যিই। জিজু আপনার গলার একটা গান দিয়ে এই সুন্দর রাতটুকুর সমাপ্তি চাই। ‘
— ‘ শান্তর বাচ্চা তুই তো দেহি কবি হইয়া গেলি! না, না কবির মহিলা ভার্সন যেন কি-তা? ‘
— ‘ আপনার মাথা। এটা উভয় লিঙ্গ। ‘
— ‘ ছিঃ তুই সবার সামনে লিঙ্গ নিয়ে আলাপ করছ! ভাইসব, আমার মতো এমন ভদ্র পোলা এই কি নির্লজ্জ মেয়েরে ঘরের বউ বানাইয়া আনতাসি? ‘
শাহেদ নিজের ইজ্জতের ফালুদার পাঠ চুকিয়ে এবার সজোরে তানবীরের কান টেনে ধরলো।
— ‘ আহ্ ভাই লাগে। ‘
— ‘ লাগার জন্যই ধরেছি। মুখটা এতো বেশি বেশি চলে ক্যান। ‘
— ‘ তোমার যে কতকক্ষণ আগে উম্মা পর্যন্ত চইলা গেছিলি! তার বেলা? ‘
শাহেদ সঙ্গে সঙ্গেই অপ্রস্তুত হয়ে পরে শুকনো কাশি দিলো। অতঃপর কানে টান রেখেই নিচুস্বরে ধমক দিলো,
— ‘ চুপ কর। আমি বড়। কিন্তু তোর মুখ এতো বেশি চলে কেন? বোন-ভাবীবের সামনে কিসব কস? ‘
তানবীরের বোধহয় ফাঁকা মস্তিষ্কে এবার কিছু জ্ঞান প্রবেশের রাস্তা বের হলো। তাই ভদ্র সেজে চুপচাপ সে মুখে তালা লাগালো। শান্ত এখনও মাথা নিচু করেই রয়েছে। আল্লাহ জানে এই ছেলের জন্য তার আর কি কি দেখে যেতে হবে!
পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শাহেদই বলল,
— ‘ সাদি, একটা গান হলে কিন্তু খারাপ হয় না। ‘
— ‘ তোমরা শুরু করো। সবসময় তো আমাকেই বলির পাঠা বানাও। ‘
— ‘ শালা গলা একখান পাইছো বইলা দাম মারো? মনে রাইখো তোমার ঐ দাম আমার..
— ‘ থাক দোস্ত বাক্যটা অসমাপ্ত রাখ। নতুবা তোর বাক্যের সমাপ্তির সাথে সাথে উপস্থিত সবার সমাপ্তি হয়ে যাইবো। ‘
— ‘ আমি কইলেই দোষ? বোধহয় তোর মুখখান তুলসিপাতাসহ দুধে ধইছোস? ‘
— ‘ আমি দুধে না ধুই কিন্তু তুই গোবর দিয়া অবশ্যই ধইছোস। ‘
— ‘ শালা হারামি..
