অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৬৬

0
4852

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৬৬

রাতের শেষ প্রহর চলছে। কারো জন্য হয়তো এই সময়টা একান্ত নিজেদের মধ্যেকার ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তের একটি। সারাদিনের ব্যস্ততম কর্মজীবনের পর ভালোবাসার মানুষটাকে একান্তে কাছে পাবার তীব্র আকাঙ্খা প্রত্যেকটা নর-নারীর মধ্যেই বিরাজমান। হয়তো বা এই একই প্রহরের নিস্তব্ধ রজনীতে কেউ একসময় নিজের প্রিয়তমাকে আদুরে আদুরে পূর্ণ করেছে। তাকে নরম আদরের চাদরে মুড়িয়ে রেখে নিজে তৃপ্ত হয়েছে। হয়তো বা সেই সুখ মুহূর্তগুলোতে প্রবল আশ্লেষে ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে মুড়িয়ে রেখেছিল নিজের পুরুষালী রোমশ বুকটাতে৷ হয়তো বা কত নির্ঘুম রাত প্রেমময়ী কথোপকথনে তারা নিজেদের সুখস্বপ্নগুলো বুনেছে। কিন্তু আজ? আজ কালের বিড়ম্বনায় সেই একি প্রহরে এসে প্রিয়তমার নরম তুলতুলে শরীরটাকে সি-সেকশনের নাম করে কাটাকাটি করা হচ্ছে। যেই প্রেমিক পুরুষ আলতো করে ছুঁয়ে দেবার আগেও হাজার বার চিন্তা করে নরম শরীরটা নিতে পারবে তো? তার সেই আদুরে দিনগুলোকে হেলায় ফেলে দিয়ে তারা নরম শরীরটাতে অ্যানেস্থেসিয়াসহ সার্জারির নামে অনবরত কাঁচি চালাচ্ছে।
দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতেই লাল চোখজোড়া যেন আরও লালচে হলো। পুরুষালি হাতের মুঠিটা কি নিজ অজান্তেই অনেকটা কঠিন হয়ে গেল?
নাকি কার্নিশ গড়িয়ে পড়া ঐ বিন্দু পরিমাণ মুক্তো দানাগুলো সবটাই অযাচিত কল্পনা?

— ‘ ভাই আর লাগবো? ‘
— ‘ মনে হচ্ছে তো আর লাগবে না। তুই আর আমি দিলাম। ডক্টর দুই ব্যাগই বলেছে। ‘
— ‘ আমরা নিজ দায়িত্বে এক্সট্রা নিয়ে রাখি। মন্দ কি? ‘
— ‘ হুহ্। খারাপ বলিসনি৷ দেখি আমি অফিসে কল করছি৷ অন্ততপক্ষে আরও দুইজন ডোনার এসে হসপিটালে উপস্থিত থাকুক। যদি ইমারজেন্সিতে প্রয়োজন পড়লে কোনো সমস্যা না হয়। ‘

তানবীর শাহেদের কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ালো। পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষের চোখে-মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তারা এসে জড়ো হয়েছে। ক্রমস নিজেদের জায়গা থেকে তারা পায়চারি করছে। আর ক্ষণে ক্ষণে উৎসুক চোখগুলোর দৃষ্টি বন্ধ দরজারটার দিকে স্থির। যেন এই বন্ধ দরজাটার মতোনই তাদের দমটাও গলায় এসে বন্ধ হয়ে রয়েছে। দুশ্চিন্তায়-কষ্টে ক্রমশ আটকে যাওয়া গলা হতে কেবল একটাই নীরব প্রার্থনা ভেসে আসছে।

— ‘ আল্লাহ সহায় হোন। মা-বাচ্চা দুইজনকেই সহিসালামতে যেন দেখতে পাই। ‘

সকলের এতো করুণ আর্তি বোধহয় করুণাময় ফেরাতে পারেননি৷ তাই সব দিতে না পারলেও কিছু একটা বান্দার শূন্য হৃদয়ে প্রশান্তি দেওয়ার জন্য পাঠালেন৷ সকল উৎসাহি চোখকে এক বিন্দু স্বস্তি দিতে ওটির রুমের বন্ধ দরজাটা আচমকা খোলে গেল।
দরজা খোলতে দেরি নেই আর সাদিদের হুড়মুড়িয়ে আসতে দেরি নেই। এতক্ষণের নীরব জড়সড় ছেলেটাকে হঠাৎ এমন ক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখে হাসিবুর রহমান ছেলের কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরলেন৷ সাদিদের গলা কাঁপছে। যদি অপ্রত্যাশিত কিছু শুনতে হয় সেই ভয়ে তার শব্দগুলো একে-অপরের সাথে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একইসাথে তার শরীরটাও অনবরত মৃদুভাবে কেঁপে চলেছে। অবশেষে কন্ঠে রাজ্যের জোর চাপিয়ে ভাঙা গলায় সে বলে উঠল,

