#আনকোরা
#রূবাইবা_মেহউইশ
২৪.
প্রচণ্ড রকম দূর্ভিক্ষ চলছে জীবনটায়। আজ তিনটা মাস হয়ে গেল দিহান শান্তিতে একটা রাত দু চোখের পাতা বুজতে পারেনি। যতটুকু ঘুম না হলে বেঁচে থাকা অসম্ভব ঠিক ততটুকুই সে ঘুমিয়েছে। তার পাশের বেডের ছেলেটা প্রতি রাতে টের পেয়েছে তার ছটফটানো, রাত জেগে মেসের বাইরে গিয়ে রাতভর সিগারেট খাওয়া। মাঝেমধ্যে পাশের রুমের ছেলেরাও এসব লক্ষ্য করে তাকে কতরকম সাবধান বাণী শুনিয়েছে।কিন্তু সেসব কথা সে কানে তোলা পর্যন্তই শেষ। মেনে চলা সম্ভব নয় এত বাণী। জীবনের সকল অশান্তিকে ছাপিয়ে একটু স্বস্তি পাওয়া তার জন্য দুঃসাধ্য ব্যাপার। ছয়টা মাসে সে প্রতিদিন ভেবেছে চৈতীর কথা কিন্তু সেই ভাবনায় মিশে ছিলো আকাশসম রাগ।সেই রাতটা তার মন থেকে কিছুতেই সরেনি একটুর জন্যও ; খেতে,বসতে, ঘুমোতে সব ক্ষেত্রেই তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে খুব। চৈতীর প্রতি এতদিনেও তার স্ত্রী স্বরুপ ভালোবাসা জন্মায়নি তবুও কিছু একটা তো ছিলো যা তাকে চৈতীকে নিয়ে ভাবতে বাধ্য করতো। সে মায়ের সাথে কথা বলারও অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু তার চেষ্টা প্রতিবার ব্যর্থ করে দিয়ে মা তার ফোন তোলেনি। কিন্তু আজ যখন মা ফোন তুলল তাকে দেখলো,কথা বলল তখনি চৈতী তার নতুন রুপে দৃষ্টি সীমানায় এলো। না চাইতেও তার বুকের ভেতর এক অজানা বিধ্বংসী ঝড় শুরু হয়ে গেল। দিহান ভিডিও কলে মাকে যখন দেখছিলো তখন মায়ের পেছনে থাকা ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় সে স্পষ্ট দেখেছিলো চৈতীকে। গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে গিয়েই চোখ আটকে যায় ফোলা,ভারী পেটটাতে। বুকের ভেতর ধ্ক করে উঠে তার। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করাতে খুব কষ্ট হয়েছে সেই সাথে মনটাকেও। সে যখন ‘চৈতী’ নামটা আওড়ালো তখনি দিলশাদ খেয়াল করলো পেছনে চৈতী দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করেই সে চৈতীকে বলল, “তুই তোর ঘরে যা আমি একটু পর আসছি।”
চৈতী আর দাঁড়ায়নি কিন্তু দিহানের চোখ অস্থির হয়ে ক্যামেরায় দেখতে চাইছে চৈতীকে। চৈতীর পেট দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার সময়টা। দিহান মাকে কোন প্রশ্ন করবে তার আগেই দিলশাদ পরে আবার কথা হবে বলে ফোন কেটে দিলো। ব্যস, কল কাটার সময়টুকুই মাত্র এরপর আর দিলশাদের কান্নার জোয়ার থামেনি অনেকটা সময় পর্যন্ত। দীর্ঘ ছয়টা মাস দিহানের প্রতি রাখা কঠিন মনোভাবটা তার অচিরেই ভেঙে গেল। চিৎকার করে তার দিহানকে ডাকতে ইচ্ছে করছিলো খুব। বারবার বলতে ইচ্ছে করছিলো দিহান ফিরে আয় তুই। দ্যাখ না তোর সন্তান আসবে আমার ঘর আলো করতে৷ ফিরে আয় চৈতীর কাছে। ফিরে আয় তুই চৈতী আর তোর সন্তানের একলা রাতগুলো তোকে ছাড়া কতটা অন্ধকার দেখে যা। তুই পাশে থাকলে তাদের এই অন্ধকার ফিকে হয়ে যাবে। কিন্তু মানব মন বড়ই অদ্ভুত যে কথাগুলো দিলশাদের মন চিৎকার করে বলতে চাইছে সেই কথাগুলোই সে আওয়াজ তুলে বলতে পারলো না।