— ‘ তুই বইনরে বিয়া করতাম বইসা নাই। অলরেডি হ্যাপিলি মেরিড উইথ উডবি ফ্রাদার। ‘
আবারও সাদিদ-তানবীরের একদফা কথার খুনসুটির পরে একজন স্টাফ এসে সাদিদের হাতে গিটার দিয়ে গেল। নীলা এতক্ষণ নির্নিমেষ প্রিয়মানুষটার হাসিমুখটা দেখে যাচ্ছিল। সময় ভেদে মানুষটা কতটা পরিবর্তন! কখনও বা দায়িত্বশীল স্বামী, আড্ডায় বন্ধুদের সাথে মেতে থাকা উচ্ছল এক যুবক। কখনও বা আদুরে বাচ্চা। এই ছেলেটাকে ঘিরে যেন নীলার মুগ্ধতার শেষ নেই৷
— ‘ এই পাখি, কোথায় হারালে? ‘
— ‘ ভীষণ ভালোবাসি। ‘
ঘোরের মধ্যেই নীলা এই বাক্যটা ব্যবহার করে বসলো। অপরদিকে এই পরিস্থিতিতে হঠাৎ এমন কথায় সাদিদও কিছুটা অবাক হলো। দৃষ্টিতে সেটা পরিলক্ষিত৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সেই চমকিত ভাব কেটে গিয়ে একরাশ মুগ্ধতায় মন-প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল।
সে আলতো করে নিজের পাখিটাকে কাছে টানলো। বড়-ছোট কাউকে পরোয়া না করে তুলতুলে নরম গালে হাত রেখে মুখটা আঁজলাভরে ধরলো। ছোট্ট কপালটাতে দীর্ঘ একটা চুমু খেল।
— ‘ আমিও। সেই প্রথম থেকে, সেই অদূরে থেকেও। এমনকি ভবিষ্যতেও। বারংবার। ‘
একসাথে অনেকগুলো উৎসাহ পূর্ণ শিস বাজানোতে সাদিদ মৃদু হেসে সরে আসলো। অপরদিকে নীলা পারে না মাটি ফাঁক করে নিচে ডুকে যেতে। বোন, বোনের হাসবেন্ড আর এতগুলো মানুষের সামনে এই নির্লজ্জ ছেলেটা কি করে বসলো!
কিন্তু সাদিদের তাতে খেয়াল নেই। তার মুখে চাপা হাসি।
Jab-jab tere paas main aaya ik sukun mila
Jise main tha bhoolta aaya woh wajud mila
Jab aaye mausam gam ke tujhe yaad kiya
Ho jab sehme tanhapan se tujhe yaad kiya
Dil sambhal ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Dil yahin ruk ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
সবাই গানের প্রথম কলিতেই আবারও একসাথে হাতের করতালি আর শিস বাজাতে শুরু করলো। কেননা সাদিদের একদৃষ্টিতে নীলার দিকে তাকিয়ে গান গাওয়াতে কারো আর বুঝার বাকি নেই গানটা কাকে ডেডিকেট করে গাওয়া হচ্ছে। স্থান-কাল ভুলে গিয়ে বর-কনে পর্যন্ত এই কাপলকে নিয়ে পরেছে। সবাই হইহট্টগোল শুরু করলেও দুটি ব্যক্তির কোনো তাড়াহুড়ো নেই। একজনে নির্বাক শ্রোতা আর অপরজনে মনের মাধুরি তুলে কন্ঠে তাকে ভালোবাসার জানান দিচ্ছে।
Aisa kyun kar hua jaanun na main, jaanun na
O dil sambhal ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Dil yahin ruk ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Jis raah pe hai ghar tera
Aksar wahan se haan main hoon ghuzra
Shaayad yehi dil mein rahaa
Tu mujkho mil jaaye kya pataa
Kya hai yeh silsila jaanun na, main jaanun na
Dil sambhal ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Dil yahin ruk ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Kuchh bhi nahin jab darmiyaan
Phir kyun hai dil tere hi khwaab bunta
Chaha ki dein tujhko bhula
Par ye bhi mumkin ho na sakaa
