হিমি পর্ব-৪০

0
703

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৪০.

উন্মুক্ত মাঠে ঘাসের উপর পা লম্বালম্বি করে বসে আছে সূর্য। তার পাশেই ফোনে মগ্ন ইমন। দোহা গালে হাত রেখে শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমন সময় তাদের সাথে যোগ দিলো হিমি। হাটু ভাজ করে বসেই ভ্রু নাচালো সে। সূর্য সোজা হয়ে বসে পা ভাজ করলো। দু তিনটে ঘাস ছিড়ে হাতের মধ্যে পিষতে পিষতে বললো,

“মুখে কথা ক। মাইয়াদের চোখের ভাষা বোঝার লাইগা আমার জন্ম হয় নাই।”

হিমি দাঁত খিঁচে সূর্যের পিঠে চড় বসালো। ইমনের দিকে তাকিয়ে বললো,

“ওই ইমন? ফোন রাখ। আড্ডা দিতে আসলাম আর তোরা এক একজন এক এক কাজে বিজি? বাকিরা ক‌ই?”

ইমন ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বললো,

“প্রেম করে।”

হিমি আশ্চর্যান্বিত গলায় বলে,

“কার সাথে?”

সূর্য হাই তুলে গালের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি চুলকে বলে,

“দুইজন দুইজনার লগে প্রেম করে। বুঝিস না?”

হিমি গোল গোল চোখ করে দোহার দিকে তাকায়। দোহা ভাবলেশহীন হয়ে হিমিকে দেখে লম্বা শ্বাস ফেলে। সূর্য বাঁকা হেসে ছোট ছোট ঘাস ছিড়ায় মন দেয়। যেনো এই কাজটা খুব‌ই গুরুত্বপূর্ণ। এই খা খা রোদে বসে থাকার কারনটাও ঘাস ছিড়া। ইমন গাল ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে ফোন পকেটে পুরে বিজ্ঞ বিজ্ঞ গলায় বলে,

“দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ একে অন্যের প্রেমে পরবে স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিক ঘটনা আরো বেশি স্বাভাবিক হয়ে উঠে যখন ওরা দুজন‌ই বন্ধু হয়। বলা হয়, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনোই শুধু বন্ধু হতে পারে না। তারা প্রেমে পরবেই। মেঘ আর সোহুর ব্যাপারটাও এক। ওরাও প্রেমে পরেছে। দেরি হয়েছে তবে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে। এই স্বাভাবিক বিষয়টা এতো অস্বাভাবিক ভাবে নেয়ার কিছু নেই। আর না এতো ভাবার আছে। যা হয়েছে মেনে নে। শান্ত হো। খুব শিঘ্র‌ই ওদের বিয়ে। দাওয়াতের অপেক্ষা কর। বেশি ভাবিস না। চিল!”

হিমির চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় বড় হয়ে গেলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,

“সত্যি সত্যি ওরা প্রেম করছে?”

“না। সোহু প্রপোজ করেছে শুধু। মেঘ কিছু জানায় নি।”

দোহার কথায় চরম অবাক হলো হিমি। অবিশ্বাসী গলায় বললো,

“সোহু প্রপোজ করেছে?”

“হ্যা।”

হিমি হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বললো,

“অসম্ভব।”

“জগতে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। সব‌ই সম্ভব। এটাও সম্ভব হয়েছে।”

হাসি থামিয়ে দোহার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিলো হিমি। কৌতুহলী গলায় বললো,

“কি করে?”

“কি করে জানি না। তবে এটা হয়েছে। পরীক্ষা চলাকালীন সোহুকে খুব ছন্নছাড়া টাইপ লাগছিলো। গুমোট ভাব ধরে ছিলো। শেষ পরীক্ষার দিন কাউকে কিছু না বলে দুম করে বাড়ি চলে গেলো। দুদিন পর ফিরে এসে সোজা প্রপোজ করলো মেঘকে। ক্যাফে তে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। তোদের দুজনের‌ও থাকার কথা ছিলো সেখানে। তুই তো এলি না তবে সোহু এসেছিলো। কারো সাথে কথা না বলে মেঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছিলো, ‘মেঘ আমায় বিয়ে করবি?’ আমরা সবাই থ বনে গেছি ওর কথায়।”

“মেঘ কি বললো?”

