অন্তরালের অনুরাগ ❤ পর্বঃ৭০

0
5123

গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৭০ ❤

সূর্যোদয় মানেই মানবজীবনকে স্নিগ্ধতায়, পরিপূর্ণতায় ছুঁয়ে দেওয়ার জন্য প্রকৃতির এক নিয়মবদ্ধ পরিকল্পনা। রোজ একই স্বাদে মানব সভ্যতার মুখের রুচিতে বিতৃষ্ণা নামক অরুচি প্রকাশ পেলেও প্রকৃতির এই ডেইলি রুটিনের নিয়মবদ্ধতায় আমাদের কখনোই হাসফাঁস লাগে না।
সাদিদের জন্য তো আজকের নতুন সকালটা আরও তৃপ্তিময়। আরও প্রশান্তি ছুঁয়ে যাওয়া হিমেল বায়ু। সে একদৃষ্টিতে তার জীবনের সুখের তরীর সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা নিষ্পাপ এই দুটি মানবীর দিকে তাকিয়ে রইল। যার মধ্যে বিদ্যামান নিজের একান্ত ব্যক্তিগত এক রূপসী রমণী এবং তারই রূপের সমন্বয়ে সৃষ্টি এক অনবদ্য নিষ্পাপ প্রাণ। থাই গ্লাসের আলো নিবারক ক্ষমতা ছাপিয়ে সকালের উষ্ণ কিরণ ছোট্ট মুখটায় এসে পরতেই তার কপালে ছোট্ট দুইটা ভাঁজ পরলো। মুখটা অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকটাই বিরক্তিমাখা হয়ে উঠল। এ যেন সাদিদেরই প্রতিচ্ছবি। কপালে ভাঁজ, বিরক্তিমাখা চোখ-মুখ! কলিজার টুকরোটা নিজের অজান্তেই সাদিদের ছোট্টবেলাটাকে চোখের সামনে তুলে ধরাতে সে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল। মেয়েকে টেনে নিজের কাছে আনতে উদ্ধৃত হতেই অধৈর্য্য মেয়েটা নিজেই মায়ে বুকে মুখ লুকিয়ে নিলো। মায়ের শরীরের তীব্র ঘ্রাণ আর উষ্ণতায় নিমিষেই যেন ছোট্ট পেটের ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। চোখ বন্ধ রেখেই ছোট্ট মুখটা আস্তে করে মায়ের বুকে ঘষতেই নীলার ঘুম হালকা হয়ে এলো। মেয়েকে আস্তে করে নিজের কাছে আরেকটু টেনে নিয়ে ছোট্ট প্রাণটার পেটের খিদে নিবারণে দায়িত্বশীল মায়ের কর্তব্য পালনে লেগে গেল।
সময় মানুষকে কতটা পরিবর্তন করে দেয়। তাই না? একসময় ঘুমন্ত নীলাকে কোলে নিয়ে সাদিদ পুরো বাড়ি একবার টহল দিয়ে ফেললেও তার খবর থাকতো না। আর সেই নীলাই নাকি এখন মেয়ের আলতো পরশে গাঢ় ঘুম থেকে জেগে যায়! সেটাও রাতে এতবার ঘুম ভাঙার পরও?
মাতৃত্বে মেয়েদের কতোটাই না পরিবর্তন করিয়ে দেয়। বাবার আদরের দুলালী তখন নিজের অংশের কাছে দায়িত্বশীল মা। যেই মা হাজারও কষ্ট বুকে চেপে সন্তানের মুখে হাসি দেখতে চায়। তাতে বাবার আদরের অবুঝ প্রিন্সেস হয়ে থাকার সময় কোথায়?
নীলা ঘুমন্ত চোখেই মেয়ের মাথায় আলতো করে ঠোঁটযুগল ছুঁয়ে দিলো। হঠাৎ সামনে চোখ পরতেই সাদিদকে এমন করে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা ভরকে গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে তার উদ্দেশ্য প্রশ্ন করলো,

— ‘ কখন উঠেছেন? ‘

সাদিদ নিঃশব্দে মৃদু হাসলো। অতঃপর বাম হাতের উপর নিজের শরীরের ভর দিয়ে নীলার দিকে এগিয়ে আসলো। মুখটা নামিয়ে আলতো করে প্রিয়তমার কপালের মাঝখানে দীর্ঘ সময় নিয়ে ভালোবাসার একটা দীর্ঘ চুম্বন দিলো। ডানহাতে তুলতুলে গরম গালটাতে হাত বুলিয়ে নম্রস্বরে বলল,