Kya hai yeh mamla jaanun na, main jaanun na
Dil sambhal ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Dil yahin ruk ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
Dil sambhal ja zara
Phir mohabbat karne chala hai tu
আবারও একদফা হাসির করতালির শব্দের আওয়াজের সাথে এতক্ষণের মুগ্ধতায় ঘেরা পরিবেশটার সমাপ্তি হলো। কিন্তু সমাপ্তি হলো না কেবল দুইজোড়া চোখের নীরব কথোপকথন। নীরবতায় ভালোবাসার প্রকাশ।
— ‘ আবে আর কতো! বেচারা চোখজোড়ারে একটু রেহায় দে। হেদের ও তো একটু নিজেদের মধ্যে বিশ্রামের দরকার আছে। না-কি তোর মতো চেহারা দেইখাই হেগো পেট ভরে? ‘
সাদিদ এবার আর পাল্টা উত্তর দিলো না। মাথা চুলকে কেবল হাসলো। আর আবারও আড়চোখে একবার নীলাকে দেখে নিলো৷ কেবলমাত্র দুইহাতের দুরত্বটুকুও যেন সাদিদের নিকট পাহাড় সমান। ছোট্ট তুলতুলে শরীরটাকে সর্বদা আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়।
সবাই সাদিদের গানের এতো প্রশংসা করছে, পরিবেশ মুহূর্তেই এতো জমজমাট কিন্তু নীলা সেদিকে এখনও নির্বাক। শব্দগুলো যেন তার থেকে হাজার কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে।
— ‘ আর ইউ অলরাইট জান? ‘
সাদিদের মৃদু ঝাঁকানিতে নীলা হকচকিয়ে উঠল। সেটা লক্ষ্য করে সাদিদ মুহূর্তেই বিচলিত হয়ে পড়ল এবং উদ্ধিগ্নস্বরে বলল,
— ‘ কি হয়েছে আমার পাখির? দেখি, তাকাও আমার দিকে। আরে বাবা তাকাও না। ‘
নীলা মুখ তুলে তাকালো না। শুধু সাদিদের বুকে মুখ গোঁজে নিচুস্বরে বলল,
— ‘ আমাকে এখনই বাড়ি নিয়ে যান। ‘
সাদিদ হঠাৎ নীলার এমন পরিবর্তনে স্বস্তি পেল না। মনটা ভীষণ অস্থির হয়ে আছে৷ কিন্তু নীলার এমন ভেজা স্বর শুনে আর প্রতি উত্তর করতে পারলো না। এমনিতেই রাত অনেক হয়েছে। তারা আর একটু পরেই ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্য রউনা দিতো। কিন্তু নীলাকে এমন দেখে সাদিদ আর দেরিটুকু করলো না। সবাইকে বলে তৎক্ষনাৎ নীলাকে নিয়ে রউনা দিলো।
.
গাড়ি চলেছে অনেকক্ষণ। রাতের ফাঁকা রাস্তায় সাদিদ কিছুটা অমনোযোগী হয়েই ডাইভ করে যাচ্ছে। নীলা সাথে থাকলে সে কখনও এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীনতার কাজ করে না। কিন্তু আজ করে যাচ্ছে। ডাইভ করাকালীন তার সম্পূর্ণ নজরটুকু নীলাতেই আটকে রয়েছে। কিন্তু নীলার সেদিকে খেয়াল নেই।
সে একধ্যানে খোলা জানালার বাহিরে তাকিয়ে। পুরোটা রাস্তা সাদিদ এতকথা বললেও নীলা প্রতিউত্তরে বরাবরই নির্বাক ছিল। সাদিদ নিজের অস্থিরতাটা আর আটকে রাখতে পারলো না। ফাঁকা জায়গা দেখে তৎক্ষনাৎ গাড়ি ব্রেক করলো।
— ‘ পাখি? ‘
নীলা এখনও নির্বাক। এমনকি সাদিদের দিকে একবার ফিরেও তাকালো না। সাদিদ এবার সিটবেল্ট খুলে নীলার দিকে ক্রমশ এগিয়ে গেল। তার বাহুতে চেপে নিজের দিকে ফিরাতেই,
— ‘ কখন থেকে…
সাদিদ নিজের মুখের কথাটা শেষ করতে পারলো না। গলাটা বোধহয় কেউ শক্ত করে চেপে ধরেছে। বুকটা তার অসহ্যকর এক ব্যাথায় তড়পাচ্ছে। সাদিদ এটা কিভাবে সহ্য করবে? তার পাখিটার চোখে যে জলের ধারা!