— ‘ প্রাণপাখি। মানে.. আমার ওয়াইফ কেমন আছে? ‘

সিনিয়র নার্সটা কয়েক মুহূর্ত থমকালেন। যে আশাটুকু পরিবারের মানুষগুলোকে দিতে এসেছিলেন সাদিদের একটা প্রশ্নে যেন তাতে ভাঁটা পরেছে৷
তিনি হয়তো বা ভেবেছিলেন সবাই এখন বাচ্চাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত হবেন৷ এই ভেবে কিছুটা সাহস করেই এসেছিলেন৷ কিন্তু তেমন যে কিছুই হলো না। পাগলাটে বর এখনও তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে আঁকড়েই পরে রয়েছে।
নার্সের থতমত খাওয়া গম্ভীর চেহারা দেখে যেন সাদিদের আত্মায় পানি শুকিয়ে যাবার জোগাড়। যেটুকু জোর এতক্ষণ গলায় ছিলো এখন যেন সেটিও বিলুপ্তির পথে।

— ‘ সমস্যা কি আপনার? আই সেইড হাউ ইজ সি? হুয়াই ডোন্ট ইউ সে সামথিং? ‘

সাদিদের গম্ভীর রাগীস্বরে ডিউটিরত নার্স বিষম খেয়ে বলতে শুরু করলেন,

— ‘ সরি। বাট আপনার ওয়াইফের কন্ডিশন খুব একটা ভালো হয়। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। আর তার পার্লস রেটও আচমকা ডাউন করেছে৷ ডক্টররা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ‘

হসপিটালের এতো এতো কৃত্রিম লাইটের মধ্যে থেকেও যেন সাদিদের নিকট সবকিছু মুহূর্তেই ঘোর নিকষ কালো অন্ধকার। নার্সের মুখ হতে বের হওয়া বাক্যগুলো যেন কানে গরম শিশা ঢালার সমতূল্য। সে মুখ ফোটে আর কিচ্ছুটি বলতে পারলো না। পা টলমলিয়ে সেখানেই দাড়ানো থেকে পরে গেল।
শাহেদ হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এসে আদরের ছোট ভাইটাকে একপ্রকার ঝাপটে ধরলো।

— ‘ নিজেকে সামলা সাদি। এরকম ভেঙে পড়লে কিভাবে হবে? ‘
— ‘ ভাইয়া উনাদের একটু বলবে, আমাকে যেন গভীর তন্দ্রায় যাবার কোনো মেডিসিন দেয়। না.. না একেবারে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে এমন কিছু দিলে আরও ভালো৷ ‘
— ‘ চুপ। এমন পাগলামি করলে মার খাবি কিন্তু। ‘
— ‘ আমিতো পাগলই ভাইয়া। বড্ড উন্মাদ। প্লিজ এই পাগলটাকে চিরনিদ্রায় যাবার ব্যবস্থা করে দাও। ওকে এই অবস্থায় আমি সহ্য করতে পারছি না ভাইয়া। আমার পাখিটা একা কিভাবে এতোটা কষ্ট সহ্য করছে? আমি যে কিছুই করতে পারছি না। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া বোধহয় ভালো ভাইয়া। প্লিজ একটু সহায় হও। একটু দয়া করো ‘