— ‘ যখন আমার রাজ্যের রাণী আর রাজকন্যা নিজেদের আদুরে ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে ব্যস্ত ছিল। ‘

নীলা মাথা নুইয়ে লাজুক হাসলো। অতঃপর সাদিদের চোখের দিকে মোহাচ্ছন্নের মতো তাকিয়ে থেকেই মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। সাদিদ তার চোখে চোখ রেখেই কয়েকটা মুহূর্ত নীরবতায় অতিবাহিত করলো। অতঃপর মৃদু হেসে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। দুষ্টুস্বরে নীলার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফের বলল,

— ‘ আদর আদর পায়? ‘

নীলার যে কি হলো, মুহূর্তেই গালগুলো রক্ত জবার ন্যায় টুকটুকে লালচে হলো। আলতো করে ধাক্কা দিয়ে সাদিদকে সরিয়ে নিচুস্বরে বিড়বিড় করলো,

— ‘ অসভ্য একটা। ‘

নীলার মুখে এতোবার এই শব্দটা শুনেছে যে সাদিদের এটা মুখস্ত প্রায়। তাইতো নিঃশব্দের তার ঠোঁট নাড়ানো দেখেই সে বুঝে ফেলল।

— ‘ এতো ভদ্রভাবে থেকেও এমন অপবাদ! ‘
— ‘ আপনি ভদ্র? ‘
— ‘ নতুবা কি? বলো, আমি কি অভদ্রের কাজ করেছি? লাস্ট কবে ইন্টিমেট হয়েছি মনে আছে তোমার? সেই শ্রীমঙ্গলের রাতের পরতো ভালোভাবে কাছেই আসা হলো না। শুধু মাঝেমধ্যে যে কয়েকটা শুকনো চুমু-টুমু। যেগুলো তো আজকালের নিব্বা-নিব্বিরা অহরহ খায়। আর কি করেছি আমি বলো? ‘

নীলার কান দিয়ে যেন গরম ধোয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় তার পায়ের পাতা পর্যন্ত কাঁপছে আর সেখানে এই নির্লজ্জ ছেলে বলে কি-না সে কি করেছে? তাকে কেন এই অসভ্যের ট্যাগ দেওয়া হলো?
এটাও কি মানা যায়? অসভ্যের ক্লাসের হ্যাডমাস্টার এসে যদি জিজ্ঞেস করে তাকে কিসের যোগ্যতায় এই উচ্চতর পদবি দেওয়া হলো এটার কি কোনো উত্তর আছে?
নীলাকে এমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাদিদ আবারও বলে উঠল,

— ‘ বলো? কি করেছি আমি? ‘
— ‘ দোহাই লাগি চুপ যান। আপনি ফেরেস্তা, নিষ্পাপ আপনি। হয়েছে? এবার শান্তি? ‘
— ‘ মন থেকে বলছো? ‘
— ‘ আমার একটাই মন। ‘
— ‘ না তারপরও বলা তো যায় না! ‘

নীলা চোখ বাঁকিয়ে তাকাতেই সাদিদ এতক্ষণের হাসি আর ধরে রাখতে পারলো না। শব্দ করেই হেসে ফেলল। যার ধরুন মেয়ে মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে শব্দের উৎসের দিকে তাকালো। বাবার মুখটা দেখতেই তার ছোট্ট মুখে মৃদু মিষ্টি হাসির রেখা প্রকাশ পেল।
সাদিদ আদরের টুকরোটার একদম কাছে গেল। মাথা নিচু করে নরম কাপড় দিয়ে এঁটো মুখটা মুছিয়ে দিলো। অতঃপর ছোট্ট কপালটাতে আদুরে চুমু খেল। মেয়েকে বুকের সাথে আগলে নিয়ে নীলার দিকে তাকালো। প্রশান্তির গরম নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

— ‘ পাখি, আমি কিভাবে তোমার এই ঋণ শোধ করবো? ‘
— ‘ ইশ আপনিও না! এসব কেউ বলে? ‘
— ‘ না বলুক। আমি বলবো। হাজার বার একই কথার পূনরাবৃত্তি করবো। তবুও যদি ঋণের ভার একটু হালকা হয়। ‘

