হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৩৯.
ঘর্মাক্ত দুপুর। সূর্যের তাপ প্রকট। ঘড়িতে দেড়টা বাজে। সোহিনীর ভেজা চুল থেকে টপ টপ করে পানি পরছে। চুলের পানিতে শরীরে জড়ানো সুতির শাড়ির কিছু অংশ ভিজে যাচ্ছে। তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। ছাদে উঠে কড়া রোদে ভেজা জামা কাপড় মেললো সে। খালি বালতি হাতে নিয়ে সেড়ে ভেঙে নিচে নামলো। সিড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মধ্যবয়স্ক মহিলা নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন সোহিনীর দিকে। ওনার মুখোমুখি দাঁড়ানো মহিলা মুখ কুঁচকালেন। সোহিনী তাদের এক পলক দেখে নিজের ঘরে ঢোকলো। দরজাটা আটকে দিতেই মধ্যবয়স্ক সেই সুন্দরী মহিলা বললেন,
“দেখেছো? কেমন মেয়ে! বিয়ে শাদি হয় নি তবুও শাড়ি পরে ঘুরঘুর করছে।”
অন্য জন তাচ্ছিল্য গলায় বললেন,
“হয়েছে তো। বলে নি। মুখচোরা মেয়ে। কারো সাথে কথা বলতেও তো দেখি না। বলি এই এতো বড় বিল্ডিংএ একা একটা ফ্ল্যাটে থাকে কি করে এই মেয়ে? পরিবার নেই নাকি?”
“শুনলাম, আগের জায়গা থেকে নাকি বের করে দিয়েছে।”
“সে কি! বের করে দিয়েছে!”
“নয়তো কি? নাহলে ওই মাঝরাতে ব্যাগ পত্র নিয়ে থাকতে আসে! নিশ্চয় কিছু করেছে। নাহলে, বের করবে কেনো?”
“ঠিকই তো! ভাবি, তোমার মেয়েকে দেখি মাঝে মাঝে এই মেয়ের সাথে কথা বলতে আসে। ওকে সামলে রেখো। এই মেয়েটাকে কেনো যেনো ভালো মনে হয় না আমার। তারউপর যা বললে! কাল বেশ রাতে ফিরেছে। ব্যাপার স্যাপার ভালো ঠিকছে না ভাবি!”
মাঝবয়সী মহিলার মুখে চিন্তার ছাপ পরলো। ওনার সতেরো বছর বয়সী মেয়ে যে সোহিনীর সাথে কথা বলে তা ওনার অজানা ছিলো। কিন্তু কি কথা বলে ওরা? বিগরে দিচ্ছে না তো মেয়েটাকে? দিচ্ছে নিশ্চয়! নাহলে, সন্ধ্যে বেলা ছাদে বসে থাকে কেনো ওনার মেয়ে? দুদিন পর সোহিনীর মতোই মাঝরাতে বাড়ি ফিরবে? আকাম কুকাম ঘটিয়ে মান সম্মান ডুবাবে? সোহিনীর নাহয় কিছু যায় আসে না তাতে, কিন্তু ওনার তো যায়! না যে করেই হোক এই মেয়েকে বিদায় করতে হবে এখান থেকে। মেয়েটাকে দেখলেই রাগ লাগে ওনার। শুধু ওনার নয়, বিল্ডিংএর বাকি সদস্যদেরও! মেয়েটার চলা ফেরা, সাজগোজ কিছুই ভদ্রতার কাতারে পরে না।
ওনার ভাবনার মাঝেই ঘরের দরজা খোলে বেরিয়ে এলো সোহিনী। পরনে ধূসর রঙের শাড়ি, কপালে কালো ছোট্ট টিপ, চুল ছাড়া, হাতে কয়েক গাছি চুড়ি। তাকে দেখেই চোখে মুখে তিক্ততা ছেয়ে গেলো দুই মহিলার। সোহিনী থমকে গেলো ওনাদের দৃষ্টি দেখে। এদের দুজনকে চেনে সে। একজন উপরের তলায় থাকেন। আরেকজন তার ফ্ল্যাটের সামনের ফ্ল্যাটটায়। এভাবে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার দিকে সন্দেহি চোখে তাকিয়ে থাকার কারন খুঁজে পেলো না সে। তবুও মিষ্টি করে হাসলো। দুজনকে সালাম জানিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। ভদ্র মহিলা দুজন একে অপরের মুখ দেখলেন। মুখ বিকৃত করে একজন বললেন,
“দেখলেন ভাবি? একটু আগে সুতির শাড়ি পরলো আর এখন পাতলা একখানা শাড়ি পরে বেরুলো! দেখলেন কান্ডটা!”
