হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
৬১.
নান্দনিক পার্কের উত্তর দিকে থাকা ছাতায় ঢাকা টেবিলে মুখোমুখি হিমি আর ইয়াসির। রোদ্দুরে খা খা করছে শহর। খোলামেলা এই পার্কের চারদিক গাছ গাছালিতে ঘেরা। মৃদু মন্দ বাতাস বইছে। দুপুর বেলা হওয়ায় পার্ক প্রায় খালি। এখানে সকালে আর বিকেলের দিকে ভীড় হয়। শিশু, বৃদ্ধ, জোয়ান সব ধাঁচের মানুষরাই একান্ত সময় কাটাতে এই ভীড়ে আসে। জনমানবে গিজ গিজ করা জায়গাতে কেউ কেউ আবার একাকিত্বে সময় কাটায়। মনোরম পরিবেশ। হিমি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ইয়াসির সাবলীল গলায় বললো,
‘আমি সত্যি বলছি। যা করেছি সবটা ইচ্ছাকৃত ছিলো। আমি জানতাম চিঠি প্রেরক মিশ্মি। আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসতো সে। সব জেনেই ওর সামনে এসে দাঁড়াই নি। এড়ানোর চেষ্টা করছি।’
হিমি ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বললো,
‘আপনাকে প্রফেসর বলেই সম্বোধন করছি। কিছু মনে করবেন না যেনো। তো আপনি বলছেন আপনি মিশ্মিকে আড়ালে রেখেছেন শুধু মাত্র ইগো দেখিয়ে? আমার তা মনে হচ্ছে না।’
‘উহুম! আমি ইগো দেখাই নি। আর না মিশ্মিকে ধোঁকা দিয়েছি। ব্যাপারটা হচ্ছে যখন আমি জেনেছিলাম মিশ্মিই সেই যে আমায় ক্রমাগত ফলো করছে, চিঠি লিখছে, ভালোবাসছে তখন আমি তাকে থামাতে চেয়েছিলাম।’
‘থামান নি কেনো তবে?’
‘মিশ্মির কথা ভেবে।’
‘বুঝলাম না।’
‘মিশ্মির আমার প্রতি এট্রাকশটা আমি মেনে নিতে পারি নি। কোনো স্টুডেন্ট আমাকে ‘শিক্ষক’ এর জায়গায় না ভেবে লাইফ পার্টনার করার চিন্তা করুক সেটা কখনোই আমি চাই নি। তাই যখন মিশ্মির পাগলামো, কনসার্ন দেখেছি আমার রাগ হচ্ছিলো। একবার ভেবেছিলাম মিশ্মির সামনে দাঁড়াই। ওকে জানিয়ে দেই আমি ওকে চিনে ফেলেছি। কিন্তু পারি নি। আমার মনে হচ্ছিলো যে মেয়ে অপরপ্রান্তের মানুষটির ভাবাবেগের কথা না ভেবেই তাকে নিজের করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে সে মেয়ে কিছুতেই সরে যাবে না। বরং আমি সামনে দাঁড়ালে সে নতুন ফন্দি আটবে। হয়তো তার আমার প্রতি আকর্ষন বেড়ে যাবে। তাই এমন ভাব করে চলেছি যেনো সে বুঝে আমি তাকে খুঁজছি না। একারনেই তার লিখা অধিকাংশ চিঠি ছিড়ে ফেলেছি। আমার ধারনা ছিলো মিশ্মি আমার চিঠি পড়ার পরের রিয়েকশনটাও দেখতো। তাই ওকে দেখাতেই চিঠি ছিড়ে ফেলতাম। বিরক্তি দেখাতাম। আফসোস, মিশ্মি থেমে যায় নি।’
‘অথৈকে বিয়ে কেনো করলেন? প্রতিশোধ নিতে? না কি মিশ্মিকে কষ্ট দিতে?’
