হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৪১.
সারাদিনের ব্যস্ততার পর সবে গোসল সেরেছে তাহির। ঘরময় ফর্সা আলো জ্বলছে। বাড়িতে মেহমান, ডেকোরেটার্সদের লোকজন। থেকে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে। ভেজা চুলে হাত ডুবিয়ে টেবিলে রাখা কফির কাপ হাতে উঠালো তাহির। কাপে এক চুমুক দিতেই দরজায় প্রবল ভাবে থাবা দিতে লাগলো কেউ। তাহির ভ্রু কুঁচকালো। এতবার কড়াঘাত করতে হবে কেনো? খুলবেই তো সে। ধীরে সুস্থেও ডাকা যায়! এমন ভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছে যেনো এই মুহুর্তে দরজা না খুললে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকে পরবে। এক মিনিটের জন্যও নিস্তার নেই। কোথায় আরাম করতে এলো, এখনি ডাক পরলো! কার আবার দরকার পরলো? ভাবনার মাঝেই দরজার ওপাশের ব্যক্তি ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো। একনাগারে দরজায় বারি লাগাচ্ছে। তাহির গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে দরজার লক খুললো। সাথে সাথেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকলো হিমি। তাহিরকে দ্বিগুন অবাক হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে খাটে বসে পরলো। ঠোঁট প্রশস্ত করে বললো,
“কেমন আছেন বাচ্চা ডাক্তার?”
তাহির অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে হিমিকে দেখছে। সম্পূর্ণ বিষয় বুঝতেই তার কয়েক মিনিট লেগে গেলো। অপ্রস্তুত গলায় বললো,
“আপনি এখানে কি করে?”
“হেঁটে হেঁটে!”
“বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলেন?”
“যেভাবে পাওয়ার পেয়েছি। সেটা না জানলেও চলবে।”
“কেনো এসেছেন সেটা তো জানতেই পারি?”
“পারেন। তবে আমার মনে হয় আগে দরজাটা লাগানো উচিত।”
হিমির কথায় হুশ এলো তাহিরের। ঝটপট দরজা আটকে ফিরে এলো হিমির সামনে। ভ্রু নাচিয়ে জানতে চাইলো এখানে আসার কারন। হিমি জবাব না দিয়ে মৃদু হাসলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো ঘরটায় চোখ বুলালো। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে স্টাডি টেবিলে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। কফি কাপে চুমুক বসিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“নিচে কেউ আপনাকে দেখে নি?”
হিমির সরল জবাব,
“দেখেছে।”
আঁতকে উঠা গলায় প্রশ্ন করলো তাহির,
“কেউ কিছু জানতে চায় নি?”
“কি জানতে চাইবে?”
“আপনি কে? কেনো এসেছেন? কার সাথে দেখা করতে চান? এসব!”
“না।”
“কেনো?”
“নিচে আপনার বিয়ে উপলক্ষ্যে ডেকোরেটিং চলছে। আমি কয়েকজনের সাথে চুপিচুপি ঢোকে গেছি। সবাই ভেবেছে আমিও বাড়ি সাজাতে এসেছি। উত্তর পেয়ে গেছেন! এবার আমার যা চাই দিন।”
তাহির আড়চোখে তাকালো। হিমি ভাব নিয়ে বললো,
“আপনার সম্পত্তির ভাগ চাইছি না। বিয়ের কার্ড চাইছি। দিন। চলে যাই।”
“বিয়ের কার্ড? কি করবেন কার্ড দিয়ে?”
“রেঁধে খাবো।”
“আপনি কার্ড খান?”
“খাই না খাবো। ট্রাই করে দেখি খাওয়া যায় কি না। দিন।”
তাহির নিঃশব্দে হাসলো। কাপ টেবিলে রেখে আলমারির পাল্লা খোলে কিছুটা ঝুঁকলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই একটা কার্ড হাতে আলমারি লাগিয়ে দিলো তাহির। হিমির দিকে ফিরে এগিয়ে দিলো কার্ড। বললো,
“আসবেন?”
“হ্যা। আমি একা আসবো না। সাথে জ্যাঠুমনিও আসবে।”
“আচ্ছা।”
হিমি কার্ড উল্টে পাল্টে দেখলো। ভ্রু উচিয়ে তাহিরকে দেখে কার্ড খোলে ভেতরে লিখা অংশটা পরলো। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো,
“এই কার্ডটা কি আপনি পছন্দ করেছেন?”