“দেখলাম। আচ্ছা বদমাশ তো! লোক দেখানোর জন্য এই শাড়িটা পরলো। বেয়াদব, নোংরা মেয়ে। আজ দেখবেন আমি ওনাকে বলবো। মালিককে বলতে হচ্ছে ঘটনা গুলো। এই মেয়ে তো আমাদের সবাইকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে! ছি ছি। কি অশ্লীল পোষাক!”
নিজেদের মধ্যে আরো কিছু কথা বলে তারা যার যার ঘরে গেলেন। অথচ জানলেনও না অসাবধানতায় খাটের কোনায় লেগে সুতির শাড়িটার আঁচল বিশ্রী ভাবে ছিড়ে গেছে। এই মুহুর্তে বাইরে পরে যাওয়ার মতো কাপড় তার কাছে ছিলো না। বাধ্য হয়েই পুরনো পাতলা শাড়িটা পরেছে সে। তার এই দারিদ্র কারো চোখে পরলো না। চোখে পরলো না তার অসহায়ত্ব। সেদিন রাতেও পরে নি। যখন সে হাতে মাত্র একটা ব্যাগ নিয়ে সকালের পরে থাকা জামাতেই বিল্ডিংএর সবচেয়ে ছোট কামরায় থাকতে রাজি হলো তখনও কেউ বোঝে নি এই মেয়ের অবস্থা ঠিক কতোটা খারাপ। কেউ খোঁজও নেয় নি তার কাছে রাতের খাবার টুকু আছে কি না! ওই দুই মহিলা সোহিনীকে যতোটা নোংরা ভাবছিলো তার থেকেও বেশি নোংরা ছিলো সোহিনীর জন্য বরাদ্দকৃত ঘর। রাত জেগে ঘর পরিষ্কার করে ক্লান্ত হয়ে শুয়ার সময়ও পায় নি বেচারি। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেছে টিউশনি করতে। ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে এতোদিনের জমানো সব টাকাই এডভান্সে দিতে হয়েছে সোহিনীকে। বাকি দিনগুলোতে কোনোরকমে বেঁচে থাকতে হলেও তাকে কাজের সন্ধান করতে হয়েছে। দেড় মাস ধরে পরীক্ষার কারনে কাজ নেই তার হাতে। পড়াশোনা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে আশপাশে নজর পরে নি তার। যখন পরলো তখন সব শেষ। ভবঘুরের মতো ছুট লাগিয়েছে আবারও। এই সমাজে সোহিনী শুধুই নোংরা, অশ্লীল, বেয়াদব, খারাপ, অভদ্র! কিন্তু তারা জানে না এর পেছনের কারন। জানলেও ভাবাবেগ হবে না তাদের। কেননা, তারা যা ভাবতে চায় তাই ভাবে, যুক্তি খাটে না কিছুতেই।
___________________
“শুধু আমাকেই বলছেন? এতগুলো দিনে আপনি খোঁজ নিয়েছিলেন আমার?”
হিমি অপ্রতিভ হলো কিছুটা। ডিফেন্স করে বললো,
“আমার কাজ ছিলো। ব্যস্ত ছিলাম প্রচুর!”
“তাই না কি? কি কাজ ছিলো?”
“একটা ফাংশন ছিলো। বিয়ের অনুষ্ঠান।”
তাহির হাসলো। বললো,
“দেড় মাসই অনুষ্ঠান ছিলো?”
হিমি বিরোধীতা করে বললো,
“অনুষ্ঠানের কার্যক্রম তো আমাদেরই করতে হয়েছে না কি! বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই শুধু বিয়ে নয়। আরো অনেক কিছু আছে।”
“যেমন?”