শাহেদ আর নিজেকে সামলিয়ে রাখতে পারলো না৷ বোন সমতূল্য ছোট্ট মেয়েটার জন্য প্রচন্ড চিন্তা আর পারিপার্শ্বিক অবস্থায় সাদিদের এমন পাগলামিতে রেগে গিয়ে গালে সজোরে এক থাপ্পড় দিয়ে বসলো। কিন্তু সাদিদ এতেও ভাবলেশহীন। দুনিয়ার যাবতীয় ব্যাথা-যন্ত্রণা তার এখন আর গায়ে লাগছে না। প্রিয়তমা যে নিজের অসার হওয়া শরীরটার সাথে সাথে তার দেহেও অসারের বীজ বপন করেছে।
বর্তমান খারাপ পরিস্থিতিটা যেন নিমিষেই পাল্লা দিয়ে কয়েকদাপ বেড়ে গেল। নার্গিস খাতুন, শায়লা রহমান শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন। নিধি জড় মুর্তির ন্যায় ঘুমন্ত ছেলেটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। চোখের পলকও যেন পরছে না। হতভাগা দুই বাবাও এবার চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। এতক্ষণ যেটুকু আশা নিয়ে নিজেদেরকে উপরে উপরে শক্ত রেখেছিল, এখন সেসব যেন বানের জলে ভেসে গেল।
নার্স বোধহয় চারপাশের এমন ভয়াবহ করুণ আর্তিতে নিজের বাক্যটা সমাপ্ত করতে ভুলে গিয়েছিলেন। তাই মুখে জোর পূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে পুনরায় বলল,

— ‘ আরে সবাই এতো ভেঙে পরছেন কেন? সুখবর আছে যে। বাড়িতে লক্ষ্মি পা দিয়েছে। ভগবান আপনাদের ঘরে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মি পাঠিয়েছেন। মিস্টার সাদিদ, মেয়ের বাবা হয়েছেন। কনগ্রাচুলেশনস। ‘

নার্সের অতি উৎসাহে এমন সুখবরেও যেন সাদিদের মাঝে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে যেন প্রাণহীন এক জড়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
নার্সের শেষোক্ত কথোপকথনের মধ্যেই আরেকজন নার্স সাদা একটা তোয়ালে দিয়ে মুড়িয়ে নব্য রাজকন্যাকে নিয়ে হাজির হলো।

— ‘ এই যে আপনাদের পরিবারের ছোট্ট মণি। ‘

শায়লা রহমানই প্রথম কান্না চেপে এগিয়ে আসলেন। ছোট্ট শরীরটাকে পরম যত্নে কোলে নিয়ে এবার শব্দ করেই কেঁদে ফেললেন,

— ‘ আমার সাদির মেয়ে। কই গো দেখে যাও। ঠিক যেন আমাদের ছোট্ট সাদি। ‘

শায়লা রহমান নাতনিকে কোলে নিয়ে অনবরত আপনমনেই বকবক করে চলেছেন। কষ্টকে যেন খানিকটা সময়ের জন্য বিরতি দেওয়া। একে একে সবাই নিজেদের ভেঙে যাওয়া হৃদয় নিয়ে এগিয়ে আসলো। ছোট্ট প্রাণটাকে মন ভরে দেখে যেন কিছুমুহূর্ত বর্তমানের সব অন্ধকার ভুলে গেল। যেন নার্সের পূর্বেকার কথাগুলো সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। এক চিরাচরিত রূপকথার ন্যায় মিথ্যা-বানোয়াট।
সবাই সদ্য আগমন হওয়া ছোট্ট সোনামণিটাকে স্নেহের আদর দিলো। প্রাণভরে দীর্ঘজীবি হওয়ার আশীর্বাদ দিলো। অতঃপর মেয়ের অতি কাছের মানুষ তার বাবার নিকট তাকে নিয়ে গেল।

— ‘ দেখ আব্বা, একেবারে তোর মতো হয়েছে। মাশাল্লাহ কি সুন্দর? কি বড় বড় চোখ করে তাকায়। দেখ একবার৷ নিজের মেয়েকে কোলে নে৷ ‘

শায়লা রহমানের এতো উৎসাহী গলার পিছনেও সাদিদের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল না। সে স্থির মাথা নুইয়ে মেঝেতে বসে রয়েছে। তার যেন এই মুহূর্তে শ্বাস নেওয়াও বারণ। প্রিয়তমা বিহীন এই পৃথিবীর বুকে সাদিদের নামটাও সে দেখতে অনিচ্ছুক। বড্ড বিতৃষ্ণা তার!
শায়লা রহমান আরও কিছু বলছিলেন। কিন্তু হাসিবুর রহমান তাকে হাত ধরে নিঃশব্দে টেনে আনলেন। ইশারায় এই মুহূর্তে চুপ করতে বলছেন। কিন্তু তিনিও যেন এবার অতিরিক্ত চিন্তায় তালগোল হারিয়ে বসেছেন। কান্না মিশ্রিত কপট রাগীস্বরে বলে উঠলেন,