দিশা,আরিশা চলে যেতেই বাড়িটা আবার ফাঁকা লাগছে চৈতীর। বাচ্চাটার জন্য খুব মায়া জন্মে গেছে বাড়ির সকলের মনে। বাড়িটা সারাক্ষণ ভরা ভরা লাগতো আগে এখন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে সব কোলাহল। রাতে একমাত্র দিশান ফিরলেই একটু আমেজ ফিরে পায় এই যা! দিশান আজকাল নিয়ম করে প্রতি রাতে চৈতীকে ফোনে জিজ্ঞেস করে তার কিছু চাই কিনা! আসার সময় কি নিয়ে আসবে খাওয়ার জন্য আবার ছুটির দিনে ঐশীকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ঐশী জোর করে চৈতীকে সাথে নিয়ে যায়। দিহানের বাবা মানুষটা বরাবরই হাস্যজ্জ্বল মানুষ। তিনিও অফিস থেকে ফিরেই চৈতীকে নিয়ে বসার ঘরে গল্পের আসর জমান। দিলশাদ প্রথম প্রথম বকাবকি করতেন এত আড্ডা আর আড্ডার উছিলায় প্রতিদিন ভাজাপোড়া খাবার খেতেন বলে। কিন্তু হঠাৎ করেই খেয়াল করলেন এই আড্ডার উছিলায় তার দুটো ছেলের বউই খুব হাসিখুশি থাকে আবার শ্বশুড়েরও খুব আদুরে হয়ে গেছে তারা। তাদের মধ্যে সম্পর্কটা এখন আর বউমা,শ্বশুর নয় বাবা, মেয়ে থেকেও বেশি যা বলা যায় সেটা হলো বন্ধুত্ব। কি দারুণ তাদের মধ্যে আন্তরিকতা যা হয়তো দিলশাদের সাথেও এতোটা নয়! তারা প্রতিদিন আবদার নিয়ে বসে শ্বশুড়ের কাছে বিভিন্ন জায়গায় পিকনিক করার।
চৈতীকে ভিডিও কলে দেখার ঠিক দু দিন পর সন্ধ্যায় বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো। সময়টা ভর সন্ধ্যায় হওয়াতে গেইট খোলার জন্য কেউ ছিলো না। চৈতী আর দিলশাদ চৈতীর ঘরেই একসাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করছিলো। ময়নাও ইদানীং নিয়মিত নামাজ আদায় করে বলে সেও ওই মুহুর্তে নামাজে আর ঐশীও নিজের ঘরে নামাজে ব্যস্ত ছিলো। দরজার ওপাশের ব্যক্তিটা একটু বেশিই অস্থির ছিলো হয়তো তাই সে এই ভর সন্ধ্যাতেই কলিংবেলটা অনবরত বাজিয়ে চলল যার দরুণ প্রত্যেকের নামাজের মধ্যেই কানে তালা লাগার উপক্রম হলো। দিলশাদ ঠিক আজানের মুহুর্তেই নামাজে দাঁড়িয়েছিলো বলেই তার নামাজ তখন শেষের দিকে৷ সে ছোট করে মোনাজাত করে নফল ছেড়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। প্রচণ্ডরকম বিরক্তি আর রাগের মিশ্রণে তার কপালে লম্বা এক রেখার সৃষ্টি হলো। মনে মনে বলছিলো, দরজাটা খুলে বাইরে থাকা ব্যক্তিটাকে সে তার বাবার বহু বছর পুরনো একটা শিকার করার রাইফেল