তুলতুলে নরম মুখশ্রীতে নোনাজল চিকচিক করছে। মায়াবী আঁখিযুগলে যেন রক্ত জমেছে। সিঁদুররাঙা আবিরে চোখজোড়া টকটকে লাল। ফর্সা বর্ণের মুখটাতে লালচে আভা৷
— ‘ কলিজা, কি হয়েছে? তোমার.. তোমার চোখ-মুখ এমন কেন? শরীর খারাপ পাখি? ডক্টরের কাছে যাই? ‘
নীলা তারপরও কথা বললো না৷ শুধু ছলছলে চোখে নির্নিমেষ সাদিদের অস্থিরতাভরা মুখটাতে তাকিয়ে রইল। সাদিদ যেন এবার পুরোপুরিই দিশেহারা।
— ‘ প্লিজ সে সামথিং। ফর গড সেক প্লিজ জান। ‘
— ‘ আই ওয়ান্ট টু লিভ। আই ওয়ান্ট টু লিভ উইথ ইউ এন্ড আওয়ার বেবি। প্লিজ আই ওয়ান্ট টু লিভ। ‘
অঝোর ধারায় কান্নায় ভেঙে পরে নীলা সাদিদের বুকে হেলে পড়ল। সাদিদের কাছে এই চোখের জল সহ্যের বাহিরে। তার অবস্থা মুহূর্তেই পাগলপ্রায়।
— ‘ লক্ষীটি আমার। এমন করে কাঁদে না জান। দেখি তাকাও। ‘
নরম মুখটা আঁজলাভরে ধরে সাদিদ কপালো শব্দ করে চুমু দিলো। সযত্নে ভেজা গাল থেকে চোখের জলগুলো মুছিয়ে দিলো। তার নিজের গলাও যেন লেগে আসছে।
— ‘ আমি বাঁচতে চাই বাবুর আব্বু। আমি আমাদের ছোট্ট প্রাণটাকে নিয়ে অনেকগুলো বর্ষ বাঁচতে চাই। আমি এই ভালোবাসাগুলো ছেড়ে যেতে চাই না। আমি মরতে চাই না। আমি আরও বাঁচতে চাই। ‘
কান্না ভেজা কন্ঠের এই আকুতি যেন সাদিদের কানে লোহিত ধাতুর প্রলেপ। অসহ্যকর এক যন্ত্রণা। তুলতুলে শরীরটাকে সাদিদ নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। ধরা গলায় একপ্রকার আকুতি জানালো,
— ‘ আমরা বাঁচবো পাখি। আমাদের প্রিন্সেসকে নিয়ে অনেক অনেক বছর বাঁচবো। ওর আধো বুলিতে মা-বাবা ডাক শুনবো, একপায়ে-দুইপায়ে ওর হাঁটা দেখবো। আরও অনেক কিছু। আমরা অনেকদিন বাঁচবো জান। তুমি কান্না থামাও। আমার সহ্য হচ্ছে না কলিজা। প্লিজ কান্না করে না। ‘
নীলার কান্না আজ থামবার নয়। ঐদিকে এমন করে কান্নার ফলে নীলার শরীর মুহূর্তেই খারাপ হবার আশংকায়। সাদিদের অবস্থা বেহাল। সে তুলতুলে গালগুলোতে অজস্র চুমু খেল।
— ‘ তুমি আমার লক্ষ্মি পাখি না? এমন করে না। শরীর খারাপ করবে যে। ‘
সাদিদের এতো আকুতি-মিনুতির পরও নীলা হেঁচকি তুলে কান্না করছে। নিজের ভাগ্যকে বোধহয় তার নিজেই নজর লেগে গিয়েছে। নতুবা এতো স্বামী সুখ পেয়েও কেন হাতেগোনা দিনটুকু তার ভাগ্য নিয়ে এসেছিল? তার যে ভালোবাসা চায়। এমন অন্তরালের ভালোবাসার মায়ার বাঁধন ছেড়ে সে কিভাবে যাবে? তার যে সহ্য হচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তা কি একটুখানি রহম করবেন না?