নীলা আর প্রতিউত্তর করলো না। কেবল আলতো হাতে সাদিদের কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিলো। দুইজনেই আবারও নিঃশব্দের চোখাচোখির প্রেমে মজলো। মা-বাবা নিজেদের প্রেমে এতোই বিভোর যে পিচ্চি মেয়ে যে জাগ্রত সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। দুইজনের ধ্যান তখন ভাঙলো যখন মেয়ে নিচুগলায় হাঁচি দিলো।
সাদিদ-নীলা দুইজনই মেয়ের মুখের দিকে তাকালো। ছোট্ট হাতগুলো দিয়ে সে তখন নাকের উপর থেকে বাবার উন্মুক্ত বুকের বক্ষরোম সরাতে ব্যস্ত। নীলা তা দেখে ফিক করে হেসে ফেলল। সাদিদ চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই সে দ্রুত ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে ধরল।
সাদিদ মেয়েকে দুইজনের মাঝখানে আস্তে করে শুইয়ে দিলো।
মেয়ের ছোট্ট শরীরটাকে আলতো করে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

— ‘ আমার আম্মাটা। ‘

অতঃপর বাপ-মেয়ে নিজেদের খুনসুটিতে লেগে গেল। নীলা একদৃষ্টিতে এই মধুময় দৃশ্য দেখলো। তাদের আপাতত কারো দিকে খেয়াল নেই। নীলা যেন নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির ভূমিকা পালন করছে।
কিন্তু তাতে নীলার বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। বরং সে তৃপ্ত। ভীষণ আনন্দিত।

— ‘ ঠক ঠক ঠক। ‘

দরজার মৃদু আওয়াজে সাদিদ-নীলা দুইজনই শব্দের উৎসের দিকে তাকালো। নীলা মাথা উঁচিয়ে দেয়াল ঘড়ি দেখলো। কেবলমাত্র সকাল হয়েছে। এতো সকালে তাদের দরজায় কে?
পারতপক্ষে এই বাড়ির কেউই খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া এতো সকালে কারো দরজায় আসে না। এতদিনে নীলা তাদের এই অভ্যাসটার সাথে ভালোভাবেই পরিচিত। তার উপর আবার ছোট্ট পিচ্চিটা এখন আছে। ডাকার তো আরও চান্স নেই। তাহলে?
কিন্তু সাদিদ এতোসব নিয়ে ভাবলো না। কেবল শব্দের উৎসটার দিকে মনোযোগী হলো। অতঃপর ধীরে ধীরে তার ঠোঁটের কোণ প্রসারিত হলো। সে মেয়ের গালে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে হাসি চেপে বললো,

— ‘ যাও। গিয়ে দরজা খুলো। মেয়ে জামাই এসেছে তো। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ আরে শাদ এসেছে। ‘

নীলা চোখ বাঁকিয়ে তার দিকে তাকালো। মেয়ের জন্মের পর থেকেই সাদিদকে এই বিষয় নিয়ে নীরব থাকতে দেখেছে। নীলা বরাবরই এটা নোটিশ করেছে। কিন্তু কেন?
সেই কারণটা আজকেও জানা হলো না। কিন্তু সাদিদকে কোনোরকম আওয়াজ ছাড়াই দরজার পিছনের মানুষকে চিনে ফেলতে দেখে নিজের মধ্যেকার উৎকন্ঠাটা চেপে রাখতে পারলো না। খানিকটা বিষ্ময় নিয়েই বলল,

— ‘ কিন্তু আপনি কিভাবে বুঝতে পারলেন? ‘

সাদিদ মৃদু হাসলো। অতঃপর রহস্য উদঘাটনে লাগলো,

— ‘ ভালোভাবে খেয়াল করো। শব্দের আঘাতটা দরজার একেবারে নিচের দিকে হচ্ছে। আর এতো নিচে সেই আঘাত করবে যার উচ্চতা কম। আর আমাদের বাড়িতে এমন উচ্চতার কে আছে? ‘

এবার নীলাও হেসে ফেলল।

— ‘ সত্যিই! আপনি পারেনও বটে। ‘

নীলা দরজা খুলতেই ঘুমঘুম চোখে শাদের চাপাস্বরের অভিযোগ,

— ‘ খালামণি এতো লেইট কেন? সেই কখন থেকে ডাকছি। ‘
— ‘ সরি বাবা। ‘

নীলা ডানকানের লতি ধরলো। শাদ আরেকবার হাত দিয়ে চোখ কচলে নীলার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অর্থাৎ তার মন গলে গিয়েছে বোধহয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারও চাপাস্বরে বলে উঠল,