তাহির ভ্রু কুঁচকালো। মনে করার চেষ্টা করে বললো,
“উহু। আমার পছন্দ খুব বাজে। এটা মায়ের পছন্দ।”
হিমি ফিক করে হেসে ফেললো। তাহির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে হিমির হাসিতে। দূর থেকেই বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে তার। হিমি হাসি থামালো। মাথা ঝেড়ে বললো,
“সরি। আসলে আপনার মায়ের পছন্দ ভীষন বাজে। তাই হাসি পেয়ে গেলো।”
তাহির গাম্ভীর্য নিয়ে তাকালো। হিমি সন্দিহান গলায় বললো,
“বিয়েটা আপনার পছন্দের মেয়ের সাথে হচ্ছে তো?”
তাহির মাথা নেড়ে অমত জানালো। ছোট্ট করে বললো,
“মায়ের পছন্দ।”
“আপনার একটুও পছন্দ হয় নি?”
“পছন্দ হওয়াটা জরুরি?”
“না। ভালোবাসাটা জরুরি। যাকে বিয়ে করবেন তাকে যদি ভালোই না বাসেন তবে সম্পর্কটা টিকবে কি করে?”
“বলতে পারছি না। আমার সাথে জড়িত কাউকে আমি কখনো ভালোবাসতে দেখি নি।”
“আপনার বাবা মাকেও না?”
“না।”
ছোট্ট করে জবাব দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলো তাহির। বেশ অনেকক্ষন পর নির্লিপ্ত গলায় বললো,
“আমার বাবা মা আপনার বাবা মায়ের মতো ভালোবেসে বিয়ে করেন নি। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়েছিলো। বিয়ের দু বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ওনারা কখনোই একে অপরকে ভালোবাসেন নি। আমার পৃথিবীতে আসাটাও পরিবারের ইচ্ছেতে হয়েছিলো। কিন্তু তা বলে আমাকে কম ভালোবাসেন নি। শুধু নিজের সাথে জড়িয়ে থাকা অপর মানুষটিকে ভালোবাসা দিতে পারেন নি।”
তাহিরের বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। উল্টো ঘুরে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কি এখন চলে যাবেন?”
“আপনি চাইলে থেকে যেতে পারি!”
তাহির হাসলো। বললো,
“আপনি ছেলে হলে আপনাকে থাকতে বলতাম। মেয়ে বলেই পারছি না।”
“আর আমি ছেলে হলে এতদূর আসতামই না।”
“কেনো?”
“বলা যাবে না। আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি?”
“না।”
হিমি তাতে পাত্তা না দিয়েই বললো,
“বিয়েটা কেনো করছেন?”
“আমি ‘না’ বলেছিলাম হিমি!”
“আই ডোন্ট কেয়ার! জবাব দিন। কেনো করছেন বিয়ে?”
“মায়ের ইচ্ছা।”
“দারুণ! তা বিয়ের পর বাচ্চা কাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত আপনার মা নেবেন? আর আপনি ওনার ইচ্ছের কথা ভেবে সংসার করবেন?”
“তা করবো।”
“বাঃ। অসাধারন। আপনার বাবা মা তাদের বাবা মায়ের ইচ্ছার কথা ভেবে বিয়ে করেছিলো। আর আপনি আপনার মায়ের কথা ভেবে বিয়ে করছেন। দেখা গেলো আপনার বউও তার বাবা মায়ের ইচ্ছের কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। আপনাদের ব্যক্তিগত কোনো ইচ্ছা অনিচ্ছা, মতামত নেই?”
“আমার নেই।”
“কিহ! কেনো?”
“ছোটবেলা থেকে একা হাতে মা বড় করেছেন। ওনার কথার অবাধ্য হতে শিখি নি। উনি যা বলেন তা করতে এক পায়ে খাড়া থাকি আমি। মায়ের খুশিটাই মুখ্য।”
হিমি বাঁকা চোখে তাকিয়ে বললো,
“আপনার মা যদি বলেন, এক্ষুনি ব্যলকনি থেকে ঝাঁপ দিতে। দিবেন?”
“মা একথা বলবেন না।”
“যদি বলেন?”
“তবে ঝাঁপ দিতেও রাজি।”
হিমি আস্তে করে দুহাতে তালি বাজিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,
“আপনার মতো ছেলে যদি ঘরে ঘরে থাকতো তবে পৃথিবী বড়ই সুখের হতো। যেহেতু নেই তাই আপনাকেই আগামী প্রজন্মের জন্য আইডল করে তুলতে হবে। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অনেক বছর পর মিউজিয়ামে আপনার ছবি টানানো। নিচে লিখা, ‘দ্যা বেস্ট সন।’ বাচ্চারা খুটিয়ে খুটিয়ে আপনার ছবি দেখছে। শিক্ষকরা তাদের শিখাচ্ছেন কি করে মায়ের বাধ্য সন্তান হতে হয়। ঠিক আপনার মতো। আহা,,, পৃথিবী হঠাৎই সুন্দর হয়ে উঠলো। অদ্ভুত সুন্দর!”