সাদিদ এবার নীলাকে ছেড়ে দিয়ে নিজের চুলই টেনে ধরলো। এই কান্নার আওয়াজ তার সহ্যসীমার বাহিরে।
— ‘ কান্না থামাও নীলাঞ্জনা। আই সেইড স্টপ দ্য ক্রায়িং ড্যাম ইট। ‘
সাদিদের রাগীস্বরের ধমকিতে কাজ দিলো। নীলার কান্নার বেগ না থামলেও অভিমানী মেয়ে মুখ চেপে কান্না বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সাদিদ একবার সেদিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলল। না আর এই দৃশ্য সহ্য করে যাওয়া সম্ভব নয়।
নিঃশব্দে গাড়ির ভিতরকার লাইট এবং হেডলাইটের আলো নিবিয়ে দিয়ে সে ডাইভিং সিট থেকে বাহিরে বেড়িয়ে আসলো। এবং দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পিছনের দরজা খুলে দিয়ে নীলার পাশের দরজাটাও খুলে দিলো। এবং মুহূর্তেই তাকে আলতো করে পাঁজাকোলে তুলে নিলো।
যেভাবে যত্নে সহকারে কোলে নিয়েছিল সেই একইভাবে তাকে কোলে নিয়েই পিছনের সিটে এসে বসলো।
এই পুরোটা সময় নীলা অবাক হলেও কান্নার বেগ থামাতে পারেনি। কান্নাভেজা চোখেই নিঃশব্দে সে সাদিদের এইসব পাগলামি দেখে গেল।
কিন্তু এতেই যে শেষ হবার নয়। ভালোবাসার পাগলামি যে কেবল শুরু। পিছনের সিটে এসে বসার পরমুহূর্তেই বোধহয় বন্ধ গাড়িতে একটা ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল। প্রবল আশ্লেষে সাদিদ নীলার নরম অধরযুগল নিজের মধ্যে নিয়ে নিলো। লাগাতার, বিরামহীনভাবে ভেজা ঠোঁটজোড়া একইসাথে মিলিত হতে লাগলো।
নীলা বোধহয় এতোটা পাগলামিও আশা করেনি। তার চোখজোড়া হিসেবের চেয়ে বড় আকার ধারণ করেছে। অপরদিকে সাদিদ চোখ বন্ধ করে একমনে প্রিয়তমার গোলাপের পাপড়ির ন্যায় নরম ঠোঁটের স্বাদ নিতে ব্যস্ত। এতটাই বিভোর যে অবাধ্য হাতগুলো কোথায় কোথায় গিয়ে পৌঁছাচ্ছে সেদিকেও তার খেয়াল নেই। আর থাকবেই বা কেমন করে?
এতক্ষণ পাখিটাকে কান্না বন্ধ করতে বহুত বারণ করে গিয়েছে। কিন্তু তার নরম পাখিটা যে কথা শুনতে অনিচ্ছুক। তাই এবার সাদিদকেই তার কান্নায় লাগাম টানতে হতো।
একাধারে এমন উষ্ণ ভালোবাসাময় আদরের পর নীলার আবেশে শরীর অসার হয়ে যাচ্ছে। সাদিদের বাহুবন্ধনী এতটাই প্রবল যে ছুটবার সম্ভাবনা একেবারেই দূর্লভ।
তাই আবেগে-আবেশে, শরীরী উত্তেজনায় নীলাও সাদিদের ঘাড়ে-গলায় জড়িয়ে ধরেছে।
এতক্ষণের আদর যেন নীলার এককদম এগিয়ে আসাতে আরও প্রখর হলো। সাদিদ নীলাকে নিজের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়ে নিলো। প্রিয়তমা যে এখন কেবল প্রাণোচ্ছল রমণী নয় বরং তার অনাগত সন্তানের মা সেদিকে পাগল বাবার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই। সম্পূর্ণ বিষয় মাথায় রেখেই সে শরীরী উত্তেজনায় প্রিয়তমাতে ডুব দিয়েছে। অবাধ্য হাতগুলো ততক্ষণে নীলার ঢিলেঢালা জামার জিপারে গিয়ে ঠেকেছে। খুবই অভ্যস্তভাবে সাদিদ অন্ধকারেই নীলার কামিজের জিপ খুলে দিলো। অতঃপর নগ্ন পিঠে চলতে থাকলো নিজের পুরুষালী হাতের অসহ্যকর আদর। নীলা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠতেই সাদিদ ঠোঁট ছেড়ে দিলো। নরম শরীরের গলায় মুখ গোঁজে ভেজা ঠোঁটের চুমু দিতে লাগলো। কাঁধে, পিঠে, গলা, গালে, কপালে কোথায় কোথায় ভেজা ঠোঁটের চুম্বন পড়লো না! প্রিয়তমার তুলতুলে নরম শরীরটার প্রত্যেকটা ভাঁজে যেন সাদিদ নিজের ছোঁয়া দিতে ব্যস্ত। নরম বুকে বলিষ্ঠ হাত পরতেই নীলা এবার লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়ে সরে যেতে চাইলো। কিন্তু সাদিদ এতো সহজে দিলে তো? তাকে কষ্ট দেওয়া তাই না?