— ‘ বউ উঠেছে? ‘
— ‘ কে বউ? ‘

বলেই নীলার তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল। তার পিচ্চি মেয়ে তো ইতিমধ্যেই কারো পাতানো বউ। নীলা মৃদু হাসল।

— ‘ হুম উঠেছে। ‘

শাদমান যেন খুব খুশি হলো। সে নিজেই নীলাকে সাইড কাটিয়ে ফাঁক দিয়ে চলে আসলো। নিজেই দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বলল,

— ‘ মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসেছি। প্লিজ বলো না। ‘

নীলা দ্রুত হ্যাঁবোধক মাথা নাড়ালো। হাসি পেটে চেপে রাখতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে শাদের সামনে হাসলে তার রেগে যাবার মারাত্মক সম্ভাবনা। তাই না হাসাই শ্রেয়। শাদ ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। সাদিদ যে পাশে শুয়ে আছে তার অপরপাশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বিছানায় উঠলো। ছোট্ট মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এবং কন্ঠে বিষয় মায়া নিয়ে সাদিদের থেকে পারমিশন নিলো,

— ‘ বউকে ধরি? ‘

একটুখানি পিচ্চি ছেলেই যেন ইতিমধ্যে ছোট্ট প্রাণটার উপর সাদিদের আধিপত্য বুঝে গিয়েছে। তাই সাদিদ হালকা হেসে উত্তর দিলো,

— ‘ হুম ধরো। ‘

শাদমান খুব খুশি মনে ছোট্ট নীয়ানার বামহাতটা আলতো করে নিজের মুঠিতে নিলো।

— ‘ একটু জড়িয়ে ধরি? ‘
— ‘ আচ্ছা। ‘

শাদ এবার পূর্বেকার চেয়ে দ্বিগুণ খুশি হলো। ছোট্ট নীয়ানাকে পারে না তার ছোট্ট বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে। অপরদিকে নীয়ানা ইতিমধ্যে লালচে ঠোঁটগুলো ফুলিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখগুলোও হালকা ঝাপসা। মানে যে কোনো মুহূর্তে নোনা জলের আনাগোনার তীব্র সম্ভাবনা।

— ‘ বউকে একটা চুমু খাই? ‘

শাদমান আবারও হাসিমুখে হ্যাঁবোধক উত্তরের অপেক্ষায় সাদিদের মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। আর মেয়েতো এখন যেন কেঁদেই ফেলবে।
সাদিদ পড়েছে মহা বিপদে। না এদিক যাবে না ওদিক?
নীলা পাশে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। সাদিদের চোখ তার উপর পরতেই সে চোখ রাঙানি দিলো। তাকে এমন বিপদের মধ্যে দেখে হাসা হচ্ছে? নীলা কোনোভাবে মুখ চেপে ধরল। এদের কান্ডে কোন দিন না জানি তার পেট ফেটে যায়!

— ‘ বাবা, চুমু না দিলে হয় না? ‘
— ‘ একটু চুমু খেলে কি হবে? ‘
— ‘ মানে ছোট্ট মানুষতো, দাঁত ব্রাশ করেনি। ‘
— ‘ তাহলে দাঁত ব্রাশ করিয়ে দাও। ‘

মানে শাদ তার বউকে চুমু খেয়েই ছাড়বে। সাদিদও নিরুপায়। একদিকে মেয়ে অপরদিকে ভাতিজা। মেয়ের কান্নার আগাম মুহূর্তের মুখের দিকে তাকিয়ে সাদিদ হঠাৎ একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এতে মেয়ের মনও রক্ষা পাবে আর ভাতিজাও তাকে ভুল বুঝবে না।

— ‘ ছোট্ট মানুষের তো দাঁত থাকে না বাবা। ‘
— ‘ তাহলে তো আরও ভালো। এবার চুমু দিই? ‘
— ‘ তুমি বরং তাকেই জিজ্ঞেস করো যাকে চুমু খেতে চাও। ‘
— ‘ মানে চাচ্চু? ‘
— ‘ প্রিন্সেসকেই জিজ্ঞাসা করো। ‘
— ‘ বউতো কথা বলতে পারে না। ‘
— ‘ সেটাও ঠিক। তাহলে কথা বলা অবধি অপেক্ষা করলে কেমন হয়? ‘
— ‘ সেটাতো অনেক দূর। আমি এতদিন অপেক্ষা করতে পারবো না। এখনই চুমু খাবো। ‘