ছিলো সেটার ট্রিগার চেপে ধরবে ব্যক্তিটির কপালে। পা দুটো তার দরজার কাছে এসে থামতেই কেন জানি বুকটা ভারী হয়ে এলো। কিছুদিন হলো ঘরের প্রধান এই দরজাটা বদলেছে দিশান। আগের দরজায় লুকিং গ্লাস ছিলো ওপাশে থাকা মানুষকে দেখে পরেই দরজা খুলতো। কিন্তু এই দরজাটায় সেই ব্যবস্থা নেই এর জন্য অবশ্য খুব বকাও খেয়েছে দিশান। বলেছিলো খুব শিগ্রই এটাতে গ্লাসের ব্যবস্থা করবে কিন্তু এখনো তা করা হয়নি। এমন সন্ধ্যে বেলা কে আসতে পারে ভেবে একটু মন কেমন করলো দিলশাদের তবুও আবার সাহস করে দরজাটা খুলল। বাইরে আকাশে বিজলী চমকাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে সেই সাথে বাতাসও হচ্ছে। সেই বাতাসে ধূলো উড়ছে আর দরজা খুলতেই ধূলো উড়ে এসে পড়লো দিলশাদের চোখে। এক হাতে চোখ ঘষে সামনে তাকানোর আগেই দরজায় থাকা ব্যক্তিটি তাকে জাপটে ধরলো। বাইরে বর্ষণ তখনও অসম্ভাবী কিন্তু তার আগেই বর্ষণ শুরু হলো জড়িয়ে ধরা ব্যক্তিটার। দিহান কাঁদছে মাকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইছে বারবার না বলে চলে যাওয়ার জন্য। তাকে কি মা ক্ষমা করবে না! দিলশাদ ততক্ষণে বরফের মত জমে গেছে ছেলের বাহুবন্ধনে আটকে। কিছু বলার মত শব্দ তার কন্ঠনালীকে ছাপিয়ে উঠতে পারলো না। এত বড় ছেলেটার চোখের জল তার হিজাব ভিজে কাঁধ ছুঁলো।কখন যে তারও গাল সিক্ত হলো টেরই পায়নি সে। দিহান কান্নার মাঝেই সামনে দেখতে পেল দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি মানুষকে। পা থেকে দৃষ্টি তার মুখ পর্যন্ত পৌঁছুতেই মানুষটি নিঃশব্দে চলে গেল সেখান থেকে। দিহানকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই দিলশাদ ভাবলো চৈতীকে কি ডাকবে একটু! দোটানায় পড়ে গেল তার মনটা। ছেলের ওপর থাকা আক্রোশ কখন যে অশ্রুর সাথে ভেসে গেছে তা সে নিজেও জানে না। এটাই হয়তো মায়ের মমতা। মুখে যতোটা শক্ত কথাই বলুক না কেন মন তার মাতৃত্বে গলে নরম কাঁদামাটি হবেই হবে। আর এটাই মাতৃত্বের অলিখিত নিয়ম৷ দিলশাদের দোটানা আর বেশিক্ষণ রইলো না যখন দেখলো দিহান কিছু না বলেই নিজের ঘরে পা বাড়ালো। ময়না খালা আর ঐশীও ততক্ষণে বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তারা দু’জনও যেন অনায়েসেই পড়ে নিলো দিলশাদের মনের কথা। হয়তো মনের সাথে মনের মিলটা তাদের সত্যিকারের আর ভালোবাসাটাও নিঁখাদ ছিলো তাই তারা বুঝে গেল সব। ঐশীই প্রথমে মুখ খুলল, “মা এত ভাবছেন কেন? চৈতী যা বলবে আপনি তাই সিদ্ধান্ত নিবেন কিন্তু তার আগে ভাইয়াকে একটু বোঝা দরকার।”
“কি বুঝবো ঐশী।”
দিলশাদ প্রশ্ন করতেই ময়নাও একটু সাহস দেখিয়ে কথা বলল, “আফা, মামা বাড়ি আসছে আজকে আপনের মন কি কয় ক্যান আইছে?”