— ‘ নীলা মামণির জন্য চিন্তা কি শুধু তোর একার হচ্ছে? আমাদের কষ্ট হচ্ছে না? তাই বলে এই নিষ্পাপ বাচ্চাটার কি দোষ? তার মুখ দেখতে তোর কেন এতো অনীহা? এসবে এই বাচ্চাটার কি হাত? ‘

শায়লা রহমান রাগ-ক্ষোভে আরও অনেক কিছুই ছেলের উদ্দেশ্য বললেন। কিন্তু ছেলে তার একটি শব্দও বিপরীতে উচ্চারণ করলো না। একেবারে নিঃশব্দের প্রতিউত্তর। এতো নিস্তব্ধতায় যেন গা ক্রমশ শিউরে উঠছে।

____________

কোলের বাচ্চাটা অনবরত নিজ জোরে চেঁচিয়ে নিজের খিদের কথাটা জানাচ্ছে। নিজ ভাষায় বোধহয় মায়ের বিরুদ্ধে হাজারো কষ্টেভরা অভিযোগও জানাচ্ছে। মা কেন তাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে? ছোট্ট প্রাণটার যে এতো খিদে সহ্য করার মতো শক্তি নেই। মা কি ছোট মানুষটার মনের কথা বুঝে না? না বুঝলে এতোদিন কিভাবে ঠিক সময়মতো খাবার পৌঁছে দিতো৷ এতোদিন তো মা একটু পর পর ভারি মজাদার জিনিস তার জন্য পাঠাতো৷ কিন্তু ভালো আম্মাটা আজ হঠাৎ এতো পঁচা হয়ে গিয়েছে কিভাবে?

— ‘ ডক্টর আর কতক্ষণ? ছোট্ট মানুষটা যে খিদের যন্ত্রণা আর সহ্য করতে পারছে না। ‘
— ‘ সরি মেম। আমরা এই মুহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না৷ আপনারা বরং মায়ের দুধের বিকল্প অন্য কিছু খাওয়ান। তাছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না৷ তাই আবারও সরি। ‘

নার্গিস খাতুন আর শায়লা রহমান অশ্রুসিক্ত চোখে একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। এই রাজকন্যাটা কি এতোই হতভাগ্য নিয়ে জন্মেছে যে, জন্মের পর মায়ের অমূল্য সুধাটুকু পান করার সুভাগ্য তার হবে না?
কিন্তু করার যে কিছু নেই। ঐদিকে মেয়ের মা এখনও জীবন-মরণের পথে লড়াই করে যাচ্ছে। আর এদিকে ছোট্ট প্রাণটা কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পরছে৷ আর যে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই তারা ফরমূলা মিল্কের ব্যবস্থা করলো। কিন্তু সোনামণিটার যেন তাতেও ঘোর আপত্তি। মা যদি তার সাথে রাগ করতে পারে তাহলে সেও মায়ের সাথে রাগ করবে৷ নিজ কান্নার বাক্যেতে যেন সে নিজের জোর আপত্তি জানাচ্ছে। মা খাবার না দেওয়া পর্যন্ত সে কিচ্ছুটি খাবে না। একেবারে জেদি বাপের জেদি মেয়ে।
নিধি, শায়লা রহমান, নার্গিস খাতুন একে একে সবাই ছোট্ট জেদি মেয়েটাকে খাওয়ানোর জন্য চেষ্টা করলো। কিন্তু সবাই নিজ চেষ্টায় বিফল।
একদিকে খিদের যন্ত্রণায় অনবরত কান্না করে যাচ্ছে অপরদিকে ফরমূলা মিল্কটা মুখেও নিচ্ছে না। এ যেন সব কূল হারিয়ে দিশেহারা হবার অবস্থা।