“কিছু বলে নি। আমাদের মতোই বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো মে বি! সোহু অবশ্য মেঘের উত্তরের অপেক্ষাও করে নি। নিজে থেকেই বললো, ‘আমি জানি আমি কালো কিন্তু অসুন্দর ন‌ই। বিয়ের পর যদি তোর মনে হয় আমার মতো বিশ্রী দেখতে একটা মেয়েকে বিয়ে করে তোর জীবন তছনছ হয়ে যাচ্ছে তাহলে কিন্তু আমি তোকে ছেড়ে কথা বলবো না। যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ভেবে চিন্তে নে। সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। যখন সিদ্ধান্ত নিতে পারবি তখন‌ই জানাবি। আমি অপেক্ষায় থাকবো।’ আমরা অবাক হয়ে দেখছিলাম সোহুকে। তবে মেঘের কোনো ভাবান্তর হয় নি। সোহুকে শান্ত গলায় প্রশ্ন করলো, ‘তুই আমায় ভালোবাসিস?’ সোহু স্বাভাবিক ভাবে বললো, ‘জানি না। বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে তাই তোকে বললাম। করতে হলে জানিয়ে দিস। তোর উত্তর যদি না‌‌ও হয় তবুও চাপ না নিয়ে আমায় বলে দিস। আমার কষ্ট হবে না মোটেও। তোকে না পেলে যে আমি মরে যাবো বা তোর পেছনে ঘুরঘুর করবো তেমনটা নয়। আবার তোকে হুমকি ধমকি দিয়ে নিজের করবো তেমনটাও নয়! নতুন পাত্র খুঁজবো জাস্ট। বিয়ে করার তাড়া নেই, পাত্র হাতের নাগালে রাখা ভালো। তুই ভাব। তোর পরিবারকেও বল ভাবতে। তোর পরিবারের মত ছাড়া বিয়েটা হবে না। বাড়ি গিয়ে আলোচনা করিস বিষয়টা নিয়ে। আমার ছবি তো তোর কাছে আছেই। দরকার পরলে সামনা সামনিও দেখাতি পারবি আমায়। আমার সমস্যা নেই।’ ব্যস।”

হিমি চোখ কপালে তোলে বললো,

“সোহু এসব বললো?”

“বললো।” (সমস্বরে জানালো বন্ধুরা)

“তারপর মেঘ কি বললো?”

“কিছু বলে নি। উঠে চলে গেছে।”

“কোথায় গেছে?”

“হয়তো বাড়িতে, বলতে পারছি না।”

“আর সোহু?”

সূর্য নাক দিয়ে শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বললো,

“সোহু কলেজ লাইব্রেরী থেকে এক গাদা ব‌ই নিয়ে চলে গেছিলো সেদিন। আর দেখা পাই নি। ফোন রিসিভ করছে না। আগের ফ্ল্যাটে নেই এখন।”

হিমি ভ্রু কুঁচকে বললো,

“এসবের মধ্যে প্রেমের কথা আসছে কোত্থেকে? মেঘ কি জবাব দিলো না দিলো সেসব কিছুই তো জানিস না তোরা। কি করে বুঝলি ওরা প্রেম করছে?”

কাউকে বলতে না দিয়েই দোহা বলতে লাগলো,

“ওসব ওদের কল্পনা হিমি। জানিস ওরা কি কল্পনা করছে?”

হিমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। দোহা বললো,

“ওরা কল্পনা করছে সোহু আর মেঘ এই মুহুর্তে কোনো এক নদীর পারে বসে আছে। কাঠ ফাটা রোদের মধ্যে তারা নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে মন প্রাণ জুড়াচ্ছে। সোহিনীর গায়ে লাল শাড়ি, খোঁপায় ফুল, হাতে চুড়ি, পায়ে আলতা, কপালে লাল টিপ, চোখে গাঢ় কাজল। মেঘ পরে আছে লাল রঙের পাঞ্জাবি। সোহিনীর মেঘের কাধে মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন করছে। মেঘ তার এক হাত আকড়ে ধরে সান্তনা দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে ওরা ওখানে নেই।”

“তাহলে ওরা কোথায় আছে দোহা ম্যাডাম?”

ইমনের খোঁচা দিয়ে বলা কথায় ঠোঁট চ‌ওড়া করলো দোহা। বললো,

“মেঘ এখন নিজের ঘরে দরজা আটকে ঘুমাচ্ছে। আর সোহিনী অনুজ্জ্বল রঙের কোনো এক শাড়ি পরে এক টিউশনি থেকে অন্যটায় দৌড়চ্ছে। এই মুহুর্তে ঘামে ভিজে গেছে সে। তবুও রোদের মধ্যে হেটে হেটে যাওয়া আসা করছে। গট ইট?”

_________________

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের আধার নেমেছে। খাটে শরীরের উপরের অংশ এলিয়ে দিয়ে বাকি অংশ খাটের নিচে রেখে সিলিংএর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে হিমি। তার মাথার কাছে কিছুটা তফাতে বসে আছেন মোজাম্মেল সাহেব। বেশ অনেক্ষণ ধরেই তাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। আলোচনা বলা যায় না ঠিক, প্রশ্ন উত্তর পর্ব। মোজাম্মেল সাহেব একের পর এক প্রশ্ন করছেন আর হিমি তার জবাব দিচ্ছে। যদিও সে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না তবে মোজাম্মেল সাহেব থেমে নেই। হিমির থেকে এই রহস্যের উদ্ধার করেই ছাড়বেন তিনি।

“বিয়ে কবে?”

“জানি না।”

“ও বলে নি?”

“কার্ড দিতে চেয়েছিলেন। আনি নি।”

“কেনো?”

“বিয়েতে যাবো না তাই আনি নি।”

“বিয়েতে কেনো যাবি না?”