তাই এবার সে ও কষ্টের ভাগ ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু স্বামীর দেওয়া পরম সুখের কষ্ট।
বুকে আলতো করে চাপ প্রয়োগ করে সাদিদ নরম বুকে মুখ গোঁজল। ছোট্ট বড় অসংখ্য চুমুর বন্যায় প্রিয়তমার কান্নার সাথে সাথে সে নিজেও থেমে গেল। বুকে মুখ রেখেই সাদিদ মাথা তুলে নীলার মুখপানে তাকালো।
নীলার একটাহাত সাদিদের কালচেবাদামি চুলে আর অপর হাতটি অনবরত নিজেকে সামলাতে সাদিদের ঘাড়ে খামচে আঘাত করে যাচ্ছে। নীলার নিঃশ্বাস ইতিমধ্যে ঘন হয়ে এসেছে। সাদিদের নিজেরও একি অবস্থা। কিন্তু আর সামনে যাওয়া সম্ভব নয়। শরীরের খিদে জেগে উঠলেও সাদিদ সেগুলোকে নিঃশব্দে ধমকে বিদায় করলো। অতঃপর ঘর্মাক্ত মুখটা নীলার খোলা বুকে ঘষে মুছিয়ে নিয়ে মাথা উঁচু করলো। গোলুমোলু মুখটা তিরতির করে কেঁপেই চলেছে। নিঃশব্দে চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে সাদিদ নীলার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে যেতে সাদিদ গম্ভীর কিন্তু নরমস্বরে বলে উঠল,
— ‘ আর কখনও যেন এমনটা না শুনি পাখি। আজকেই ফাস্ট এবং আজকেই লাস্ট। এই শব্দটা উচ্চারণ করা তোমার জন্য নিষিদ্ধ। আমি এটা তোমার ডিকশনারিতে বরদাস্ত করবো না। কোনোভাবেই না। ‘
নীলার এতক্ষণে কান্না-কষ্ট, আবেগ ভুলে গিয়ে হাসি পেল। এবং সে আটকাতে না পেরে নিচুস্বরে হেসেও ফেলল। এবং সেটা মুহূর্তেই সাদিদের কাছেও স্থানান্তরিত হয়ে গেল। সে নিজেও তার হাসি দেখে নিঃশব্দে হেসে নীলার মাথায় চুমু খেল। এবং জামার জিপারটা লাগাতে হাত দিলো। নীলা আবারও তাতে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করতেই সাদিদের দুষ্টুমিরা পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠল,
— ‘ আগেও তুলতুলে ছিলে কিন্তু প্রিন্সেস আসার আগমনে আরও বেশি তুলতুলে হয়ে গিয়েছো পাখি৷ শুধু আদর করতে ইচ্ছে হয়। সারাটাদিন নরম শরীরটাকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয়। আমার এতো ইচ্ছেগুলো কি পূরণ হবার নয়? ‘
নীলা উত্তর দিতে পারলো না। আরেকদফা এমন লাগামহীন কর্মকান্ড এবং কথাবার্তায় কুঁকড়ে গিয়ে লজ্জার স্থানেই মুখ লুকিয়ে নিলো। ইশশ দিনশেষে কি লজ্জাটাই না তার প্রাপ্য ছিল! এখনও শরীরে যেন লজ্জার বিষাক্ত নীল বিষেরা নিজেদের কার্যসিদ্ধিতে মত্ত রয়েছে।
#চলবে…