— ‘ দাদু মণি আমার, একটু খাও। এভাবে কান্না করে না। গলাটা ভেঙে যাচ্ছে। ‘

না কিছু বলে কয়েই লাভ হচ্ছে না। ছোট্ট মেয়েটা একবিন্দু পানীয়ও মুখে তুলছে না।
নিধি চিন্তাগ্রস্ত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করলো। এবং অদূরে হসপিটালের মেঝেতে হাটু ভেঙে বসা সাদিদের দিকে তার চোখ পড়ল। যে এতক্ষণ একটা কথাও মুখ ফুটে বলেনি। না ছোট্ট মেয়েটার দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়েছে।
এতদিন নীলা এবং পেটের বাচ্চাটার প্রতি সাদিদের অত্যাধিক কেয়ার পরিবারের কারো নজর এড়ায়নি। নীলার মৃদু ব্যাথাতেও সাদিদ যেই হারে চিন্তিত হয়ে পড়ত এটা নিয়ে তারা একসময় দুষ্টুমি করে হাসাহাসি পর্যন্ত করেছে। নীলা তখন লজ্জায় জড়সড় হয়ে থাকলেও সাদিদ নির্বিকারভাবে নিজ কাজ সমাপ্ত করতো৷ নীলার ক্ষেত্রে যেন দিন-দুনিয়াকে পরোয়া করার তার সময় নেই৷ কে কি ভাবলো আর কি না ভাবলো এটা সে বিগত দিনগুলোতে একপ্রকার পাত্তা না দিয়েই কাটিয়ে এসেছে। কিন্তু আজ নিজের মেয়ের এতক্ষণ কান্নার পরেও সেই সাদিদ কিভাবে নীরব থাকতে পারে? এটাই ভাবার বিষয়! তাই কিছু একটা ভেবে নিধি শায়লা রহমানের উদ্দেশ্য বলল,

— ‘ মা, বাবুকে আমার কাছে একটু দেন। ‘

দিশেহারা হয়ে শায়লা রহমান আর কোনো পাল্টা প্রশ্ন করলো না। অঝোরে কান্না করা ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিধির কোলে তুলে দিলো। নিধি তোয়ালে মুড়িয়ে ছোট্ট শরীরটাকে নিজের সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। এবং একপ্রকার বিনা কোনো বাক্যে ব্যয়ে বাবার কোলে আদরের মেয়েকে তুলে দিলো।
সাদিদ এতক্ষণ মেঝের দিকে তাকিয়ে বসা ছিল। তাই আচমকা বাবুকে কোলে দেওয়াতে চোখ তুলে কিছুটা হুড়মুড়িয়ে উঠল। কিন্তু নিধি তাতে মাথা ঘামালো না। বরং বোনের ন্যায় সামান্য আদেশ মিশ্রিত গলায় বলল,

— ‘ নিজের মেয়েকে ধরো। কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙে ফেলছে। তোমাদের মতোই পাঁজি হয়েছে। সবসময় জ্বালাতন। ‘

সাদিদ কয়েকপলক ফ্যাল ফ্যাল করে নিধির মুখপানে তাকিয়ে রইল। যেন আচমকা ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি।
তার হতবিহ্বল চাহনি দেখে নিধি আবারও একইস্বরে বলল,

— ‘ আরে ধরো। ছেড়ে দিলাম তো। ‘

এবার যেন সাদিদের হুঁশ ফিরেছে। মানে কি? তার কলিজার টুকরোটাকে নিধি ফেলে দিবে!
সিংহের খাঁচায় যেন অসময়ে শেয়ালদের দুষ্টুমি। সাদিদ ভস্ম করা দৃষ্টি নিয়ে নিধির দিকে তাকালো। অতঃপর এক ঝটকায় মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরল। আগুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মেয়েটা বুকে জড়িয়েই সে সামনে হাঁটা দিলো।
তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে নিধি এমন সংকটপূর্ণ অবস্থায় থেকেও নিচুস্বরে হেসে ফেলল। কেবল সে নয়। উপস্থিত সবার মুখেই ক্ষীণ হাসির রেখা।
শাহেদ ঘুমন্ত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে নিধির দিকে এগিয়ে এলো। তাকে নিচ থেকে তুলে খানিকটা রাসভারী স্বরেই বলল,

— ‘ তুমি মজা করার আর টপিক পেলে না? এখনইতো তোমাকে ভস্ম করে দিতো। ‘

শাহেদের কথায় আবারও সবাই একবার কান্নামিশ্রিত চোখে মৃদু হাসল। ইশশ কি ব্যাথা সেই হাসিতে! বুকে কি নিদারুণ আঘাতের ফলে এই হাসির রেখাটুকুর সৃষ্টি হয়। সেটা যদি কাউকে বুঝানো যেত!

.