“জানি না ময়না কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন দিহান চৈতীকে দেখে কিছুটা থমকে গিয়েছিলো।”
“হের পরেই বাড়ি ফিরলো।”
“না সে দুদিন পর ফিরলো।”
“হোক দুই দিন পরে কিন্তু ফিরলো তো! আমার মন কয় ভালা কিছু হইবো।”
“তাই যেন হয়।”
দিহান নিজের ঘরে ঢুকে হাতের ব্যাগটা রাখলো। চৈতী ঘরে এসে একটা বই হাতে নিয়ে ডিভানে বসে বইয়ে মনযোগ দিলো। দিহানের দিকে একটা পলক ফিরেও তাকালো না সে। দিহানও যেন অস্বস্তিতে পড়লো ঘরে এসে। মন বলছিলো এ ঘরে আসাটা কি অন্যায় হলো! চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর অনেক জড়তা নিয়েই প্রশ্ন করলো, “কেমন আছিস?”
চৈতী চোখ তুলে তাকালো না দিহানের দিকে কিন্তু মনটা হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলো ভেতরে ভেতরে। একবার ইচ্ছে হলো চোখ তুলে তাকাতে পরক্ষণেই নিজের পেটের ওপর তার দৃষ্টি আটকে গেল। আপনাআপনিই একটা অজানা কষ্ট এসে তোলপাড় করে দিলো বুকের ভেতর। গত ছয়টা মাসেরও বেশি সময় হয়ে গেছে দিহান বাড়ি ছেড়ে গিয়েছে আর সেই থেকে তার চোখে অশ্রুদের আনাগোনা ছিলো না। এই মুহুর্তে সেই অশ্রুরাই এসে হানা দিলো চোখের জমিনে। দৃষ্টি নিচু কিন্তু জল টইটম্বুর চোখটা পানি ঝরালো না। অনেক কষ্টে কান্নাটাকে আটকে রাখলো গলার ভেতর। দিহান এগিয়ে এলো চৈতীর ঠিক সামনে। হাঁটু গেঁড়ে বসলো তার পায়ের কাছে আর তখনি জলের ধারা বাঁধা ডিঙিয়ে ঝরে পড়লো বৃষ্টির বড় বড় ফোটার মত। বারান্দার দরজাটা খোলা থাকায় বাইরের উন্মাদ বাতাস ঘরে ঢুকেই উষ্ণ ঘরটাকে কান্নার স্রোতে শীতল করে দিলো।
“চৈতী!”
চৈতী কাঁদছে; দিহান বার কয়েক আবারও ডাকলো কিন্তু চৈতী জবাব দিলো না। ইচ্ছেমত অশ্রুবিসর্জন দিলো সে। তারপর একটা সময় ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল ফুপির ঘরে। তখনও ফুপা কিংবা দিশান ভাই বাড়ি ফেরেনি। দিলশাদ ইচ্ছে করেই চৈতীকে দিহান সম্পর্কিত কোন কথা বললেন না। তিনি চাইছেন যা বলার চৈতীই আগে বলুক। কিন্তু রাত অনেক হলো, দিশান আর তার ফুপাও বাড়ি ফিরল কিন্তু চৈতী কোন কথাই তুলল না দিহানকে নিয়ে। দিহান বাড়ি ফিরে এতটুকু বুঝতে পারলো সে এই বাড়িতে এই মুহুর্তে অযাচিত। কিন্তু তাতে তার কষ্ট হলো না বরং নিজের ওপরই ঘৃণার আভাস পেল সে। জীবনটা সত্যিই অদ্ভুত তার। যখন মানুষগুলোকে আপন হিসেবে পায় তখন সে আপন মানুষগুলোকে পায়ে ঠেলে দেয়। আর যখন মানুষ গুলো তার থেকে দূরে সরে যায় একটু একটু করে ঠিক তখনি তার উপলব্ধি হয় মানুষগুলোকে নিয়ে। এ যেন তার জন্মজন্মান্তের এক অঘোষিত যুদ্ধ। প্রিয়ন্তির ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছে। মেয়েটা যখন তাকে ভালোবাসতে চাইলো তখন সে বুঝলোই না মেয়েটার ভালোবাসা কতোটা খাঁটি আর যখন মেয়েটা মৃত্যুপথে ঠিক তখনি দিহান বুঝলো সে ভালোবাসে ওই মোহিনীকে। আবারও তার একই ভুল হলো চৈতীর ক্ষেত্রেও। চৈতী যখন ধরে বেঁধে জীবনটাকে গুছাতে চাইলো তখন সে আচ্ছন্ন রইলো তার জগৎ-সংসার ছেড়ে যাওয়া মোহিনীর প্রেমে। আর যখন সে চৈতীর মাঝে নিজের এক নতুন সত্তাকে দেখে ফিরে এলো তখন চৈতী তার জন্য অলীক হয়ে গেছে। বাবা আর দিশান বাড়ি আসতেই ঘরের মহল ভারী হলো আরো অনেকটা। প্রত্যেকেরই যেন ক্ষোভ জমে আছে তার প্রতি। দিশান আজ দিহান নয় বরং চৈতীরই ভাই হয়ে উঠলো নিমেষেই। সে দিহানকে দেখতেই চোখ মুখ গম্ভীর করে ফেলল। দূরে থাকা দিহানকে সে মিস করেছে, কথা বলে মনের ভেতর শান্তি অনুভব করেছে। কিন্তু আজ যেই মুহুর্তে দিহানকে বাড়িতে দেখেছে তখনই মনে হয়েছে, “চৈতী কোথায়? তার মনের অবস্থা কি?”
বিগত সময়গুলোতে বাড়িতে সবাই অপেক্ষায় ছিলো চৈতী কবে দিহানের কথা মুখে আনবে! কিন্তু না চৈতী এই ছয় মাসে অসুস্থ হয়েছে, সুস্থ হয়েছে। কত কত দিন-রাত সে নানা রকম সমস্যায় ভুগেছে। কখনো অবসাদ কখনো মুড সুইং কিন্তু একটাবারও সে দিহানকে পাশে চায়নি। তার মনের ভেতরে কি চলে কেউ জানে না কিন্তু তার বাইরেটা যেই শক্ত আবরণে ঢাকা ছিলো তা আর কেউ ভাঙেনি। আর এ কারণেই দিশান প্রথমেই ভেবেছে চৈতীর মনের অবস্থাটা এখন কি! ছোট্ট চৈতীর জীবনটা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে কখনো তার মা আর মামার কারণে এরপর দিহানের কারণেও। এই সময়টা সে নিজের পাশে তার স্বামীকে পায়নি এতোটা দূর্ভাগ্য চৈতীটার দিশান কিছুতেই মানতে পারেনি। রাতের খাবারে অন্যান্যদিন দিশান আর ফুপার সাথেই বসে চৈতী কিন্তু আজ সে ভালো লাগছে না বলে খাবার ঘরে বসে খেল। দিহান ছিলো আজ টেবিলে তাই সে আসেনি এখানে। দিহানের জানা নেই বাড়ির বর্তমান নিয়মগুলো তাই সে আগের মতোই খেতে বসে মাকে ডাকলো। দিলশাদ আর ঐশী খাবার খান একটু লেট করে তাই দিহানকে বলল, “তুই খা আমি চৈতীকে খাইয়ে পরে খাবার খাই।” দিহানের খাবার গলায় আটকে গেল। পরের খাবারগুলো আর কিছুতেই উৎরালো না গলা দিয়ে। সন্ধ্যে থেকে ঝড়ো