“যেমন এঙ্গেইজম্যান্ট, গায়ে হলুদ, মেহেদী ফাংশন, বিয়ে, বাসর, বউ ভাত। এতো কিছুর জন্য প্রচুর সময় ব্যায় হয়। প্রতিটি ফাংশন আলাদা আলাদা জায়গায় হয় বলে সেসব জায়গার সাথে অনুষ্ঠানের মানানসই ডেকরেশন, থিম, খাবার দাবার, গেস্টদের আপ্যায়ন, তাদের সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখা। সবশেষে অনুষ্ঠান যেনো ভালোয় ভালোয় মিটে যায় সেসব দেখা হাতের মোয়া নয়! অনুষ্ঠান শেষ হলেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যায় না। ভেনু আগের মতো ঠিক ঠাক করে রাখা, ওখানে ব্যবহৃত আমাদের নিয়ে যাওয়া যাবতীয় জিনিসপত্র আগের জায়গায় পাঠানো, খরচ, হিসাব নিকাশ, ইত্যাদি করতে হয়। আপনি কি বুঝবেন এসবের!”
তাহির থমথমে গলায় বলে,
“একটা বিয়েতে এতোকিছু করতে হয়?”
“জি হ্যা।”
“আমি তো এসবের কিছুই জানি না। মা তো বলে নি আমায়!”
হিমি নির্বোধ গলায় প্রশ্ন করলো,
“এসব আপনাকে আপনার মা বলবে? কেনো?”
“সবকিছু তো মাই করছে।”
“সবকিছু!”
“আমার বিয়ের সবকিছু।”
হিমি চমকে উঠা গলায় বললো,
“আপনার বিয়ে?”
“হ্যা। আমার বিয়ে। আমি তো শুধু জানি কনের বাড়ি যাবো, কাবিন হবে। কনে নিয়ে চলে আসবো। ব্যস। এর মাঝে যে এতো অনুষ্ঠান হয় তা তো আমাকে জানানো হয় নি!”
হিমি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“আপনার বিয়ে কবে?”
“এই মাসের শেষেই।”
“আপনি আমায় জানালেন না যে!”
তাহির বিব্রত বোধ করলো। মাথা চুলকে বললো,
“সরি। আসলে সময় হয়ে উঠে নি। কাজের এতো চাপ ছিলো! গাড়িতে কিছু কার্ডস আছে। ওয়েট আমি আনছি।”
তাহির গাড়ির দিকে যেতে নিলে আটকে দেয় হিমি। কৌতুহল মেশানো গলায় বলে,
“কিসের কার্ড?”
“ইনভিটেশন কার্ড! বিয়ের দাওয়াত দেবো না!”
হিমি মাথা নাড়লো। বললো,
“না দেবেন না।”
“কেনো?”
“এমনি। আমি বিয়ের অনুষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট করে থাকি। বিয়েতে থাকি না। তাই আপনার বিয়েতেও থাকবো না।”
“এক্ষুনি না বললেন, আপনাকে কেনো জানাই নি!”
“সেটা তো দাওয়াত পাওয়ার জন্য বলি নি। বলেছি জানার জন্য।”
তাহির বোঝলো না হিমির কথা। বোঝার চেষ্টা করার আগেই হিমি বললো,
“এনিওয়ে যা বলতে এসেছিলাম!”
তাহির সচেতন হলো। হিমি প্যান্টের পকেট থেকে একটা ভাজ করা সাদা কাগজ বের করে তাহিরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এটায় আপনার বাবার ঠিকানা আছে।”
তাহিরের চোখ উজ্জল হয়ে উঠলো। মনি চকচক করছে। ঠোঁটে হাসি নেই। হয়তো অপ্রত্যাশিত জিনিসটা পেয়ে শক্ড হয়ে গেছে সে। হিমির হাত থেকে কাগজ নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন ঝুলালো চোখে। হিমি দু হাত ভাজ করে দূরে শূণ্য দৃষ্টি ফেলে বলে উঠলো,
“জ্যাঠুমনিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বাবা যখন বাড়ি থেকে চলে গেছিলেন তখন তৌসিফ আঙ্কেলের সাথে জ্যাঠুমনির যোগাযোগ ছিলো। আঙ্কেলের একটা নাম্বার জ্যাঠুমনির কাছে আজও আছে। সমস্যা হলো সেই নাম্বার অকেজো হয়েছে অনেক বছর আগেই। যদিও অকেজো হওয়ার আগে দু বার কথা হয়েছিলো তাদের। একবার যখন বাবা মা বাড়ি ফিরে আসে তখন জ্যাঠুমনি কল করেছিলেন। আর দ্বিতীয়বার কোনো এক বিশেষ দরকারে আঙ্কেল কল দিয়েছিলেন। এই ঠিকানাও তখন দিয়েছেন। জ্যাঠুমনি ঐ ঠিকানায় যান নি কখনো। আঙ্কেল বলেছিলেন অতিরিক্ত দরকার পরলেই যেনো ওখানে খোঁজ নেয়া হয় তার। দরকার পরে নি। বিধায় খোঁজ নেয়াও হয় নি। এখন আপনার দরকার পরছে। খোঁজ নেবেন?”