বলতে দেরি নেই আর তার চুমু খেতে দেরি নেই। সাদিদ নীলা দুইজনই স্তব্ধ। এই পিচ্চিগুলোর ব্রেইন তো দেখা যাচ্ছে সুপারফাস্ট!
শাদের চোখে-মুখে বিজয়ের হাসি। ছোট্ট নীয়ানা ফোলে উঠা ঠোঁট আরও ফুলিয়ে দিলো। পাতলা ঠোঁটগুলো তিরতির করে কাঁপছে।
শাদ এতক্ষণ হাসিমুখে থাকলেও নীয়ানার মুখ এমন অন্ধকার করে রাখতে দেখে তার হাসিমুখটা নিমিষেই চুপসে গেল। এবং ধীরে ধীরে তাতে বিরক্তের স্পষ্ট আভাস ফুটে উঠল। ছোট্ট শাদ এটা বুঝে উঠতে পারে না তার আদরে এই পিচ্চির সমস্যা কোথায়? এমনিতে তো বেশ ভালোই হাসিখুশি থাকে। কেবলমাত্র সে কাছে আসলেই তার যত মারাত্মক মারাত্মক পঁচা সমস্যা দেখা যায়!

— ‘ চাচ্চু তোমার মেয়ে এমন কেন? ‘
— ‘ কেমন বাবা? ‘
— ‘ আমি কাছে আসলে এমন ঠোঁট ফুলিয়ে ফেলে! এসব কিন্তু আমার একেবারে পছন্দ নয়। আমি এসব টলারেট করবো না। খালামণি, মেয়েকে সময় থাকতে বুঝিয়ে দাও। ‘

ছোট্ট মুখটা রাগের তোপে হালকা লালচে হয়ে গিয়েছে। শাদমান রাগ নিয়েই বিছানা থেকে নেমে গেল। ছোট্ট পাগুলো দ্রুত চালিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অতঃপর রাগ নিয়েই একবার পিছনে ফিরে তাকালো। লালচে মুখে বিড়বিড় করলো,

— ‘ পঁচা বউ একটা। একবার বিয়েটা হোক তারপর এসবের শোধ তুলবো। ‘

বলেই সে হনহনিয়ে রুম থেকে বের হলো। তার কথাটা অবশ্য উপস্থিত কারো কানেই পৌঁছাতে পারলো না। সাদিদ-নীলা কেবল তার গমপথের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা হাসবে নাকি অন্যকিছু করবে সেটা বুঝে উঠতে পারলো না।
সাদিদ মুখ ঘুরিয়ে মেয়ের দিকে তাকালো। ছোট্ট মেয়েটা অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তখন কেন বাবা থাকতে ঐ বেয়াদবটা তার সাথে অভ্যতামি করলো সে এটাই বুঝে উঠতে পারছে না। সে বাবার সাথে মিষ্টি অভিমান করেছে। যতক্ষণ অভিমানের সমতূল্য প্রাপ্তি ফিরে পাচ্ছে, ততক্ষণ এই অভিমান বহাল থাকবে।
সাদিদ মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ল। একটুখানি ছেলেমেয়েগুলোর রাগ-অভিমান সাদিদের ঠিক হজম হচ্ছে না।

— ‘ মেয়ের বাবা, আপনার মেয়েকে কি বুঝাবো? ‘

নীলা সাদিদের উন্মুক্ত কাঁধে হাত রেখে প্রশ্নটা করল। তার মুখে চাপা হাসি। সাদিদ একপলক নীলার দিকে তাকালো। অতঃপর একসময় সেও মাথা চুলকে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল।