“কারন আমি বিয়ে, ফাংশন এগুলোতে যেতে পছন্দ করি না।”

ঝংকার দিয়ে বললো হিমি। মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁট গোল করে আওয়াজবিহীন ‘ও’ বললেন। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন,

“বন্ধুর বিয়েতে যাবি না?”

হিমি শীতল চোখে তাকালো। মোজাম্মেল সাহেব উত্তর জানতে হিমির দিকে তাকিয়ে।

“উনি আমার বন্ধু নন।”

“তবে ‘উনি’ তোর কে?”

‘উনি’ শব্দটা ইচ্ছে করেই জোর দেয়া গলায় বললেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমি উঠে বসলো। দ্রুত নিঃশ্বাস টানছে সে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপক রেগে গেছে হিমি। মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁট টিপে হাসলেন। গলা খাকড়ি দিয়ে বললেন,

“বললি না তো ‘উনি’ তোর কে হয়?”

“কেউ হয় না।”

“তাহলে এতো উত্তেজিত হচ্ছিস কেনো? বিয়ে হচ্ছে হোক। তাতে তোর কি?”

হিমি বিরবির করে বললো,

“আমার কিছু না? নাই তো, আমার আবার কি? উনার ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করছেন। আমায় তো ইনভাইট‌ও করেছেন। বোকার মতো ইনভিটেশন কার্ড না আনা উচিত হয় নি। আমার উচিত ছিলো কার্ড আনা। বিয়েতেও যাওয়া। বর ব‌উকে গিফ্ট দেয়া। তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করা। শুভ কামনা জানানো।”

“ঠিক তাই।”

হিমি কেঁপে উঠলো। এতো আস্তে বলা কথাটা জ্যাঠুমনি শুনে ফেললো? হিমি কি তবে জোরে কথা বললো? বুঝতে পারলো না সে। যদিও মোজাম্মেল সাহেব তাকে বুঝার প্রয়োজনীয় সময় দিয়েছেন। হিমি চুপ করে মনে মনে কিছু ভাবলো। মোজাম্মেল সাহেব উঠে এসে হিমির পাশে বসলেন। হাত দুটো মুঠো করে দু পায়ের মাঝে রেখে স্থির চোখে সামনে তাকালেন। নীল রঙা দেয়াল সামনে। দেয়ালে কিছুই নেই। তবুও ওরা দুজন ওদিকে তাকিয়ে র‌ইলেন। বেশ খানিকটা সময় পর মোজাম্মেল সাহেব স্মিত গলায় বললেন,

“ভেবেই যখন ফেলেছিস তখন মনের ডাক্তারের কাছ থেকে বিয়ের কার্ড আন।”

“এখন বললে দেবে?”

“না দিলে জোর করে আনবি। ছিনতাই করবি। তবুও আনবি।”

“তোমার কি মনে হয়? আমার ওনার বিয়েতে যাওয়া ঠিক হবে?”

“বিয়েতে না যাওয়াটাই বরং বেঠিক হবে। ভুল হবে।”

“জ্যাঠুমনি? ওনার বিয়েতে কিন্তু আমি একা যাবো না! তুমিও যাবে আমার সাথে।”

“কেনো? তুই একা গেলে কি সমস্যা?”

“অনেক সমস্যা। আমার অস্বস্তি হবে। ওখানে তো বাচ্চা ডাক্তার ছাড়া আর কাউকেই চিনবো না। যদি কিছু ভুল ভাল করে ফেলি?”

“করবি না। তবুও তুই চাইলে যাবো। দরকার পরলে পুরো পরিবার নিয়ে যাবো। তোর মামুদের সবাইকে নিয়ে যাবো।”

হিমি ভড়কে গেলো। বললো,

“সবাইকে নিয়ে কেনো যাবে? আজব! ‌আমি তুমি ছাড়া আর কেউ যাবে না।”

“আচ্ছা।”

শিশুশুলভ গলায় বললেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমি দ্বিধান্বিত গলায় বললো,

“ওইদিন মানা করলাম আর আজ যেচে ইনভিটেশন আনবো? খারাপ দেখাবে না?”

মোজাম্মেল সাহেব ঠোঁটে হাসি ফুটালেন। হিমির দিকে ফিরে বললেন,

“মনের ডাক্তারের সাথে তুই কখনো মেপে কথা বলিস নি। তাহলে কেমন দেখাবে সেই প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? যে সম্পর্কে ফরমালিটি নেই সে সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার আগে এতো ভাবছিস কেনো? যা মন বলে কর। ছেলেটা তো মনের ডাক্তার! তোর মন ভুল বললেও সারিয়ে দেবে, চিন্তা নেই। কাল সকালেই চলে যাস। নাহলে দেরি করলি আর পরে দেখা গেলো তুই যখন বিয়ের তারিখ জানতে গেলি সেদিন‌ই বিয়ে!”

কথাটা বলেই উচ্চস্বরে হাসলেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমি চোখে মুখে থমথমে ভাব বজায় রেখে বসে র‌ইলো।

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here