তাহির আবারও হাসলো। দরজায় কড়া নাড়লো হৃদি। উচু গলায় ডাকলো তাহিরকে।
“ভাইয়া? আসছো?”
তাহির অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো,
“আসছি তুই যা!”
হিমি চাপা স্বরে বললো,
“আপনার বোন?”
“হ্যা।”
“ওকে ভেতরে আসতে বলুন।”
হিমির কথায় চমকে উঠলো তাহির। হৃদিকে ভেতরে আসতে বলছে কেনো? হিমিকে দেখে ফেলবে তো! হিমি দ্বিতীয় বারের মতো বললো,
“বলুন না আসতে!”
তাহির মাথা নেড়ে গলা খাদে নামিয়ে বললো,
“পাগল হয়ে গেছেন? আপনাকে দেখে ফেলবে। মা জানতে পারলে খুব বড় তামাশা হয়ে যাবে বাড়িতে!”
হিমি তাহিরের কাছ ঘেষে দাঁড়িয়ে দরজার লক খোলে দিলো। রাগি গলায় বললো,
“আপনার বোনকে আপনি ডাকবেন না কি আমি চেঁচাবো?”
তাহির চোখ পিটপিট করে তাকালো। হিমিকে বিশ্বাস করে সে। হিমি যা বলে তাই করে। তাহির যদি হৃদিকে না ডাকে তবে হিমি চেঁচাতেই পারে। ভেবে লাভ নেই। হিমি যখন বলছে তখন ভেবেই বলছে হয়তো। কথাটা নিজেকে বিশ্বাস করিয়ে দরজা বাইরে মুখ বাড়িয়ে হৃদিকে ডাকলো তাহির। হৃদি নিচে চলে গেছিলো। ভাইয়ের ডাক শুনে দ্রুত পা চালিয়ে তার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। তাহির তাকে ভেতরে আসতে বললো। হৃদি ঘরে ঢোকলো। হিমি স্বাভাবিক ভাবেই হাত নেড়ে বললো,
“হাই!”
হৃদি চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেলো। বোঝার চেষ্টা করলো এই ঘরে সত্যিই একটা মেয়ে আছে কি নেই! পরক্ষনেই হিমির পোষাক, চুল দেখে চোখ গোল গোল করে তাকালো। বললো,
“তুমি ওই মেয়ে না যার সাথে শপিং মলে ফুপির সেই রকমের একটা ধাক্কা লেগেছিলো? তারপর কথা কাটাকাটি!”
হিমি আকাশ পাতাল ভেবে আবিষ্কার করলো মন থেকে ডিলিট করে দিতে চাওয়া সেই মহিলার কথা বলছে তাহিরের বোন। তাহির মুখ হা করে বললো,
“এনার সাথে মায়ের সাথে ধাক্কা লেগেছিলো?”
হিমি চোখ কপালে তোলে বললো,
“মা! ওই মহিলা থুক্কু ওই আন্টি আপনার মা?”
“হ্যা।”
হিমি ভীষন আহত গলায় বললো,
“আপনার হবু বউয়ের জন্য দারুণ কষ্ট হচ্ছে আমার। ইশ, বেচারিকে তো কথা শুনাতে শুনাতেই মেরে ফেলবেন আপনার মা!”
“হিমি!”
হৃদি উচ্ছ্বসিত গলায় বললো,
“তোমার নাম হিমি? কি কিউট নাম! তোমার মতো। কিন্তু বললে না তো, এখানে কি করে? কথাবার্তায় মনে হচ্ছে ভাইয়াকে তুমি আগে থেকেই চেনো!”
হিমি ঠোঁট চওড়া করে বললো,
“আমায় না পালাতে হবে। যা জানার বাচ্চা ডাক্তার থেকে জেনে নিও।”
“কে বাচ্চা ডাক্তার?”
“তোমার ভাই! স্কার্ফ দাও।”
“স্কার্ফ দিয়ে কি করবে?”
“মুখ ঢাকবো। তোমার ফুপি দেখে ফেললে আমাকে সাবান পানি ছাড়াই ধুয়ে দেবে। দাও না!”
হৃদি মাথা থেকে স্কার্ফটা খোলে হিমির হাতে দিলো। হিমি মাথা সহ মুখ ঢেকে মাথা নেড়ে চলে যেতে নিলেই তাহির বলে উঠলো,
“কার্ড নেবেন না?”
“লাগবে না। যা দেখার দেখে নিয়েছি। টাটা।”
তাহির আর হৃদিকে হতবিহ্বল রেখেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো হিমি। হৃদি চোখ সরিয়ে বাঁকা চোখে তাহিরকে দেখলো। হিমির সাথে তাহিরের কি সম্পর্ক থাকতে পারে তাই ভাবতে লাগলো।
চলবে,,,,,,,,