‘কোনোটাই না। আমি অথৈকে ভালোবেসেছি বলেই বিয়ে করেছি। আমাদের কলেজের ফাংশনে একবার অথৈ এসেছিলো। তখন তাকে দেখে অকারনেই ভালো লেগেছিলো। আমি জানতাম না ও মিশ্মির বোন। পারিবারিক ভাবে যখন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই তখন অথৈকে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। তখনও মিশ্মি অথৈর সম্পর্ক জানতাম না। এঙ্গেইজমেন্টের রাতে দেখেছিলাম মিশ্মিকে। অথৈর থেকেই জেনেছিলাম ওরা কাজিন। সবটাই কাকতালীয়।’
হিমি টেবিলের দিকে ঝুঁকলো। দুহাত টেবিলের উপর রেখে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো ইয়াসিরের দিকে। ক্ষীণ গলায় বললো,
‘মিশ্মি তো সব মেনে নিয়েছিলো প্রফেসর। আপনাদের বিয়ে, নিজের বিয়ে। সবকিছুই। তাহলে শেষ মুহুর্তে কেনো ওকে জানালেন জেনে বুঝে আপনি তাকে এড়িয়ে গেছেন? তার ভালোবাসার অপমান করেছেন?’
মৃদু হাসলো ইয়াসির। ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে রোদের তীব্রতা দেখে নিয়ে বললো,
‘গল্পটা বড়।’
‘বলুন। শুনতেই এসেছি আমি।’
‘আমি যখন ভেবেছিলাম আমার অথৈর বিয়ের পর মিশ্মি সামলে নেবে নিজেকে তখন মিশ্মি তার সম্পূর্ণ বিপরীত কাজ করছিলো। আমার কথা বাদ দিলাম অথৈর সাথেও ঠিক করে কথা বলছিলো না। অথৈ বিষয়টা আমাকে জানায়। আমি বুঝতে পারি মিশ্মির ভেতর কি চলছে। বাধ্য হয়ে আমি ডিসিশন নেই মিশ্মিকে সব জানাবো। ভার্সিটি ক্যান্টিনে ডেকে ওর সাথে কথা বলার সুযোগ চাইছিলাম। মিশ্মি সেই সুযোগটাই দিচ্ছিলো না। হুট করে কিছু বললে ওর রিয়েকশন হয়তো ভয়াবহ হতো। তাই পারফেক্ট সময় খুঁজছিলাম। এর মধ্যেই সেখানে উপস্থিত হলো মিশ্মির বর্তমান স্বামী মানে নিহান। আমি তাদের কথোপকথন দেখে বুঝতে পারছিলাম এখানে ইকুয়েশন অন্য। ভেবেছিলাম হয়তো মিশ্মির মাইন্ড ডাইভার্ট হয়েছে। নিহানই করেছে। কিন্তু আমার ভুল ভাঙলো যখন অথৈ জানালো মিশ্মি আর নিহানের মধ্যে গুরুতর প্রেম চলছিলো। চিঠি আদান প্রদান প্রেম। আসল সত্যিটা আমি জানতাম। কিন্তু কিছু করার ছিলো না। অপেক্ষায় ছিলাম মিশ্মির মেনে নেয়ার। সেটাও হচ্ছিলো না। না সে নিজেকে সুযোগ দিচ্ছিলো আর না নিহানকে। হলুদের দিন বিকালে যখন আমার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তখন মিশ্মি আমার দিকে তাকাচ্ছিলো না। মৃদু কাঁপছিলো। সব মানতে চেয়েও পারছে না দেখে আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো। সিদ্ধান্ত নিলাম তাকে জানিয়ে দেবো আমি আগে থেকেই তার পরিচয় জানতাম। কিন্তু কি করে জানাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিলাম,,,,’
‘নিজেকে মিশুর কাছে নিষ্ঠুর, খারাপ, অনুভুতিশূণ্য প্রমান করার?’
হাসলো ইয়াসির। বললো,
‘এছাড়া আর কোনো ওয়ে তো ছিলো না। ইউ ক্যান্ট ইমাজিন আমি যখন ওভাবে কথাগুলো বলছিলাম মিশ্মি না চেয়েও অবাক হয়েছিলো। রেগে ছিলো। ঘৃণা করছিলো আমাকে। তার ঠিক পর পর স্পষ্ট করে তাকিয়েছে আমার দিকে। সে তাকানোয় সংশয় ছিলো না, অভিমান ছিলো না, চাওয়াও ছিলো না। স্বচ্ছ দৃষ্টিতে আমাকে হুংকার দিয়ে নিহানের সাথে কথা বলেছিলো। বিয়েতেও কেমন সহজ হয়ে কথা বলছিলো অথৈর সাথে। ইন ফ্যাক্ট রিসেপশনে তো আমার সাথেও কথা বলেছিলো। সহজ, সাবলীল ভাষায়। আমি এটাই চেয়েছিলাম। মিশ্মির সহজ হওয়া আর বাস্তবতা মেনে নেয়া ভীষন প্রয়োজন ছিলো। আমার একটা কথায় ও যে এতোটা এগুবে আমি ভাবি নি। তবে এগিয়েছে। অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছে। আমাকে ভুল বুঝেই হোক সুখে থাকার চেষ্টায় আছে। আমি বিশ্বাস করি ও সুখে থাকবে।’
হিমি কপাল কুঁচকালো। বললো,
‘এমনটা না করলেও তো হতো!’
‘হতো না। এখন যদিও মিশ্মি আমার উপর রেগে আমায় অপরাধী ভেবে এগুচ্ছে একটা সময় পর ও ভুলেই যাবে আমার কথা। অথবা আমার এই অন্যায়টার জন্যই খুশি হবে। জীবনে পাওয়া সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার দিকে তাকিয়ে হাসবে। তাকেই ভালোবাসবে।’
‘হয়তো। কিন্তু ওর ধারনা আপনি ওর ভালোবাসার অপমান করেছেন। ভুলটা তো ভাঙানো উচিত।’
বিরোধীতা করলো ইয়াসির। বললো,
‘ভুল ভাঙাতে গেলে তার অপমান করা হবে। লজ্জিত করা হবে তাকে। আমি সেটা চাই না।’
হিমি মাথা দুলালো। কি ভেবে হঠাৎ বলে উঠলো,
‘আচ্ছা, কখনোই কি মিশ্মির প্রতি তেমন অনুভুতি জন্মায় নি?’
‘না। প্রথম থেকেই আমার মনে হতো এসব বাচ্চামো। হাসতাম আমি। পরে যখন মনে হলো ব্যাপারটা সিরিয়াস তখন রাগ লাগতো। তেমন কিছু অনুভব করলে আমি মিশ্মিকে আশা দেখাতাম। দেখাই নি তো! কখনো কখনো কারো জীবন সুন্দর করে সাজাতে হলেও তাকে এড়িয়ে যেতে হয়। রিজেকশন মানে সব সময় এই নয় যে হাস্যরস করা হচ্ছে বা অনুভুতির অপমান করা হচ্ছে। বরং অনুভুতির অপমান না করতেও কখনো কখনো রিজেক্ট করা উচিত। আমিও তাই করেছি। সামনে এলে মিশ্মি কখনোই ছেড়ে দিতো না। তাই নিজেকে দোষী বলে চালিয়ে দিলাম। থাক না ও এই বিশ্বাস নিয়েই। ওরা ভালো থাকলেই হলো।’
হিমি সতেজ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
‘মিশুর ভুলটা নাহয় নাই ভাঙালেন কিন্তু অথৈ। ওর ভুলটা ভাঙান। নাহলে আজীবন আপনাকে দোষী ভেবে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে।’
নিঃশব্দে হাসলো ইয়াসির। মাথা চুলকে বললো,
‘অথৈ যদি চিঠিটা হাতে না পেতো তবে জানাতাম না। আমি চাই না ওদের দু বোনের মধ্যে মতভেদ হোক। ওরা একে অপরের দৃষ্টি এড়াক তাও চাই না। কিন্তু কদিন ধরে অথৈ তো আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। না বলে হচ্ছে না।’
ঠোঁট চওড়া করে হিমি বললো,
‘বলে দিন। ও বুঝবে। আশা করছি মিশু অথৈ দুজনেই এই ব্যাপারটা ভুলে যাবে। সংসার গুছিয়ে নিজেদেরও সামলে নেবে।’
‘তাই হোক।’
______________________
হাসপাতাল থেকে ফিরতেই হিমি তাহিরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে। তাহির ডাক্তারি ব্যাগ টেবিলে রেখে টাই খোলায় মনোযোগ দিলো। হিমি খাটের এক পাশে দাঁড়িয়ে আয়নায় তাহিরের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। তাহির আয়নায় তাকিয়ে থেকেই ভ্রু নাচালো। হিমি মুখ কালো করে বললো,
‘আমার একটা জিনিস চাই। দেবেন?’