_______________

সকালের নাস্তায় সবাই একসাথে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। সবাই বলতে সবাই। তাদের মধ্যে পিচ্চি নীয়ানা পর্যন্ত বাদ যায়নি। সাদিদ নীলাকে মেয়েসহ উপরে রুমেই থাকতে বলেছিল। কিন্তু নীলা নিজেই জোর খাটিয়ে নিচে নেমে এলো। রুমে থাকতে আর কতো ভালো লাগে?
বেশি অনিচ্ছা প্রকাশ করাতে সাদিদ আর জোর করেনি। মেয়েকে নিজের কোলে নিয়ে নীলাকে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নামতে সাহায্য করেছে। এখন সেই পিচ্চি মেয়েটা দাদির কোলে আদর খাচ্ছে। শায়লা রহমান নিজেই নাতনিকে তার কোলে নিয়েছেন। এবং নীলাকে সবার সাথে নাস্তা করতে বলেছেন। নীলা বারণ করতেই তাকে এক ধমক দিয়ে টেবিলে বসিয়েছে।
সবাই নাস্তা করছে আর নিজেদের মধ্যে টুকটাক গল্প করছে। কিন্তু একমাত্র শাদমানই খাবার প্লেটের থেকে সামনে বেশি তাকাচ্ছে। আর বারবারই বিড়বিড় করে কিসব বলে যাচ্ছে। নিধির আচমকা শাদের প্লেটে নজর পরতেই সে বলল,

— ‘ কি হয়েছে বাবা? কিছুই যে খাচ্ছো না? নাস্তা মজা হয়নি? ‘
— ‘ না মা, এমনি। এইতো খাচ্ছি। ‘

নিধি ছেলের ঘন চুলগুলোতে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো। শাদমান ব্রেডে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে আবারও পিচ্চি নীয়ানার দিকে তাকালো। সে অনবরত দাদির কোলে হাত নাড়িয়ে খেলে যাচ্ছে। মুখটাও হাসিখুশি।

— ‘ খুব খুশি না? বেয়াদব মেয়ে একটা। দাদুরা বলে স্বামী সোহাগি হও। এই মেয়েকে বলতে হবে স্বামী বেহাগি হও। বেয়াদব, প্রচন্ড বেয়াদব মেয়ে। ‘
— ‘ কি হলো দাদুভাই? আবারও কি চিন্তা করো? নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো। ‘
— ‘ খাচ্ছি তো দাদু মণি। ‘

শাদ আবারও একপলক পিচ্চি নীয়ানার দিকে অগ্নিচক্ষু নিক্ষেপ করে খাবারের প্লেটে হাত দিলো। অপরদিকে পিচ্চি নীয়ানার নিঃশব্দের বাক্যগুলো যদি শাদমানের কান পর্যন্ত যেত তাহলে নিজের নামে এতো উল্টো পাল্টা ভদ্র ভাষায় গালাগাল শুনে মুহূর্তেই হয়তো তেড়েফুঁড়ে আসলো। কিন্তু ভাগ্যিস পিচ্চিদের মন্দ ভাষাগুলোও নিঃশব্দের হয়!

— ‘ মা, ওকে আমার কাছে দিন। আপনি এবার নাস্তাটা করে ফেলুন। ‘

শায়লা রহমান এবার আর দিরুক্তি করলো না। চুপচাপ নীয়ানাকে নীলার কাছে দিয়ে দিলো। সাদিদ উপরে যেতে নিতেই নীলা পিছনে ছুটলো।

— ‘ তুমি কোথায় যাও? ‘
— ‘ উপরে। ‘
— ‘ কোনো দরকার নেই। একটু পরেই আবার টইটই করে নিচে নামবে। তার থেকে বরং নিচেই থাকো। ‘
— ‘ এমন করেন কেন? প্লিজ যাই। ‘

সাদিদ ছোট্ট একটা হতাশাজনক শ্বাস ফেলল। মানুষকে কিভাবে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে হয় সেটা এই মা-মেয়ের থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত।

— ‘ দুষ্টু মেয়ে একটা। ‘

নীলা মাথা নুইয়ে হেসে ফেলল। সাদিদ সাবধানে তাকে নিয়ে উপরে গেল। মেয়েটা তার কোলেই রইল।