হাওয়াটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো আর মেঘগুলো জড়ো হচ্ছিলো যেন দিহানদেরই বাড়ির ওপর। দশটার ওপারে যখন চৈতী বারান্দার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ঠিক তখনি ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি। চৈতী হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো বৃষ্টির পানি। আর তাতেই মনটা শীতল হলো কিন্তু মনের মেঘ সরলো না পুরোপুরিভাবে। দিহান বসার ঘরে বসে রইলো অনেকক্ষণ কিন্তু ভেবে পেলো না সে কি তার ঘরে যাবে নাকি অন্য কোন ঘরে থাকবে! রান্নাঘরের কাজ গুছাতে গুছাতে ঐশী লক্ষ্য করেছিলো দিহানের মুখটা। সে খেয়াল করেছে শ্বাশুড়ি মায়ের মুখে বিষন্নতার ছাপ। প্রথমে ভাবলো তার হয়তো কিছু বলা ঠিক হবে না কিন্তু তবুও কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করলো দিহানকে সাথে শ্বাশুড়িকেও। অনেক ভেবে সে দিশানকেই বলল, “তোমার কি মনে হয় ভাইয়াকে ঘরে যেতে বলা উচিত নাকি উচিত না!”
দিশান খাটে বসে পা ছড়িয়ে পায়ের ওপর ল্যাপটপে কিছু করছিলো। ঐশীর কথা শুনে দৃষ্টি ফেরালো।
“কি বলতে চাইছো?”
“ভাইয়া অনেকক্ষণ ধরে সোফায় বসে আছে। আমার মনে হচ্ছে দ্বিধায় পড়ে ভাইয়া নিজের ঘরে ঢুকছে না। বাড়িতে বাবা আর মায়ের পরে বড় কেউ নেই যে ভাইয়ার সাথে কথা বলবে। তাকে তার দোটানা থেকে বের করে একটা পথ দেখাবে। তুমি ছোট ভাই হলেও অনেকটা বন্ধুর মতোই আমি জানি। তাই বলি কি তুমি একটু কথা বলো। ভাইয়া ভুল পথে হেঁটেছেন অনেকটা দিন। তাদের ভবিষ্যত এখনও অনেকটা বাকী ; চৈতীরও মনের ভেতর একটা ঝড় তারও একটু মুক্তি দরকার। ভাইয়া হয়তো দ্বিধা নিয়ে ঘরে প্রবেশ করতে পারছে না। তুমি তাঁকে বোঝাও এখনই সময় সব সমস্যার সমাধান করার। কথা বলুক তারা নিজেদের জন্য না হোক অনাগত যে আছে তার জন্যই।”
ঐশী এক নাগাড়ে যতক্ষণ বলল ঠিক ততক্ষণ দিশান অপলক চেয়ে রইলো তার স্ত্রীর দিকে। এই মেয়েটা তার পরিবারের কথা অনেক ভাবে, সবাইকে খুব ভালোবাসে সে জানে কিন্তু মেয়েটা সবার জন্য কতোটা গভীর ভাবনা রাখে তা যেন আজ উপলব্ধি করতে পারলো সে। ঐশীকে টেনে নিজের খুব কাছে এনে দাঁড় করালো। খুব আলতো কিন্তু উষ্ণ আর গাঢ় এক স্পর্শ দিলো ঐশীর কপালে। ঐশীও আবেশে চোখ বুঝে চুমুটাকে উপভোগ করল। দিশান চলে গেল বসার ঘরে। দিশানকে দেখতেই দিহান মুখে হাসি টেনে বলল, “ঘুমাসনি এখনো! কাল অফিস আছে না তোর?”