তাহির পেছন ফিরলো। টাই টা নামিয়ে রেখে বললো,
‘বিকেলে ফোন দিয়েছিলাম তো। তখন বলেন নি কেনো কিছু লাগবে? নিয়ে আসতাম। এখন তো যাওয়া সম্ভব না। কাল বলবেন নিয়ে আসবো।’
হিমি বিরক্ত দেখিয়ে এগিয়ে এলো। তাহিরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো,
‘কিনে আনার জিনিস না কি যে আপনি নিয়ে আসবেন?’
‘কেনার জিনিস নয়?
‘না।’
‘তবে? কি চাই বলুন!’
হিমি ঢোক গিললো। লাজুক মুখ নত করে আমতা আমতা করে বললো,
‘বাচ্চা।’
‘কার বাচ্চা?’
হিমি মুখ তোলে তাকালো। তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
‘আমাদের বাচ্চা।’
তাহিরের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কৌতুহল দমন করতে না পেরে বললো,
‘বাচ্চা দিয়ে কি হবে?’
‘কি হবে আবার কি? বাচ্চা চাই এটা বললাম।’
রেগে গেলো হিমি। তাহির ভ্রু কুঁচকে রেখে বললো,
‘কেনো?’
‘আশ্চর্য! বিয়ে হয়েছে বাচ্চা হবে না?’
‘আপনি শিওর হয়ে বলছেন?’
‘হ্যা। পুরোপুরি শিওর হয়ে বলছি। আমার বাচ্চা চাই।’
তাহির মিটিমিটি হাসলো। কোমরে হাত রেখে বললো,
‘আর ইউ শিওর এবাউট ইট?’
মাথা দুলিয়ে সায় জানালো হিমি। তাহির ধীর পায়ে এগুলো হিমির দিকে। হিমি সরু চোখে তাহিরের গতিবিধি লক্ষ করে পিছুতে লাগলো। তাহির এক বাত বাড়িয়ে হিমির বাহু ধরে কাছাকাছি দাঁড় করালো। মৃদু হেসে বললো,
‘প্রসেস টা জানো তো?’
বিষম খেলো হিমি। তাহির তাতে পাত্তা না দিয়ে হিমির মুখের কাছে মুখ আনলো। স্লো ভয়েজে বললো,
‘ভয় করছে?’
হিমি ডানে বায়ে মাথা নেড়ে মাথা পিছুতে নিলো। তাহির হিমির দুগালে হাত রেখে মাথাটা সোজা করে রাখলো। হিমি কাঁপতে লাগলো। নিঃশ্বাস তুমুল গতিতে উঠানামা করছে। তাহিরের মুখটা আরো একটু কাছে আসতেই চোখ খিঁচে বন্ধ করে দিলো হিমি। তাহির ফিক করে হেসে ফেললো। হিমিকে ছেড়ে দিয়ে আলমারি থেকে কাপড় বের করলো। ঠেস মারা গলায় বললো,
‘চুমু খেতে ভয় পায় আবার বাচ্চা চাই ওনার!’
চলবে,,,,,,,,,