— ‘ প্রিন্সেকে ধরো। আমি রেডি হবো। ‘

নীলা মেয়েকে কোলে নিতেই সাদিদ অফিসিয়াল জামা-কাপড় নিয়ে ওয়াসরুমে গেল। কিন্তু বেরিয়ে আসতেই সে কিছুটা অবাক হলো। মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে রেখে নীলা তার লেদার ব্যাগ, ওয়ালেট, ঘড়ি সব একে একে বিছানায় সাজিয়ে রেখেছে। পিচ্চি মেয়ে থাকাতে সাদিদ এতটা আশা করেনি। কিন্তু নীলা তার ভাবনার উর্ধ্বে গিয়ে এই ছোট্ট কেয়ারটুকু করাতেই ভীষণ ভালো লাগলো।
আসলে সবসময় বড় বড় জিনিস করে ভালোবাসা প্রকাশ করা লাগে না। ভালোবেসে ছোট্ট একটা কাজ করলেও সেটার মূল্য অনেক।
সাদিদ পুরোপুরি রেডি হয়ে ছোট্ট মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসলো। নিচু হয়ে নরম গালগুলোতে স্নেহময় আদর দিলো।

— ‘ বাবাই যাই? ‘

নিমিষেই যেন মেয়ের মুখের মিষ্টি হাসিটা উধাও হয়ে গেল। সাদিদ অসহায় কন্ঠে নীলার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

— ‘ এমন করলে যাব কিভাবে? ‘
— ‘ ইশ আপনিও না! পিচ্চি মেয়ে আপনার। তার কথায় উঠবেন বসবেন নাকি? ‘
— ‘ এই পাখি! আমার মেয়েকে ইনসাল্ট করছো নাকি? খবরদার তার বাবাই কিন্তু শুনছে। ‘

নীলার চক্ষু প্রায় অক্ষিকোটর থেকে বেড়িয়ে আসার উপক্রম। সে এতক্ষণ কার হয়ে কথা বলছিল? একেই বোধহয় বলে ” যার জন্য চুরি করলাম সেই বলে চোর। ”
নীলা কিছুটা ক্ষেপা স্বরেই প্রতিউত্তর করলো,

— ‘ আপনাদের বাপ-মেয়ের এসব ফালতু ঝামেলার মধ্যে আমি নেই। খবরদার যদি আমাকেও এসবে টেনেছেন তো। ‘

নীলা হনহনিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মিনিট দুয়েক অযথাই জিনিসপত্র এখান থেকে সেখানে করলো। রাগ নয় বরং বাপ বেটিকে একটা উচিত শিক্ষা না দিলে আর হচ্ছে না। বারবার তারা নিজেদের সাথে মনকষাকষি করবে এবং নীলাকে আনবে সমস্যা সমাধানের জন্য। কিন্তু পরে হয় কি? তাদের মনকষাকষি সব মিটে গিয়ে নীলাকেই ভিলেন বানিয়ে ছেড়ে দেয়। এসব মানা যায়?

— ‘ আম্মা, তোমার রাগীলা আম্মা যে আরও রেগে গিয়েছে! কিভাবে রাগ কমাই? ‘

মেয়ে যেন বাবার প্রিয় শিষ্য। অভিমান ভুলে হালকা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো।

— ‘ এই তো লক্ষ্মি আম্মা আমার। কি সুন্দর হেসেছে। আর মন খারাপ করে না। বাবা অফিসে গিয়ে সময় পেলেই কল করবো৷ ঠিক আছে প্রিন্সেস? ‘

এবার মেয়ে আর রেগে থাকলো না। পূর্বেকার মতোই তার ঠোঁটে হাসি লেগে রয়েছে। সাদিদ আবারও মেয়ের কপালে আদর দিয়ে উঠে দাড়ালো। মেয়ে খুশি এবার মেয়ের মাকে খুশি করার সময়।
ভাগ্যিস অফিসটা নিজেদের। নতুবা মা-মেয়ের পিছনে এমন করে পরে থাকার ফলস্বরূপ চাকরিটা অনায়াসেই সাদিদকে গুডবাই বলে দিতো।
সাদিদ আস্তে করে গিয়ে নীলার পিছনে দাড়ালো। নীলা টের পেলেও কোনোরকম পাত্তা দিলো না। সাদিদ কিছু মুহূর্ত নীরব থেকে পিছন থেকে নীলার পেট জড়িয়ে ধরলো।

— ‘ এখানে কি? সরুন বলছি। আপনাদের বাপ-মেয়ের এমন সময়ে-অসময়ের আধিখ্যেতায় আমি নেই। ‘
— ‘ তুমি তো বড্ড হিংসুটে বউ। আমার পিচ্চি মেয়েটাকে পর্যন্ত হিঃসে করা শুরু করে দিয়েছ! ‘