“হ্যাঁ ভাইয়া। কিন্তু বাইরে বৃষ্টি শুরু হচ্ছে তাই ভাবলাম এখানে বসি৷ ব্যালকোনির পর্দা সরিয়ে একটু বৃষ্টিমাখা বাতাস উপভোগ করি।”
“আচ্ছা, বোস তাহলে।”
দিশান বসলো ভাইয়ের গা ঘেঁষে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ফিরে তাকালো দিহানের দিকে। তার তাকানো দেখেই দিহান বুঝলো ভাই তাকে কিছু বলবে।
“কি বলবি?”
“ঘরে যাওয়া উচিত তোমার। আমার মনে হয় তোমার কথা বলা উচিত তার সাথে।”
“কি বলবো বল তো! কি বলা যায়?”
“ভাইয়া তুমি কি বুঝতে পারছো চৈতী কেমন আছে? তোমার সন্তানটা তার মাঝে কেমনভাবে বাড়ছে? তোমার জানতে ইচ্ছে করে না এই সন্তানের সৃষ্টি লগ্ন থেকে তার মায়ের গর্ভে কি করে বেড়ে উঠছে!”
দিহান নিরুত্তর রইলো। কিন্তু তার কানে বাজছে দিশানের একটা কথাই, “তোমার সন্তান!”
সত্যি বলতে ভিডিও কলে চৈতীকে দেখার পর থেকে গত দু দিন সে শুধু ভেবেছে চৈতীর অবস্থা আর তার মাঝে বেড়ে ওঠা সন্তানের কথা। সন্তানটা তার এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই অন্তত এই সন্তানের বয়সটা অনুমান করে। কিন্তু এই সন্তানটা কি সত্যিই তার হওয়ার ছিলো! সে রাতটা কি কোন আকাঙ্ক্ষিত রাত? নিশ্চয়ই না। দুটো দিন সে শুধু ভেবেই গেছে তার মনে এই বাচ্চাটাকে নিয়ে কিরকম ভাবনা আসে। কিন্তু সে যা ভেবেছিলো তার ব্যতিক্রমটাই হয়েছে তার মনের সাথে। যখনই মনে হয়েছে এই বাচ্চাটা তারই রক্ত, তারই ঔরসজাত তখনি আর তাকে অবহেলা করার সাহস হলো না। মনটা তাকে ধিক্কার দিলো সে সকল ভাবনার জন্য যা সে সন্তানটাকে না মানার জন্য ভেবেছিলো। এরপরই আর মনটাকে বেঁধে রাখা বিপদজনক হয়ে উঠলো। আর তাইতো আজ মন, প্রাণের অন্যান্য সকল ভাবনাকে পায়ে ঠেলে ছুটে এলো এখানে। দিশান আরো কিছু কথা বলে চলে গেল নিজের ঘরে এরপর আর দিহান দেরি করলো না। সেও পা বাড়ালো নিজের ঘরের দিকে।
বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে অসময়ী এই বৃষ্টিতে কিছুটা শীত শীত লাগছে চৈতীর। তবুও সে দাঁড়িয়ে রইলো জানালার সামনে। এক হাত বাড়িয়ে জল ছুঁয়ে দিচ্ছে আনমনে আর তাতেই সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দিহান ঘরে ঢুকে দেখলো মৃদু আলোটা জ্বলছে। চৈতীর বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে কেঁপে উঠা দেখে সে ভাবলো কিছু বলবে। পরক্ষণেই মনে হলো তার অধিকার আছে কি এ কথা বলার! দিহান ঘরে ঢুকেছে এখনো টের পায়নি চৈতী। নিঃশব্দে তার ঠিক পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হঠাৎই প্রশ্ন করলো, ” আমার সাথে কি একটু কথা বলবি?”
হঠাৎ প্রশ্নে একটুও চমকালো না চৈতী যেন সে জানতো দিহান আসবে এখন আর সে এমনই কিছু বলবে।
চলবে
(বড় লিখতে গিয়ে রিচেক করতে আলসেমি লাগে।কালকেও খুব বড় একটা ভুল এডিট করা হয়নি। একটা জায়গায় লিখেছি “দিশার ছেলে হয়েছে” শব্দটা হবে “মেয়ে”)