সাদিদ সবার কোলাহল থেকে একটু দূরে ভিজিটরদের জন্য সংরক্ষিত চেয়ারে মেয়েকে নিয়ে এসে বসলো। এতক্ষণ বুকের সাথে ছোট্ট শরীরটা জড়িয়ে রেখেছিল। যার ধরুন রাজকন্যাটার মুখশ্রীটা নজরে পরেনি। এবার পড়ল। নিজের বলিষ্ঠ হাতটাতে ছোট্ট রাজকন্যাটাকে আঁকড়ে ধরে তার মুখ ফুটে সর্ব প্রথম একটাই বাক্য বের হলো,

— ‘ মাশাল্লাহ। ‘

মেয়ে কি বুঝলো সেটা বুঝা গেল না, কিন্তু পিচ্চি একেবারে চুপ। এতোক্ষণের ঝাঁসির রাণী যেন এখন ঘরের আদরের ছোট্ট দুলালী। কান্না ভুলে সে ডাগর ডাগর চোখে সাদিদের মুখপানেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখের ভাষায় যেন সাদিদকে জানিয়ে দিচ্ছে এই মুখ আমার খুব চেনা। খুব যেন কাছের কেউ।
সাদিদ ছোট্ট কোমল কপালটাতে আলতো করে স্নেহের চুম্বন আঁকলো। অতঃপর সেই চির-পরিচিত স্নেহময় ডাক,

— ‘ প্রিন্সেস? ‘

এইতো মেয়ে বুুঝতে পেরেছে। এতক্ষণ যেই চেনা-অচেনার ধোয়াশাতে ছিল এটা মাত্রই এই সম্বোধনের সাথে সাথে কেটে গেল। এটাই তো বাবা৷ যে নাকি সময়ে-অসময়ে প্রিন্সেস ডেকে ডেকে তার শান্তির ঘুম উড়িয়ে দিতো। কিন্তু বেশ মজা লাগতো তখন। আর মায়ের সাথে বাবা যখন ছোট্টদের মতন ঝগড়াঝাটি করতো কি হাসিটাই না পেত তার। কেবল মুখফুটে বলতেই পারতো না।
মেয়ে তার বাবার মুখপানে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। আর ধীরে ধীরে পিচ্চির ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত হলো। ইশশ নবজাতকের মুখে সেই মিষ্টি হাসির রেশটুকু কতটাই না মধুর!
সাদিদের ঠোঁটের কোণ বিস্তৃত হতে গিয়েও হতে পাড়ল না। নিজেকে তার বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। মেয়ের হাসিতে বাবা হয়ে তার মুখ ভারাক্রান্ত কেন?
কিন্তু সে যে অসহায়। তাই সেই অসহায় বাবা আদরের কলিজার টুকরোটার এক বিন্দু হাসির বিনিময়ে অজস্র স্নেহের আদর দিলো৷ ছোট্ট মুখটার কানায় কানায় তখন বুকে পাথর চেপে এক বিধ্বস্ত বাবার স্নেহময় উষ্ণ পরশ।
মেয়ে ততক্ষণে খিদে ভুলে গেল। ভুলে গেল এতক্ষণের কান্না। কেবলমাত্র ঘন আঁখি পল্লবের মধ্যে দিয়ে বাবার মুখটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ঠোঁটের কোণের মৃদু হাসিটা এখনও বহমান।
সাদিদও কলিজার টুকরোটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যেন এতো দেখেও তৃপ্তি হচ্ছে না। সাদিদের নিজেরই বোধহয় নজর লেগে যাবার অবস্থা। যেমনটা ঠিক সেই নিষ্ঠুর মেয়েটার ক্ষেত্রে হতো। সেই একই মায়া, একই মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য। যা হতে চোখ ফেরানো দায়।
সাদিদ ছোট্ট কপালটাতে আবারও প্রবল স্নেহময় চুমু খেয়ে মেয়ের মুখপানে তাকিয়েই ধরা গলায় বলে উঠল,

— ‘ মায়ের মতো মায়াবতী হয়েছিস! নিজেদের মায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিতে চাস। যেমনটা তোর নিষ্ঠুর মা করেছে। মায়ায় জড়িয়ে এখন ছেড়ে যেতে চাচ্ছে। তোর মা নিষ্ঠুর প্রিন্সেস। বড্ড মায়াবতী এক নিষ্ঠুরমনের অধিকারিণী সে! ‘

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here