তাহির কাগজের ভাজ খোলে ঠিকানায় চোখ বুলালো। নিভে গেলো তার চোখের উজ্জলতা। হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“বাবাকে ওখানে পাওয়া যাবে না হিমি।”
“আপনি এতো শিওর কি করে? একবার খোঁজ নিন।”
“নিয়েছি।”
“আমি তো এই মাত্র ঠিকানা দিলাম আপনাকে। খোঁজটা নিলেন কখন?”
“আপনি ঠিকানা আজ পেয়েছেন। আমি পেয়েছি বহু আগে। তখন বাবা ওখানে থাকতেন। কিছুদিনের ব্যবধানে ওখান থেকে চলে যান। ওই ঠিকানায় এখন কেউ থাকে না।”
“থাকেন। একজন বৃদ্ধকে রোজ ওই বাড়িতে থাকতে দেখা যায়!”
“জানি আমি। কিন্তু ওনার সাথে বাবার কোনো সম্বন্ধ নেই। আচ্ছা, আপনি কি করে জানলেন ওই লোকের কথা?”
“সূর্যকে পাঠিয়েছিলাম। ওই জানালো।”
“কে সূর্য?”
“আমার বন্ধু। যখন আমার কোনো তথ্য জানতে হয় এবং ব্যক্তিগত কারনে নিজে যেতে পারি না তখন সেই যায়।”
তাহির মাথা দুলালো। কয়েক মুহুর্ত নিরবতায় কেটে গেলো। হিমি শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“চলি বাচ্চা ডাক্তার। বিয়ের জন্য শুভ কামনা।”
তাহির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। হিমি বাইকে বসতেই পেছন থেকে বলে উঠলো তাহির,
“আপনি সত্যি বিয়েতে আসবেন না?”
“আসবো?”
“আপনার ইচ্ছা।”
“আচ্ছা।”
হিমি বাইক স্টার্ট দিলো। তাহির ব্যস্ত গলায় বললো,
“শুনুন!”
হিমি ঘাড় বাকালো। তাহির অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে হাসলো। এগিয়ে এসে হিমির বাইকের কাছে দাঁড়ালো। বললো,
“থেঙ্ক ইউ ফর ইউর হেল্প! আমার বাবাকে খোঁজার জন্য অনেক সাহায্য করছেন আপনি।”
“আমার সাহায্য কোনো কাজে লাগে নি বাচ্চা ডাক্তার। তাই ধন্যবাদ দেবেন না। তুলে রাখুন। যেদিন কাজে লাগবে সেদিন ধন্যবাদ দেবেন।”
তাহির ভ্রু উচিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ দিতেই হবে?”
“আপনি চাইলে এর বদলে অন্য কিছু দিতে পারেন। আমি মাইন্ড করবো না।”
হেসে ফেললো তাহির। হিমি শুকনো হেসে মাথা নেড়ে বললো,
“আসছি।”
তাহির হাত নাড়লো। হিমি বেরিয়ে গেলো বাইক নিয়ে। অলস ভঙ্গীতে গাড়িতে এসে উঠলো তাহির। সেইফটি বেল্ট পরে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে পেছনের সিটে তাকালো। সিট জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা এক গাদা ইনভিটেশন কার্ড। বিষাক্ত লাগে সবকিছু। কেমন যেনো অসামঞ্জস্য লাগছে। সামিয়ার বিয়ে করতে চায় না তাহির। কিন্তু করতে হচ্ছে। মা বলেছে তাই করতে হবে। মানা করতে পারে নি আগে এখন আটকানও যাবে না। বাধ্য হয়েই মায়ের হ্যা তে হ্যা মেলাতে হবে। তবুও আক্ষেপ নেই তাহিরের। এতো বছর পর মাকে আবারও খুব খুশি হতে দেখেছে তাহির। এই খুশিটা আজীবন দেখতে হলে বিয়ে তাকে করতেই হবে।
চলবে,,,,,,,,,
[পর্বটা অগোছালো হয়েছে? হয়েছে!😑 দুঃখিত। চেষ্টা করছি তবুও এগুতে পারছি না, গুলিয়ে ফেলছি সব। ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন।]