নীলা কটমট চাহনি নিয়ে সাদিদের মুখের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। কিন্তু সাদিদের মুখে দুষ্টু হাসি দেখতেই কনুই দিয়ে তার পেটে খোঁচা দিলো। সাদিদ নিচুস্বরে হেসে ফেলল।

— ‘ ইশশ বউটা দিনদিন মারকুটে হয়ে যাচ্ছে। ‘

নীলা আবারও ছুটার জন্য দাপাদাপি শুরু করতেই সাদিদ আলতো করে তার কানের নিচে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। ব্যস মেয়ে কুপোকাত। সাদিদ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। পিছন ফিরে বিছানার দিকে তাকাতেই মেয়েকে হাত নাড়িয়ে খেলতে দেখলো। সুযোগ যেহেতু আছে তাই রিক্স একটা নেওয়াই যায়।
সাদিদ নীলার পাশ কাটিয়ে সামনে চলে আসলো। অতঃপর আলতো করে তাকে কোলে তুলে নিলো।

— ‘ আরে কি করেন? ‘

সাদিদ তার কথাকে পাত্তা দিলো না। তাদের রুমটা বেশ বড়। তাই মেয়ের দৃষ্টির বাহিরে নিয়ে নীলাকে কোল থেকে নামালো। কেবিনেটের পাশে নীলাকে ঠেস দিয়ে দাড় করাতেই তার আবারও ছটফট শুরু।

— ‘ আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না। এসবের মানে কি? ‘
— ‘ রাগ কমেছে? ‘
— ‘ রাগ কখন করলাম? ‘
— ‘ তারমানে বলছো রাগ নেই? ‘
— ‘ থাকলেও বা কি? ‘
— ‘ অনেককিছু। ‘
— ‘ শুনি কেমন কিছু? ‘
— ‘ এটাতো শুনানো যায় না। শুধু ফিল করা যায়। ‘
— ‘ মানে? ‘
— ‘ মানে হচ্ছে…

সাদিদ বাক্যটা সমাপ্ত করলো না। ছোট্ট করে নীলার ডান গালে চুমু খেল। অতঃপর অপর গালেও। নীলা ততক্ষণে তার কাজের ধরণে কথার সারমর্ম বুঝে নিয়েছে। তাই নরমস্বরে বলল,

— ‘ মেয়ে আছে। ‘
— ‘ তাইতো এখানে নিয়ে এলাম। এখন বলো না এখানেও মেয়ে দেখতে পাবে। যেটা অসম্ভব। ‘

নীলা লাজুক হাসলো। মেয়ের বাবাটা বড্ড অসভ্য!

— ‘ অফিসের জন্য লেইট হচ্ছে না? ‘
— ‘ হচ্ছে তো। তাই তুমি আর লেইট না করালেই হয়। ‘
— ‘ যান তো। সবসময় দুষ্টুমি। ‘
— ‘ বরকে এমন শুকনো মুখে অফিসে পাঠিয়ে দিবে? এতো নিষ্ঠুর তুমি! ‘

নীলা মেকি রাগ নিয়ে তাকালো। কিন্তু সেটাও ধরে রাখতে পারলো না। ফিক করে হেসে ফেলল। সাদিদ তার গালের পিছনে হাত গলিয়ে ঝুঁকে আসলো। আলতো করে কোমল ঠোঁটে নিজের পুরুষালী ঠোঁট চেপে ধরলো। বারকয়েক ছোট্ট ছোট্ট চুমু খেয়ে ছেড়ে দেবার সময় শব্দ করে একটা আদুরে চুমু খেল। অতঃপর ভেজা ঠোঁটে প্রিয়তমার কপালে আলতো করে ভালোবাসাময় স্পর্শ আঁকলো।
অফিস ব্যাগটা নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে দুষ্টু কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘ চাইলে অনুভবের সাথে সাথে শব্দও শোনা যায়। ‘

সে বেড়িয়ে গেল। নীলা সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। অতঃপর সর্বদা তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে যেই প্রার্থনাটা করে আজকেও করতে ভুললো না,

— ‘ হে করুণাময়, তাকে দেখো। সব বিপদ-আপদ থেকে তাকে রক্ষা করো। ‘

#চলবে…

[ পাঠকমহল, প্রায় অন্তিম সময়ে পৌঁছে যাচ্ছি। তাই সময় নিচ্ছি। শেষ পর্যায়ে এসে আমিও ব্যক্তিগতভাবে কষ্ট অনুভব করছি। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here